কবি কৃষ্ণধন দে-র কবিতা
*
নিশির ডাক
কবি কৃষ্ণধন দে

চাঁপার গন্ধ আরো যে নিবিড় হ’ল,
.                 -----খোল বধূ, দ্বার খোল !
রাত্রিটা দেখ, ঘুমন্ত চোখে কি যেন কাহিনী বলে,
অশ্রু তাহার করে ঝিক্ ঝিক্ নিথর গাঙের জলে ;
দ্বাদশীর চাঁদ ঢলে পশ্চিমে শিরীষসারির ফাঁকে,
দূরে বালুচর চাঁদের আলোয় হাতছানি দিয়ে ডাকে ;
.                চারিদিক নিঃঝুম্ ,
অজানা পাখীর ডানার ঝাপটে আকাশের ভাঙে ঘুম !


চাঁপার গন্ধ আরো যে নিবিড় হ’ল,
.                ----- খোল বধূ, দ্বার খোল !
বাতাসে ভাসিয়া এল বুঝি কার ব্যথাভরা নিশ্বাস,
কার এলোচুলে এখনো কাঁদিছে হারানো মালার বাস,
কে যেন খুলিয়া ফেলেছে নূপুর , হাতের কাঁকন দুটি,
আঁধারের বুকে কে গো অভিমানে মাটিতে পড়েছে লুটি !
.                  কৃষ্ণচূড়ার তলে
ঝরাফুলে কার মিশেছে সিঁদুর শিশির-অশ্রুজলে !


চাঁপার গন্ধ আরো যে নিবিড় হ’ল,
.                -------খোল বধূ , দ্বার খোল !
নিশীথ-বাতাস পথ ভুলে যায়, বেউড় বাঁশের ঝাড়ে,
থেকে থেকে তার আকূল কাকুতি কাঁদিছে অন্ধকারে ;
কোথা কতদূরে মাঠের ও-পারে জ্বলে আলেয়ার আলো,
দীঘির কিনারে দেবদারুসারি হয়ে গেছে আরো কালো ;
.                 চারিদিক নির্জন,
থম্ থমে রাতে ঝম্ ঝম্ করে শ্মশানে তালের বন !


চাঁপার গন্ধ আরো যে নিবিড় হ’ল,
.                 -------খোল বধূ, দ্বার খোল !
ঐ শোন, দূরে দিশাহারা পথে কে যেন কাঁদিয়া ওঠে,
কার নীরক্ত তৃষাতুর ঠোঁটে বেদনার বাণী ফোটে !
মাঠে মাঠে ঘোরে কোন্-সে পাগল ঘূর্ণি-হাওয়ার সাথে,
সোঁদালের বনে দেয় করতালি তন্দ্রা-নিশুতি রাতে !
                         ধরা সম্বিৎ-হারা,
কালপুরুষের অসির ফলকে কেঁপে ওঠে নীল তারা |


চাঁপার গন্ধ আরো যে নিবিড় হ’ল,
.                   -----খোল বধূ, দ্বার খোল !
আড়ি পেতে কারা চুপি চুপি যেন ফেলিতেছে নিশ্বাস,
ঝিল্লী-নূপুরে ধরা পড়ে যায় কূতুহলী উল্লাস !
বকুলবীথিতে কাদের সিঁথিতে জোনাকি-মানিক জ্বলে,
সাড়া পেয়ে কারা বনের আড়ালে মুখ ঢেকে ছুটে চলে !
.                    নিশীথিনী -অন্তরে
কৌতুকভরা কলহাসি শুধু জাগে বনমর্মরে !


চাঁপার গন্ধ আরো যে নিবিড় হ’ল ,
.              -------- খোল বধূ, দ্বার খোল !
সপ্ত-ঋষির শিয়রে কাঁদিছে বন্দিনী ধ্রুবতারা,
কার পথ চাহি অনিমেষ আঁখি আজো ফেরে দিশাহারা !
আকাশ-গঙ্গা মথি’ চলে কোন্ অপ্সরী সাহসিকা,
লীলার ছন্দে খসে মণিহার ছড়ায়ে উল্কাশিখা  !
.                  কোন্-সে অলকাপুরে
রতন-নূপুর পড়েছে ছড়ায়ে গগন-পথটি জুড়ে’ !


চাঁপার গন্ধ আরো যে নিবিড় হ’ল,
.                 ----- খোল বধূ , দ্বার খোল  !
বিবশা ধরণী, উতলা রজনী, মহুয়া ফুটেছে বনে,
আজিকার রাতে ঘুমায়ো না বধূ, পুরাতন গৃহকোণে ;
ফাগুনোত্সবে আনিয়াছি লিপি, তোমারি আমন্ত্রণ,
রূপময়ী নিশা ডাকিছে তোমার রূপময় যৌবন !
.                          সাড়া দাও একবার,
চাঁপার গন্ধ হয়েছে নিবিড়,  খোল বধূ,  খোল দ্বার  ||

.                   *************************  
 
.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
বধু যাবে সেই দেশ ?      
কবি কৃষ্ণধন দে

তারকাবিহীন অন্ধকারের পঞ্জরে
.                পথহারা ঝড় কাঁদে যে ককিয়ে, শুনতে পাও ?
জমেছে আঁধার দিশাহারা ধূ-ধূ প্রান্তরে,
.                কদম-কেয়ার বন একটি কি নেই কোথাও ?
.        সাতটি সাগর, তেরোটি নদীর ও-পারে পথ,
.        রাজার দুলাল এঁকেছে সে-পথে ভবিষ্যৎ,
.        জোছনা-হারানো মৌন নিশার নূপুর-সুর
.        সুদূর গগনে এখনো যেখানে হয়নি শেষ, ---
.                        . . . যাবে বধূ, সেই দেশ ?


কোথা নিশি-পাওয়া যূথিকাবনের নিঃশ্বাসে
.                জড়ায় নিবিড় চারপাশে ভীরু অন্ধকার,
কালো-মেঘভরা কালো চোখে কার নিদ্ আসে,
.                কে আজ খিলেছে হারানো যুগের বন্ধ দ্বার!
.        সেই রূপকথা বল বল তুমি আমার কাছে,
.        ---সে অচীন্ পুরী আকাশের নীচে কোথায় আছে,
.        শিয়রে ও-কার সোনার প্রদীপ এখনো জ্বলে,
.        হিমেল হাওয়ায় কে দিয়েছে মেলি’ কাজল কেশ ?---
.                        . . . যাবে বধূ, সেই দেশ ?


গহিন রাতে যে-রূপকথাবলে চাঁপার বন
.                অতন্দ্র পথ সে-কাহিনী তার নীরবে শোনে,
তার সাথে আজ শুনি সে কাহিনী মোরা দু’জন,
.                শোনে ফালি-চাঁদ কালো আকেশের রুপালী কোণে।
.        পাষাণ-পুরীতে ঘুমে অচেতন রূপসী মেয়ে,
.        মালতীমালার গন্ধ কাঁদে-যে অঙ্গ ছেয়ে,
.        অভিমানে তার কুসুম-মেখলা গেল যে ছিঁড়ে,
.        শিথিল হোল-যে তন্দ্রা-অলস বাসক বেশ,---
.                        . . . যাবে বধূ, সেই দেশ ?


ঐ শোনো বধূ, কে কাঁদে কানন মর্মরে
.                ---হাজার যুগের রাজার দুলালী সুন্দরী,
নিশীথ-বাতাসে কনক-নূপুর গুঞ্জরে,
.                পথে চিহ্নে ফেলে যায় নীপ-মঞ্জরী,
.        নয়ন-কাজলে এঁকে যায় লিপি পথের ধারে,
.        ফুলের আখরে মনের কথাটি জানায় কা’রে,
.        আজো সে একলা আসে অভিসারে শুক্লারাতে,
.        ---শোন নি কি তা’র মদির-মধুর নূপুর রেশ ?
.                        . . . যাবে বধূ, সেই দেশ ?


পড়ে’ আছে পথ অতীত যুগের চেতনা-হারা,
.                তুমি আর আমি চলেছি যাত্রী অসীমকাল,
তোমারি নিবিড় কালো কুন্তলে জ্বলে-যে তারা,
.                চোখে আঁকা কত মধু-যামিনীর ইন্দ্রজাল,
.        পাতাল-পুরীর প্রবাল-দুয়ার কে রাখে খুলে,
.        ঘুম-ভরা চোখে কে জাগে প্রহর এলানো-চুলে,
.        নাগিনীরা রচে ফণার মালায় মেখলা কা’র,
.        নয়ন-প্রহরী জানে না ক্ষণিক তন্দ্রালেশ!
.                        . . . যাবে বধূ, সেই দেশ ?


হিম০পাণ্ডুর আকাশের নীচে ঘুমায় রাত,
.                চাঁদ ডুবে গেছে দূরে দেবদারু-সরল-বনে,
আমারে ঘিরে কি কামনা-তপ্ত ও-দু’টি হাত
.                কাঁপিবে অধীর নিবিড়-মদির আলিঙ্গনে!
.        রূপকথা আজ মুখর হয়েছে ও-কার চোখে,
.        কে যেন ডেকেছে মায়াবী নিশার স্বপ্ন লোকে,
.        বিদায়ের ক্ষণে ঊষা-তারকার অস্তপথে
.        কনকদুয়ারে কে হেরে তোমারে নির্নিমেষ!
.                        . . . যাবে বধূ, সেই দেশ ?

.                   *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
পারুল ফুলের ব্যথা
কবি কৃষ্ণধন দে

ভুলে গেছে লোকে সেই পুরাতন কথা,
.        দিদিমার মুখে কদাচিৎ কেহ শোনে ;
মা-হারা শিশুর করুণ বুকের ব্যথা
.        বুঝেছিনু শুধু মোরা ক’টা ভাই বোনে।
সাতটি ভাইয়ের স্নেহের আশিষ্ মাথে
ফুটেছিনু সেই কোন সে অজানা প্রাতে!

চেয়ে গেছে ফুল, বলে’ লোক কত কি-যে,
.        কেহ বা সেধেছে, কেহ বা দিয়েছে গালি,
এসেছে মন্ত্রী, এসেছে ভূপতি নিজে,
.        এসেছে রাণীরা, এসেছে চকের-মালী,
আসেনি’ক শুধু মোদের দুখিনী মাতা।
মা’র পথ চেয়ে ভিজেছে চোখের-পাতা!

ভোরের প্রভাতী গেয়ে যায় যবে পাখি,
.        পূরব আকাশে ম্লান শুকতারা জ্বলে,
ভাই-সাতটিকে ঘুম হতে তুলি ডাকি’
.        আজো চেয়ে থাকি সুদূর গগন তলে।
যদি কোনদিন মা আবার আসে ফিরে,
ডেকে তুলে লয় বক্ষের স্নেহ-নীড়ে!

.            *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
বেদে
কবি কৃষ্ণধন দে

দড়ি-দড়া-ঝুড়ি টিন-বাঁশ-তাঁবু-পেটরায়,
ডুগ্ ডুগি-খঞ্জনি-ঢোলকের ঢেঁটরায়,
বন-মানুষের হাড়, মরা শকুনের আঁত,
সাদা বাদুড়ের ডানা, শাখামুঠি-বিশদাঁত,
শ্মশানের পোড়ামাটি, শিকড়ের ঝুলি আর,---
পথে পথে চলে ওরা, নিয়ে বেদে-সংসার ;
দল বেঁধে থাকে সব, যেথা যায় প্রাণ চায়,
মেয়েগুলো ঘোরে ফেরে রঙদার ঘাঘরায়।

কুকুর ছাগল হাঁস মুরগীও সাথী তাই,
বাঁকে ঝোলে হাঁড়িকুঁড়ি, তাঁবু গাড়ে সব ঠাঁই ;
ঝাড়ফুঁক তুক্ তাক্ জানে ভানুমতী-খেল,
আছে কুমীরের দাঁত, ধনাই পাখির তেল,
হাত দেখে বলে দেয়---কোথা যশ, অপযশ,---
মনের মানুষ টানে শিকড়েতে করি বশ ;
ঘরভাঙা, ঘরবাঁধা মারণ ও উচাটন,
সবকিছু জানে ওরা যখন যা প্রয়োজন ;
ট্যারা-চোখো বুড়ো বেদে, ঝানু বুড়ী বউ তার,
মিটিমিটি হাসে শুধু খুক্ খুক্ কাশে আর!

মেঘ-কালো আকাশের নীচে বসে গালে-হাত,
ঘুমহারা চোখে বুড়ী কি যে ভাবে সারারাত,
কত গ্রাম দেখেছে সে, কত গিরি, নদীপথ,
কত বন, কত মরু, সাগরের সৈকত ;
জানে না সে পথচলা কবে তার হবে শেষ,
মরণের শেষ-ঘুমে ডেকে নেবে কোন্ দেশ!
যে মাটিতে কিছুদিন ওরা এসে বাঁধে ঘর,
সে মাটির মায়া যেন ভরে থাকে অন্তর।
তবু ছেড়ে যেতে হবে,---যাযাবর ওরা, তাই---
চল-পথে দেখে নেবে পৃথিবীর শেষটাই!

.            *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর