সারাদিন ছিলাম সহজে দ্বন্দ্বে কিছু মসৃণতা ছিল . এখন রজনী আসে রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিদ্যুৎ চমকায়, পশ্চিমী অরণ্য থেকে নেকড়ের পাল সূর্যাস্ত ধর্ষণ করে বিছূর্ণ শিশুর ঘিলু ছড়ায়, টেবিলে
. বিধ্বস্থ মানচিত্র খুলে ঝুঁকে আছে . কাঁধের তারকা |
চার পাহাড়ের খাঁজে রক্তস্রোত ঢুকে পড়ে রাত্রির বাণিজ্য ঘিরে নেমে আসে ধস্ |
যারা ছিল এতক্ষণ কাছে . অক্ষম আমাকে ফেলে ছুটে গেল হাতে নিয়ে টাঙ্গি ও মশাল দিগন্ত বিশাল ধ্বনি, লাল, . যে বাটিতে অন্নপান সে বাটিতে যন্ত্রণার সুরাপান করি . জ্বলে যাই উৎকন্ঠ শর্বরী |
ভোর পাঁচটায় উনুন ধরিয়ে, ঘুগ্ নির হাঁড়িটা চাপিয়ে, মন্টু ঘুমচোখে . বাসন মাজে | লালগোলা থেকে সদ্য-নামা ঝুড়ি যার বাজারে--- বরফের মধ্যে মাথা গুঁজে ল্যাজ উঁচিয়ে দিয়ে ---- ইলিশের চলন্ত ছায়া --- এবং সামনের দোকানে সুতোর ঝোলা আপেলের দিকে চোখ রেখে মন্টু ডিস কাপ ধোয় |
একে একে বাবুরা আসেন ----অমৃতবাজার এবং আনন্দবাজার টেবিল থেকে টেবিলে ওড়ে | লম্বা ছুরিটা ময়লা ন্যাকড়ায় দু’ বার ঘসে নিয়ে মন্টু চার হাতে রুটি কাটে, একটাতে সর মাখায়, আড়তদার কেশববাবুকে দেয়, অন্যটাতে সর মাখিয়ে শ্রমিক নেতা দীনবন্ধুকে | মাখন মাখায় হেডমাষ্টার বিপ্লববাবুকে, সর মাখিয়ে রিপোর্টার তরুণ মুখুজ্যেকে, . দুধের সর নন্দীবাবু, মাখন--- তলাপাত্র, মাখন ---- ঘোষবাবু, সব--- সমাজপতি, সর, মাখন---- সর মাখন সর মাখন |
বাসি পচা ঘুগ্ নি ছাড়া মন্টুর আর কিছুই থাকে না | কিন্তু পাঁউরুটি কেটে দু’টুকরো করে দু’জনকে দিয়ে দিলেও তার হাতে আর . একটা জিনিস থাকে--- ভারতবর্ষের অন্ধকার আকাশে হঠাৎ লাফিয়ে-ওঠা বিদ্যুতের মতো আট ইঞ্চি লম্বা ঝক্ ঝকে একখানা ছুরি |
এক একটা জ্যোত্স্নারাত প্রান্তরের দিক থেকে ফিরে এসে . ছিঁড়েখুঁড়ে নিয়ে গেছে আমার হৃদয়, বাহুমূলে নেমে আসা চুলের ঝাউয়ের গন্ধে নক্ষত্রের অন্ধকার . শুয়েছিলো চোখের পাতায়, বলিনি সে সব কথা, মৃদুস্বরে, ভাষায় প্রকাশ পেলে . অভিমান স্পষ্ট হয়ে যাবে, বলিনি কিভাবে আয়ু নষ্ট হয় প্রস্তুতি বা প্রতীক্ষায়---- . ওষ্ট ও কন্ঠের তাপে, ছিন্ন পরিতাপে গভীর গোপন রাত্রি খেলা করে, খেলা জুড়ে নেমে আসে . আপেক্ষিক কালের স্তব্ধতা |
তোমাকে লিখিনি চিঠি ---- খাম ছিঁড়লে চাপা ঠোঁট খুলে যাবে, . ছোট্ট তিলে কেঁপে উঠবে ক্ষতিগ্রস্ত এলাচের ঘ্রাণ ; কখনো দেইনি ফুল জন্মদিনে ---- ফুলের ঈর্ষার হাত . বড়ো বেশি স্নিগ্ধ হয়ে যাবে, পাখি, কিংবা মৌমাছির গুনগুন যাওয়া আসা, ফিরে ফিরে . যাওয়া আসা ঘিরে উদ্বৃত্ত উদ্বেগ নিয়ে যতটুকু মধু ঝরে অপরাহ্নবেলা . তুমি তার অতিরিক্ত কিছু দাও, তুমিতো ঘরের, তাই . ঋণী করো সমগ্র ভুবন, ঠোঁটের অল্প ফাঁকে যতটুকু কলরোল---- যতখানি নীরবতা নত হয়---- . ভুরুর আলস্য ঘেরা কৃষ্ণপক্ষ জলে---- আমি সেই খোলামেলা রূপ নিয়ে ডুবে যাই, ডেউয়ের সংসার পলকে রচনা করি, নির্মাণের খুব কাছে এসে ভেঙে ফেলি . আবার গড়ার হঠকারিতায়, ঠিক আগের মতো ব’লে খুলে ফেলি, চোখের গড়ানো জল . হাত ধুয়ে নেমে যায় চোখের আগুনে----- এভাবে নিজের কাজে পড়ে থেকে হঠাৎ গর্জনে রাত ভীষণ অবশ হয়ে আসে---- ট্রিগারে তর্জনী রেখে, ফুল নেই, পাতা নেই, শহরে বসন্ত আসে, . দক্ষিণের বুক ভাঙা বাতাসে কিশোরের লাশ ঘিরে সিগারেট টেনে যায় তিনটি পুলিশ অফিসার, খিটখিটে শুকনো স্তনে মুখ গুঁজে ঝুলন্ত কঙ্কালরাত্রি নেমে আসে . গঞ্জে ও শহরে, কিন্তু সেই শ্মশানমুহূর্তে যদি তিরিশ হাজার ছেলে জেলের গরাদ ধরে . আমাকেই দেখে আমি জেগে উঠি এক জ্বলন্ত শক্তির চাপে জনস্রোতে, সৈকতে নেমেছে রাত্রি . দু’পায়ে মিহিবালি ধুয়ে নিয়ে চলে যায় নীল নুন জলে সন্ধ্যার ঢেউয়ের মধ্যে প্রতিটি ভোরের রক্ত আমাকে তাদের কথা বলে |
জানি একদিন তুমি আঁচলে জড়াবে রূপ, রূপদর্শী চোখে ও চিবুকে . বারবার কেঁপে উঠবে কেবল আমার নয় পরাভূত মানুষের . অনন্ত বেদনা বুকে নিয়ে---- ক্রমশ জাগ্রত হবে জনশ্রুতি, গ্রাম দিয়ে ঘিরে ফেলা নগরের অস্ত্রাগার . মানুষের গরিষ্ঠ গর্জিত মহিমায়----- তুমিও আমাকে নেবে, যেমন ভ্রমর নেয় অদৃশ্য ফুলের রেণু . বাগানের ফুলের গভীরে---- তুমি সেই অবিরল রূপবতী, আমি ঊর্দ্ধবাহু হয়ে নতজানু কালস্রোত থেকে তোমার সরল হাঁটু ---- বিভক্ত সোনালিস্রোত . জড়াবো চুম্বনে |
“কারণ, পোশাক নেই সেহেতু আমার মৃতদেহ ফুটপাতে পড়ে আছে | পৌরসভা বড়ই দয়ালু চুক্তিবদ্ধ শকুনেরা বুকে নিয়ে অনবদ্য স্নেহ গোল হয়ে বসে আছে | নাগরিক শিরঃপীড়া মুগ্ধ করে তালু |
আমার শীতল রক্ত শহরের খোলা নোংরা নর্দমার জল, মস্তিষ্কে সাজানো আছে সবজান্তা শয়তানের বাসা, স্বর্গে না নরকে যাব স্থির করতে পারি না কেবল মরবার পরও দেখি বেঁচে আছি খাসা |
অর্থ যশ প্রতিপত্তি দিগ্বিজয়ী পান্ডিত্য প্রতিভা কিছুই ছিল না, তাই চিত্পটাং হয়ে আমি আজ নির্বিঘ্নে ঘুমিয়ে আছি | ফুলের স্তবক শোকসভা বিব্রত করে না জেনে বড় সুখী ; সুহৃদসমান যে যার ফিকির খোঁজে ফুটপাত থেকে বহু দূরে, কাকের সঙ্গীত, আহা কী মধুর নির্জন দুপুরে |”
শুনেই বন্ধুরা বলে, “নৈরাশ্যবাদীর কথকতা সামাজিক সততায় আস্থাহীন এই ভদ্রলোক সমস্ত নৈতিক মূল্য ধ্বংস করে যায়প্রগল্ ভতা আসুন সকলে মিলে একে আজ শূলে দেওয়া হোক |”
সুতরাং শুয়ে আছি শবাধার-শূন্য এই সাজানো শহরে আমাদের মৃতদেহ, অন্ধকার, প্রতিটি পোষাক ভেসে যাচ্ছে গোধূলির রক্তবর্ণ উদ্বিগ্ন প্রহরে আমার শোণিতে ভেজা দৃশ্যাবলী তীব্র পরমায়ু ফিরে পাক ||”
আবার বাহিরে দাঁড়াব, আবার ফুলের দোকান খুলে ফুলের চাহিদা বাড়াব এবং ভিতরের ফুলদানি সাজাব আমার বাহিরের ঘরে, নৈশ শ্লীলতাহীন যেখানে প্রখর মজলিস বসে, যেখানে আমার সব বন্ধুর মুখে সোনালী সাপের মাদকতা খেলা করে : পিপাসায় কাঠ ভিতরে বাহিরে মদের দোকান খোল অথচ দোকানে হ্যারিকেন নেই, তেল নেই, ফিতে নেই |
কেমন আছেন ? ভালো না | কারণ, ছেলের অসুখ, আর পলিসিবিহীন বীমার কিস্তি এক্ষুণি দিতে হয়, ভাল না, সাতটি আইবুড়ো মেয়ে, অথচ ফিরতি বাসে ভারী মাণিব্যাগ আরেক পকেটে চালান হয়েছে কাল, ভালো না, কারণ -------- |
ফুলের দোকানে ভিড় জমে, আর রাত্রি গভীর হলে বন্ধ-দোকান ভেদ করে চলে যেতে হয় দূর দেশে সব ভালো না-র আরকে ভিজানো রাত্রির ফুসফুস লাল হয়ে ওঠে ভোরের পাঁজরে, উপত্যকায় লাল আয়োজনগুলি তৎপর মনে হয় |
কে কোথায় আছো, বাহিরে দাঁড়াব, কে যেন বাহিরদিকে তালা দিয়ে গেছে, সাত মিনিটের মধ্যে না পেলে চাবি শিরায়-শিরায় অসমর্থিত সংবাদ রটে যাবে !
গতকাল কার ছেলে হারিয়েছে, পাওয়া গেল মাঝরাতে, মাঝরাতে কাল এই বাড়িতেই ডানকান খুন হয়, মাঝরাতে কারা লরিতে আমার ফুলময় মৃতদেহ নিয়ে গেল, ফের ঐ লরিতেই নতুন ভাড়াটে এল !
আমি তো রাইফেলের গুলি নই যে সটান্ ছুটে যাবো--- ঢোঁড়া সাপ, আমাকে এঁকে বেঁকে চলতে হয় | যতই এ-গলি ও-গলি করি না কেন আমার লক্ষ্য কিন্তু বাদশাহী সড়ক, অবশ্য আমরা যখন পৌঁছব তখন সেটা আর বাদশাহী থাকবেন, বাদশাহরা তার আগেই ইতিহাসের পচা ডোবায় পেটফোলা কোলাব্যঙের মতো চিৎপটাং হয়ে পড়ে থাকবে ফলে, পদ্ধতিটা বুঝে নেবার জন্য দেওয়ালগুলোর উপর নজর রাখতে হয়, কারা কখন কীভাবে কেন লিখছে এবং কী লিখছে কারা মুছে দিচ্ছে এবং কারা তাবৎ মোছামুছি তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিয়ে আবার লিখছে,---- সবই আমাকে মুখস্ত করতে হয় | যখন দেখি, ‘সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক’ তখন বুঝতে পারি বিষয়টা সহজে হবার নয় | কিংবা যখন দেখি অমুকচন্দ্র তমুককে ছারপোকা-মার্কা বাক্সে ভোট দিন, তখন বুঝতে পারি বাক্সের আড়ালে মস্ত কলা এবং কৌশল আছে | অথবা যখন অধ্যয়ন করি ---- ‘এশিয়ার মুক্তিসূর্য জিন্দাবাদ’ তখন রাস্তার মোড়ে একটা ভিখিরির বাড়ানো হাত ঠেলে সরিয়ে দিয়ে আমি এই দু’নম্বর মুক্তিসূর্যের দিকে ভুরু কুচকে তাকাই---- ঝাঁ ঝাঁ রোদ্দুরে চোখ পুড়ে যায়, গলা শুকিয়ে কাঠ হয়, কিন্তু ঝলসানো তামার থালার মতো আকাশ আমাকে মুক্তির কথা কিছুই বলে না |
যখন পড়ি, ‘কমরেড কানু সান্যালকে জেল ভেঙে ছিনিয়ে আনুন’---- তখন ভাবি এঁরা অন্যের উপর দায়িত্ব দিয়ে চলে গেলেন কেন ? কিংবা আলকাতরা ও ব্রাশের নৈশসংঘর্ষে যখন দেওয়ালে ফুটে ওঠে, বন্দুকের নলই ক্ষমতার উৎস’ তখন ক্ষমতার আগে ‘রাজনৈতিক’ শব্দটা নেই ব’লে আমি আঁতকে উঠি এবং খুবই চিন্তিত হয়ে পড়ি এবং চিন্তা করতে করতে বার তিনেক হোঁচট খেয়ে, একটা গুঁতায়মান ষাঁড়কে ধাপ্ পা মেরে, সেই সারি সারি ভাঙা টালির ঘরগুলোর সামনে এসে দাঁড়াই | এবং সমস্ত নিস্তব্ধ উনুন, নর্দমার গড়ানো নোংরা জল, পচা গোবর, বিচুলির বোঁটকা গন্ধ, আর কানে আঙুল-দেয়া খিস্তির বান এড়িয়ে এ-গলি ও-গলি ক’রে শেষ পর্যন্ত পল্টুদের দরজায় এসে কড়া নাড়ি ; কিন্তু খুব সূক্ষ্ম দরকার থাকা সত্ত্বেও পল্টুকে পাই না---- তা’র নাকি দুটো-দশটা ডিউটি |
পল্টুকে পেলাম না বলে আমি অতিশয় মুষড়ে পড়ি এবং হতাশ হ’তে হ’তে পৃথিবীর সমস্ত শ্লেগানের অর্থ এবং অন্তঃসারশূন্যতা বিষয়ে যখন মনে মনে তর্ক ক’রে একমত হই এবং আলবেয়ার কাম্যু কিংবা বুদ্ধদেব বসুর উপন্যাসের নায়কের মতো আমার ফোক্ লা অস্তিত্বের বিলকুল গহন প্রদেশে যখন মহান শূন্যতার রুচিকর ঘনঘটা দেখা দিতে আরম্ভ করে এবং আমি ক্রমশ রাতের হাওড়া ব্রিজের মতো বড্ড একা কিংবা অভিমানী শুশুকের মতো ডোবা-ভাসা হয়ে যাই--- ঠিক সেই সময়ে একটা খোলার ঘরের বারান্দায় ঠান্ডা উনুনের পাশে দু’হাত কোমরে রেখে খাটিয়ার উপর ডান পা তুলে দিয়ে গন্ গনে রাগ এবং কান্নায় ফুঁসে-ওঠা একটা আট-দশ বছরের উলঙ্গ ছেলে গুলমার্গ থেকে বিবেকানন্দশিলা পর্যন্ত থর থর করে কাঁপিয়ে দিয়ে ভারতবর্ষের সমস্ত দক্ষিণবাহিনী নদীকে বাঁ দিকে ঘুরিয়ে দিয়ে সমস্ত অস্ত্র-কারখানা বিমানবন্দর, সমস্ত বেনামী জমির দলিল পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার খসড়া, যৌন সাহিত্যে আগুন লাগিয়ে দিয়ে বিশাল পর্বতমালা জলস্রোত মাঠ-ময়দানের সমস্ত খসশান জমায়েতকে তিনটি শব্দের মধ্যে স্তব্ধ ভয়ঙ্কর তোলপাড় ক’রে খাটিয়ার উপর লাথি মারতে মারতে তার সুকেশিনী ধূর্ত সৎমাকে চীত্কার করে বললো---- ‘ভাত দে হারামজাদী’ |
গান্ধীনগরে এক রাত্রি কবি মণিভূষণ ভট্টাচার্য ১৯৭৪ সালে প্রকাশিত কবির "গান্ধীনগরের রাত্রি" কাব্যগ্রন্থের কবিতা। আমরা ভীষণভাবে কৃতজ্ঞ কবি দিলীপ কুমার বসুর কাছে কারণ তিনি এই কবিতাটি চয়ন করে আমাদের পাঠিয়েছেন। মিলনসাগরে কবি দিলীপ কুমার বসুর কবিতার পাতায় যেতে এখানে ক্লিক করুন . . .।