শুধুই প্রাণের দায়ে। নবজাত শিশুর রোদন। চঞ্চল মুষ্ঠি যে তার ব্যর্থ হয় আচ্ছন্ন সন্ধ্যায়। স্তিমিত মোমের আলো। তাও তো কৃপণ। এই গৃহ-অন্তঃপুরে মৃত্যুহীন মৃত্যু-বীজ করেছে রচনা আপন সাম্রাজ্য তার। মানুষের কাছে অধিকার কেবলই নির্বাক মৃত্যু। এ কলকাতার গলিতে দুঃসহ এই নাগরিক দায়। সূর্য, তুমি কেন হলে বিগতযৌবন এই বসন্তসন্ধ্যায় ?
মুগ্ধতার জন্য কবি কৃষ্ণ ধর ১৯৯২ সালে প্রকাশিত, দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায় ও দীপক রায় সম্পাদিত “বাংলা আধুনিক কবিতা ১” সংকলন থেকে নেওয়া।
এখন আর কিসের জন্য বসে থাকা! নদীতে যারা গেল, মাঝদরিয়ার দামাল হাওয়ার খোঁজ পেয়েছে ওরা : ফিরবে সেই সন্ধ্যায় আকাশে তারা ফোটার অপেক্ষায় ; দিনমানে কেন তবে বসে থাকা। নদী ওদের ডাক দিয়ে নিয়ে গেছে, জলের অপরূপ যাদুতে ওরা বিস্মিত যুবক, মন্ত্রের জগতে ওদের আনাগোনা, ডাকলেও ওরা আর ফিরবে না এখন। এখন আর কিসের জন্য তবে বসে থাকা। আমার দুঃখকে তুমি নিয়ো, অন্ধকারে তার ছায়াগুলি দেখি, টুপটুর বৃষ্টির মতো নিঃশব্দে পাতা ঝরছে। আমার সন্দিগ্ধ ভাবনাগুলে ঘাসের ডগার ওপর জড়ো হতে হতে শিশির হয়ে গেল। আমাকে যদি দরিয়ায় নিতে, নদীর জলের পরিচিত শব্দে ওদের সঙ্গ পেতাম। আমার বধির দৃষ্টিহীন দিনগুলোকে কো পার করবে, কোন পারানিয়া!
অনুতাপের প্রশ্নে কবি কৃষ্ণ ধর ২২শে শ্রাবণ ১৪১০বঙ্গাব্দে (অগাস্ট ২০০৩) প্রকাশিত, শামসুর রাহমান ও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত “দুই বাংলার প্রেমের কবিতা” সংকলন থেকে নেওয়া। মিলনসাগরে প্রকাশ - ১৫.৬.২০১৩।
অনুতাপ যদি আসে কোনোদিন, কোনোদিন যদি মনে হয়, এ আমার প্রতারণা, প্রেম নয়, তুমি সব মনটুকু অনীবৃত করে যাকে চেয়েছিলে যে শুধু মুখোশ পরে, উজ্জ্বল বাক্যের বিবিধার্থে মিথ্যা এক প্রেমিকের অভিনয় করে গেল, তবে বলো তুমি কোনোদিন অনুতাপে দগ্ধ হয়ে শেষে নিজেকেই নিহত করার ইচ্ছে হবে না তোমার ?
কখনো হবে না, ঠিক জেনো, আমি কত যে কৃতজ্ঞ এই বিস্মিত সময়টুকু ধরে কত স্বপ্ন, এই রৌদ্রে ঘ্রাণ নিই, তুমি কতক্ষণ এসে বসে আছো! আমাকে বিস্মিত করে যদি ফের কোনোদিন নাই ডাকো, এই পরমাশ্চর্য দিন তবু তো আমার হয়ে বলবে খোঁপা বাঁধা সুকেশী সন্ধ্যাকে, উজ্জ্বল যুবক এক এসেছিল, উজ্জ্বলতর ভালবেসে।
আশ্রয়ের খোঁজে কবি কৃষ্ণ ধর ২০০৭ সালে প্রকাশিত, আশিস সান্যাল ও মৃণাল বসুচৌধুরী সম্পাদিত “বাংলা কবিতার ভুবন” কাব্য সংকলন থেকে নেওয়া। মিলনসাগরে প্রকাশ - ১৫.৬.২০১৩।
একদিন দিশাহীন দিগন্ত আমাকে এখানে নিয়ে এসেছিল নাঙ্গাপায়ে বিস্তর হেঁটে . এখানে আসা বড়ো কষ্ট নিয়ে এসেছিলাম অপমানের জীবন থেকে যদি রেহাই মেলে, জীবনযাপনেরও . আকাঙ্খা ছিল হলো না। এই গাছপালা বোবা আকাশ . তার সাক্ষী রেখে যাচ্ছি কিছু মায় নিয়ে যাচ্ছি কিছু স্মৃতি ওরা দেখেছে কীভাবে কেটেছে . আমার জীবন আমার ভেতরটা কেউ দেখেনি আমি জানি দিশাহীন দিগন্তের দিকেই আবার ফিরে যেতে হবে আমাকে চলে যাচ্ছি কাঁটা-মারা তাঁবুর জীবন গুটিয়ে, নাঙ্গাপায়ে যেমন এসেছিলাম . একদিন তোমাদের কাছে . আশ্রয়ের খোঁজে॥
ভোরবেলার গল্প কৃষ্ণ ধর মিলনসাগরে প্রকাশ - ১৫.৬.২০১৩।
ভোরবেলাগুলি কখন যেন হাত গলিয়ে চলে গেছে ওরা অন্য পোশাকে দাঁড়িয়ে আছে বিকেলের বারান্দায় যখন সময় দৌড়ুত যেন টগবগে দুরন্ত ঘোড়া তাকাবার কথা মনে হয় নি ওদের দিকে নিমগ্রীষ্মের দুপুরে চলতে চলতে দেখা যেত রোদে চমকানো প্যারাসোল
হাতের মুঠোয় ধরা প্রিয় শব্দাবলী এখন ঘুমে কাতর তাকে জাগাতে হলে ভোরবেলাগুলিকে ফিরে চাই ভোরের মানুষগুলিকে দেখতে চাই আবার ভোরের স্বপ্নের গায়ে ডানা লাগিয়ে ওরা এখন অজস্র প্রদাপতি হয়ে বিকেলের মরা রোদে উড়ছে ওদের আমি দেখেই চিনতে পেরেছি
বিকেলবেলার জন্য কোনও স্বপ্ন আর বাকি নেই পাতাঝরারও একটা মাধুর্য আছে নিসর্গে নিস্তব্ধ নিশ্বাসে টুপ করে খসে পড়ে এক একটা প্রবীণ পাতা হলুদ বিবর্ণতা শরীরে নিয়ে এতকাল না-ঘুমের স্বপ্ন দেখে বিকেলের এই আয়োজনে মজাই লাগে আমি তো জেগে থাকতে চাই বিকেলের বারান্দার রেলিং-এর ফাঁকে ফাঁকে ভোরবেলার স্বপ্নের টুকরোগুলো গুঁজে দিয়ে ফের আড্ডা জমানো যাবে।
স্ববিরোধী নয় কবি কৃষ্ণ ধর ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত, অসিতকুমার বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত “বাংলা কবিতা সমুচ্চয় ২য় খণ্ড” থেকে নেওয়া। মিলনসাগরে প্রকাশ - ১৫.৬.২০১৩।
কখনো মানুষ চায় নিঃসঙ্গতা, কখনো সে মিশে যেতে চায় জনারণ্যে এই তার বিরুদ্ধ স্বভাব তবু সে স্ববিরোধী নয় গভীর দুঃখের দিনে সে বুঝি একাকী আনন্দের ভাগ দিতে সে যায় প্রতিবেশী ঘরে
মনুষ কখনো শিল্পী, করিগর, কখনো ভাবুক সে স্বপ্ন দেখে, সময়ের স্রোত তাকে টানে কখনো উজানে যায়, গা ভাসায় মোহানার দিকে তার হাতের মুঠোতে ধরা সত্যাসত্য, অভিজ্ঞতা পায়ে পায়ে চড়াই উৎরাই
নিজের আয়নায় দেখে মুখ গভীর দুঃখের দিনে সে বুঝি একাকী আনন্দের ভাগ সে দিতে যায় প্রতিবেশী ঘরে প্রেমহীনতা থেকে যেতে চায় গভীর হৃদয়ে অন্য কোনো হৃদয়ের সমাচারে
কখনো মানুষ চায় নিঃসঙ্গতা, কখনো সে মিশে যেতে চায় জনারণ্যে
আমার বন্ধু লতিফ কবি কৃষ্ণ ধর ১৯৮৮ সালে প্রকাশিত, নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী, সরল দে, এখ্লাসউদ্দিন আহ্মদ (বাংলাদেশ) ও অর্ধেন্দু চক্রবর্তী সম্পাদিত “পাঁচশো বছরের কিশোর কবিতা” সংকলনের কবিতা। মিলনসাগরে প্রকাশ - ১৯.৮.২০২০।
লতিফ আমার বন্ধু ছিল ছোটবেলার স্কুলে সে কবেকার কথা জানো, সবই ছিলাম ভুলে। ক্লাশেতে সে ফার্স্ট হত, ছিল খেলায় সেরা সাঁতার দিয়ে উজান চরের বিল হত সে পার। লতিফ আমার ছোটবেলার বন্ধু ছিল স্কুলে।
মাঝখানেতে অনেক কথা, অনেক গেছে দিন অনেক সকাল পেরিয়ে গেছে, অনেক সন্ধ্যাবেলা। ভাগ হয়েছে দেশ আমাদের, টুকরো হল গ্রাম কে যে কোথায় ছিটকে গেছি, কেই বা রাখে খোঁজ ভুলেই ছিলুম সে সব কথা, ছেলেবেলার দিন।
এখন আমি হোমরা-চোমড়া, মস্ত আমার নাম হাঁকাই গাড়ি, হিল্লি-দিল্লি যখন তখন ছুটি আমার কথা সবাই জানে, কাগজে নাম ছাপে তারই চাপে কখন আমার ছোটবেলার কথা হারিয়ে গেছে জানিই না তা, ছেঁড়া স্মৃতির পাতা।
হঠাৎ সেদিন একটি চিঠি এল সকাল ডাকে অবাক আমি কে লিখেছে, চিনি না তো তাকে? সন্বোধনে আরও অবাক, ডাকনামেতে লেখে, নিরু তুমি চিনবে কি আর, কিংবা গেছ ভুলে? কুসুমপুরের লতিফ আমি, ছেলেবেলার সাথী।
লিখেছে সে অনেক কথা, ছেলেবেলার কথা আম্মা যে তার ভালবাসতেন আপন ছেলের মতন। বোশেখ মাসে মারা গেছেন লতিফের সেই মা যাবার আগে আমার কথা বলেছিলেন তাকে, খবর দিবি ওপারেতে কেমন আছে ছেলে।
লিখেছে সে পুকুরপাড়ে বকুল গাছের চারা পুঁতেছিলুম দুইজনেতে মনে করতে পারো? সে গাছ এখন ঝাঁকড়া পাতায় ঘন-গভীর ছায়া মিষ্টি ফুলের গন্ধে মাতায় সকাল-সন্ধ্যা বেলা। তার ছায়াতে আম্মা আমার আছেন চিরঘুমে।
লতিফ গাঁয়ের স্কুলে পড়ায়, কুসুমপূরেই থাকে সবই আছে তেমনি, যেমন ছিল ছোটবেলায়। নতুন কালের নতুন মানুষ এসেছে তার ঘরে, তাদের কাছে পুরনো দিন শুধুই গল্পকথা লতিফ জানে আর জানে ওই একলা বকুল গাছ।
চিঠি পড়ে বুকের ভিতর মোচড় দিয়ে ওঠে লতিফ কেন এমন করে স্মৃতির দরজা খুলে তুলে আনলে সে সব দিনের হীরে-পান্না-মোতি? কেন বা আজ একলা বকুল গন্ধে পাগল করে? আমি কি আর সেই আমি আজ, লতিফ-কে কি চিনি?