কবি মন্দাক্রান্তা সেনের কবিতা
*
দেবীজন্ম
কবি মন্দাক্রান্তা সেন

যে ছেলেটি আমার মনের মতো নয়
সে যদি আমার বুকে মাথা রাখে, বুক খসে যাবে ?

ভেবেছি অনেক বার, তবু, সে যখন কাছে আসে,
পাগলের মতো শুধু ছুঁতে চায় মুহুর্তের প্রেমে,
আমারও কেমন লাগে।
আমি জানি। এইসব কষ্ট জানি। ছোঁওয়া জানি।
.        ছুঁতে চেয়ে থেঁৎলে যাওয়া জানি।
যখন ইষৎ দূরে বসে থাকে আমার মনের মতো ছেলে,
আমি তো এমনই করি,
.        মাথা খুঁড়ি পাথরে, শরীরে!
সে কবে আদর করবে, শুরু হবে মানুষ জন্মের

ততদিন---প্রেম নয়, আমি কোনও করুণার দেবী . . .

.                 *************************  

.                                                                                       
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
সতী
কবি মন্দাক্রান্তা সেন

ধ্যাবড়া সিঁদুর, মৃত গাঁদাফুল, করোটির মতো বাসি নারকেল---
এই উপচারে বর্ষা নামে না। বর্ষা আসলে সতীমা’র খেল।

সতীর শোণিতে অথবা যোনিতে আঁকা ছিল এক আদিম চিহ্ন,
জীবনে মরণে পতিব্রতা যে, ভগবতী আর সে তো অভিন্ন!

ভগবতী, তার ক’হাত জানি না। প্রতি আস্তিনে লুকোন
.                                        ম্যাজিক।
তাঁরই করুণায় আজও এ দেশ নৈতকিভাবে ঐতিহাসিক।

এক সীমান্তে দাঙ্গা আর অন্যপ্রান্তে বিবাহোত্সব,
একদিকে পোড়ে ভ্রূণ, বিপরীতে জলে ভেসে যায় সোমত্ত শব।

আধখানা দেশ ফেটে চৌচির মাইল মাইল অবাধ খরায়,
বৃষ্টিপাতের কামনায় ওরা সতীমন্দিরে সিঁদুর চড়ায়!

বাকি অর্ধেক ডোবাল তখন পারাপারহীন অথৈ বন্যা,
সেখানে কি তবে চিতার বদলে জলে ঝাঁপ দেবে দৈবী কন্যা ?

কপালে সিঁদুর। বুকে মৃত ফুল। করোটিভর্তি অলীক পাথর---
ঈশ্বরী, তুই বাঁচিয়ে রাখিস বেঁচে উঠবার আকাঙ্খা তোর . . .

.                 *************************  

.                                                                                       
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
সুইসাইড পয়েন্ট
কবি মন্দাক্রান্তা সেন

শুকনো পাতায় পায়ের শব্দ শুনে
হঠাৎ চমকে পিছনে তাকিয়ে দেখি
বিকেল কেমন স’রে গেল দ্রুতপায়ে
খাদের কিনারে ঝুঁকে প’ড়ে দেখি---ওই . . .
নীচে বহু নীচে গড়িয়ে যাচ্ছে আলো

ঝরা পাতারাও কুয়াশায় ভিজে গেছে

সন্ধে নামছে দীর্ঘশ্বাসের মতো

.      *************************  

.                                                                                       
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
তুমি কি সাঁতার জানো ?
কবি মন্দাক্রান্তা সেন

জিনস্ পরা ছেড়ে দিতে পারি
তুমি যদি বল ; অন্য নারী
হয়ে যাব অতি অনায়াসে
যে মেয়ে তোমাকে ভালবাসে
তার ছোট চুল, বিনাতেলে
( তুমি যেন কাকে বলেছিলে )
সে কখনও হতেই পারে না!
বেশ, হব নিজের অচেনা
কাল থেকে, তুমি বলো যদি
তোমার পায়ের কাছে নদী
খুলে রাখবে নীল ধনেখালি।
আমার সমস্ত পুরুষালি
মুদ্রাদোষ ওড়াব হাওয়ায়।
জিনস্ পরা ছেড়ে দেওয়া যায়
সহজেই ; নদী হতে পেলে . . .

সাঁতার জানো তো তুমি, ছেলে ?

.      *************************  

.                                                                                       
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
বৃষ্টিদিন
কবি মন্দাক্রান্তা সেন

দ্যাখো আজ অনেকদিন পর এমন মেঘ করল,
হাওয়া দিল পাগল পাগল, মাটির ভেতর থেকে
ঝাঁপিয়ে বেরিয়ে এল অদ্ভুত সোঁদা গন্ধটা,

তাও কেন তোমার মনে পড়ল না গো, আমার কথা ?
এই যে বৃষ্টি নামল, ওই যে পশ্চিমের মাঠ উঠল
ধোঁয়া হয়ে জলেক ঝাপটায়, আকাশ কাঁপিয়ে দিল বাজ

তুমি বুঝি এখনও বুঝলে না, এ আয়োজন কীসের জন্যে ?

দ্যাখো বৃষ্টি বেড়েই চলেছে। বান ডাকবে, বান ডাকবে,
সোনা! আমিও যদি আর একটু কষ্ট পেতে পারি,
আরও আরও আরও একটু ভয়, . . .

ততদিনে, ততদিনে নিশ্চয়ই তোমার মনে প’ড়ে যাবে . . .

.              *************************  

.                                                                                       
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
চিলজন্ম
কবি মন্দাক্রান্তা সেন

কি শিখেছ ইহজন্মে ? চিলের মত সুযোগসন্ধান
এক টুকরো অন্ধকার হাতিয়ে নেওয়া ঠোঁটের ভেতরে
যথেষ্ট সময় নেই, দ্রুত ছিঁড়ে ফেলা রক্তমুখ
গভীর অসুখী ডানা সারাদিন চক্রাকারে ঘোরে . . .

এ জন্ম চিলের জন্ম, আজীবন প্রখর উড়ান
তোমার মসৃণ পিঠে বিঁধতে চাওয়া সুতৃক্ষ্ণ পালক
কতবার আকাঙ্ক্ষিত অপরাধ, লক্ষ্মীছাড়া সুখ
মুঠোয় সংসার ঢেকে একা-একা চলেছে বালক

যে মুহুর্ত একা পাই সে মুহুর্ত আমার আমার
বালক হতচকিত, হাত থেকে সমাজ গড়ায়
রাস্তা থেকে নর্দমায় গিয়ে পড়ে ; পড়েছে পড়ুক,
মারণাস্ত্র দুই ঠোঁট, ঢুকে গেছে তীব্র নিশানায়

তোমার সুস্বাদু ত্বক ছিঁড়ে নিয়ে আকাশে পালাব
যেখানে কঠিন চূড়া লবনাক্ত, সমস্ত পাথুরে
নখরে বিঁধিয়ে রাখব মনুষ্যজন্মের মত ক্ষুধা
যতবার কাছে পাব তোকে তোর বাড়ি থেকে দূরে।

.              *************************  

.                                                                                       
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
চাঁদমামা
কবি মন্দাক্রান্তা সেন

চাঁদ উঠেছে জোথনাতে আজ
সারা আকাশ ভাসে
তাই দেখে ওই বারান্দাতে
ছোট্ট খোকা হাসে।
ছোট্ট খোকার মা বলেছে,
আয় আয় চাঁদমামা,
চাঁদকপালে টি দিয়ে যা---
দেবো জরির জামা।

জোছনাতে আজ বান ডেকেছে
সোনার বরণ চাঁদে,
তাই দেখে ওই পথের ধারে
ছোট্ট খোকা কাঁদে।
ছোট্ট খোকার মা বলেছে,
আয় আয় চাঁদমামা,
শুকনো রুটি জুটিয়ে খোকার
রান্নাটাকে থামা।

এমনি করেই ছোট্টবেলায়
চাঁদ দেখে প্রত্যেকে,
সব মায়েরাই খোকন ভোলায়
চাঁদকে ডেকে ডেকে।
চাঁদ তো নিজের জোছনা মেখে
হেসেই কুটিকুটি,
এর কাছে সে সোনার থালা
ওর কাছে সে রুটি!

.   *************************  

.                                                                                       
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
একটি অসম পরকীয়া
কবি মন্দাক্রান্তা সেন

কথা বলো মা-বাবার সাথে
আমার আপত্তি নেই তাতে
আমাদের কথা পরে হবে।

সবকিছু দারুণ সংযমী
গোপনে যে দুঃসাহসী তুমি
একথা জেনেছি যেন কবে ?

মা তোমাকে পছন্দই করে
বাবাও ভাইয়ের মতো ধরে
কিন্তু তুমি বন্ধু তো আমারি

কাকিমা এলনা কেন সোনা ?
ওকে যেন কখনও বোলো না
আমি ভাল চুমু খেতে পারি!

সদর দরজা খুলে দিতে
একসঙ্গে নামবো সিঁড়িতে
সে মুহুর্তে আমরা পাগল,

ঝোড়ো শ্বাস সিঁড়ির আড়ালে
অতর্কিতে বিছে কামড়ালে
রক্তময় জ্বাল অনর্গল

ধ’রে যাবে ; ধরবে ধরুক
তোমার বুকের মধ্যে মুখ
ধরে যায় কেমন সহজে---

কাকিমা, মিতালি, ভাল আছে ?
ওরা কি তোমার কাছে কাছে
আসে, দ্যাখে, কোনও দাগ খোঁজে ?

কাল যাব তোমার অফিসে
ঠিক ঠিক চারটে পঁচিশে
তারপর ভুল দিগ্বিদিক . . .

শহিদমিনারে উঠে গিয়ে
বসে দেব আকাশ ফাটিয়ে
ইন্দ্রকাকু আমার প্রেমিক।

.   *************************  

.                                                                                       
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
সিংহবাবুর বন্ধু
কবি মন্দাক্রান্তা সেন

পশ্চিমের ওই বারান্দাটার চট্ লা-ভাঙা জাফরিটা,
তার ওপাশে অন্ধকারে অরণ্যময় আফ্রিকা।
ভাবছে মনে --- অরণ্য কই! এই তো টানা বারান্দা!
সামনে দ্যাখো তাঞ্জানিয়া, তার ওদিকে উগাণ্ডা
গা-ছমছম দিনদুপুরে গহীন জলে জঙ্গলে
দুরন্ত সব জন্তুগুলো বেড়ায় দলে দঙ্গলে।
ভাবছো এটা ভ্যারেণ্ডাঝোপ ? ওর ভেতরে সিংহ নেই ?
বুঝবে যখন ফাটবে পিলে হুংকারে আর বৃংহণেই।
বৃংহণ কী, তাও জানো না ? হাতির ডাকের শুদ্ধ নাম।
বানানটা খুব খটমটে। হ্যাঁ তারপরে যা বলছিলাম---
বুক ফুলিয়ে নিজের মনে হাঁটছি একা সাবধানে,
জন্তুরা তো লুকিয়ে আছে এদিক ওদিক সব খানে।
বলতে পারো, ঠিক না আমার, এমনতরো দুঃসাহস,---
কিন্তু আমি মন্ত্র জানি, বনের পশু মানবে পোষ।
শিকার আমার পছন্দ নয়, কাজ কী তবে বন্দুকে।
না হয় ধরো যাচ্ছি আমি ডাকতে আমার বন্ধুকে।
বন্ধুটা কে ? ওই ওপাড়ার সিংহবাড়ীর সাত্যকি।
যুদ্ধে আমায় হারিয়ে দেবে, সিংহবাবুর সাধ্য কী!

.  
             *************************  

.                                                                                       
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর