সুরেন্দ্রনাথ মজুমদারের কবিতা
যে কোন কবিতার উপর ক্লিক করলেই সেই কবিতাটি আপনার সামনে চলে আসবে।
১।     রূপ ("ফুলরা" কাব্য থেকে)       
২।     
পহার ("মহিলা" কাব্য থেকে)      
৩।     
জননী     
       
*
রূপ
ফুলরা কাব্য থেকে নেওয়া
(নির্বাচিত অংশ)

(১৯)
মুদ্রা করে লয়ে কোথা জন্মে কোন জন
কৌলিন্যের চিহ্ন থাকে কার?
বিধাতার কর কে না করে দরশন
অঙ্গে তার, রূপ আছে যার?

(২০)
নাই যার সেই বলে রূপ কিছু নয়,
এল গেল ক্ষণিক প্লাবন ;
চির নব যদিও না চির দিন রয়
তথাপি সে রূপ পুরাতন |

(২১)
যত্নে চায় অসিত পক্ষের শশধরে,
যত্নে চায় গ্রীষ্ম-সরোবরে,
ব্যয় ক্ষয় দেখে ধন যত্নে চায় নরে
প্রিয় আরো প্রিয় হ্রাস ভরে |

(২২)
প্রকৃতির বিস্তৃত বিনোদ আবরণ
বিশ্বপটে স্নেহের মার্জ্জন ;
রূপ তুমি প্রণয়ের অঙ্গজ নন্দন,
কর যত্নে পিতার পালন |

(২৩)
যে যারে সাজায় তারে প্রেম থাকে তার
সামান্য এ কথা বুঝিবার ;
অঙ্গে রূপ ভালবাসার দান বিধাতার ;
ভালবাস অঙ্গে রূপ যার |

(২৪)
রূপবেদী পরে প্রেম উপহার দিয়া
উপাসিব পুলকে ধাতার ;
পাযাণ কাষ্ঠের বেদী কি কাজ রচিয়া,
কি কাজ বা পট প্রতিমায়?


.                                                ****************                                        
উপরে


মিলনসাগর
*
উপহার
মহিলা কাব্য থেকে নেওয়া, ১৮৮০
(নির্বাচিত অংশ)


       (১)
ইন্দুকুন্দ-বিনিন্দিত বরণ বিমল,
.        সিত কণ্ঠ-হার, সিত বাস,
সারদে! চরণারুণে চিত-শতদল
.        বিকসি আসিয়া কর বাস ;---
.        ভাব রাগ বাক্ তানে
.        জাগাও নিদ্রিত প্রাণে,
হৃদিযন্ত্র কর মা তন্ত্রিত ;---
গীতোচিত কণ্ঠহীনে কিঙ্কর কুণ্ঠিত!


        (২)
বর্ণিতে চাই না হ্রদ, নদ, সরোবর,
সিন্ধু, শৈল, বন, উপবন,
নির্মল, নির্ঝর, মরু---বালুর সাগর,
.        শীত-গ্রীষ্ম-বসন্ত-বর্ত্তন ;
.        হৃদয়ে জেগেছে তান,
.        পুলকে আকুল প্রাণ,
.        গাবো গীত খুলি হৃদি-দ্বার,---
মহীয়সী মহিমা মোহিনী মহিলার!


        (৩)
কোন বরবর্ণিনী বিশেষ নায়িকার
চাটু স্তুতি চাই না রচিতে ;
সমুদয় নারীজাতি নায়িকা আমার,
.        বাঞ্ছা চিতে বিশেষ বর্ণিতে ;
.        স্মরি চির উপকার,
.        দিব গীত-উপহার,
.        শুধিবারে ধার মমতার,
মায়া-কায়া মাতা, ভগ্নী, নন্দিনী, জায়ার |


        (৬)
সবিলাস বিগ্রহ মানস সুষমার,
.        আনন্দের প্রতিমা আত্মার,
সাক্ষাৎ সাকার যেন ধ্যান কবিতার,
.        মুগ্ধমুখী মূরতী মায়ার ;
.        যত কাম্য হৃদয়ের,
.        সংগ্রহ সে সকলের,
কি বুঝাবো ভাব রমণীর ;---
মণি-মন্ত্র-মহৌষধি সংসার-ফণীর!


        (১১)
নবীন জনমে নর জাগি সচকিতে,
.        শ্যামকান্তি নিরখে ধরার,
জলে স্থলে বিমল আলোকে পুলকিতে,
.        চরাচর বিহরে অপার ;---
.        সমীরণে দোলে ফুল,
.        গুঞ্জে গুঞ্জে ভৃঙ্গকুল,
পাখী গায় বসি শাখী পরে,
সবে সুখী, নর শুধু কাতর অন্তরে!


        (১২)
শূণ্য মনে বসি শূণ্য আকাশের তলে,
শূণ্যে দেখে শোভিত সংসার!
নিকূপিতে নাহি পারে নিজ বুদ্ধিবলে,
.        কিসে দুঃখী, কি অভাব তার!---
.        বুঝি ভাব মানবের,
.        ধাতা তার মানসের,
করিলেন প্রতিমা রচনা;---
ভূলোক পুলকপূর্ণ, জন্মিল ললনা!


        (১৩)
বিকচ পঙ্কজ-মুখে শ্রুতি পরশিত,
.        সলাজ লোচন ঢল ঢল,
চাঁচর চিকুর চারু-চরণ-চুম্বিত,
.        কি সিমন্ত ধবল সরল!
কাতর হৃদয় ভরে,
স্বচ্ছ-মুক্তা-কলেবরে,
.        ঢল ঢল লাবণ্যের জল!
পাটল কোপল কর-চরণের তল!


         (১৪)
পূজিবার তরে ফুল ঝ'রে প'ড়ে পায়,
.        হৃদি-ফল পরশে পাখীতে,
মুগ্ধ মুখে কুরঙ্গিণী মুগ্ধ চোখে চায়,
.        ধায় অলি অধরে বসিতে!
.        স্পর্শে পদ-রাগ-ভরা,
.        অশোক লভিল ধরা ;
এলোকেশে কে এল রূপসী!---
কোন্ বনফুল, কোন্ গগনের শশী!!


           (২৪)
শ্রুতিহর চারুনাদে চরণসঞ্চার
.        ভাবভরা বিলাশ আঁখির,
শোভিত সশব্দে অর্থবহ অলঙ্কার,
.        আবরিত রসের শরীর ;---
.        পেয়ে হেনরূপ ছবি,
.        মানব হইল কবি ;
বনিতা সবিতা কবিতার!
মর্ত্ত্য-কুঁড়ে বিকসিল কুসুম মন্দার!


           (২৭)
এক দুগ্ধে দধি. তত্রু, ঘৃত, নবনীত,
.        নানা উপাদেয় যথা হয় ;---
এক নারী নানারূপে করে বিরচিত
.        সংসারের সুখ সমুদয় ;---
.        সৃষ্টি পুষ্টি জননীর,
.        প্রিয় চিন্তা ভগিনীর,
কন্যা সেবা, জায়ার বিহার ;---
অতুলনা দান যাঁর কুমারী কুমার!


           (৩৯)
ফুটেছে অতুল ফুল-উদ্যান ধরায়,---
.        নরত্ব বিখ্যাত নাম তার ;
বৃন্তদল, কলেবর,---পুরুষের তায় ;---
.        নারী---বর্ণ, মধু, গন্ধ যার!
.        আছে কাঁটা অগনিত,
.        তবু অতি সুশোভিত ;---
.        সুধু এই শোক তার তরে!
কাল-অলি-মধুপান-অবসানে ঝরে |


           (৪০)
সংসারে যে দিকে চাই, করি বিলোকন,
.        বিপরীত দুইভাব মেলা,---
বাহ্যে দোহে অরি, মনে মধুর মিলন,---
.        কোমল-কঠিনে কিবা খেলা!---
.        একে শোষে, অন্যে পোষে,
.        একে রোষে, অন্যে তোষে,
.        একো মূঢ়, অন্যে অতি কৃতী ;
হরগৌরীরূপ বিশ্বপুরুষ-প্রকৃতি!


           (৪২)
ধন্য সাংখ্য তত্ত্বশাস্ত্র-সার-নিরূপণ!---
.        পেয়ে স্পর্শরস প্রকৃতির,
পুলকে টলিল কায়, খুলিল লোচন
.        অবশ পুরুষ অকৃতির ;
.        প্রকৃতির ভোগ্য কায়,
.        জীব ভোক্তা ভুঞ্জে তায়,---
.        কে ইহা করিবে অস্বীকার?
পতি-পত্নি-ধাম ধরা প্রমাণ যাহার!


           (৪৪)
সংসার পেষণি, নর অধঃশিলা তায়,
.        রেখে মাত্র আলম্বন যার,
নারী ঊর্দ্ধখণ্ড, কার্য্য করিছে লীলায়,
.        কীলে রন্ধ্রে মিলন দোহার!---
.        ভাব-চক্ষে নিরখিয়া,
.        দেখ হে ভবের ক্রিয়া,
বিপরীত বিহার অতুল!---
রমণী-রমণ-রসে পুরুষ বাতুল!


           (৪৫)
মূষা উক্তি, মানবে মজালে মহিলায়,
.        দিয়া জ্ঞান-রস-আস্বাদন ;
সদলে সে হেতু দুঃখ পশিল ধরায়,---
.        জরা ব্যাধি রোদন মরণ |
.        মিলাইয়া নিজ যুক্তি,
.        ভাবুকে বুঝিবে উক্তি,
.        নিন্দা নয়, স্তুতি ললনার ;---
অমরত্ব ছাড়ে নরে প্রেমভরে যার!


           (৪৮)
যদি মৃত্যু এনে থাকে মহিলা ধরায়,
.        সে ক্ষতি সে করেছে পূরণ ;
যম-যানে জরাজীর্ণে লোকান্তরে যায়,
.        নারী করে প্রসব নূতন!
.        কোন্ দুঃখ ধরা ধরে
.        নারী যারে নাহি হরে?
.        তাই পুন মূষার লিখন,---
নারী-বীজে হবে ফণি-ফণার দলন!


.           ****************                                             
উপরে


মিলনসাগর
*
জননী

হে মাতঃ! হৃদয়ে ধর,                            সন্তানের ত্রাস হর,
তোমা বিনা ভব-দুঃখে কোথা পরিত্রাণ!
তুমি পরশিলে করে,                          জ্বর জ্বালা তাপ হরে,
তব অঙ্ক, শঙ্কাশূণ্য বৈকুণ্ঠ সমান!
তুমি মুখে দিবে যাহা,                          মৃত্যুহরী সুধা তাহা,
আশীর্বাদ তোমার অভেদ্য অঙ্গত্রাণ!
তব কাছে স্বর্গবাস,                            তব তুষ্টি শ্রেষ্ঠ আশ,
ধরায় না ধর্ম তব সেবার সমান |
জীবে কৃপা করি তুমি ঈশ মূর্তিমান ||

ধরা হীরা হয়, হায়!                           সিংহাসন রচি তায়,
বসাইতে পারি যদি জননী তোমায় |---
ফুল হয় তারা দল,                                চন্দন সাগর-জল,
শত কল্প বসি যদি পূজি তব পায়,
সুধাকর-সুধাগারে,                           পারি যদি আনিবারে,
নিত্য যদি সেই সুধা করাই ভোজন,
পারিজাত-দল দিয়া,                          নিত্য শয্যা বিরচিয়া,
করাইতে পারি যদি তোমায় শয়ন,
তবু না শুধিতে পারি তোমার পালন ||

তুমি মা, না ধর দোষ,                        তুমি নাহি কর রোষ,
দুঃশীল মানব, প্রাণে বেঁচে থাকে তায়!
শত অপরাধ করে                               তবু না মানব মরে,
শুধু তব হৃদয়ের প্রেম-মহিমায় |
বাণী বর্ণিবারে চায়                             শেষ যদি সদা গায়,
তবু তব মহিমা না হয় সমাধান!
হে সুর, অসুর, নর,                        যেবা তনু বুদ্ধি ধর ;---
এস মিলি করি সবে মাতৃস্তুতি গান |---
বিশ্ব যাঁর কর-গড়া কন্দুক সমান ||


.                                                  ****************                                            
উপরে


মিলনসাগর