কবি মায়া বসুর কবিতা
*
সম্রাট ও সন্ন্যাসী
কবি মায়া বসু
(দেব সাহিত্য কুটির থেকে প্রকাশিত, ১৯৬৭ এর “বেণুবীণা” শারদীয়া সংকলন থেকে নেওয়া )

নৃপতি বিবস্বান---
প্রজাবত্সল সংযত চেতা বড়ই ধর্মপ্রাণ।
ঘন অরণ্যে সারাদিন ধরে মৃগয়ায় অবশেষে
শ্রান্ত ক্লান্ত ফিরিতেছিলেন সন্ধ্যায় নিজ দেশে।
মাঝখানে তিনি শিবিকায় আর সৈন্যরা দুই দলে
আগে পিছে তাণর অস্ত্রশস্ত্র শিকার লইয়া চলে।
কিছুদূর এসে পাত্রমিত্র চেয়ে দেখে বিস্ময়ে,
গভীর বনেতে সন্ন্যাসী এক সমাধিমগ্ন হয়ে
মুদিত চক্ষে পথের উপরে একা বসে যোগাসনে,
পরমারাধ্য ইষ্ট মন্ত্র জব করে এক মনে।

ত্যক্ত চিত্তে অমাত্য এক তাঁর কাছে গিয়ে কয়,
“ধ্যান করিবার জায়গাটা বেশ পেয়েছেন মহাশয়।
দেখুন চাহিয়া, পিছনে শিবিকা, নিজে রাজা সমাসীন,
মাঝপথ ছেড়ে সরে গিয়ে তাঁকে যাইবার পথ দিন।”

শুনে সেই কথা, চক্ষু মেলিয়া যোগীবর তাকে কয়,
“তোমার রাজাকে বল, হেথা এক মহারাজা বসে রয়।
সহস্র কোটি জপ মোর শেষ না হবে যতক্ষণ,
এক তিলও আমি নড়িব জেনো, ছাড়িব না যোগাসন।”

শুনে তাপসে হেন নির্ভিক কথা,
পাত্রমিত্র, রাজার মনেও জাগিল চঞ্চলতা।
শিবিকা হইতে নামিলেন তিনি, বিচলিত অতিশয়
“এত বড় কথা বলে যে সাধক, সে তো সাধারণ নয়!”
প্রণমি তাপসে কহিলেন রাজা, “ কে আপনি যোগীবর?”
মুনি বলিলেন, “তব প্রশ্নের পরে দিব উত্তর।
আগে বল মোরে, তুমি কোন জন, কিবা তব পরিচয় ?”
বলিলেন রাজা ; “আমি অভাজন সাধারণ নর নয়।
রাজা বলে মোরে জানে এই দেশবাসী!”
শুনিয়া সাধুর অধরে ফুটিল ঈষৎ মধুর হাসি।

“রাজার উপরে মাহারাজা আমি, এ কথাও জেনো তুমি,
রাজ্য আমার এ তিন ভূবন, এই অরণ্যভূমি।”
মৃদু হেসে রাজা প্রশ্ন করেন, “মহারাজা যদি হন,
সেনাসামন্ত অস্ত্রশস্ত্র তাহলে, কোথায় কন ?”
বলিলেন যোগী শির করি উন্নত,---
“শত্রু থাকিলে সৈন্যে অস্ত্রে তবে প্রয়োজন হত।
এ জগতে মোর কোন শত্রুই নাই,
ও সব ঝামেলা---যন্ত্রণা জ্বালা, কিছুই রাখিনি তাই।”

পরাজিত রাজা তবু বলিলেন, “কোথা তব কোশাগার ?
কোথা প্রাসাদ, তোষাখানা আর অর্থের ভাণ্ডার ?
কই রাজবেশ ? কোথায় বা প্রজা ? কোথায় সিংহাসন ?
কমণ্ডুলু আর কৌপিনে কেন ধূলি ’পরে বসে রন ?”
শিশুর মতন সরল হাস্যে এবার বলেন যোগী ;
“আমি সন্ন্যাসী হে মহারাজ, নহি তব সম ভোগী।
খরচ কোথায় ? কী করিব টাকা দিয়ে ?
কী করিব বল কোষাগার আর অর্থের বোঝা বয়ে ?

.                 *****************

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
বৈজু বাউরা
কবি মায়া বসু
(দেব সাহিত্য কুটির থেকে প্রকাশিত, ১৯৬৭ এর “বেণুবীণা” শারদীয়া সংকলন থেকে নেওয়া )

দাক্ষিণাত্য জয় অভিযান শেষে ;
আলাউদ্দিন খিলিজি যখন ফিরিলেন নিজ দেশে,
লুণ্ঠিত যত ধন-দৌলত, মণি মরকত আর
সঙ্গে তাহার সবচেয়ে সেরা ছিল এক উপহার॥

গোপাল নায়ক, দাক্ষিণাত্যে সংগীত বিশারদ,
সম্রাট তারে দিলেন আপন সভা-গায়কের পদ।
অযাচিত ভাবে পেয়ে রাজসম্মান---
অহংকারেতে মত্ত গোপাল ভাবে ধরা সরাখান!
‘তাতাম ভারতে আমার সমান গায়ক নাহিক আর,
বাদশাহ তাই গুণীকে দিলে উচিত পুরস্কারষ’

আলাউদ্দিন খিলিজি একদা গোপালেরে কন ডাকি,
“শুনেছি কে এক বৈজু বাউরা অদ্ভুত গায় নাকি ?
জনপদ হতে দূরে যমুনার তীরে,
পাগলা সে সাধু একা বনে থাকে, ভাঙ্গা শিবমন্দিরে।
লোকে বলে তাঁর গান শুনে নাকি দেবতা ধন্য মানে
সে গানের সুরে বনের পশুরা হিংসা ভুলেছে প্রাণে।

আদি ও অন্ত ‘ঔঁ’কার মন্ত্র সব বৈজুর সাধা
রাগরাগিণীরা স্বেচ্ছায় তাঁর কণ্ঠে পড়েছে বাঁধা।
এত কথা শুনে ইচ্ছা জেগেছে সেই গান শুনিবারে
মোর নাম করে, বহু সমাদরে আন তুমি হেথা তাঁরে।”

রাজার আদেশে গোপাল নায়ক দিল্লীর পথ ছাড়ি,
বনের গভীরে যমুনার তীরে ছুটে আসে তাড়াতাড়ি।
আড়াল হইতে বৈজুর গান শুনে সে স্তব্ধ রহে,
এ কী গান! এ যে অমৃত লোকের সুর সুরধুনী বহে!

গান শেষ হতে সম্মুখে আসি বৈজুর পায়ে ধরি,
বলিল গোপাল, “গুরু বলে আমি তোমারে নিলাম বরি।
অতি সুকঠিন যে রাগরাগিণী হয়নি এখনো শেখা
হে প্রভু, তোমার করুণা হলেই পাব তাহাদের দেখা।

বিমুখ করিলে পাব মনে বড় ব্যথা।”
সদাশিব সাধু রাজী হল শেষে, হেরি তার আকুলতা!
মুখে বলে এক, মনে ভাবে, রাজা যদি শোনে এর গান
সভা-গায়কের পদ যাবে মোর, যাবে মান সম্মান।
বাদশার কাছে ফিরে এসে বলে, “লোকে প্রভু কি না কয় ?
বৈজুর গান অতি সাধারণ, এমন কিছুই নয়।
বাদ্যযন্ত্র নাহিক কিছুই, মন্দিরা জোড়া সার
রাগরাগিণীর জ্ঞানও বেশী নেই তার।

মিনতি করিয়া আমার নিকটে শিখিতে চেয়েছে গান
ভাবিয়াছি মনে শিষ্যকে কিছু করিব শিক্ষা দান॥”
“গোপালের কথা শুনি বাদশাহ হৃদয়ে অবাক মানে,
‘বৈজু বাউরা’ কত বড় গুণী, এ ভারতে কে না জানে ?
এতই স্পর্ধা! শিষ্য বলিয়া করে তারে অপমান?
সহিব না হেন দম্ভের দিব, সমুচিত প্রতিদান।”

কিছু কাল গত হলে ;
বহু সম্মানে বৈজুকে নিজে আনিলেন সভাতলে।
সহসা সেখানে গোপালেরে হেরি ‘বাউরা’ উচ্ছ্বসিত
“শিষ্য আমার! তব দরশনে হনু অতি পুলকিত।”
সব কথা বুঝি ফাঁস হয়ে যায়! ক্রুদ্ধ গোপাল বলে,
“কে কার শিষ্য ? ভুলেছ নিজেকে এসে এই সভাতলে ?
পাগলের রীতি মাথা ঘুরে গেছে, পেয়ে রাজসম্মান,
মনেও পড়ে না, এতদিন ধরে কে কারে শিখাল গান ?”

মর্মান্তিক কটু কথা শুনে সাধু মনে ব্যথা পায়,
দরবারে গিয়ে অতি সত্বর বিদায় লইতে চায়।
বলে, “বন ছেড়ে আসিতে চাহিনি এই রাজসভাতলে
আমি জ্ঞানহীন, যথার্থ ঠাঁই, ইষ্টের পদতলে।”
করজোড়ে তাঁরে সম্রাট্ কন, “মাত্র একটি গান,
দয়া করে প্রভু শুনায়ে সবারে তারপর চলে যান।”

রাজ অনুরোধ এড়াতে না পেরে বৈজু বাউরা গায় ;
আহা কি মধুর! রাগরাগিণীরা তানে তাঁর মূরছায়!
বন্ধ কুঁড়ির কোষে কোষে জাগে প্রকাশের যন্ত্রণা
অন্ধকারে মর্মের মূলে আলোকের প্রার্থনা।
পাথরের বুক ভেদ করে যেন জেগে ওঠে নির্ঝর
সভাজন ছার---এ গানে বন্দী আপনি যে ঈশ্বর।
এ গানের শ্রোতা সংগীত গুরু শঙ্কর মহাকাল,
জটায় বন্দী গঙ্গার ধারা এই গানে উত্তাল!

গান শেষ হতে মন্দিরা জোড়া সহসা পড়িল খসে,
পাষাণ রচিত চত্বর গলি বেদীর ভিতর পশে।
যত সভাজন নবাব আদেশে করে তারে টানাটানি
তুলিতে না পেরে শ্রান্ত ক্লান্ত, ছেড়ে দিল হার মানি।
গোপালের পানে চাহিয়া তখন বাদশা কহেন ধীরে,
“তোমার গানেতে পাষাণ গলায়ে মন্দিরা আনো ফিরে।
তোমার শিষ্য হয়ে যদি সাধু এমন গাহিতে পারে,
গুরুর ধর্ম রাখ, মন্দিরা খুলে দাও তুমি তারে।”

শুষ্ক বদন, কম্পিত দেহ, গোপাল ধরিল তান,
যত সুর তোলে, খোলে না যন্ত্র, হয় আরো হতমান।
দুই দণ্ডেই যত সভাজন করে তারে ধিক্ ধিক্।
দণ্ডিত হল বাদশার হাতে মূর্খ সে দাম্ভিক।
লাজে অপমানে ভাসি নয়নের জলে,
সভার মাঝারে আছাড়ি পড়িল গুরুর চরণতলে।

ক্ষমি গোপালেরে সাধক বাউরা স্নিগ্ধ শান্ত মুখে,
ইষ্টদেবের স্মরি পুনরায়, গান ধরে কৌতুকে।
কঠিন পাথর গলে যায় ফের মন্দিরা উঠে আসে,
অমর মহিমা বৈজুর চিরস্মরণীয় ইতিহাসে॥

.                 *****************

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
অনুচ্চারিত
কবি মায়া বসু
( রঞ্জনকুমার দাস সম্পাদিত, শনিবারের চিঠি কবিতা সংখ্যা, ২০০৫ থেকে নেওয়া )

অনেক পেয়েছি তবু---অনন্ত---অনন্ত---
.        আরো কিছু পেলে ভাল হত।

জোয়ার জলের স্রোতে আকস্মিক বন্যাবেগে
.                                ভেসে ভেসে আসা।
নির্জন দ্বীপের পর ভঙিগুর ঢেউয়ের মত
.        ভেঙে পড়ে কত প্রেম কত ভালবাসা।
ভাটার নিষ্ঠুর টানে পলাতক প্রত্যহেক সাথে---
হঠাৎ কখন তার অশরীরী আবির্ভাব
.        মিশে যায় অন্ধকার রাতে ও প্রভাতে।

. . . আবার উত্তাল এক ঢেউ ওঠে।
.        নিয়ে যায় সব কিছু হারিয়ে ভাসিয়ে
এ মগ্ন চেতনা তবু জেগে রয় জ্যোতির্ময়
.        কোনো এক সুদুর্লভ দুরাশাকে নিয়ে।


*        *        *        *        *        *        *


বীতনিদ্র অন্ধকারে সুনিবিড় গভীর আশ্লেষে
গহন গহ্বরে ঢাকা সেই দুরাশাকে আমি
.        টেনে আনি তিক্ত পরিহাসে।
রাত্রির দর্ফণে তার প্রতিবিম্ব হেরি নিত্য---
.        নব নব দুঃখ রূপাত্মিকা
ধূসর মেঘের স্তরে সমাচ্ছন্ন অনুজ্জ্বল
.        বর্ণহীন ম্লান নীহারিকা।


*        *        *        *        *        *        *


সহসা কখন সেই উজ্জীবিত ক্ষীণ অগ্নিকণা
রক্তাক্ত বিক্ষত করে---নখদন্তে ছিন্নভিন্ন করে
জ্বালায় জ্বালায় দেহে অচিন্তিত অব্যক্ত যন্ত্রণা!
যত জ্বলি যত পুড়ি তীব্রতার উত্তপ্ত আগুনে
.        তত তার কাছে যাই অন্ধ মুগ্ধ ঊর্ণনাভ সম
দেহের জারক রসে অতি সূক্ষ্ম অতি অনুপম
.        অদৃশ্য সে তন্তুজাল নিরন্তর চলি বুনে বুনে।

চিরন্তন এই এক নির্ভুল নিয়মে---
সিক্ত হয় বালুচর ; মৌচাকের কোষে কোষে
.        বিন্দু বিন্দু মধুরস জমে।
উদ্দাম রক্তের স্রোতে মদমত্ত যত মৌমাছির দল
অগ্নিমুখ পতঙ্গের মত হয় বার বার বিভ্রান্ত চঞ্চল।

প্রজ্বলন্ত সেই শিখা আলেয়ার মায়ারূপ ধরে
.        মুগ্ধভ্রষ্ট পতঙ্গের সুনিবিড় যাচে আলিঙ্গন
স্তনাগ্রে কটিতে তার জ্বালাময়ী বাসনার দাহ
.        ওষ্ঠে তার হিম স্পর্শ---বিষ নীল মৃত্যুর চুম্বন।

দুরন্ত তুরঙ্গ সম যত ছুটি তত চেয়ে দেখি
আরো আছে বহুদূর---
.        আরো পথ এখনো যে বাকি
সমাপ্তির রেখা টেনে সেই অন্ধ গতির আবেগ
কোন দিন থামাতে কি কেউ পারে নাকি ?

অকস্মাৎ লোষ্ট্রাঘাতে স্বচ্ছ হ্রদে জাগে ক্ষুব্ধ
.                                তীব্র আলোড়ণ
একদিন তাও জানি শান্ত হয়---মোছে না মোছে না শুধু
.        স্মরণের রুধির ক্ষরণ!

তার চেয়ে কুয়াশার অন্ধকারে ভরা থাকে থাক
.        হৃদয়ের আ-দিগন্ত সীমা
সেই দৃশ্য হীনতায় ঢাকা থাক চিরদিন
অচরিতার্থতা আর আকাঙ্খার অমল মহিমা।

.                 *****************

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
নিঃসঙ্গ
কবি মায়া বসু
( নমিতা চৌধুরী ও অনিন্দিতা বসু সান্যাল সম্পাদিত “দামিনী” কাব্য সংকলন থেকে নেওয়া।)

তোমার টেবিলে ছড়ানো অনেক বই
সারা দিনরাত এলোমেলো পড়ে থাকে ;
এটাকে সরাও---ওটা টেনে নাও কাছে
.                খুঁজে পেলে না তো মনের মতনটাকে?
.                তোমার জীবনে শুধু বই আর বই,
.                তবু তো হৃদয় রয়ে গেল শূন্যই!

তোমার ঘরের বাতায়নখানি খোলা
ভেসে আসে দূর দ্বীপপুঞ্জের হাওয়া---
মহাসাগরের অতলস্পর্শ দিয়ে,
.                ভোলায় তোমার সব চাওয়া সব পাওয়া
.                ---তবুও কাউকে মনে পড়ে যায় নাকি?
.                হৃদয়ে তোমার তার ছোঁওয়া চাও নাকি?

তোমার দুয়ার চিরদিন আছে খোলা
.                কত অতিথির, পথিকের যাওয়া-আসা
তবু সমুদ্র ঢেউ তোলে চারিদিকে
.                নির্জন দ্বীপে একা বেঁধে আছ বাসা!
.                সঙ্গীবিহীন কাটালে সারাজীবন ;
.                খুঁজে পেলে নাকো মনের মতন মন!

হে নিঃসঙ্গ একবার চোখ তোল
ঐ আকাশের--- এই পৃথিবীর দিকে
দেখ কত তারা, আর জ্যোত্স্নার চাঁদ
.                রঙের প্রলেপ ছড়ায় দুর্নিরীখে।
.                আকাশ-প্রদীপ শূন্যেই জেগে রয়!
.                তুমি আকাশের---পৃথিবীর, ---কারও নয়!

.                 *****************

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর