কবি মীরা দেব বর্মন  -  বাংলা গানের স্বর্ণ যুগের একজন খ্যাতনামা গীতিকার এবং সঙ্গীত শিল্পী
ছিলেন। তিনি প্রখ্যাত সুরকার শচীন দেব বর্মনের স্ত্রী এবং রাহুল দেব বর্মনের মা। তিনি অবিভক্ত বাংলার
কুমিল্লায়, ১৯২৩ সালের মার্চ মাসে জন্ম গ্রহণ করেন। দাদু ও দিদিমার বাড়ীতে জন্ম থেকেই থেকেছিলেন
পারিবারিক অসুবিধার কারনে। দাদু, রায় বাহাদুর কমলনাথ দাশগুপ্ত ছিলেন ঢাকা হাইকোর্ট-এর চিফ
জাস্টিস। কবি, পরে কলকাতার সাউথ এন্ডে বসবাস শুরু করেন দাদু দিদিমার সঙ্গে।

সেখানে শুরু হয় পড়াশুনার সঙ্গে সঙ্গীত এর তালিম। দাদু দিদিমার বাড়ীতে বিদ্যালয় শিক্ষা ও সঙ্গীত শিক্ষা
সমানতালে চলে। দাদু রায় বাহাদুর কমলনাথ নাতনীর সঙ্গীত শিক্ষার যথেষ্ট আয়োজন করেছিলেন। মীরা
দেবী, ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের কাছে শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম নিয়েছিলেন। কীর্তন ও ঠুমরী শেখেন
ধীরেন্দ্রনাথ দেবের কাছে। ১৯৩০ সালে অনাদি দস্তিদারের কাছে রবীন্দ্র সঙ্গীতের শিক্ষা লাভ করেন। তিনি
শান্তিনিকেতনে আমিতা সেনের কাছে নৃত্যচর্চাও করেন। সঙ্গীতের সকল ক্ষেত্রে সমান পারদর্শিতা ছিল তার।

ভীষ্মদেব চট্টোপাধ্যায়ের কাছে শিক্ষার সময়তেই, পরিচয় হয় ভীষ্মদেবের আর এক কৃতী ছাত্র সচিন দেব
বর্মনের সঙ্গে। গুরুর থেকে বয়সে বছর ২-৩ ছোটো ছিলেন শচীন কর্তা। শোনা যায় যে মীরা দেবী ও
সচিনের প্রেম ভীষ্মদেব খুব একটা ভালো চোখে দেখেননি। এবং তার ঠিক পরেই আরো দু’একটা
ঘটনা নিয়ে শচীন কর্তা এবং ভীষ্মদেবের সম্পর্কের মধ্যে একটা শীতলতা এসে পড়ে। ভীষ্মদেব সব
ছেড়েছুড়ে পন্ডিচেরী চলে যান।

মতান্তরে ১৯৩৭ সালে এলাহাবাদ মিউজিক কনফারেন্সে তাঁর দেখা হয় শচীন দেব বর্মনের সঙ্গে। তাঁর
প্রতিভায় মুগ্ধ হন শচীন। বিয়ে হয় ১৯৩৮ সালে। বয়েসের তাফাত ছিল অনেকটা। এ ছাড়া শচীন ছিলেন
ত্রিপুরা রাজ পরিবারের সদস্য। তাই বিয়েতে আপত্তি উঠেছিল। কিন্তু দুজনেই ছিলেন অনড়। তাই শুভ
অনুষ্ঠান সম্পন্ন হয়েছিল সাড়ম্বরে। শচীন এসেছিলেন ঘোড়ায় চড়ে, হাতে তারবারি। বসেছিল নহবতখানা,
বাজিয়েছিলেন আলি হুশেন খাঁ।

১৯৩৯-এর জুন মাসে জন্ম হয় ছেলে পঞ্চম বা রাহুল দেব বর্মনের। প্রথমে স্বামী এবং পরে ছেলেকে সবার
সামনে রেখে মীরা দেবী নিজে বরাবর আড়ালেই থেকে গিয়েছিলেন।

বিবাহের বছরেই আকাশবাণী কলকাতা থেকে অডিশন দিয়ে উত্তীর্ণ হলেন। শুরু করেন পড়াশোনাও।
আই.এ. পরীক্ষায় বসেছিলেন। কিন্তু পড়াশোনায় ইতি দিয়ে সঙ্গীতের পথ ধরেই হাঁটলেন। শচীন দেব বর্মণ
বম্বে চেলে এলেন। বম্বে গিয়ে মীরা দেবী ফয়াজ মহম্মদ খানের কাছে আবার তালিম নিতে শুরু করলেন।

১৯৪৫ সালে আকাশবাণী বম্বে থেকে অডিশন পাশ করে ঠুংরি ও গজল পরিবেশন করতেন।
BOMBAY
IPTA
-র সঙ্গেও যোগাযোগ ছিল। বম্বের সাংস্কৃতিক জগত তখন প্রগতিশীলতার কেন্দ্র। সেই সময় দুটি নাটক
“শান্তি” ও “নয়া প্রভাত”-এর গানের কথা রচনা করেন।

শচীণ দেব বর্মণের সঙ্গে অনেক গানের রেকর্ডও করেন তিনি - আজ দোল দিল কে (১৯৪৬), তুম হো বড়ে
চিতচোর (১৯৪৬), কেন হায় স্বপ্ন ভাঙ্গার আগে (১৯৪৯), কালি বদরিয়া ছা গয়ে, ডালি ডালি ফুল (১৯৪৮), কে
দিল ঘুম ভাঙ্গায়ে (১৯৪৯) তার মধ্যে উল্লেখনীয়।

মীরা দেবী এসিস্ট্যান্ট মিউজিক ডাইরেকটার হিসেবেও উল্লেখযোগ্য অবদান রেখে গিয়েছেন। নয়া জমানা,
তেরে মেরে স্বপ্নে, শর্মিলি, অভিমান, বারুদ, প্রেম নগর প্রভৃতি বিখ্যাত চলচ্চিত্র গুলোর সহযোগী সঙ্গীত
পরিচালক ছিলেন তিনি। এখনো এগুলো আমাদের কাছে স্বর্ণযুগের গান।

১৯৭৫ সালে স্বামীর মৃত্যু পর্যন্ত বম্বের বাড়ি “জেট”-এ বাস করেছেন। তারপর পুত্র রাহুলের সঙ্গে থাকতেন।
রাহুল দেব বর্মন হঠাৎ মারা গেলেন ১৯৯৪ সালে। পুত্র ও স্বামীর মৃত্যুর অসম্ভব শোক তাকে মানসিক
ভারসাম্যহীনতায় পৌছে দিয়েছিল। বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তাঁর কথা। কেবল শচীন দেবের গান শুনলে নড়ে চড়ে
উঠতেন। চেতনার জগত তার কাছে মুল্য হারিয়েছিল।
"Sharan" নামে ভাসির একটি ওল্ড এজ হোমে তার
মৃত্যু হয় ২০০৭ সালের ১৫-ই অক্টোবর।

১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর গিয়েছিলেন সেখানে। যখন ফিরছিলেন গ্রামের পুকুরের
পার দিয়ে, দেখলেন একটি চৌদ্দ পনের বছরের মেয়ে, পুকুর পাড়ে বসে হাপুশ নয়নে কাঁদছে। জিজ্ঞেস
করায় মেয়েটি বলল – সদ্য বিয়ে হয়েছে, ভাই আসবে বাপের বাড়ি নিয়ে যাওয়ার জন্য। সকাল থেকে
অপেক্ষা করে করে ক্লান্ত সে, ভাইয়ের আর দেখা নেই। লিখেছিলেন ‘কে যাস রে ভাটি গাঙ বাইয়া আমার
ভাই ধনরে কইও নাইয়র নিত আইয়া’। এই সময়েই নাকি “আমি তাক্ দুম তাক্ দুম বাজাই বাংলা দেশের
ঢোল" গানটিও তিনি রচনা করেছিলেন।

চলচ্চিত্রের বাইরে গাওয়া ২৬ টি গানের শুধু একটিতে শচীন দেব বর্মন নিজে কন্ঠ দেননি তাতে
কন্ঠ দিয়েছেন মীরা দেব বর্মন নিজে। আমরা মাত্র ৯টি গানের কথা যোগাড় করতে পেরেছি।

যাঁর কথার গান শুনে আজও বাঙালী নস্টালজিয়ায় ভোগে, এমন এক গীতিকারকে কোনো সরকার বা কোনো
সংস্থা থেকেই কোনো পুরস্কারে ভূষিত করা হয় নি। নারী কবিদের বাংলায় যে যথাযত মর্যাদা দেওয়া হয়
না, মীরা দেবীর জীবন আরেকবার তা আমাদের চোখে আঙ্গুর দিয়ে দেখিয়ে গেল।

আমরা কৃতজ্ঞ নন্দীতা ভট্টাচার্যর কাছে আগরতলা থেকে প্রকাশিত সাতকাহন পত্রিকায়, মীরাদেবীর জীবনের
বহু তথ্য-বিশিষ্ট লেখাটির জন্য এবং নিচে, উত্স
-তে দেওয়া অন্যান্য লেখকদের কাছে। নিচে “উত্স” তে গিয়ে
লিংকে ক্লিক করলেই তাঁদের লেখা যে যে পাতায় রয়েছে, সেখানে চলে যেতে পারবেন।   


কবি মীরা দেব বর্মনের লেখা গান শুনতে নিচের লিংকগুলিতে ক্লিক্ করতে পারেন . . .

http://ganerkoli.blogspot.in/2012/05/blog-post_9976.html      
http://www.raaga.com/channels/bengali/lyricist/Meera_Dev_Burman.html    
http://music.deshergan.com/bangla-music.aspx?album=Sachin%20Dev%20Burman%20Collections%204  
http://www.in.com/mira-dev-burman/profile-1967127.html    


আমরা
মিলনসাগরে  তাঁর গান প্রকাশিত করে আগামী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে পারলে আমাদের এই
প্রচেষ্টা সার্থক বলে মনে করবো।

কবি মীরা দেব বর্মনের মূল পাতায় যেতে এখানে ক্লিক করুন

.                     
উত্স:
নন্দিতা ভট্টাচার্য, মীরা দেব বর্মন একটি তারা মেঘে ঢাকা, সাতকাহন, আগরতলা, ২০১১,    
নন্দিতা ভট্টাচার্যর প্রবন্ধটি পড়তে এখানে ক্লিক্ করুন ,     
শিশির চক্রবর্তী, এ শুধু গানের দিন ২য় পর্ব, ২০০৯, সপ্তর্ষি প্রকাশন,             
ইন্দ্রনাথ মুখার্জী, বর্ণে গন্ধে ছন্দে গীতিতে, বাঙ্গালনামা,    
Sagar Kopardekar,      
বাংলা উইকিপেডিয়া,    
www.sdburman.com/,          
www.sdburman.net/,        
দ্য হিন্দু,      
উইকিপেডিয়া,   
http://bengali.evergreenbangla.com/     
গুরুচণ্ডা৯    


আমাদের ই-মেল
- srimilansengupta@yahoo.co.in      


এই পাতার প্রথম প্রকাশ - ১৯.৭.২০১২

...