কবি মৃণাল বসু চৌধুরীর কবিতা
*
অক্ষরবালিকা
কবি মৃণাল বসু চৌধুরী

মেধাশ্রিত
যে সব বিষাদ
.        অন্তর্মুখী পারাপারে
.                 ঘিরে থাকে তোমার শরীর
যে সব আগুন এসে
.        ছুঁয়ে দেখে ছায়ার নির্জন
স্বপ্নহীন কুয়াশায়
.        যে সব আঁধার এসে
.                জমা হয় রক্তের ভেতরে
অস্পষ্ট দ্রাঘিমা থেকে
.        নিঃসঙ্গ ফুলের সঙ্গে
.        হঠাৎ বেরিয়ে আসে
.               যে সব মানুষ
তারা কেউ
আমাদের মুখোপেক্ষী নয়
তারা জানে
.       সভাঘরে কোথায় কখন
নিঃশব্দে লুকিয়ে থাকে অক্ষরবালিকা
স্বরক্ষেপে
কখনই বা অলৌকিক আলো
কখনই বা অনিবার্য
.        নান্দনিক খেলা

.        *****************             

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
তোমাদের ধিক্কারসভায়
কবি মৃণাল বসু চৌধুরী

আয়ুহীন কবিতার জন্ম নিয়ে
তোমাদের ধিক্কারসভায়
.           নিঃশব্দ নূপুর পায়ে
.                       যে যুবতী বসেছিল একা
.                              তার চোখ
.                              ঠোঁট আর
.                              হাতের আঙুলে
.                              ছিল কিছু নক্ষত্রবিষাদ
.                              ছিল শব্দবীজ
.                              ছিল বসন্তলালিত কিছু
.                              উন্মাদ আগুন
শিখাহীন
যে আগুনে
পুড়ে যায় দক্ষিণ দুয়ার
.            ইতিহাস
.            সামাজিক বিধিজাল
.            হৃদয়হীন কিছু বিকল্প মিনার
শরীরী জ্যোত্স্না নিয়ে
যে যুবতী বসেছিল তোমাদের ধিক্কারসভায়
জন্মের যন্ত্রণা নিয়ে
.            তাকে ঘিরে
.                    শব্দযান
.                    রাশিরাশি
.                           দুর্লভ কবিতা

.             *****************             

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
যে দিকে চাও
কবি মৃণাল বসু চৌধুরী

যারা তোমার পায়ের বেড়ি তাদের কথা ভাবছো কেন
ইচ্ছেমতোন যেদিকে চাও উড়ে বেড়াও স্বাধীনতায়
উত্সমুখে আগুন যখন ডাকবে তখন দেখা যাবে
এখন শুধু আঁচলভরা খুশি ওড়াও আলোছায়ায়

সাতপুকুরের সাঁকোর ওপর যেমন খুশি নাচতে থাকো
সূর্যমুখির পাপড়ি ছিঁড়ে নানারঙের মৃত্যু আঁকো
রাতদুপুরে সপ্তডিঙ্গায় অন্তরঙ্গ মানুষ ডাকো
টুসুগানের ছন্দেপাগল স্বপ্নকাতর বাঁচতে থাকো

হৃদয়পুরের আস্তাবলে রুগ্ন ঘোড়া মরছে মরুক
প্রিয়গাছের হলুদপাতা বিস্ফোরণে ঝরছে ঝরুক
ভাষান্তরে গিরিচূড়ায়যে কবিতার মুগ্ধবয়ন
তাকে ঘিরেই মগ্ন থাকুক নগ্নহাঁটুর শব্দচয়ন

যে দিকে চাও
.          ইচ্ছেমতোন
.                    ইচ্ছেমতোন
.                            ইচ্ছেমতোন

.              *****************             

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
বাজুবন্ধে লুকনো আকাশ
কবি মৃণাল বসু চৌধুরী

বলেছিলে
নদীর ওপারে গিয়ে ঝড়াপাতা কুড়িয়ে কুড়িয়ে
.                               জ্বালাবে আগুন
বলেছিলে        ইঁদুরের উন্মত্ত আবেগ
.                   মাটি ও হাওয়ার সঙ্গে
.                   শিরীষফুলের খেলা মুগ্ধ খুনসুটি
.                   পাড় ভাঙা ঢেউ আর
.                   শোলার টোপর নিয়ে নতুন কবিতা

বলেছিলে        সুখের তালিকা নিয়ে
.                   ভোরের আকাশ ছুঁয়ে
.                   উড়ে যাবে নীলবর্ণ পাখি
.                   স্বপ্নভরা পায়ের আঙুল থেকে
.                   রক্ত নয় প্রতিবাদী বসন্তের গান

বলেছিলে        বিষের মোড়কে ঢাকা শীত
.                   তুষার প্রতিমা হয়ে
.                   থেকে যাবে ভিতর উঠোনে

বলেছিলে        সাদারঙ ঘোড়া
বলেছিলে        কলার মান্দাস
বলেছিলে        চিলেকোঠা
.                  বাজুবন্ধে লুকনো আকাশ

.              *****************             

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
নির্বাসিত মানুষেরা
কবি মৃণাল বসু চৌধুরী

নির্বাসিত মানুষেরা
যুদ্ধের কৌশল নিয়ে কিছুই ভাবে না
সারারাত অনাদরে       কিছু ছায়া
.                             কিছু তীব্র পদপাত
.                             ছলনামিশ্রিত কিছু শরীরী স্তব্ধতা
.                             কিছু আর্তনাদ
.                             বিকৃত স্বপ্নের ঘুম
.                             অসুস্থ বিবেক
সারারাত                   উপেক্ষায়
.                             সারিসারি ঘড়াভর্তি জল
.                             নীলকন্ঠ পাখির দুঠোঁটে
.                             ম্রিয়মাণ সাপের খোলস
সারারাত                   পুণ্যস্নান মৃত্যুভয়
.                                        ক্ষুধার কৌতুক
সারারাত                   শুধু অম্লজান
.                             বিধিবদ্ধ মেঘের উড়ান


পরাজিত                  মানুষেরা
.                            হয়ত বা উদাসীন নির্বাসন জানে
.                            যুদ্ধের কৌশল কিংবা
.                                     পরিপূর্ণ বিক্রম জানে না

.                **************************************             

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
শব্দনির্মাণ
কবি মৃণাল বসু চৌধুরী

‘জাহাজে’র কথা ভেবে বলতেই তুমি বললে ‘জানলা’
‘আকাশ’ বলতে গিয়ে ‘আ’ বলতেই তুমি বলে উঠলে ‘আরাম’
‘সমুদ্রে’ যাবার আগে ‘স’ বলার সঙ্গে সঙ্গে
‘সংসার’ উচ্চারণ করল তোমার ঠোঁট

কেমন অবলীলায়
আমার ‘অনন্ত’ হয়ে গেল ‘অন্ধকার’
‘মেঘ’ হয়ে গেল ‘মেদ’
.           ‘গুলমোহরে’র কথায় এল ‘গুহা’
যৌবনের স্মৃতিময় ‘টিলা’র ‘টি’ নিয়ে
.                             তুমি বললে ‘টিপ’
‘বিষাদে’র বি নিয়ে ‘বিমান’
মৃত্যুর ‘মৃ’  নিয়ে ‘মৃদঙ্গ’

আর ঠিক এভাবেই
কোনো কিছু উচ্চারণ করার আগেই
আমার মুখ থেকে সমস্ত কথা
কেড়ে নিচ্ছ তুমি

ভেঙে দিচ্ছ
উড়িয়ে দিচ্ছ আমার ঈপ্সিত সব শব্দ
তোমার এই
শব্দনির্মাণের খেলায়
.     হারিয়ে যাচ্ছে আমার প্রকাশভঙ্গি
.                 আমার ভাষা
.                 আমার উচ্চারণ

বলা হয় না
নিজের মতো করে কোনো কিছুই আর বলা হয় না আমার

.                **************************************             

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
দিতে পারি
কবি মৃণাল বসু চৌধুরী

চেয়েছিলে       আনন্দলহরী
দিতে পারি      কাশবন
.                  রিনিঝিনি রূপোর নূপুর
দিতে পারি      শিউলির ছায়া
.                  ভোরের শিমূল
.                  পরাক্রমী নদীর হিল্লোল
দিতে পারি      নীল সরোবর
.                  ছায়াঘন ঘাসের বিছানা
দিতে পারি      স্মৃতিধার্য সুদীর্ঘ চুম্বন
চেয়েছিলে       স্বপ্নের মিছিল
.                   শিল্পময় শরীরী ভঙ্গিমা
চেয়েছিলে       বুনোপাখি উদ্ধত আগুন
চেয়েছিলে       দীর্ঘস্থায়ী মোম
.                   মধুমাখা মাতাল আঙুর

দিতে পারি      
সব দিতে পারি
এমন কি         এসব না চেয়ে যদি
.                  প্রতিবাদী পরম্পরা চাও
.                  চাও ইতিহাস
দিতে পারি      মাতঙ্গিনী
.                  গণনাট্য
.                  হেমাঙ্গ বিশ্বাস

.       ************************             

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
একটু জোরে হাঁটলেই
কবি মৃণাল বসু চৌধুরী

একটু জোরে হাঁটলেই
.       হয়ত তোমার হাত ধরতে পারতাম ঠিক সময়ে
.       ঘুরিয়ে দিতে পারতাম তোমার গতিপথ
আর একটু জোরে হাঁটলেই
.       আধুনিক পরিকাঠামোর বিরুদ্ধে আনা প্রস্তাবের সঙ্গে
হয়ত জুড়ে দিতে পারতাম তুমুল বিতর্ক
মৌপালকদের কাছ থেকে
.       জেনে নিতে পারতাম
.               মৌমাছিদের জীবনযাপন
.               ঘরকন্না মুগ্ধ ছোটাছুটি
একটু জোরে হাঁটলেই
হয়ত বসন্তের বিরহ-বিষাদ
.        বাইসন কিম্বা বুনো মোষ ঘিরে
.        তোমাদের গল্পের বিষয় নিয়ে
.                 কিছু বলা যেত
পরিবর্তনের নামে
.        জীর্ণ প্রতিশ্রুতি
.        কিংবা পুনরাবৃত্তির ভুল নিয়ে
.        হাসা যেত কিছুক্ষণ
একটু জোরে হাঁটলেই হয়ত
কিন্তু বয়সও নয়
.       শরীরো নয়
.                 ইচ্ছেটাই তো ভিতরমুখী
নিজের সঙ্গে হাঁটছি যখন
আবার কেন মাপ পরিমাপ
.                 গতির বিধান
আত্মবিভোর হাঁটতে পারছি
.       এটাই কি আজ যথেষ্ট নয়

.       ************************             

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
কবিকে
কবি মৃণাল বসু চৌধুরী

কবিকে উজ্জ্বল হতে বলেছিল কোনো এক উদাসীন নারী
কবিকে চতুর হতে বলেছিল মেধাবী বন্ধুরা
কবিকে লম্পট হতে বলেছিল বাচাল বান্ধবী
কবিকে পন্ডিত হতে বলেছিল কিছু সম্পাদক
কবিকে প্রেমিক হতে বলেছিল কিশোরী পাঠিকা
কবিকে মাতাল হতে বলেছিল দক্ষিণ বাতাস
কবিকে আত্মস্থ হতে বলেছিল নিষ্ঠুর প্রকৃতি
কবিকে নিজের কাছে ফিরে যেতে বলেছিল আশ্চর্য কলম


কবি খুব সন্তর্পণে
.      পাখির ভাষায়       মানুষের জন্য
.           শোকগাথা গাইতে গাইতে ফিরেছিল ঘরে
পান্ডুলিপি দিয়ে
.       জ্বালানো আগুনে
.            নিশ্চিন্তে পুড়িয়েছিল নিজের হৃদয়
তারপর নতজানু হয়ে
.       নির্বিকার প্রর্থনায় চেয়েছিল অবিচ্ছিন্ন ঘুম

.                ************************             

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
একলা মানুষ
কবি মৃণাল বসু চৌধুরী

নিজের সঙ্গে একটা মানুষ
ছায়ার সঙ্গে একটা মানুষ
রোদের মধ্যে একটা মানুষ
.         হাঁটছে কেবল হাঁটছে কেবল হাঁটছে

ধর্ম সে তার ব্যক্তিগত
আদর্শ তার ব্যক্তিগত
চিন্তাভাবনা ব্যক্তিগত
জীবনযাপন ব্যক্তিগত
যন্ত্রণাভার  ব্যক্তিগত
তবুও কেমন একলা মানুষ
.       রোদের মধ্যে ছাযার মানুষ
.       ছায়ার মধ্যে রোদের মানুষ
.                সংঘবদ্ধ হবার জন্য
ভিরের মধ্যে একলা মানুষ
হাঁটছে কেবল হাঁটছে  কেবল হাঁটছ

.        ************************             

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর