কবি কৃষ্ণা বসু কবিতা
www.milansagar.com
*
বলে দুই হাতে তাকে আগলে রাখিস,
ওই দ্যাখ নিচু হয়ে আসে ধূর্ত চিল,
গ্রাম- শকুনের দল মাথার ওপর
চক্রাকারে উড়ে উড়ে বেড় দেয় সুখ,
তোমার সঙ্কল্প ওরা খাবে বলে ঠিক
নিচু হয়ে নেমে আসে মেধার ওপর ||
তুই তবে জেনেছিস কীভাবে মৃত্যুর
গভীর মারের থেকে পচনের থেকে
গলিত শবের থেকে জেগে ওঠে প্রেম
ফের, জেগে ওঠে মায়া, স্থাপত্য বিলাস
জাগে, ভাঙনের মুখ গান ফিরে আসে !



ওই দ্যাখ নেতা ধোপানীর ঘাট দেখা যায় দূরে,
প্রেম নিয়ে মাথাব্যথা নেই তার, আছে আত্মরতি,
ক্ষার কাচে, রোদে দেয় কাপড়-চোপড়, মুদ্রা গোনে,
স্বাধীন ভর্তৃকা নারী, শেখেনি সে প্রণয়-শাসন,
স্বর্গের নিকটে বাস, তবু তার অনুপম গান
ভেসে গেছে নদীস্রোতে, ধোপানীর ভিতরে জাগেনি |
ওই দ্যাখ ভূমন্ডল চেয়ে আছে তোর দিকে সোজা,
মুখে হাসি, অবিশ্বাস, অন্ধ অবজ্ঞার কূট ছায়া
মুখের নিকট, ওরা তোর শব-জাগানোর গানে
জেগে উঠে নদী ঘাটলায় এসে ও-মন মজেনি,
ওরা ঘোর রঙ্গখোর মানুষ ও মানুষীর দল,
তোর রঙ্গ দেখে নেবে বলে ওভাবে হেসেছে খুব,
জেগেছে তুমুল তারা কৌতুক-বিলাসে, অবহেলা
দিয়ে যাস মেয়ে, ও মেয়ে, সোনার মেয়ে, শোন বলি,
বাদামখোসার মত অবহেলা দিয়ে যাস তাকে !
সমুদ্র-সন্ধানী নদী বেঁকে গেছে অসীমের দিকে,
ওই দিকে চলে যাস, পরান-পুতলি, ওরে তুই
ফিরে ফিরে গ্রামরেখাটির দিকে তাকাস না আর |
সমুদ্র-সমীপে গিয়ে মহাজীবনের কানে কানে
বলে আয় শব-জাগানোর মন্ত্র, গূঢ় তন্ত্র কলা,
তোর গানে গানে ভেসে যাক পাথার আকুল করা
গানে তোর ভেসে যাক মহাদেশ, প্রণয়-প্রতিমা |
সমস্ত নারীরা আজ তোর মুখ চেয়ে আছে ওই,
ও মেয়ে, সোনার মেয়ে, স্বামী কিংবা বন্ধু-সহচর
প্রেমিক পুরুষ কিংবা সুগোপন সখা, যেই হোক,
বারবার মরে তারা, মরে যায় প্রেম তারো আগে,
তুই রে কামিনী গাঢ় কামনার গূঢ় মহাদেশ,
প্রেমের পবিত্রতমা, তোর শুদ্ধ তীব্র গানে ফের
পুরুষ পেয়েছে ফিরে মৃত্যুর গভীর তীর্থ থেকে
জীবনের সারাত্সার, ক্ষীর প্রেম, প্রেমের উপমা |



আবহমানের নারী, অপরূপা, সায় বণিকের মেয়ে,
প্রেমকে জাগাবি বলেই কলার মান্দাস বেয়ে বেয়ে
ভেসে যাবি কতদূর তুই ? শুধু ভেসে থাকা কোনোখানে
মূল নেই, মাটি নেই, কিছু নেই, শিকড়বাকড় টানে
গাছের প্রকৃতি, তোর তাও নেই, অতলবিলাসী জল
বয়ে গেছে দূর মাঠ ঘাট ছুঁয়ে ছুঁয়ে, মেয়ে তুই বল,
এই ভেসে থাকা, ব্যাকুলের রাত, নবজীবনের দিকে
কোল পেতে থাকা, নবীন জীবনে ফিরে পাবি আশাটিকে
তাই তুমি সোনা মেয়ে, রাত জাগো, কালো রাত জাগে একা,
ডাকিনীযোগিনী রাতশেষে দেয় জলের উপর দেখা |
বিবাহ-বাসর, আহা, তার ফুলগুলি শুকোবার আগে,
মিলনের স্বাদ ফুরোবার আগে, বিবাহে বিরহ জাগে |



গোদার ঘাটে ডাকছে গোদা হাজার লোকে,
কান দিওনা সোনার মেয়ে মন দিও না ওকে ;
নিজের থেকে সহজ গাঢ় ডাক পাঠাবে যাকে
তাকেই টেনো বুকের কাছে মুগ্ধ কথার বাঁকে !
বাঘ চেয়েছে লোভ করেছে বাঘের মেসো পিসে
প্রেমের শরীর গলে যাচ্ছে এমন করে কি সে ?
মহাকালের রোদ পড়েছে ক্ষণকালের দেহে,
গলে যাচ্ছে শবের শরীর, ডুকরে উঠছ স্নেহে,
স্রোতের ওপর বহতা স্রোতকেবল ভাঙে গড়ে,
শত বছর কত বছর হাজার বছর ধরে
বাঁচাবে প্রেম জাগাবে প্রেম ? ভিত গিয়েছে নড়ে,
ভিত নড়েনি, ভিত ছিল না , কলার ভেলা করে
অনন্তকাল ভেসে চলিস ভেসে চলিস কন্যা,
একবারে তোর স্বপ্নকে খায় খরা আর বন্যা |
ভয় কেঁপেছে ভয় জেগেছে প্রাণের ভিতর তোর
ঝড়ে কাঁপায় বৃষ্টি ভেজায় স্বপ্ন ঘন ঘোর |
রঙ গলে যায়, মাংস গলে কয়েক টুকরো হাড়ে
এমনি করে ঘনিষ্ঠ প্রেম মৃতের মধ্যে বাড়ে !
ভাসছে কন্যা ভাসছে স্বপ্ন ভাসছে চোখের জলে,
আকাশ থেকে নেমে এলেন সপ্তঋষির দলে ;
স্বাতী এলেন, শতভিষা, এলেন অরুন্ধতী,
অন্ধকারের মধ্যে এলেন, চন্দ্র ছন্ন-মতি,
এক হাত ধরেন শোকাতুরার, আরেক হাতে সুরা
সুরা ও সুর তুমুল ছড়ায় স্বর্গীয় তানপুরা  !
সবার শেষে ঊষা এলেন সূর্যের বান্ধবী
কখানা হাড়, বুকের মধ্যে সামান্য এক চবি
আঁকড়ে ধরে ভাসছে মেয়ে প্রেম ফেরাবে বলে
প্রতিজ্ঞা তার ফেরাবে প্রেম যে কোনো কৌশলে |
ফেরাবেই সে প্রেমিককে তার পুরুষকে তার ঠিক
দুঃসাহসী যাত্রা দেখে চুপ করে দশ দিক !



ভিতর থেকে নাচের মুদ্রা জমে উঠছে আজ,
কিসের বাড়ি, কিসের মায়া, কাদের গৃহের কাজ ?
নাচ দেখতে আকাশ এলেন স্বর্গসভার কাছে,
নাচ দেখবেন বলে বাতাস থমকে আছেন গাছে |
নাচছে মেয়ে নাচছে যাদু নাচছে ছন্দ ভরে
তার শ্রেণীদেশ, তার দু-খানি অমল হস্ত ‘পরে
হাত রেখেছেন পিনাকপানি নাচের মহারাজে,
নাচছে সভায় নাচছে মেয়ে নাচের কারুকাজে,
নাচছে দুঃখ নাচছে জ্বালা তীব্র অপমানে,
নাচের সঙ্গে গভীর ব্যথা ঝলসে উঠছে গানে ;
প্রেম চাই তার ভালোবাসার পুরুষও এক চাই,---
বিত্ত  আছে সায় বণিকের, চাঁদ বণিকের টাই
কে খায় ঘরে ? উপছে পড়ে দুধ-ভাতের থালা,
ভাত নয়কো, কাপড়ও নয়, বুকের মধ্যে জ্বালা,
সকল কিছু পাবার পরেও সঞ্জীবনী চাই,
নাচছে ব্যথা, নাচছে দুঃখ, হাজারো রোশনাই
স্বর্গসভা ম্লান হয়েছে দুঃখী মেয়ের গানে,
কী আশ্চর্য ইন্দ্রানীর ওই চোখের কাজল টানে
জল জমেছে, স্বর্গপুরীর প্রথম চোখের জলে
ছল ছলালো দুঃখ ও সুখ অলীক পরিমলে,
সুখের থেকে বিত্ত থেকে অধিক মায়া যারই
দুঃখ দিনের তীব্র গানের অমন বাড়াবাড়ি !
বর দিয়েছেন জরত্কারুর পরিত্যক্তা নারী,
প্রেমহীনা সে আজ চিনেছে প্রেমের ঘরবাড়ি |
স্বর্গপুরী শুদ্ধ হল অশ্রু ছুঁয়ে শেষে
বর দিয়েছেন দেবের রাজা, বর দিয়েছেন নিজে |

প্রাণ পেয়েছেন প্রেমের পুরুষ, প্রাণ পেয়েছেন নারী,
দুঃখ ছুঁয়ে শুদ্ধ হল স্বর্গসভার দ্বারী,
সুখ ছুঁয়েছে সুখ ছেনেছে হাজার বছর ধরে ;
দুঃখ ছুঁয়ে প্রেমর জন্য দুঃখ ছুঁয়ে ওরে
সোনার মেয়ে, শিল্পী মেয়ে শিল্প থেকে কেন
সফেদ শাঁখা সিন্দুর টিপ ভিখ মেগেছে যেন ?

সফেদ শাঁখায়, সিঁদুর টিপে, কাপড় জোড়া লালে
আর কত দিন নারীর আদর প্রদীপ শিখায় জ্বালে ?



আকাশ, ওরে আকাশ, অসীম নীল আকাশ ওরে,
বাতাস ওরে গভীর বাতাস, অনন্ত কাল ধরে
এই কাহিনী ছড়িয়ে দিস দেশ আর দেশান্তরে,
হায় রে প্রেমের জন্য কী প্রতিজ্ঞা মেয়ের অন্তরে
জন্ম নিয়ে শেষে ভেলা ভাসায় কালের পারাবারে,
ধারণ করো গহন সাগর আপন জলাধারে !

.              ************************     
.                                                                                           
সূচিতে . . .    




মিলনসাগর
*
বলি দিয়েছেন মহাকাল, নদীর চড়ায়  পোঁতা তাদের কখানা কচি হাড় |
হা হা করে হাওয়া ঘোরে, ভৌতিক চাঁদের আলোয়
জান্তব চিত্কার করে উন্মাদ জননী
মুখ থেকে লালা ঝরে, চোখ থেকে লবণাক্ত স্নেহ

ক্ষুধায় কান্নায় কষ্টে অবসন্ন ঘুমিয়ে পড়েছে
ভোরের বাতাসে জাগে, ক্ষুধার মোচড়ে জাগে
জীবনের থাবা এসে প্রবল ঝাঁকায় তাকে শেষে
জেগে উঠে দেখে দুর্ভিক্ষপীড়িত গ্রাম তার দিকে চেয়ে আছে
ঠিক যেন দিকে নয়,  তার আঁচলের দিকে চেয়ে
যেখানে লুকানো আছে  অস্বচ্ছল অন্নের আশ্বাস |

তীক্ষ্ণ তীব্র অসভ্য উদ্ধত রোদ উঠে আসে
দুর্ভিক্ষ্য তাড়িত গ্রামে নির্লজ্জের মতো
এক বিংশ শতাব্দীর দিকে পাশ ফেরে
সগৌরবে সুসভ্যতা, সুপ্রাচীন ভূমি  |

.         ************************     
.                                                                                           
সূচিতে . . .    




মিলনসাগর
*
এই ভন্ড, ভুল মাতৃতন্ত্রের স্বদেশে
তন্ত্রাচারে মাকেই সবচে বেশী হেলা,
হেলা ফেলা দিয়ে গেছ সুসভ্যতা তুমি !
না, কোনো অভিমান নয়, অভিমান অতি
মহার্ঘ সঞ্চয়, ভুল ব্যবহারে তাকে
নষ্ট করা ঠিক নয়, রাগ নয়, অভিযোগ নয়,
প্রত্যাহার করে নিই সমস্ত দাবীই---- |
শুধু এক প্রার্থনা রেখে যাই মহাকালের নিকট
----‘নারীহীন, মাতৃহীন, কন্যাহীন যোষিত সংসর্গহীন
বান্ধবীবিহীন হয়ে বেঁচে থাক্, আগামী প্রজাতি |’

.             ************************     
.                                                                                           
সূচিতে . . .    




মিলনসাগর
*
যা পেয়েছ, যা দিয়েছি, তারও যোগ্য নও তুমি নারী,
তোমাকে মর্যাদা দিতে কে পেরেছে ? একা, আমি পারি !

মা কাঁদেন একা একা, শব্দহীন, খুব সংগোপনে
বোবা ঘর, বোকা ঘর চুপচাপ মার কান্না শোনে |
ক্রমে বড় হয় মেয়ে, ডাঁটো হয় সকলের চেয়ে,
আদি মাতা রক্তের ভিতরে ওঠে তীব্র গান গেয়ে,
সে দেখেছে আশৈশব মায়ের ওপর ঘোরে ছড়ি,
শাঁখা আর সিন্দুরের মহিমায়, আহা, মরি মরি,
সেবাদাসী মাকে তার ছেড়ে গেছে অকৃতজ্ঞ বাবা ;
সর্বত্র বিছিয়ে আছে পরাক্রান্ত পিতাদের থাবা |

বেড়ে ওঠে মেয়ে ধীরে, অবিবাহে আর উপার্জনে,
নতুন পৃথিবী আজ মন দিয়ে তার কথা শোনে |
সন্তান চেয়েছে মেয়ে বিবাহ চায়নি বলে তাই,
অবিবাহে সন্তানের মার নামে পরিচয় চাই,
এই মর্মে কেঁপে ওঠে সামন্ত ভারতভূমি আজো
নতুন যুগের সাজে, সাহসিনী কে রয়েছ সাজো |

.             ************************     
.                                                                                           
সূচিতে . . .    




মিলনসাগর
*
সেবা করে, সেবা করে, মুখ বুজে থেকে,
তার কাছে সত্যি কথা জানতে চেয়েছি,
মাইনের সব টাকা কোনখানে যায়,
স্বাভাবিক অধিকারে জানতে চেয়েছি সব কিছু ;
তখন-ই জুতিয়ে বেঁকিয়ে দেবে মুখ বলে আমাকে শাসায়  |
মাগো, আমি কার কাছে যাবো,
ছোটন তোতন খুব ছোট আছে আজো,
ওরা কোন্ নির্ভরতা দিতে পারে বলো ?
বিয়ের পরের বাড়ি, বিয়ের আগের বাড়ি, বলো,
কোন বাড়ির আমার নিজের অধিকারে ?
মাগো, মুখ বুজে, মার খেয়ে রান্না করে,
সেবা করে, ‘রমণীরতন’ হয়ে জীবন কাটাবো ?
মাগো, বলো, আমার নিজের বাড়ি কোনখানে আছে ?
মেয়েদের নিজেদের বাড়ি থাকে কোনো দিন ?

.             ************************     
.                                                                                           
সূচিতে . . .    




মিলনসাগর
আবহমানের মান্দাস
কৃষ্ণা বসু


   
আদিকথা
কৃষ্ণা বসু
কন্যাভ্রূণ
কৃষ্ণা বসু
 
সাহসিনী কে রয়েছ, সাজো
কৃষ্ণা বসু
   
একটি সামান্য চিঠি
কৃষ্ণা বসু