কবি লীলাবতী দেবীর কবিতা
*
স্মৃতি
কবি লীলাবতী দেবী

কবে কোন্ অতৃপ্ত চুম্বনে                                জীবনের প্রথম মিলনে
অনিদ্রায় কেটেছে যামিনী ?
লুকানো সে প্রাণের বাসনা,                        বাহিরিতে করি আনাগোনা
সরমেতে ফুটেও ফুটেনি ;
প্রথম প্রণয় পুষ্পরাশি                                 সবেমাত্র উঠিল বিকাশি
প্রাণে জাগে কত সুখ সাধ,
কেঁপেছিল পুলকে হৃদয়,                       এত কি গো তারে বলা যায় ?
লজ্জা আসি সাধিল রে বাদ।
নয়নেতে ছিল ঘুম ঘোর,                              সুখনিশা হয়-হয় ভোর,
বলি-বলি বলাত’ হল’না!
পূর্বদিকে অরুণ কিরণ                                  জানাইল ঊষা আগমন,
নিশি গেল’ আর ত’ এল’না!
দোয়েল গাহিল মধুস্বরে                                “জাগ-জাগ নববধু ওরে”!
সলাজেতে শিরে দিনু বাস,
কত রাতি গেল, পুন এলো,                          কিন্তু হায় আর কি মিটিল
সেদিনের সেই পিয়াস!
আজি সব দিলে কি গো মম,                        ফিরে পাবো সেদিনের সম
মিলনের মধুর রজনী,
তাই আজ জাগিছে স্মরণে,                        কোথা দিয়ে কাটিল কেমনে
ফুলশয্যা স্বপন-কাহিনী!

.      *************************       
.                                                                                             
সূচিতে . . .      



মিলনসাগর       
*
মৃগয়া
কবি লীলাবতী দেবী
ভারতী পত্রিকা, অগ্রহায়ণ ১৩১৬ সংখ্যা (নভেম্বর ১৯০৯) থেকে নেওয়া।

স্তব্ধ দ্বিপ্রহর। পথ ধূলিধূসরিত ;
প্রান্তে তায় ক্ষুদ্র এক জীর্ণ পর্ণ গেহ।
অদূরে বিশীর্ণা নদী, ক্ষীণ রেখা তায়
গ্রাম প্রান্তে বক্রগতি রেখেছে আঁকিয়া।
তীর দেশে বসে আছে চক্রবাক্ একা,
হৃদে লয়ে মৌনসুখ আকুল আকাঙ্ক্ষা
আশাপথ চেয়ে কার? ক্ষুদ্র আঁখি কোণে
প্রস্ফুরিত জ্যোতি রেখা স্থির অচঞ্চল।
এখনি আসিবে বুঝি চক্রবাকি তার?
পরিপূর্ণ আশা, আর আনন্দ হিল্লোল
ক্ষুদ্র বিহঙ্গম হৃদে করিয়া ধারণ
ধ্যানমগ্ন যোগী যেন মহা তপস্যায়!
ডুবে গেল দ্বিপ্রহর সায়াহ্ন ছটায় ;
বাহিরি কুটীর হতে, আগ্নেয়াস্ত্র হাতে
ধীরে ধীরে অতি ধীরে যুবা একজন
দাঁড়াইল বৃক্ষতলে সতৃষ্ণ নয়নে।
দেখিলনা জানিলনা --- বিহগ নির্ভয়।
আকাশে উঠিল শব্দ এ হেন সময়ে
শন্ শন্ শন্ ; উর্দ্ধে চাহে গ্রীবা তুলি।
ওই আসে প্রিয়া বুঝি। ক্ষুদ্র পক্ষ দুটী
বিস্তারিয়া মহাশুন্যে ; পুলক চঞ্চল
নৃত্যপরা অপ্সরার মুখর নুপুর
@@@ মধুরে যেন মিলায় আবার।
পুলকিত চক্রবাক ঈশৎ কাঁপায়ে তার
@@ ছোট ডানাদুটী বায়ু সঞ্চালনে---
পুনঃ স্থির ধীর ভাবে বসিল তখনি।
মিলন আকুল হিয়া তৃষিত অধর
নির্ব্বাক্ নয়নে যেন কহিছে কাতরে
“তৃপ্ত মোর সর্ব্ব সাধ পূর্ণ এতদিনে
আয় তুই হৃদিমাঝে বাঞ্ছিত আমার
স্বল্প স্থায়ী এ জীবন হউক সার্থক।
এখনি আসিবে সন্ধ্যা দৃষ্টিহীন আঁখি
চলে যাব দুইজনে দুই পরপারে
সীমাহীন বিরহের দূর ব্যবধানে ;
গাহিব আকুল কণ্ঠে উন্মত্ত সঙ্গীত
তৃপ্তিহীন শ্রান্তিহান বসি সারা নিশি।”
নামে চক্রবাকী ধীরে, বাড়াইয়ে গ্রীবা
সম্মিলন ব্যগ্র হৃদি, ক্ষুদ্র পদভার
ধরণীতে রাখিবার বিলম্ব না সয়।
কঠোর চঞ্চুর স্পর্শে চকিত চুম্বনে
মিলাল অধর দ্বয় উর্দ্ধে দেহভার।
গুড়ুম গুড়ুম গুম্ গর্জ্জিল অদূরে
অশনির জ্বালাসম ধাঁধিল নয়ন।
বিদ্ধ-কণ্ঠ বিহঙ্গম ধূলায় পড়িল
ঝরিল শোণিত ধারা দুনয়ন বেয়ে।
ভয়ত্রস্তা চক্রবাকী চকিতে উড়িল
ক্ষণপরে সংজ্ঞা পেয়ে আসিল নামিয়া,
সেইমত ঠোঁটে ঠোঁটে অঙ্গে অঙ্গ রাখি
সৈকত শ্মশানে শুয়ে দৃঢ় আলিঙ্গনে
চাহিল কাতর দৃষ্টি উদার গগনে,
বিন্দুমাত্র তপ্তজল নয়নের কোণে।

.      *************************       
.                                                                             
সূচিতে . . .      



মিলনসাগর