ঝড়
কবি মৈত্রেয়ী দেবী
নমিতা চৌধুরী ও অনিন্দিতা বসু সান্যাল সম্পাদিত, মহিলা কবিদের বাংলা কবিতা
সংকলন দামিনী ১৪০০ - ২০০০ থেকে নেওয়া।
ওমা, সেদিন হাটের ধারে, মাঠের ধারে---
. করতে গেছি খেলা
. ---দুপুরবেলা,
এমন সময়, এলোমেলো
কোথা থেকে বাতাস এলো!
. হঠাৎ থেকে থেকে
অন্ধকারে সমস্ত দিন কেমন দিল ঢেকে!
. বল্লে ওরা, ছুটে পালাই ঘর
. ওই এসেছে ঝড়।
আমার যেন লাগল ভারী ভালো,---
চেয়ে দেখি আকাশখানা এক্কেবারে কালো।
. কালো হ’ল বকুললতা,
. কালো চাঁপার বন,
. কালো জলে দিয়ে পাড়ি
. আসলো মাঝি তাড়াতাড়ি,
. কেমন জানি করল আমার মন।
. ---ঝড় কারে মা কয় ?
. আমার মনে হয়,---
. কাদের যেন ছেলে,
কালির দোয়াত কেমন করে’ হঠাৎ দিল ফেলে,
. যেমন করে’ কালি---
. আমি তোমার মেঝের উপর ঢালি।
. হাসল কোমল ঠোঁটটি মেলে
. ভীষণ কেমন আগুন জ্বেলে
. আকাশ বারে বারে,
. আবার বুঝি ঘুরে ঘুরে
. পালিয়ে গেল অনের দূরে
. সাত সাগরের পারে।
. *****************
. সূচীতে . . .
মিলনসাগর
অন্তর
কবি মৈত্রেয়ী দেবী
নমিতা চৌধুরী ও অনিন্দিতা বসু সান্যাল সম্পাদিত, মহিলা কবিদের বাংলা কবিতা
সংকলন দামিনী ১৪০০ - ২০০০ থেকে নেওয়া।
এত যে মধুর রসে ভরে গন্ধে গানে,
তবু কি যে রয়ে যায় এর কোনখানে
নিজেরে আঢ়াল করি লুকাইয়া রাখি
কি যেন গোপন থাকে কিছু থাকে বাকি
এত যে মাধুর্য আছে এত গন্ধ গান
এত যে বিছান আছে মোহময় প্রাণ
এত যে রূপের খেলা হয়ে রূপময়
এত যে রঙিন হয় সব আবরণ
সবটুকু বহিরের ভুলাতে নয়ন।
. *****************
. সূচীতে . . .
মিলনসাগর
শুভলগ্ন
কবি মৈত্রেয়ী দেবী
উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত বিচিত্রা পত্রিকার ফাল্গুন ১৩৩৮ (ফেব্রুয়ারী ১৯৩২)
সংখ্যা থেকে নেওয়া।
শুভ দিনে ভক্ত যত গেল দেবালয়ে
নত নেত্রে মুগ্ধ হাতে অর্ঘ্য থালা লয়ে,
বিকশিত পুষ্পদলে দিল অবিরাম
অসংখ্য অঞ্জলি আর অসংখ্য প্রণাম।
অনন্ত এ নিখিলের কাল অগণন
একটি মুহূর্ত্ত আসে পরম শোভন।
শুষ্ক বৃক্ষশাখা হতে ঝরে পুষ্পরাজি
দিকে দিকে সে মুহূর্ত্তে শঙ্খ ওঠে বাজি ;
ত্রিলোকের মর্ম্মে মর্ম্মে বাজে ধ্বনি তার,
অনন্ত আকাশ হতে কলস সুধার
ঝরে নিখিলের পাত্রে। তারি মধুরিমা
উদয় আলোতে আনে অপার মহিমা।
শেষের রেশ
কবি মৈত্রেয়ী দেবী
উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত বিচিত্রা পত্রিকার কার্তিক ১৩৩৫ (নভেম্বর ১৯২৮)
সংখ্যা থেকে নেওয়া।
কোনখানেতে শেষ আমার, কোনখানেতে শেষ!
কোন খানেতে থামে আমার দুঃখ সুখের লেশ।
ভরা স্রোতের মাঝখানেতে কোথায় পাব পার ;
অসীম মাঝে সীমা কোথায় অচিন পারাবার।
বর্ষার আয়োজন
কবি মৈত্রেয়ী দেবী
উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত বিচিত্রা পত্রিকার ভাদ্র ১৩৩৫ (সেপ্টেম্বর ১৯২৮) সংখ্যা
থেকে নেওয়া।
থেকে থেকে চমকি যায় মন,
বর্ষা নাই রয়েচে আয়োজন।
আকাশ ছেয়ে আছে গভীর কালো মেঘে
যেন সে চেয়ে আছে স্বপ্ন মাঝে জেগে!
সকলি হেরি ম্লান চক্ষু আসে ভরে,
চাতক উঠে ডাকি, বক্ষ হাহা করে!
দুয়ার খুলে রেখে বসিনু তারি পাশে,
ওধারে ঢেকে গেছে সবুজ ঘন ঘাসে ;
একটি পাশে জমি এসেছে নীচু নেমে,
সকাল হতে জল রয়েছে থেমে থেমে।
আকাশ কালো হল গভীর ব্যথা লয়ে,
তাহারি ছায়া জলে পড়িল কালো হয়ে।
মুক্তি অন্বেষণ
কবি মৈত্রেয়ী দেবী
উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত বিচিত্রা পত্রিকার শ্রাবণ ১৩৩৬ (অগাস্ট ১৯২৯) সংখ্যা
থেকে নেওয়া।
. (বিশ্বযোগে)
গৃহছাড়া দক্ষিণের উত্তাল হাওয়াতে
চ্যুত শাখা উত্তোলিত শাল বন মাতে,
গন্ধে ভরি চৈত্র সন্ধ্যো আসে স্নিগ্ধ হ’য়ে
বনে বনান্তরে তারি স্পর্শ যায় ব’য়ে।
জলের কল্লোলে জাগে তরুশ্রেণী মাঝে
সাড়া লাগে বাঁশ বনে প্রতিধ্বনি বাজে,
সন্ধ্যামণি অক্ষি মেলে পক্ষী কলরোলে
ক্ষণে ক্ষণে যুথীকারে মত্ত করে তোলে।
অস্তের অন্তিম আলো অপূর্ব্ব মায়ায়
অর্ঘ্য
কবি মৈত্রেয়ী দেবী
উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত বিচিত্রা পত্রিকার আশ্বিন ১৩৩৬ (অক্টোবর ১৯২৯)
সংখ্যা থেকে নেওয়া।
আমার বাণী ছড়িয়েছিল ধূলোয় ধূলোময়
তোমার দ্বারে আজকে তাহার ঘটুক পরিচয়॥
সেদিন আলোর রক্তমাখা নাম্ ল বনচ্ছায়ে,
ভাসিয়ে দিয়েছিলেম তরী গন্ধে ভোলা বায়ে।
দুই ধারেতে তীর দেখা যায় বাব্ লা গাছের সারি,
যাত্রা
কবি মৈত্রেয়ী দেবী
উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত বিচিত্রা পত্রিকার পৌষ ১৩৩৬ (জানুয়ারী ১৯৩০)
সংখ্যা থেকে নেওয়া।
তখন সন্ধ্যার আলো স্নিগ্ধ মোহচ্ছটা
দিয়েছিল ছড়াইয়া, কবে নব ঘটা,
মত্ত হয়ে বসেছিল দক্ষিণের বায়
দিকে দিকে দোলা দিয়ে বনের শাখায়।
প্রত্যেক মুহূর্ত্ত আমি বুঝিনু সে দিন
আসে যায় নিত্য হয়ে অনন্ত নবীন।
আমি সেই নূতনের নূতন খেলায়
নিরুদ্দেশ
কবি মৈত্রেয়ী দেবী
উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত বিচিত্রা পত্রিকার জ্যৈষ্ঠ ১৩৩৮ (জুন ১৯৩১) সংখ্যা
থেকে নেওয়া।
আজও যাহা অসমাপ্ত
. আজও যার হয় নাই শেষ,
আজও যার জীবনেতে
. পাই নাই কিছুই উদ্দেশ ;
প্রভাতের সূর্য্যালোতে মাঝে মাঝে যাহার পরশ
লভিয়াছি চিত্ত তলে অমৃত সরস---
. মুগ্ধ এই হিয়া
সে সুধা সুগন্ধ লভি ওঠে উচ্ছলিয়া
উন্মুক্ত আকাশতলে হৃদয়ের কোণে ;
যাহার অতৃপ্ত ছোঁয়া লেগে ক্ষণে ক্ষণে
. কেঁদেছে আকুল চিত্ত
. নিত্য নিত্য,
. সে অনিত্য মধুর দোলায়
দুলায়ে দুলায়ে মোরে বাঁধন খোলায়
উত্ল শ্রাবণ রাতে স্নিগ্ধ মধুমাসে ;
যার তীব্র স্পর্শখানি চিত্তে ভেসে আসে
উছল উথল রস বেদনা-বিধুর
তবু নাহি ধরা যায় তবু সে সুদূর---
অশেষ সে রসধারা অসংখ্য সে মায়া
কভু আলো মনে হয় কভু যেন ছায়া,
তবু এই হৃদিশতদলে
. খুলিল যে-কটি পাতা
আজি তার পরশ কোমলে
. সে কয়টি দল
কখনো শুকাতে চায়
. কখনো বা সুগন্ধ-উতল।
কভু তৃপ্ত মধ্যাহ্নেতে সূর্য্যালোকময়
অস্পষ্ট হৃদয়ে তারে মিথ্যা মনে হয়---।
আজও এই জ্যোত্স্না-রাতে
. সে বিভোল আনে গন্ধখানি
একি সত্য? একি মিথ্যা?
. কিছু নাহি জানি।
একি মুগ্ধ অগ্নি-শিখ,
. একি দীপ্ত হেম?
নিরুদ্ধ হৃদয়-দ্বারে
. একি মোর প্রেম?
মধুময় মরীচিকা আনন্দে অশেষ
মুক্ত অন্তরীক্ষতলে হ’ল নিরুদ্দেশ।
আজি এই জ্যোত্স্নারাতে সেই স্বপ্নখানি
চক্ষুতে দেখিতে চাই সম্মুখেতে আনি ;
কিছু তার অর্থ নাই, কিছু তার নাহিক নিয়ম,
সে যে আলোছায়াময়
. সে যে স্বপ্নসম,
কখনো সুতীব্র, কভু মধুর সরস,
আলোড়িত হৃদিতলে সে মৃদু পরশ
বাহিরে আনিতে চাই
. নিখিলের নিত্য সুষমায়।
. আপনারে ধন্য হণি
. যতটুকু শুনি ধ্বনি
. ধ্বনিত করিতে যাই---
. দক্ষিণের মর্ম্মরিত বায়।
. *****************
. সূচীতে . . .
মিলনসাগর