কবি তপন বাগচীর কবিতা
যে কোন কবিতার উপর ক্লিক করলেই সেই কবিতাটি আপনার সামনে চলে আসবে।
.            বোধঘুড়ি   


ছিঁড়ে যায় চিন্তাসূত্র, বোধের নাটাই
খোঁজে মেঘের নিশানা
পথকান্ত মেঘদূত ক্ষণেক দাঁড়িয়ে পাশে জানায় কুশল
আনন্দবায়ুর স্রোতে বিচলিত বোধিদ্রুম মেলে দেয় ডানা
হেসে ওঠে কালিদাস-প্রেরিত দূতের যাত্রা তাহলে সফল!

আমার বোধিরা হাঁটে আকাশের খোলাপথে সতর্ক চরণে
উড়ে যায় মেঘদূত, প্রেয়সীর বার্তা তার কাঁধের ঝোলায়
থামার সময় নেই-যেতে হবে বহু দূরে সুষম ত্বরণে
প্রণয়ের বার্তাবহ মেঘ যায় মন্দ্রাক্রান্তা ছন্দের দোলায়।

ভূপতিত বোধঘুড়ি সহাস্যে জানায় এই অমিয় সন্দেশ
স্থিরচোখে দেখি আমি আষ্টেপৃষ্ঠে ঝুলে আছে মেঘস্পর্শরেশ।


.      
             ***********************                                              পরে


মিলনসাগর
.       নৌকাকাণ্ড   


দুধের পসরা কাঁধে কারা যায় যমুনার ঘাটে?
এপারে কদমতলি, বৃন্দাবন-ওপারে মথুরা।
গোকুলের গোপিনীরা একসাথে নদী পার হবে।
ওলো মাঝি, কেন এত ছোট তোর তরণীর গুড়া?

ভাঙা নায়ে হাল ধরে বসে তুই কোন ঘাটিয়াল?
শুধু তোর চোখে লাগে রাধিকার সোমত্ত শরীর-
এই পাড়ে লীলাসখী সমবেত পারের আশায়
মিলনের সুখে দোলে যমুনার জল তিরতির।

কে গো তুমি ভাণ্ড হাতে মূর্তিমতী মরণবিলাসী,
আমার হৃদয়গাঙে ঝাঁপ দাও শুভ্রা অনামিকা
ননীচোর কানু আজ দুঃসাহসী পারের কাণ্ডারী
ডোবে নৌকা, মধুভাণ্ড, ডোবে না রাধিকা।


.               *******************               
                               পরে


মিলনসাগর
.         চিরন্তনী   


সাগরের কাছে গেলে নদী আর নদীটি থাকে না
তবু তার আজন্ম ইচ্ছের ব্রত সমুদ্রসঙ্গম
আগুনের সোহাগী
ছোঁয়ায় পোড়ে পতঙ্গের প্রাণ
কে ফেরায় বল তার অগ্নিমুখী যাত্রা পারঙ্গম!

জন্ম মানে অমোঘ মৃত্যুর কাছে লেখা দাসখত
মানুষের কাঙক্ষা তবু পৃথিবীতে অযুত জীবন
কিছুটা প্রকাশ মানে বেশি কিছু গোপনের দায়
তবুও কলম পিষে রাত জাগে তৃষাতুর মন।

.               *******************                                              
পরে


মিলনসাগর
জীবনের নৈশগাড়ি : এক  


প্রশ্নময় নৈশগাড়ি একা হেঁটে যায়
সভ্যতার স্মৃতিবিষে পূর্ণ প্র
তি চোখ
লক্ষ্য তার বিম্বিসার মনুষ্যবসতি
গতায়ুর জন্যে আমি মিথ্যে করি শোক।

সন্তাপের স্বরলিপি বাজে দিনরাত
অসুখের জলটুঙি শব্দভ্রমে কাঁদে
আমি তো চলিষ্ণু এক জ্যোৎস্না-হরিণ
কখনো পড়ি না ধরা অলৌকিক ফঁদে।

যৌবন-কান্তির ভার কোথায় লুকোব
জন্মদাতা ছড়ি হাতে নীরবে শাসায়
দূর থেকে ডাক দেয় শিল্পবারবধূ
কোথায় জয়ের মালা জীবনপাশায়!

জীবনের নৈশগাড়ি কখনো থামে না
অচেনা পথের ভুল তার চিরচেনা।


.          *******************       
                                          পরে


মিলনসাগর
জীবনের নৈশগাড়ি : দুই  


সময়ের ফুলখড়ি লেখে ইতিহাস
যাবতীয় দুষ্টুক্ষুধা, ভূগোল, পুরাণ-
বিকেল-বাতাসে ভাসে শ্লৈষ্মিক বক্তৃতা
পল্টনের মাঠে চলে নিন্দাজয়গান।

আমাদের
ক্ষেত্রমিতি পূর্ণ হয় রোজ
ভরে ওঠে শাদাপৃষ্ঠা শূন্য-তালিকায়
ঋণপত্র জমে-জমে পর্বত-সংহিতা
অসহায় অপরাধ নিত্য বেড়ে যায়।

একদিন এইসব পুরনো দলিল
পুড়ে হবে ভস্মসাৎ ব্যর্থ হাহাকারে
তবুও সমুদ্রগামী আমাদের আশা
রা পাবে নামমুদ্রা কালের বিচারে।

আমি তো থাকি না বসে অর্থহীন ভেবে
জীবনের নৈশগাড়ি সব তুলে নেবে।



.          *******************                                                 
পরে


মিলনসাগর
জীবনের নৈশগাড়ি : তিন   


নিয়ম-নিগড় কখনো মানি না আমি
গা-সহা আমার প্রভূত প্রতিকূলতা
আমি চিনি পথ, শুধু পথময় পথ
পথচলা ছাড়া শিখি নি নতুন কথা।

পথ এনে দেয় মোহন পথের দাবি
থেমে-যাওয়া মানে মৃত্যুর অপবাদ
জেনে-শুনে কেউ মৃত্যুকে কাছে ডাকে?
জীবনের দিকে জীবন ঝাঁকায় কাঁধ।

কেউ নেই জানি নিশুতি পথের সাথী
বাতাস কেবলি বিলি কেটে যায় চুলে
একা-একা আমি পথকেই সাথী মেনে
মনের গোপন কথাগুলি বলি খুলে।

বন্দরের বাতিমুখী দীর্ঘ মনোরথ
জীবনের নৈশগাড়ি খুঁজে নেয় পথ।


.          *******************                                                 
পরে


মিলনসাগর
জীবনের নৈশগাড়ি : চার   


দ্বৈরথে হৃদয়দস্যু-জয়স্পৃহা জাগে
কেউ
ছোঁয় সাফল্যের সোনালি শিখর-
কেউ মানে পরাজয় প্রিয় অনুরাগে
কেউ
খোঁজে পোড়ামাটি, প্রকৃত শিকড়।

কখনো-বা প্রিয়পক্ষ বিশাল প্রকৃতি-
কখনো নারীর সঙ্গ পুরুষের কাছে
প্রিয়তম ভুল দাবি, অশুভ সম্প্রীতি;
পুরুষ-রমণী তবু মূলে যায়, বাঁচে।

কবি একা হেঁটে যায় কুমারের তীরে
ধ্যান ভেঙে পেতে চায় কবিতা-তালুক
কাব্যলক্ষ্মী বাস করে বোধের গভীরে
জীবনের নৈশগাড়ি এনে দেয় সুখ।

কবি নয় মুখাপেক্ষী প্রেমের দয়ার
যদিও রয়েছে হাতে প্রথম পয়ার।



.          *******************                                                 
পরে


মিলনসাগর
জীবনের নৈশগাড়ি : পাঁচ   


নিয়নমণ্ডল নেই পথের দুধারে
নিরুদ্দিষ্ট পথচলা কাগজের বুকে
একহাঁটু গোষ্ঠীবৃত্তে নিদেন আশ্রয়
নিজেরাই ভাসেডোবে নার্সিসাস-সুখে।

অরের ফাঁকে তিনি লুকোন শ্রীমুখ
গর্বে তাঁর বুক ফাটে যাই না দৈনিকে।
অঞ্চলের ভারে ঝোলে বিরাট প্রতিভা
কাব্য তাঁর আপ্তবাক্য মূল্য পাঁচসিকে।

জীবনের নৈশগাড়ি এই জৈষ্ঠ্যদিনে
যাচ্ঞা করে নিয়মিত প্রথর প্রবাহ
কিন্তু তিনি হেঁটে যান বিমুখ প্রান্তরে
নিয়মের নামে তাঁর শুধু গাত্রদাহ।

কবি এই সময়ের সাহসী অর্জুন
বিশাল প্রকৃতি তাঁর উপমার তূণ।


.          *******************                                                 
পরে


মিলনসাগর
জীবনের নৈশগাড়ি : ছয়   


উন্মন্থিত দুটি হাত কোমল মুঠোয়
প্রত্যাহত কাকস্নান প্রণয়ের বিলে।
চারচোখে খুঁজে পাবে সুশীতল ছায়া
দুজনে মুখর হব ভেঙচি ও কিলে।

আবার হয়তো দেখো হাত ধরে হাতে
ঢিল ছুঁড়ে একসাথে পেড়ে খাব আম
চুলগুলো উড়ে গেলে
খোঁপা বেঁধে দেব
যতনে লাগিয়ে দিও জামার বোতাম।

অবিভাজ্য তবু সেই সোনালি বিকেল
এত খুঁজে পেলে নাকো ভাজকের রেশ
হারানো সকাল চাই ভগফল পেতে
ভালবাসা উপাচার থাক অবশেষ।

তোমাকে মেনেছি সাথী, অনাঘ্রাতা ফুল
জীবনের নৈশগাড়ি ভেঙে দেয় ভুল।



.          *******************                                                 
পরে


মিলনসাগর
.       নতুন শরীরে  


একেবারে নতুন শরীরে আমি দেখা দিতে চাই
পুরনো ব্র“নের দাগ ঝুলকালি সব মুছে নিয়ে
নিজেকে স্থাপন করি নিন্দুকের চোখের বেদিতে
ভোঁতা অঙ্গ ঘসেমেজে আর কিছু সাহসে সাজিয়ে।

বাঙলা প্রবাদ জানে, পুরনো তণ্ডুলে ভাত বাড়ে
আমি কারো বাড়া ভাতে অজান্তেও ছিটাইনি ছাই
তবু কেন ঘেঁয়ো কুত্তা বেড়ে ওঠে আকুরটাকুরে
এতদিন বুঝি নাই কুকুরকে লাই দিতে নাই।

কুকুর ছাড়ে না পাছ যতক্ষণ গুড়ের সুঘ্রাণ
কুকুর বলেই রোজ আমি তারে করে দিই মা
তার প্রতি ঘৃণা নয়, করুণা ও মমতার
ছোঁয়া
মানুষ কুকুর হলে তার প্রতি ঘৃণা রাখি জমা।


.        
      *******************                                             পরে


মিলনসাগর
.                জসীমের সঙ্গে দেখা   


ঠাকুরবাড়ির আঙিনায় জসীমের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়। আমি তখন বুঝে উঠতে পারি নি
যে, তিনিই হয়ে ঊঠবেন রঙিলা নায়ের মাঝি।
জসীমের সঙ্গে আমার ফের দেখা হয় এক কবিগানের আসরে। নড়াইলের কবিয়াল বিজয়
সরকার আসরে দাঁড়িয়ে সেদিন আপ্লুত হয়ে সুরে ছাড়লেন-নকশীকাঁথার মাঠে রে, সাজুর ব্যথায়
আজো কাঁদে রূপাই মিয়ার বাঁশের বাঁশি।
সোজন বাদিয়ার ঘাট এখন ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। প্রেমে পড়ে মানুষ ধর্ম ছাড়ছে শুনে
জসীমকে সেদিন বেশ বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। আমি নিজের চোখে সোজন ও দুলিকে হেঁটে যেতে
দেখেছি ধ্র“পদী সিনেমার নায়ক-নায়িকার মতো। আর দেখি, ক্যামেরার পেছনে চোখ রাখছেন
স্বয়ং জসীম।
জসীমকে শেষবার দেখি বাংলা একাডেমীর সামনে। দোতলায় টাঙানো তালিকায় তাঁর নাম নেই
শুনে মৃদু হাসলেন। আমি দেখলাম জসীম ক্রমশ উঁচু হতেহতে একাডেমির স
র্বোচ্চ সীমানা
ছাড়িয়ে যাচ্ছেন। যেতেযেতে বলছেন, তুই দাঁড়া, আমি একমুঠো মটরশুটি নিয়ে আসছি। কাঁচা
শিম চিবুতেচিবুতে তোর সঙ্গে কথা বলবো।
আমি জানি, জসীমের সঙ্গে আমার আবার দেখা হবে। হয়তো ধান
ক্ষেতের আলে, নয়তো
মরানদীর বালুচরে। জসীমের সঙ্গে আমাদের দেখা না-হয়ে উপায় নেই!


.         
                       *******************                                             পরে


মিলনসাগর
.                কবিতা নিজেই মিডিয়া   


কলাভবনের উজ্জ্বল করিডোরে অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয়। কারো কারো ছায়া কলাভবন
ছাড়িয়ে আমতলায় মিলিয়ে যায়। কারো কারো মাথা ছাদ ফুঁড়ে আকাশ স্পর্শ কতে চায়।
কারো কারো অঙ্গুলি হেলনে ক্যাম্পসে বৃষ্টিপাত হয়, লতিয়ে ওঠে
ধোঁয়া। অনেকের সঙ্গেই
আমার ভাব।
আমার একবন্ধু তো বাংলাফাইভ টানতেটানতে বাংলাসিনেমার নায়ক হয়ে গেছে। একবন্ধু
নায়িকার হাত ধরে জনকণ্ঠ থেকে কানাডায়। এক
বন্ধু আনন্দলোকের স্টারসার্চ
প্রতিযোগিতায় টিকে এখন ক্যামেরার সামনের দাঁড়ানোর জন্য মেকাপ নিচ্ছে। এক
বন্ধু যে
কোনো দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর গলির  চেহারা দেখে গাঁজার দোকান খুঁজে বের  
করে নিচ্ছে। এতসব খবর জানি, কিন্তু আমার পাশে বেঞ্চে বসে থাকা মেয়েটা যে ভেতরে

ভেতরে কবি হয়ে বসে আছে, তার চোখ দেখেও এতদিন তা টের পাইনি।
আজকাল মিডিয়াঅলারা সবকিছু চিনিয়ে দেয়ার ঠিকাদারি পেয়েছে।
 তাই মিহি করে
মাটি পিষে বালির সঙ্গে মিশিয়ে বিদেশি সিমেন্ট বলে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে। মিডিয়ার হাতে
গোঁফ উঁচিয়ে ধরার আগে আমরা বিড়ালকেও চিনে নিতে পারছি না। তো এ-রকম
অবস্থায় আমরা ভুলেই যাচ্ছি যে, কবিতা নেপালের গোয়ালঘরে থেকেও উঁকি মারে।
কিংবা উড়িষ্যার নদীর জল থেকে উঠে আসে।
কবিতা হারায় না। কবিতা ডোবে না। কবিতা মিডিয়ার অবলম্বন নয়। কবিতা নিজেই
মিডিয়া।


.                                *******************                                             
পরে


মিলনসাগর
অরুণা কি রাধা ছিল  
[কবি মুহাম্মদ সামাদ, শ্রদ্ধাস্পদেষু]



একজন অরুণার ডাকে তুমি শেষতক ঘুরিয়েছ ঘাড়
মেঘের আড়ালে তুমি নও জানি ইন্দ্রজিৎ জন্মযোদ্ধা বীর
প্রকাশ্যে লড়াই করে একা জিতে নিতে চাও প্রেমের পাহাড়
তুমুল বৃষ্টিতে ভিজে অরুণাকে পেতে কত অপো অধীর!

রাজনৈতিক নেতার মেনিফেস্টো হাতে নিয়ে এসেছিলে জানি
পিছু ডাকে ফিরবে না, সমুদ্রের দিকে যাবে  তোমার ঘোষণা
পোড়াবে চন্দন কাঠ কে তোমাকে শুনিয়েছে এই শেষ বাণী
চিরন্তন কাব্য লিখে কেন তবে লক্ষ বর্ষ বাঁচার বাসনা?

অরুণা কি রাধা ছিল পূর্বজন্মে?  কেন এই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলে?
তুমি কি আয়ান ঘোষ? নাকি কৃষ্ণ? নাকি মহাভারত-নায়ক
তুমি কি জানো না হায় ‘কানু ছাড়া গীত নাই’ ভুবনে নিখিলে
কেন
খোঁজে রাধিকা-হৃদয় তুমি, কেন হও  বন্দনা-গায়ক।

তুমি কবি, তোমার উদার হাতে দেখি নীল প্রজাপতি ওড়ে
তুমি তো বাঙালি কবি, চক্ষু বুঁজে থাক তাই কল্পনার ঘোরে।


.                  
     *******************                                            পরে


মিলনসাগর
কাওরাপাড়ার ছেলেমেয়েরা এখন স্কুলে  যায়    


কবিতার জন্যে আমি গিয়েছিলাম মণিরামপুরে কাওরপাড়ায়। সেখানের স্বামীরা
বছরচুক্তির চাকরিতে শূকর চরায় অন্য এলাকায়। স্ত্রীরা বাড়ি পাহারা দেয় আর লালন
করে ভ্রূণ। তাই তিরিশ না পেরোনো রমণীর কোলেও খেলা করে ছয়টি মানবশিশু।
বছরান্তে স্বামীর ঘরে ফেরাই স্ত্রীদের একমাত্র উৎসব। তাই জন্মনিয়ন্ত্রণের সামগ্রী তারা
বালিশের নিচ থেকে বের করে আনতে ভুলে যায়। কাওরাপাড়ার ছেলেরা বাজারে গেলে
আলাদা কাপে চা খেতে পায়। প্রতিটি চায়ের দোকানি দুতিনটে কাপের নিচে লালরঙ
লাগিয়ে রেখেছে। কাওরাপাড়ার ছেলেরা এলে খেতে দেবে। কাওরাপাড়ার ছেলেমেয়েরা
এখন স্কুলে  যায়।


.                 
             *******************                                            পরে


মিলনসাগর
নারায়ণগঞ্জে বোস-কেবিনে   


নারায়ণগঞ্জে বোস-কেবিনে কাবাব খেতে গিয়ে তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল বছর দুয়েক
আগে। আর কখনো দেখা হয়নি
অইটুকু ছোট্ট শহরে তুমি কোথায় লুকিয়ে থাকো!
তোমাকে দেখতে আমি বোস-কেবিনে যাই। শহরের অভিজাত ভোজনবিলাসীরা আসে
কেবল তুমিই আসো না আর। আমি যে কাবাবের জন্য না অন্য কারো জন্য যাই, তুমিই
জানো না তা আর কেউ জানবে কী করে!
তোমাকে দেখেছি শুধু বোস-কেবিনের বারান্দায় হেঁটে যেতে, তোমার সঙ্গে কথাই হয়নি
আমার। তুমি আমাকে দেখেছ কিনা জানি না। দেখলেও মনে রেখেছে কি না জানি না।
অথচ তোমার জন্য বোস-কেবিনে যাই, কাবাব খাই আর ঠায় বসে থাকি।
তুমি কি আজ ফ্রক ছেড়ে শাড়ি পরবে! তাহলে
ঠোঁট কাঁপছে কেন? সকাল থেকে বসে
আছি। বোস-কেবিন আজ জ্বলজ্বল করছে। বোস-কেবিন আজ নতুন করে হেসে উঠবে।!


.                              *******************                                            
পরে


মিলনসাগর
ভাই-বন্ধু
[
কবি মতিন রায়হান, অভিন্নহৃদয়েষু ]


তুই ছেড়ে এসেছিস পাড়ভাঙ্গা তিতাসের কোল
আর আমি আড়িয়ালখাঁর দীপ্ত ঢেউ পাড়ি দিয়ে
দুহাতে নিয়েছি মেখে কবিতার কোমল কোরক
দু’পায়ের নিচে সর্ষে,  রোদ ভেঙে সকাল বিকাল
আমরা ঘুরেছি পোড়া রাজপথ, বুড়িগঙ্গাপাড়।
আমাদের স্বপ্ন ছিল বুকের গহীন কোণে গাঁথা
চোখে ছিল অফুরন্ত ভালবাসা, অনাদায়ী প্রেম
তবু দেখ, আমাদের আজ বুঝি না-দেখাই রীতি।

খ্যাতি নয়, আমাদের কাম্য ছিল প্রকাশের সুখ
যতি নয়, আমাদের ল্য ছিল নিরন্তর দ্রুতি
আমরা ছুটেছি আজো ভিন্নপথে
গন্তব্য অভেদ
দুপায়ে দলেছি নীল তৃণ, গুল্ম, বিটপীর পাতা
আমরা অদম্য আজো নিরাশ্রয়ে খুঁজি ধানতে
একদিন দুইভাই দুইবন্ধু গোলা ভরে নেব।


.                 *******************                                            
পরে


মিলনসাগর
সিধু-কানু
[
কবি সুকুমার চৌধুরী বন্ধুবরেষু ]


বুকের ভেতর আগুন এবং
চোখের ভেতর স্বপ্ন স্বাধীনতার
মান রেখেছি ভগনাডিহির সিধু-কানুর কথার।

আমরা জ্বলে উঠেছিলাম
সঙ্গে কুঠার টাঙ্গি ধনুক তীর
প্রথম বাধায় কেটেছিলাম
মহেশলালের ক্রদ্ধ ত্যাড়া শির।

সিধু, কানু, চাঁদ এবং ভৈরব
বাংলা জুড়ে ডাকলো যখন হুল
তিরিশ হাজার শহিদ হলো
বিশ্ব জুড়ে দারুণ হুলস্থুল।

মানুষ বটে আদিবাসী
বুঝেছিল বিদেশি রাজপ্রভু
স্বাধীন দেশে অন্যের অধীন কেউ ভাবে নি কভু!



.                 *******************                                            
পরে


মিলনসাগর
আমার চেয়ার নেই


আমার চেয়ার নেই, তাই না বসেই কেটে যায় দিন-মাস-বছর। আমার অফিসে
গিয়ে এখন বন্ধুরা আড্ডা দিতে পারে না। আমার চেয়ার নেই, তাই লিখতে হচ্ছে
হাতের ওপর। লেখা যেমনই হোক, হাতের লেখা ভালো হওয়ার কথা নয়। এই
সীমাবদ্ধতা মেনেও লিখে যাই আর লিখে যেতে চাই। যে আমার চেয়ারটাকে
কেড়ে নিয়েছে তার মুখে থুতু দিতে গিয়েও ফিরিয়ে নিয়েছি। এখন তাঁকে বরং
ধন্যবাদ দিই
আমার একটি চেয়ার কেডে না নিয়েছে বলে অনেকের চেয়ারের
বন্দোবস্ত করতে পেরেছি।




.                 *******************                                         
       পরে


মিলনসাগর
ভারতবর্ষের কবি
[
কবি উত্তম দাশ, শ্রদ্ধাস্পদেষু ]


ভারতবর্ষের একজন কবি সেদিন আমাকে বলেছিল
জ্বালামুখে কবিতার শব্দ মেখে নিলে ভূমিকম্প থেমে যায়
যখন গোধূলি ছিল, যখন লৌকিক অলৌকিক ভুলে থাকা
তখন রুণুকে পেয়ে একজন কবি মজে রসের খেলায়।

ভুল ভারতবর্ষের একজন কবির আপে মনে পড়ে
আজন্ম ভ্রমণে তার বাড়ে কিছু ভ্রম আর অভিজ্ঞতা-ঝুলি
দেশভাগ যাকে
দেশছাড়া করে নিয়ে যায় অচেনা নগরে
শুনেছি নতুন দেশে শব্দের প্রতিমা গড়ে স্মৃতিরঙতুলি।

কবিকে বাঁধতে পারে, চিন্তার চরণে দেবে রঙিন শেকল
এমন নিয়ম নেই, এই কথা জানিয়েছে শিল্প হাইকোর্ট
কবি যাবে সব দেশে সর্বত্র সাগর চর জলা কি জঙ্গল
কবির লাগে না ভিসা তদারকি অনুমতি কিংবা পাসপোর্ট!

কবি নয় দেশবন্দি, ভাষা কি বাঁধতে পারে কবির অন্তর!
কবি ঘোরে বিশ্বময় উত্তুঙ্গ আকাশে তার দশচালা ঘর।




.                 *******************                                                
পরে


মিলনসাগর
কবিরা ব্রাহ্মণ হয়   
[
কবি সুবোধ সরকারকে ]  


কবিরা ব্রাহ্মণ হয় এই কথা লেখা আছে মনুসংহিতায়
তুমি তাঁকে অস্বীকার করো কোন নিরঙ্কুশ
ক্ষমতার জোরে
যেহেতু তুমিও কবি, তাই তুমি নিজে নিজে সেজেছ ব্রাহ্মণ
তোমাকে প্রণতি আজ এই পোড়া কার্তিকের বৃহস্পতি-ভোরে।

ঊধ্বর্তন এক কবি নিজেকে প্রচার করে ষাটের ব্রাহ্মণ
অধস্তন কাব্য করে, এই অপরাধে নামে খড়গ কৃপাণ
বঞ্চিতরে ভালোবেসে কিছু লোক এঁনে দেয় তিলকের মাটি
অধস্তন কবি ছাড়ে নিয়মিত জীবিকার মোহন আহ্বান।

ষাট তো বালাই ষাট, নব্বই এনেছে জেনো নতুন সকাল
এক পা কবরে রেখে আর কত ষড়যন্ত্র, ও হে বুড়ো ভাম ?
নির্বীর্য নাটের গুরু, একদনি ভণ্ডামির দিন শেষ হবে
শূদ্ররাও কবি হয় এই সত্য এনেছেন সাধু তুকারাম।

সকলেই কবি নয়, কারো চোখে বাস করে সক্রিয় ধূর্ততা।
তুকারাম জয়ী হয়, জয়ী হয় শূদ্র আর কাব্যের ক্ষমতা।



.                 *******************                                                
পরে


মিলনসাগর