সাগরের কাছে গেলে নদী আর নদীটি থাকে না তবু তার আজন্ম ইচ্ছের ব্রত সমুদ্রসঙ্গম আগুনের সোহাগী ছোঁয়ায় পোড়ে পতঙ্গের প্রাণ কে ফেরায় বল তার অগ্নিমুখী যাত্রা পারঙ্গম!
জন্ম মানে অমোঘ মৃত্যুর কাছে লেখা দাসখত মানুষের কাঙক্ষা তবু পৃথিবীতে অযুত জীবন কিছুটা প্রকাশ মানে বেশি কিছু গোপনের দায় তবুও কলম পিষে রাত জাগে তৃষাতুর মন।
একেবারে নতুন শরীরে আমি দেখা দিতে চাই পুরনো ব্র“নের দাগ ঝুলকালি সব মুছে নিয়ে নিজেকে স্থাপন করি নিন্দুকের চোখের বেদিতে ভোঁতা অঙ্গ ঘসেমেজে আর কিছু সাহসে সাজিয়ে।
কুকুর ছাড়ে না পাছ যতক্ষণ গুড়ের সুঘ্রাণ কুকুর বলেই রোজ আমি তারে করে দিই মা তার প্রতি ঘৃণা নয়, করুণা ও মমতার ছোঁয়া মানুষ কুকুর হলে তার প্রতি ঘৃণা রাখি জমা।
ঠাকুরবাড়ির আঙিনায় জসীমের সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়। আমি তখন বুঝে উঠতে পারি নি যে, তিনিই হয়ে ঊঠবেন রঙিলা নায়ের মাঝি। জসীমের সঙ্গে আমার ফের দেখা হয় এক কবিগানের আসরে। নড়াইলের কবিয়াল বিজয় সরকার আসরে দাঁড়িয়ে সেদিন আপ্লুত হয়ে সুরে ছাড়লেন-নকশীকাঁথার মাঠে রে, সাজুর ব্যথায় আজো কাঁদে রূপাই মিয়ার বাঁশের বাঁশি। সোজন বাদিয়ার ঘাট এখন ছড়িয়ে পড়েছে সারা দেশে। প্রেমে পড়ে মানুষ ধর্ম ছাড়ছে শুনে জসীমকে সেদিন বেশ বিমর্ষ দেখাচ্ছিল। আমি নিজের চোখে সোজন ও দুলিকে হেঁটে যেতে দেখেছি ধ্র“পদী সিনেমার নায়ক-নায়িকার মতো। আর দেখি, ক্যামেরার পেছনে চোখ রাখছেন স্বয়ং জসীম। জসীমকে শেষবার দেখি বাংলা একাডেমীর সামনে। দোতলায় টাঙানো তালিকায় তাঁর নাম নেই শুনে মৃদু হাসলেন। আমি দেখলাম জসীম ক্রমশ উঁচু হতেহতে একাডেমির সর্বোচ্চ সীমানা ছাড়িয়ে যাচ্ছেন। যেতেযেতে বলছেন, তুই দাঁড়া, আমি একমুঠো মটরশুটি নিয়ে আসছি। কাঁচা শিম চিবুতেচিবুতে তোর সঙ্গে কথা বলবো। আমি জানি, জসীমের সঙ্গে আমার আবার দেখা হবে। হয়তো ধান ক্ষেতের আলে, নয়তো মরানদীর বালুচরে। জসীমের সঙ্গে আমাদের দেখা না-হয়ে উপায় নেই!
কলাভবনের উজ্জ্বল করিডোরে অনেকের সঙ্গে পরিচয় হয়। কারো কারো ছায়া কলাভবন ছাড়িয়ে আমতলায় মিলিয়ে যায়। কারো কারো মাথা ছাদ ফুঁড়ে আকাশ স্পর্শ কতে চায়। কারো কারো অঙ্গুলি হেলনে ক্যাম্পসে বৃষ্টিপাত হয়, লতিয়ে ওঠে ধোঁয়া। অনেকের সঙ্গেই আমার ভাব। আমার একবন্ধু তো বাংলাফাইভ টানতেটানতে বাংলাসিনেমার নায়ক হয়ে গেছে। একবন্ধু নায়িকার হাত ধরে জনকণ্ঠ থেকে কানাডায়। একবন্ধু আনন্দলোকের স্টারসার্চ প্রতিযোগিতায় টিকে এখন ক্যামেরার সামনের দাঁড়ানোর জন্য মেকাপ নিচ্ছে। একবন্ধু যে কোনো দেশ-বিদেশে ঘুরে বেড়াচ্ছে আর গলির চেহারা দেখে গাঁজার দোকান খুঁজে বের করে নিচ্ছে। এতসব খবর জানি, কিন্তু আমার পাশে বেঞ্চে বসে থাকা মেয়েটা যে ভেতরে ভেতরে কবি হয়ে বসে আছে, তার চোখ দেখেও এতদিন তা টের পাইনি। আজকাল মিডিয়াঅলারা সবকিছু চিনিয়ে দেয়ার ঠিকাদারি পেয়েছে। তাই মিহি করে মাটি পিষে বালির সঙ্গে মিশিয়ে বিদেশি সিমেন্ট বলে চালিয়ে দেয়া হচ্ছে। মিডিয়ার হাতে গোঁফ উঁচিয়ে ধরার আগে আমরা বিড়ালকেও চিনে নিতে পারছি না। তো এ-রকম অবস্থায় আমরা ভুলেই যাচ্ছি যে, কবিতা নেপালের গোয়ালঘরে থেকেও উঁকি মারে। কিংবা উড়িষ্যার নদীর জল থেকে উঠে আসে। কবিতা হারায় না। কবিতা ডোবে না। কবিতা মিডিয়ার অবলম্বন নয়। কবিতা নিজেই মিডিয়া।
রাজনৈতিক নেতার মেনিফেস্টো হাতে নিয়ে এসেছিলে জানি পিছু ডাকে ফিরবে না, সমুদ্রের দিকে যাবে তোমার ঘোষণা পোড়াবে চন্দন কাঠ কে তোমাকে শুনিয়েছে এই শেষ বাণী চিরন্তন কাব্য লিখে কেন তবে লক্ষ বর্ষ বাঁচার বাসনা?
অরুণা কি রাধা ছিল পূর্বজন্মে? কেন এই প্রশ্ন ছুঁড়ে দিলে? তুমি কি আয়ান ঘোষ? নাকি কৃষ্ণ? নাকি মহাভারত-নায়ক তুমি কি জানো না হায় ‘কানু ছাড়া গীত নাই’ ভুবনে নিখিলে কেন খোঁজে রাধিকা-হৃদয় তুমি, কেন হও বন্দনা-গায়ক।
তুমি কবি, তোমার উদার হাতে দেখি নীল প্রজাপতি ওড়ে তুমি তো বাঙালি কবি, চক্ষু বুঁজে থাক তাই কল্পনার ঘোরে।
কবিতার জন্যে আমি গিয়েছিলাম মণিরামপুরে কাওরপাড়ায়। সেখানের স্বামীরা বছরচুক্তির চাকরিতে শূকর চরায় অন্য এলাকায়। স্ত্রীরা বাড়ি পাহারা দেয় আর লালন করে ভ্রূণ। তাই তিরিশ না পেরোনো রমণীর কোলেও খেলা করে ছয়টি মানবশিশু। বছরান্তে স্বামীর ঘরে ফেরাই স্ত্রীদের একমাত্র উৎসব। তাই জন্মনিয়ন্ত্রণের সামগ্রী তারা বালিশের নিচ থেকে বের করে আনতে ভুলে যায়। কাওরাপাড়ার ছেলেরা বাজারে গেলে আলাদা কাপে চা খেতে পায়। প্রতিটি চায়ের দোকানি দুতিনটে কাপের নিচে লালরঙ লাগিয়ে রেখেছে। কাওরাপাড়ার ছেলেরা এলে খেতে দেবে। কাওরাপাড়ার ছেলেমেয়েরা এখন স্কুলে যায়।
নারায়ণগঞ্জে বোস-কেবিনে কাবাব খেতে গিয়ে তোমার সঙ্গে দেখা হয়েছিল বছর দুয়েক আগে। আর কখনো দেখা হয়নিঅইটুকু ছোট্ট শহরে তুমি কোথায় লুকিয়ে থাকো! তোমাকে দেখতে আমি বোস-কেবিনে যাই। শহরের অভিজাত ভোজনবিলাসীরা আসে কেবল তুমিই আসো না আর। আমি যে কাবাবের জন্য না অন্য কারো জন্য যাই, তুমিই জানো না তা আর কেউ জানবে কী করে! তোমাকে দেখেছি শুধু বোস-কেবিনের বারান্দায় হেঁটে যেতে, তোমার সঙ্গে কথাই হয়নি আমার। তুমি আমাকে দেখেছ কিনা জানি না। দেখলেও মনে রেখেছে কি না জানি না। অথচ তোমার জন্য বোস-কেবিনে যাই, কাবাব খাই আর ঠায় বসে থাকি। তুমি কি আজ ফ্রক ছেড়ে শাড়ি পরবে! তাহলে ঠোঁট কাঁপছে কেন? সকাল থেকে বসে আছি। বোস-কেবিন আজ জ্বলজ্বল করছে। বোস-কেবিন আজ নতুন করে হেসে উঠবে।!
আমার চেয়ার নেই, তাই না বসেই কেটে যায় দিন-মাস-বছর। আমার অফিসে গিয়ে এখন বন্ধুরা আড্ডা দিতে পারে না। আমার চেয়ার নেই, তাই লিখতে হচ্ছে হাতের ওপর। লেখা যেমনই হোক, হাতের লেখা ভালো হওয়ার কথা নয়। এই সীমাবদ্ধতা মেনেও লিখে যাই আর লিখে যেতে চাই। যে আমার চেয়ারটাকে কেড়ে নিয়েছে তার মুখে থুতু দিতে গিয়েও ফিরিয়ে নিয়েছি। এখন তাঁকে বরং ধন্যবাদ দিইআমার একটি চেয়ার কেডে না নিয়েছে বলে অনেকের চেয়ারের বন্দোবস্ত করতে পেরেছি।
ভারতবর্ষের একজন কবি সেদিন আমাকে বলেছিল জ্বালামুখে কবিতার শব্দ মেখে নিলে ভূমিকম্প থেমে যায় যখন গোধূলি ছিল, যখন লৌকিক অলৌকিক ভুলে থাকা তখন রুণুকে পেয়ে একজন কবি মজে রসের খেলায়।
ভুল ভারতবর্ষের একজন কবির আপে মনে পড়ে আজন্ম ভ্রমণে তার বাড়ে কিছু ভ্রম আর অভিজ্ঞতা-ঝুলি দেশভাগ যাকে দেশছাড়া করে নিয়ে যায় অচেনা নগরে শুনেছি নতুন দেশে শব্দের প্রতিমা গড়ে স্মৃতিরঙতুলি।
কবিকে বাঁধতে পারে, চিন্তার চরণে দেবে রঙিন শেকল এমন নিয়ম নেই, এই কথা জানিয়েছে শিল্প হাইকোর্ট কবি যাবে সব দেশে সর্বত্র সাগর চর জলা কি জঙ্গল কবির লাগে না ভিসা তদারকি অনুমতি কিংবা পাসপোর্ট!
কবি নয় দেশবন্দি, ভাষা কি বাঁধতে পারে কবির অন্তর! কবি ঘোরে বিশ্বময় উত্তুঙ্গ আকাশে তার দশচালা ঘর।
কবিরা ব্রাহ্মণ হয় এই কথা লেখা আছে মনুসংহিতায় তুমি তাঁকে অস্বীকার করো কোন নিরঙ্কুশ ক্ষমতার জোরে যেহেতু তুমিও কবি, তাই তুমি নিজে নিজে সেজেছ ব্রাহ্মণ তোমাকে প্রণতি আজ এই পোড়া কার্তিকের বৃহস্পতি-ভোরে।
ঊধ্বর্তন এক কবি নিজেকে প্রচার করে ষাটের ব্রাহ্মণ অধস্তন কাব্য করে, এই অপরাধে নামে খড়গ কৃপাণ বঞ্চিতরে ভালোবেসে কিছু লোক এঁনে দেয় তিলকের মাটি অধস্তন কবি ছাড়ে নিয়মিত জীবিকার মোহন আহ্বান।
ষাট তো বালাই ষাট, নব্বই এনেছে জেনো নতুন সকাল এক পা কবরে রেখে আর কত ষড়যন্ত্র, ও হে বুড়ো ভাম ? নির্বীর্য নাটের গুরু, একদনি ভণ্ডামির দিন শেষ হবে শূদ্ররাও কবি হয় এই সত্য এনেছেন সাধু তুকারাম।
সকলেই কবি নয়, কারো চোখে বাস করে সক্রিয় ধূর্ততা। তুকারাম জয়ী হয়, জয়ী হয় শূদ্র আর কাব্যের ক্ষমতা।