কবি লক্ষ্মীমণি দেবীর কবিতা
*
বিদ্যাশিক্ষার্থ ভগিনীগণের প্রতি উপদেশ
কবি লক্ষ্মীমণি দেবী
কলিকাতা বামাবোধিনী সভা হতে প্রকাশিত, বামারচনাবলী, প্রথম ভাগ, ১১মাঘ ১২৭৮ (জানুয়ারী ১৮৭২)

ওগো সব কুলবতী.
হও সবে বিদ্যাবতি,
বিদ্যাহার যত্নে পর গলে।
বিদ্যা না থাকিলে পরে,
কেবা সমাদর করে,
অনাদরে প্রাণ যায় জ্বলে॥
পুরুষেতে মন্দ কয়,
মনে বড় লজ্জা হয়,
বলে সদা মূর্খ যত নারী।
কটিবাক্য কত সব,
হয়ে যেন আছি শব,
এ দুঃখ যে সহিতে না পারি॥
আছ যত ভগ্নিগণ,
সবে হয়ে একমন,
বিদ্যাধন উপার্জন কর।
পাইবে কতই সুখ,
উজ্জ্বল হইবে মুখ,
সুনির্মল থাকিবে অন্তর॥
স্বামা পুত্র বন্ধুগণ,
করিবে কত যতন,
রমণী রতন নাম হবে।
বিশ্বাস করিবে সবে,
অবিশ্বাস নাহি রবে,
লজ্জাহীনা আর নাহি কবে॥

. *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
প্রিয়বাক্য কি মধুর!
কবি লক্ষ্মীমণি দেবী
কলিকাতা বামাবোধিনী সভা হতে প্রকাশিত, বামারচনাবলী, প্রথম ভাগ, ১১মাঘ ১২৭৮ (জানুয়ারী ১৮৭২)

প্রিয় বাক্য কহে যেই তার কোথা পর।
প্রিয় হয়ে পর তার থাকে নিরন্তর॥
প্রিয় কথা কহিবে গো সদা সর্বক্ষণ।
প্রিয়বাক্যে প্রিয় হন জগতের জন॥
ধনী মানী জ্ঞানী যদি কটু কথা কয়।
অনুগত হয়ে তার কেহ নাহি রয়॥
দিবানিশি দগ্ধ হয় আপনার মন।
সকলের হন তিনি অপ্রীতি ভাজন॥
আপনার মন হয় মার্জিত দর্পণ।
যেমন দেখাবে ভাই দেখিবে তেমন॥
যদি কারো প্রিয় হতে ইচ্ছা থাকে মনে।
যত্ন করে প্রিয় বাক্য রাখিবে বদনে॥
দাস দাসী ভাই বন্ধু যত পরিজন।
সকলে কহিবে ভাই অমৃত বচন॥
কহিলে এপ্রিয় কথা ভাল থাকে মন।
প্রিয় বাক্যে হয় সদা মঙ্গল সাধন॥
প্রিয় বাক্য হতে প্রিয় কিবা আছে আর।
প্রিয় বাক্য হয় দেখ সংসারের সার॥

.
         *************************  

.                                                                                     
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
পরাধীনতা কি কষ্ট
কবি লক্ষ্মীমণি দেবী
কলিকাতা বামাবোধিনী সভা হতে প্রকাশিত, বামারচনাবলী, প্রথম ভাগ, ১১মাঘ ১২৭৮ (জানুয়ারী ১৮৭২)

পরাধীন যেই জন তার কোথা মান।
দিন দিন হয় তার কত অপমান॥
পরাধীন মনুষ্যের কিছু নাহি সুখ।
শয়নে ভোজনে তার সদাই অসুখ॥
আপনার মন নহে আপনার বশ।
কত কষ্টে রহে লোক হয়ে পরবশ॥
তোষামদ করে থাকা সহজাত নয়।
দিবা নিশি নয়নেতে বারিধারা বয়॥
পরের অধীনে রাখি আপন জীবন।
তথাপি না কোন কালে পায় তার মন॥
পরের রাখিতে মন চক্ষে বহে জল।
সুখসূর্য একেবারে যায় অস্তাচল॥
মন প্রাণ সচঞ্চল কখন কি হয়।
পদ্মপত্রবারি যথা স্থির নাহি রয়॥
পরাধীন নর নারী কারাবাসী মত।
সতত মলিন মুখ দুঃখ কব কত॥
প্রভুর বদন হেরে উড়ে যায় প্রাণ।
কি জানি কখন হয় দণ্ডের বিধান॥
কথায় কথায় বলে দূর হতে হবে।
আমার গৃহেতে আর কতকাল রবে॥
পরাধীন লোক নাহি নিজ কার্য পায়।
পরেতে গঞ্জনা করে ছুতায় লতায়॥
পরের যোগাতে মন ওষ্ঠাগত প্রাণ।
ওহে নাথ! পরাধীনে কর পরিত্রাণ॥

.        *************************  

.                                                                                     
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
হিংসা কি দুর্জয় রিপু
কবি লক্ষ্মীমণি দেবী
কলিকাতা বামাবোধিনী সভা হতে প্রকাশিত, বামারচনাবলী, প্রথম ভাগ, ১১মাঘ ১২৭৮ (জানুয়ারী ১৮৭২)


হিংস্রক মনুষ্য কভু নাহি পায় সুখ।
সাধুর করিতে নিন্দা চলকায় মুখ॥
ভদ্র কুচ্ছ করে সদা স্বচ্ছ নাহি মন।
ইচ্ছা মত তুচ্ছ কর্মে যত্ন অনুক্ষণ॥
মিষ্ট বাক্যে রুষ্ট হয় রুষ্টে শিষ্ট রয়।
শিষ্ট প্রতি অত্যাচার দুষ্ট প্রতি ভয়॥
বিজ্ঞকে অবজ্ঞা করে অজ্ঞে বিজ্ঞ জানে!
অযোগ্য জনেরে সদা যোগ্য বলে মানে॥
পর গুপ্ত-দোষ ব্যক্ত করিবারে ফেরে।
দোষ না থাকয়ে যদি রবে ঘোরে ফেরে॥
দানী মানী হইলেও না পায় নিস্তার।
হায়রো হিংস্রক তোর গুণ চমত্কার॥
পর সুখে দুঃখ পায় পর দুখে সুখ।
পণ্ডিতে প্রশংসা দিতে হয় পরাঙ্মুখ॥
আপনি আপন শ্লাঘা পুনঃ পুনঃ করে।
সেই ধনী জ্ঞানী মানী ধরণী ভিতরে॥
সকলের হতে বড় মানে আপনারে।
অন্যের অসাধ্য কর্ম সে করিতে পারে॥
কথায় কথায় বলে “তারা কিবা জানে।
কি গুণে তাদের লোক এমত বাখানে”॥
সুখ্যাতি শুনিলে মনে উঠে হিংসানল।
দহে মন দিবা  নিশি না হয় শীতল॥
ওহে বিশ্বনাথ ওহে বিশ্বের আধার।
অসংখ্য প্রণতি নাথ চরণে তোমার॥
পুনঃ পুনঃ কহি প্রভু এই দুঃখ হর।
হিংস্রক হইতে ধরাতল মুক্ত কর॥

.        *************************  

.                                                                                     
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
বিদেশ ভ্রমণ
কবি লক্ষ্মীমণি দেবী
কলিকাতা বামাবোধিনী সভা হতে প্রকাশিত, বামারচনাবলী, প্রথম ভাগ, ১১মাঘ ১২৭৮ (জানুয়ারী ১৮৭২)

মাঘের প্রথম ভাগে আনন্দিত চিতে,
বাষ্প রথে চলিলাম বিদেশ ভ্রমিতে॥
কত দেশ কত নদী এড়াইয়া যাই,
এবশেষে সোমভদ্রে দেখিবারে পাই॥
দেখিয়া তাহার রূপ ভয়ে উড়ে প্রাণ,
ক্রমে ক্রমে দিনমান হলো অবসান॥
সন্ধ্যার পরেতে যাই মঙ্গল সরাই,
এত লোক এক স্থানে কভু দেখি নাই॥
আট ঘন্টা রাত্রি যবে, প্রবেশিনু কাশী,
জয় জয় করিতেছে যত কাশী বাসী॥
জিউক কল্যাণে পুরী হলো আলোময়,
বম্ ভোলা বম্ ভোলা সকলেতে কয়॥
কাশীর ভিতরে দেখি গলি অতিশয়,
শঙ্খ ঘন্টা বাজিতেছে যত দেবালয়॥
পচা গন্ধে বমি ওঠে নাহি থাকে নাড়ি,
ঘেসাঘেসি কত শত পাষাণের বাড়ী॥
একে কাশী তাহে যোগ লাগিল গ্রহণ,
লোকের গোলেতে নাহি স্থির হয় মন॥
ছয় দি থেকে মাত্র কাশীত্যাগ করি,
এলাহাবাদেতে যাই জগদীশ, স্মরি॥
ধন্য বলি সাহেবের অপরূপ লালে,
যমুনার সেতু ভাই কি করে বাঁধিলে॥
গাড়ি গেলে পরে যেন ভূমিকম্প হয়,
কার সাধ্য নিম্ন ভাগে এক-দৃষ্টে রয়॥
সেখানেতে কুম্ভযোগ লোক সেইরূপ,
অশ্ব করি চড়ি কত আসিতেছে ভূপ॥
কোথা বা বড়বাজার কোথা কালীঘাট,
থরে থরে কত দ্রব্যে শোভে বেণীঘাট॥
আমার সঙ্গিণীগণ বেীঘাটে যায়,
একে একে সকলেতে মস্তক মুড়ায়॥
নাপিতে ধরিয়ে কেশ মাথে দেয় ক্ষুর,
পৈরাগী দাঁড়াল কাছে সাক্ষাৎ অসুর॥
দেখিয়া ঘৃণিত কাজ অঙ্গ গেল জ্বলে,
আমাকে সকলে মাথা মুড়াইতে বলে॥
অনুরোধ নাহি রাখি না কহি বচন,
বিরস বদনে করি বাসায় গমন॥
কহিলাম তিল অর্দ্ধ এখানে না রব,
রজনী প্রভাতে সবে আগরাতে যাব॥
সেই মতে মত দেন যত সঙ্গীগণ,
পর দিন সন্ধ্যাকালে করিয়া গমন,
দেখিলাম মন্দ নহে আগরা নগর,
তাজ বিবি মসজিদ অতি মনোহর॥
ফওরাতে জল উঠে পড়ে ঝর ঝর,
বাগ বাটি পরিষ্কার দেখিতে সুন্দর॥
নীলাম্বরী পরিয়াছে যমুনা সুন্দরী,
কত মত হাব ভাব আহা! মরি মরি॥
বাগানের শোভা দেখে হরষিত প্রাণ,
বাটিঘর যত কিছু মার্বেল পাষাণ॥
সেই খানে ডাকি প্রভু কোথা দয়াময়,
হিন্দুস্থানি দেশে নাথ হয়েছ সদয়॥
পঞ্চদিন আগরাতে করিলাম বাস।
মথুরা যাইতে মন হইল উদাস॥
পর দিন বৈকালেতে মথুরায় যাই।
দেব দেবী হাট ঘাট দেখিবারে পাই॥
উত্তম সহর বটে মধুপুরী গ্রাম।
গাছে গাছে বসে আছে কত শালগ্রাম॥
কমিসারি কর্মচারী নাম *** নাথ।
দয়া করেছেন তাঁরে অখিলের নাথ॥
তাঁহার বাসায় থাকি করেন আদর।
যতিন করিলেন কত যেন সহোদর॥
সপ্তদিন থাকি পরে বৃন্দাবন যাই।
দেখি ব্রজবাসী যত দয়া মাত্র নাই॥
কিন্তি বটে বৃন্দাবন অতি রম্য স্থান।
নয়ন জুড়ায় দেখে সেটের বাগান॥
সেট, সাহা, লালা বাবু, গোয়ালিয়া ভূপ।
দেবালয় করিছেন অতি অপরূপ॥
নিধুবন কঞ্জবন হেরে মন হরে।
নদীতে কচ্ছপ গাছ সজ্জিত বানরে॥
রাধাকুণ্ড শ্যামকুণ্ড গিরিগোবর্ধন।
বিরাজিত রাধাকৃষ্ণ মদনমোহন॥
গোকুল দেখিয়া প্রাণ হইল আকুল।
মহাবনে গেলে পরে নাহি থাকে কুল॥
মহাবনবাসী ধরে টানাটানি করে।
অর্থ নাহি পেলে তারা জোরে গিয়া ধরে॥
এমন তীর্থেতে বল শ্রদ্ধা কার হয় ?
সেই খানে ডাকি প্রভু কোথা দয়াময়॥
নন্দ যশোদার কীর্তি দেখিলাম কত।
পাছু করে চলিলাম হইয়া বিরত॥
ক্রমে ক্রমে আসিলাম যথা কানপুর।
দেখিলাম খাদ্য দ্রব্য তথায় প্রচুর॥
উত্তম সহর বটে থাকিবার স্থান।
ফেরিওয়ালা ফিরিতেছে করি ‘পান পান’॥
ইটুয়া টুণ্ডুয়া আর যতগুলি গ্রাম।
এক্ষণেতে মনে নাই প্রত্যেকের নাম॥
কত শত গাছ পালা আছে সারি সারি।
কেবল মনুষ্য ভাষা বুঝিতে না পারি॥
থাকিতে বাসনা হয় পশ্চিম প্রদেশে।
হাট ঘাট মাঠ গুলি যেন আছে হেসে॥
চণ্ডাল গড়েতে পরে সকলেতে যাই।
দেখিয়া গড়ের শোভা নয়ন জুড়াই॥
আহা মরি গঙ্গাজল কিবা পরিষ্কার।
কেল্লা যেন পরিয়াছে রত্নময় হার॥
নাচ গান দেখিলাম দেখি যত গ্রাম।
পরিশ্রমে মানুষের নাহিক বিরাম॥
পরিশেষে সঙ্গী সবে গয়া তীর্থে যায়।
পিণ্ড দিবে মনে করে গদাধর পায়॥
সঙ্গে সঙ্গে চলিলাম তুষ্ট নহে মন।
সদা হৃদে ভাবিতেছি পতিত পাবন॥
গোয়ালিরে পূজা কর বলে সঙ্গীগণ।
কহিলাম নাহি পূজি মনুষ্য চরণ॥
দিবানিশি ভাবিতেছি সত্য সনাতন।
আশীর্বাদ কর পাই সেই নিরঞ্জন॥
এ কথা শুনিয়া সবে কানে দিল হাত।
বলে তুমি হও গিয়া ত্বরায় নিপাত॥
      *****************************  
দেশে দেখি প্রতিবাদী প্রতিবাসীগণ।
চুল আছে মাথে বলে কথা নাহি কন॥
নিরুপায় হয়ে ডাকি কোথা দয়াময়।
সকলে ত্যজিল ত্যজনাকো এসময়॥

.        *************************  

.                                                                                     
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর