কবি কৃষ্ণকুসুম পাল-এর কবিতা
*
দুরন্ত ফুটবল
কবি কৃষ্ণকুসুম পাল
‘রাতের কাব্য’  কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

নিদ্রাজয়ী স্ফটিকোজ্জ্বল শৌখিন সূর্য,
মরুমায়ারাক্ষস হতে নিরাপদ নীলান্তে
গা – বাঁচিয়ে নিষ্পলক চিতা, কবর, দ্রোহ – দাবানলে,
নিরুত্তর নীলকান্ত, শান্ত, স্থির, সম
প্রবাহে,
সতর্ক, সন্ত্রস্থ, দূরন্ত --  উদয়াস্ত এবং রাত |

এমন ফুটবল পেলে পায়ে পায়ে উঠতো ধূলিঝড়
কে কোথায় ? কে কার রাখতো খবর ?
প্রসব বেদনায় যদিও বা পৃথিবীর প্রাণ ওষ্ঠাগত,
ধর্ষিতা সতীর জড়ায়ুতে সুগভীর ক্ষত,
অষ্টসখী রুগ্ন রাতনারী কাঁদে দেউড়ীতে
সূর্য পুরুষ – উল্লাস ফুটবল, ঘোরে আপন গতিতে |

.     ****************    
.                                                                                                 
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
*
নিখাদ প্রেম
কবি কৃষ্ণকুসুম পাল
‘রাতের কাব্য’  কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

জীবত্মা অতৃপ্ত হলে প্রেতাত্মা হয়,
তৃপ্ত হলে মহাত্মা হতে পারে |
প্রাণদাহী ইন্দ্রিয় করোটি খুঁড়ে সহস্রার খায়,
ইন্দ্রিয়সুখে জ্বালাময় হৃদয় অসুখে অসুখে অসহায় |
ব্রহ্মচর্য্য পালন কর অথবা ক্লীবত্ব নাও ইন্দ্রিয়,
স্বর্গের ইন্দ্র নয়, নির্বাসনায় আমি পরমাত্মা হবো |
আমি পরমাত্মা --- অভিঘাতে প্রান্তিক অধঃ পতন,
আজ নিঃসঙ্গ, অযাচক, শুভাশুভত্যাগী, অষ্টাঙ্গ তপস্যারত,
সিদ্ধি-অব্যক্ত, অজ, অক্ষর, ব্রহ্ম সর্বব্যাপী সদানন্দময় |
প্রেম – আসক্তি নয়,  খেলা নয়,  লীলা –  নিখাদ প্রেম জয়,
সর্বত্মার সাথে অদ্বৈত সত্তা পরমাত্মা একাত্ম হয়,
আরতি কৃষ্ণরতি, রতি কৃষ্ণারতি – মধুর মৃত্যু উপত্যকায় |

.     ****************    
.                                                                                              
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
*
জীবন্মৃত
কবি কৃষ্ণকুসুম পাল
‘রাতের কাব্য’  কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

কেউ ভালো নেই,
সুনীলকে পেয়েও নীরা ভালো নেই,
বনলতাকে পেয়ে জীবনানন্দ শুধু দুদন্ড ভালো থাকে,
আমাকে পেয়ে সুতপা কি ভালো থাকে ?

কেউ ভালো থকে না চিরদিন
দুঃসময় দরজায় কড়া নাড়ে প্রতিমুহূর্তে,
শ্রবণ শ্রান্ত হয়, ভ্রমণ ব্যর্থ হয়,
শ্রমণ মন জ্ঞানভিক্ষু করে বসি কোন বটতলে,
নির্জনে, নিশ্চল, নির্বাক হয়ে নিরাকার সাধনায় মগ্ন থাকি,
সকলে ভালো থাকুক প্রার্থনা করি |

চিতার আগুনে সব সুখ, দুঃখ, জ্বালা যন্ত্রণা ভষ্ম হয়ে যায়,
মৃতদের হাসি নেই, কান্না নেই,  ক্ষিধে , লোভ, হিংসা নেই,
সাকার সীমানা ভেঙ্গে, জগৎ শূন্য করে –
ওরা কেবল এক অনাবিল ভালবাসা বিলায় |
আমি জ্ঞানভিক্ষু, জিতেন্দ্রিয়, নিস্পৃহ, নিশ্চল, নির্বাক,
আমি জীবন্মৃত , আমার ভালো থাকা চাই |

.     ****************    
.                                                                                              
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
*
মালালা
কবি কৃষ্ণকুসুম পাল
‘রাতের কাব্য’  কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

মালালা এপথে চড়াই উত্ড়াই ভেঙ্গে পাঠশালায় যায়,
পাঠশালা স্বর্গ যেন, কত অজানা জানায়, শেখায় |
পাঠশালায় নাচ, গান, খেলাধূলা, সকলে গল্পে মাতে,
কেমন চেনা, জানা, হৃদ্যতা, ভালবাসা সবার সাথে,
পাখীর মতো মুক্ত ডানা মেলে চলে মালালা |

তালেবান মালালার প্রাণ চায়, জারি করে ফরমান,
এই পুচকি মেয়ে পড়াশুনা ছেড়ে গৃহবন্দী থাকিস্ ,
বেশী বকিস্ না মেয়ে জেদ্ ছাড় বজ্জাত বাঁদী,
পড়াশোনার এতো শখ ! জল্লাদ হয়ে জাহান্নামে পাঠাবো,
শুকরী, মাংস তোর শেয়ালের মতো কামড়ে কামড়ে খাবো |

মালালার মনে সূর্য স্বপ্ন, নিষেধ শোনেনা মানা,
মালালা ভাবে, যা হবার হবে, জগৎটাকে কেন জানবো না,
চুপকথায় কে
বিষণ্ণ হবে জীবন , মেয়েরা চলো মন দিয়ে পড়ি,
মানিনা তালেবান, চোখ খুলবো, গেয়ে যাবো জীবনের জয়গান
প্রাণতো আসে যায়, আলো অন্ধকার দূর করে, ঘরে ঘরে |

তালেবান চিত্কার করে হারামজাদী  -- মালালা,  মালালা |
পাহাড়ের – চূড়ায় চূড়ায় প্রতিধ্বনি  -- মালালা,   মালালা  |

.     ****************    
.                                                                                              
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
*
অমর একুশ
কবি কৃষ্ণকুসুম পাল
‘রাতের কাব্য’  কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

একুশ, একুশ ওরে একুশ
অমর একুশ মোর কলিজায়,
বুকের আশা, ভালোবাসা,
মাতৃভাষা অমর কবিতায় |
একুশ তুমি চোখের মণি,
একুশ তুমি সোনার খনি ,
শিশুর মুখ, প্রিয়ার সুখ,
মায়ের মুখ, বুকের দুঃখ,
একুশ তুমি ভোরের পাখী,  বোনের রাখী,
একুশ তুমি রক্তনদী,  অশ্রু আঁখি,
একুশ তুমি অভ্যূথ্বান, জয়গান,
একুশ তুমি অগ্নিবীণা, নতুন প্রাণ,
একুশ তুমি রফিক সালাম, বরকত, জব্বার,
একুশ তুমি এপার, ওপার, বিশ্বে সবার” |
একুশ, একুশ, ওরে একুশ, অমর একুশ মোর কলিজায়,
তোকে আদর করে পুষব বলে,  কলম ধরেছি এই কবিতায় |

.     ****************    
.                                                                                              
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
*
সুচরিতা নেই
কবি কৃষ্ণকুসুম পাল
‘রাতের কাব্য’  কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

সুচরিতা সে, বাবার বড় আদরের মেয়ে,
মাতঙ্গিনী বিশ্ব বিদ্যালয়ের স্বর্ণপদক প্রাপ্ত কৃতী ছাত্রী |
জীবনের উচ্চতম সোপানে ওঠার জন্য অবিরাম তপস্যারত |
উচ্চশিক্ষিত মেয়েটি অনেক বড় স্বপ্ন নিয়ে বাঁচে |

সুচরিতা সেন, শ্যামলা মেয়ে, সুরেলা কন্ঠ তার |
যৌবনে সব যুবতীকেই সবার ভালো লাগে,
তাকে কতো কাজে যেতে হয়, ফাঁকা রাস্তায় একা ফিরতে হয়,
রাস্তার ধারে কিছু হায়না হা করে থাকে, সুচরিতা কুঁকড়ে মরে |

সুচরিতা বলে এখন আর কেউ নেই,
সুচরিতাকে কামড়ে খুবলে খেয়ে নিয়েছে হায়নারা,
বাবা মেয়ের শোকে অর্ধ উন্মাদ, মা, বোবা কথা বলে না আর,
স্বর্ণপদকে ঝুল পড়েছে, সকলে সুচরিতার গুণ গাইছে,
সঙ্গীতা, মিতারা আতঙ্কে বাঁচে, দুঃস্বপ্নে সুচরিতার কান্না শোনে,
সুচরিতা বলছে, বাঁচতে পারবি না, হায়নারা কাউকে রেহাই দেবে না |
এখন আর কোন সুচরিতা থাকবে না |

.     ****************    
.                                                                                              
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
*
ইচ্ছামৃত্যু
কবি কৃষ্ণকুসুম পাল
‘রাতের কাব্য’  কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

তোমরা যাকে আত্মহত্যা বলো, আমি তাকে ইচ্ছা মৃত্যু বলি,
ভীষ্ম যেমন মৃত্যুবরণ করে শরশয্যায় |
যে শরশয়্যায় থাকে, মৃত্যু তার সাথে গোপন সংলাপ করে,
মৃত্যু তাঁকে বাঁচতে বলে | সে বলে তুমিতো অনিবার্য,
তোমার জন্য প্রতীক্ষা কেন ? কেন বৃথা কাল হরণ ?
দেখ, আমি নির্বিকার সন্ন্যাসীর মতো দেহত্যাগের জন্য প্রস্তুত |

মৃত্যু পরাজিত, মৃত্যু ভাষাহীন, লোকটি যে আপোষহীন,
নাকে নিচ্ছে না সে গন্ধবহ, কানে শুনছে না ভূতভাষা,
মুখে তুলছেনা সে প্রসাদকণা, চোখে দেখছে না মর্ত্যলীলা,
অন্তরে নেই তার অর্থহীন ব্যর্থ ভাবনা, কামিনী, কাঞ্চন, কামনা,
দুর্দম মায়ার গলাটিপে, অন্ধনির্ভরতায় চায় না সময় যাপন,
আত্মাহুতি দিয়ে নীলান্তে উজ্জ্বল নক্ষত্র হবে, এ তার তর্পণ, প্রত্যাশা |

.     ****************    
.                                                                                              
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
*
কয়েদী রূশো
কবি কৃষ্ণকুসুম পাল
‘রাতের কাব্য’  কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

জেলার,
– রূশো, আপনি দার্শনিক,
জেলে যাবার জন্য আবেদন করলেন কেন ?

রূশো,
– পৃথিবীটা উন্মুক্ত কারাগার,
নকলে, আসলে মিলে মিশে একাকার,
কয়েদীরা মুক্ত, নম্বর শূন্য |
বিকৃতি কার নেই বলো ?
চতুর্দিকে লাগামহীন উন্মাদনা, আত্মপ্রবঞ্চনা,
আমি তাই, নকল কারাগারে থাকবো
যেখানে কয়েদীদের নম্বর আছে,
সঠিক মূল্যায়ন আছে |

আমি রোজ ঈশ্বরের কাছে চিঠি লিখি,
কিন্তু গীর্জার বেদী রেলিং দিয়ে ঘেরা,
কোন চিঠি যায় না ঈশ্বরের ঠিকানায়,
চিঠির উত্তর পেলে বুঝতে পারতাম—
ঈশ্বর কত বড় দার্শনিক,
ঈশ্বর কত বড় জেলার |

.     ****************    
.                                                                                              
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
*
অলীক বীক্ষণ
কবি কৃষ্ণকুসুম পাল
‘রাতের কাব্য’  কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

আমি দিবাস্বপ্ন দেখছি-
সব পশু মানুষ হয়ে হাঁটছে,
সব মানুষ ঈশ্বর হয়ে হাসছে
সমুদ্র শান্ত, অসংখ্য পদ্ম ফুটেছে বুক জুড়ে,
আকাশ নির্মল, অনন্ত নক্ষত্র নিমন্ত্রিত আমার ঘরে,
বাতাস শান্ত, আসেনা ঝড়, টাইফুন----
পৃথিবী শান্ত,  ঘুরছে না সে,  এখন তার অনন্ত অবসর,
আসেনা অমাবস্যা  প্রতিদিন সোনালী পূর্ণিমা,
বাক্ দত্তা বুকে বসে নীরবে প্রেম বিলায় |

পাপ বলে নেই কিছু,  পুন্যের প্রয়োজন নেই,
দানব বলে নেই কিছু,  দেবতার ভয় নেই,
ক্ষিধে বলে নেই কিছু ,  ঝুলির মোহ নেই,
দান বলে নেই কিছু,  দাসত্বের শৃঙ্খল নেই,
অলীক বলে নেই কিছু, স্বপ্নের যাদু নেই,
মিথ্যে বলে নেই কিছু, শাস্তির খাঁড়া নেই,
মরণ বলে নেই কিছু, শুধু জীবনের আয়োজন,
নরক বলে নেই কিছু,  চারিদিকে স্বর্গীয় সুষমা |
তোমার আমার প্রাণের আকুতি মিটবে না, মিটবে না |

.     ****************    
.                                                                                              
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
*
প্র্যাক্টিকেল প্রেম
কবি কৃষ্ণকুসুম পাল
‘রাতের কাব্য’  কাব্যগ্রন্থ থেকে নেওয়া

প্রেমের কবিতা পড়ার চেয়ে-
তোমার সাথে চুটিয়ে প্রেম করা ভালো,
একদম প্র্যাক্টিকেল প্রেম |

তোমাকে যেদিন পাবো না—
সেদিন দিস্তা দিস্তা প্রেমের কবিতা পড়বো,
বিরহে মরার চেয়ে প্রেমের কবিতা পড়া ভালো,
কবিতায় নীরা, বনলতা, সুতপা সকলেই তুমি,
কারণ সে কবিতায় তখন আমিই কবি |


তুমি বারো রাজ্যের বারোমাস্যা নিয়ে ফিরলে—
শুনবো সবার প্রেমের কাহিনী |
শোন, কেউ রণে ভঙ্গ দিলে আমার সহ্য হয়,
কিন্তু প্রেমে ভঙ্গ দিলে আমার সহ্য হয় না |
তুমি কি আমাকে কোনদিন ভুলতে পারো ?
এটা সত্য ‘অসম্ভব’ শব্দটি অভিধানে অবান্তর |
মনেরেখো,
প্রেম ভঙ্গ দিলে আকাশে চাঁদ, সূর্য ওঠেনা,
সাগর সুনামি তুলে পৃথিবী গ্রাস করে,
সপ্তস্বর্গ, সপ্ত পাতাল হয় শয়তানের কারখানা ,
প্রেমক্ষেত্র কুরুক্ষেত্রে আমি হব অকুতভয় অর্জুন |

.     ****************    
.                                                                                              
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর