কবি মৃণালিনী সেন-এর কবিতা
যে কোন কবিতার উপর ক্লিক করলেই সেই কবিতাটি আপনার সামনে চলে আসবে।
দেবপূজা


সেই ভাল ; ---থাক দূরে দেবতার মতো,
দূর হতে দেবতারে পূজিব উদ্দেশে ;
হীনতা অভাব শুধু ভরা শত শত---
মানব জীবনে ;---তবে এসো না সে বেশে |

মানবের স্থান হতে অতি উচ্চ স্থানে,
যতনে তোমার তরে রচেছি আসন ;
নিভৃতে সে সুপবিত্র প্রেমময় প্রাণে,
করিব তোমার দেবত্বের আরাধন |

সঙ্কীর্ণতা নাই সেথা,---প্রশান্ত উদার ;
আবেশ বিভ্রম নাই, পবিত্র সে ঠাঁই |
বিলাস চাঞ্চল্য নাই, স্থির চারি ধার ;
সাধনা রয়েছে শুধু, সম্ভোগ তো নাই |

সে নির্জন কুঞ্জ নহে প্রমোদ কানন
মানবের ;---নহে তার রঙ্গ লীলা-ভূমি |
পূজার মন্দির দেবতার ; ---অনুক্ষণ
বিকশিত ফুলকুল ফিরিতেছে চুমি---
ধীর গন্ধবহ |

.                আমোদিত চারিভিত---
চন্দন ও ধূপে ;  পূর্ণ পাত্র গঙ্গাজল ;
পবিত্র যা কিছু দেব তরে আয়োজিত
অন্তহীন রবি-করে সে স্থান উজ্জ্বল |

এস তুমি! দেবতার বেশে এ মন্দিরে ;
পুণ্য জ্যোতির্ময় কিরণ-বসন পরি---
ব'স আসি বেদী-'পরে ;

.                শুনাও গম্ভীরে---
অমৃতস্যন্দিনী উপদেশ |
.                        পান করি'---
ঘুচিবে আমার তৃষা --- চির জনমের |
বিশ্ব প্রেম শিখাইবে আদর্শ হইয়া |
ধরিব তোমার প্রেমে প্রেম অসীমের,
এ পূজা হইবে শেষ অসীমে মিশিয়া |


.          ****************                                                           
উপরে   




মিলনসাগর
*
আমার হৃদয়

কতনা অব্যক্ত-ভাব হৃদয়ে রয়েছে ভরা
প্রকাশিত করি সাধ, ভাষায় না দেয় ধরা!
নাহি পারি বলিবারে, শুধুই বুঝেছি ভাবে
হৃদয়ের কথা কি গো হৃদয়ে মিলায়ে যাবে?
দু'টি অশ্রুধারা রূপে ফুটিয়া উঠিতে চায়,
পাছে লোকে সে কথার কিছু অর্থ নাহি পায়,
অথবা বুঝিতে এক---তারা বুঝে ফেলে আর,
রেখেছি গোপনে রুদ্ধ তাই হৃদয়ের ভার |
সে অব্যক্ত ধ্বনি মোর প্রতি শিরে বহমান,
আধ-ঘুম-ঘোর প্রায় ছেয়ে আছে এ পরাণ |
কে যেন বসিয়া মোর হৃদয় আসনোপরি
গম্ভীর নিনাদময় কি বিচিত্র যন্ত্র ধরি---
বাজাইছে অবিরত কি মহা রাগিণী তায়,
সুরগুলি তার, ধীরে আমার পরাণে ভায়?
শুনিয়া সে সুরগুলি কি যেন গো মনে পড়ে
এ বিস্মৃত মোহমুগ্ধ পরাণ আকুল করে |
মনে হয় কি যেন গো হোলোনা হোলোনা হায়,
মনে হয়---এ জীবন বুঝিবা বৃথায় যায়!
যে আদেশ শিরে ধরি এসেছি ধরণী পরে,
ভুলে গেছি সমুদায়, আছি মত্ত মদভরে |
যে রাগিণী নিশিদিন ধ্বনিছে হৃদয়ে মোর,
মনে হয় যেন আমি চিনি তা জনম ভোর!
শুনিয়া সে মহামন্ত্র কত কি যে মনে আসে
প্রকাশ করিতে তাহা পারি না---পারিনা ভাষে,
ভুলেছিনু যে আদেশ---কে যেন গম্ভীর স্বরে
জাগায়ে তুলিছে পুন হৃদয়ের স্তরে স্তরে |


.          ****************                                                           
উপরে   




মিলনসাগর
*
নূতন রাগিণী

শুধুই গাহিতে গান যদি গো! জনম মম,
.        তবে দেবী! গানে মোর দাও সেই সুর,
যে সুরে মৃতেরো প্রাণে অমৃতলহরী বহে,
.        যে সুরে জড়েরো করে অবসাদ দূর!
মরুতে জনমে তরু, পাষাণেতে বহে নদী,
.        অঙ্গার সে হয়ে যায় সহসা হীরক!
যে তীব্র উন্মত্ত সুর তড়িৎ সঞ্চারি দেয়
.        হৃদয় হইতে হৃদে, ফেলিতে পলক |
এমন করিয়া শুধু গতানুগতের মত
.        কেবলি জ্যোছনা, পুষ্প, কল্পনা-বধুর
সহিত করিয়া খেলা, জীবন স্বপ্নের মত
.        করিতে চাহিনা আর সমাপ্ত মধুর |
আমি অগ্রসর হ'ব সত্যের ধরিয়া হাত,
.        সূর্যের রশ্মির মত কিরণ যাহার?
নিখিল বিশ্বের সর্ব-স্বচ্ছ মুকুরের সম,
.        সবাই হেরিবে তাহে চিত্র আপনার |
ক্ষুদ্র যশ অপযশ থাকে ক্ষুদ্র গৃহ-কোণে ;
.        ---এ সঙ্কীর্ণ সীমা মম দাও বাড়াইয়া,
কেবল আমার তরে রেখো না অস্তিত্ব মম,
.        আমারে অনন্ত মাঝে দাও হারাইয়া |
ব্রহ্মাণ্ডের সাথে মম দাও এক করি দেবী!
.        দাও যোগ করি দেবী! হৃদয়ের তার,
ওই ক্ষুদ্র তৃণগাছি, ওরো সুখ, ওরো দুখ,
.        ---অনুভব করি যেন আমায় আবার!


.                 ****************                                                      
উপরে   




মিলনসাগর
*
বাসনা

ঘুচেছে সকল সাধ, সাজিব যোগিনী,
বিভূতি ভূষিত অঙ্গ গৈরিকধারিণী।
রুদ্রাক্ষের মালা আহা শ্রেষ্ঠ অলঙ্কার,
সাগরে ধরিব এবে অঙ্গে তা আমার।
দূর কর হীরা মুক্তা! দাও বিলাইয়া---
দীন দরিদ্রেরে, আর কি কাজ রাখিয়া।
লালসা বিলাসমাখা ঐশ্বর্য্যে কি হবে,
অনন্তের পথে যদি কাজ নাহি দিবে।
কর্ম্মপথ সম্মুখেতে রয়েছে বিস্তৃত,
সাধিতে পারি গো যেন জগতের হিত।
কর্ম্ম কর্ম্ম এই বাক্য রবে সদা মুখে,
প্রাণ মন ঢেলে দিব জগতের সুখে।
নাহি চাই কর্ম্মফল, নাহি চাই কিছু,
অগ্রসর হব শুধু নাহি চাব পিছু।
জগৎ সংসার মোর আপনার ঘর,
সকলেই ভাই বোন কেহ নহে পর।
ভাই ভগিনীর কাজে জীবন আমার
যাপিবে, কামনা মোর নাহি কিছু আর।
প্রভাত হইবে যবে এ ঘোর রজনী,
চলে যাব মহালোকে হইতে ধরণী।
হে পিতা হে পরমেশ এই শুধু দিও,
---তখন আমারে তুমি কোলে তুলে নিও।

.                        ১৫ই শ্রাবণ ১৩০১

.                 ****************                                                      
উপরে   




মিলনসাগর
*
আমার অতীত

আমার অতীত! আর আসিবে না ফিরে ?
দেখিব না সে মধুর মুখ আর---ফিরে ?
এখন ভাবিতে হবে শুধু কি স্বপন---
সে সব অতীত কথা ? এ এবোধ মন---
অতীতের সুখস্মৃতি পারে না বলিতে
মিথ্যা শুধু ; --- পারে না যে স্বপন ভাবিতে।
কেমনে পারিবে ? সবি জ্বলন্ত অক্ষরে
লেখা যে রয়েছে হৃদয়ের স্তরে স্তরে!
মুছিবে না এ লেখা তো থাকিতে জীবন,
অতীতে কেমনে তবে ভাবিব স্বপন!
জীবনে অতীতই শুধু সুখদ আমার ;
এ জগতে যদি দেখা নাহি পাই আর,---
তাহারই মধুর ধ্যানে কাটাব জীবন।
আমার অতীতই সত্য,---সে নয় স্বপন!

.                              ২১শে ভাদ্র ১৩০১

.                 ****************                                                      
উপরে   




মিলনসাগর
*
প্রভাতে এক খানি ছবি

.           ( ১ )
প্রতিদিন আগেকারি মত
ঘুম ভাঙ্গে প্রভাতে যখন ;
ব্যাকুল নয়নে চারিদিকে
কারে যেন করি অন্বেষণ।

কে যেন গো ছিল এক দিন,
আর না দেখিতে পাই তায় ;
খুঁজিবার তরে রেখে মোরে
কে জানে সে গিয়েছে কোথায়।


.           ( ২ )
প্রতিদিন ঘুমঘোর চোখ---
মেলি, যেন দেখিতে কাহায় ;
যারে খুঁজি পাই না তো তারে,
এক খানি ছবি শুধু, হায়!---

প্রথমেই চোখে পড়ে মোর।
সে সৌম্য প্রশান্ত মূরতিরে,---
আধ আলো আধের আঁধারে,
প্রণিপাত করি নতশিরে।

.                    ২২শে ভাদ্র ১৩০১

.                 ****************                                                      
উপরে   




মিলনসাগর
*
একাদশী

স্মরণীয় দিন এই জীবনে এখন,
পালিতে একাদশী, এবে বড় ভালবাসি,
একি কষ্ট ? কুছু নয়, বোলো না এমন ;
এই স্মরণীয় দিন জীবনে এখন।

পক্ষান্তরে এক দিন বঙ্গবিধবার---
পবিত্র সুখদময় ;  এতে কষ্ট কার ?
এ দশা হয় নি যবে, আমি ভাবিতাম তবে,
পোড়া একাদশী কেগো করেছে বিচার ;---
দুঃখিনী, অভাগী তরে-বঙ্গবিধবার।

করেছে নিয়ম এ যে, বুঝেছি এখন,
বঙ্গবিধবার বন্ধু প্রকৃত সে জন ;
কামনা করিতে নাশ, করিতে সংযমাভ্যাস,
সহায় পুণ্যের পথে নাহিক এমন ;
এতে যার কষ্ট হয় সে মেয়ে কেমন ?

বোঝে না যে পাপ পুণ্য দুগ্ধপোষ্য বালা,
তারি পক্ষে একাদশী মর্ম্মান্তিক জ্বালা।
সমাজের নেতা যারা, কেমনে দেয় গো তারা,---
এ বিধি তাহারে, এ যে দাবানল জ্বালা,---
তার বুকে ; এ আগুনে পুড়ে মরে বালা।

নহি আমি কচি মেয়ে বোলো না ও কথা,
ভেবো না তোমরা কিছু, পেয়ো নাক ব্যথা ;
অম্লান বদনে আমি, যাপিব দিবস যামী
---পক্ষান্তরে এক দিন, একি বড় কথা!
ভেবো না তোমরা ওগো, পেয়ো নাক ব্যাথা।

গত কথা মনে করে দেখ এক বার,
কতই না উপবাস গিয়াছে তাঁহার ;
বারেক শরীর প্রতি, চাহিতে হয়নি মতি,
করেছেন দেহোপরি কত অত্যাচার ;
সাধ করে সয়েছেন কত অনাহার!

মাসে দুটো একাদশী, কিছুই ত নয়---
তার কাছে ; এরে সবে কষ্ট কিসে কয় ?
শয্যায় শুইয়া আহা, দারুণ যাতনা যাহা
অকাতরে সহ্য করিয়াছে সে হৃদয় ;
একাদশী তার কাছে কষ্ট কিছুই নয়।

একাদশী প্রিয় সখী এখন আমার,
তাঁর কথা মনে পড়ে আজি বার বার ;
কত না যাতনা হায়! পেয়েছেন এ ধরায়,
তেমন সহিষ্ণু কোথা দেখি নাই আর ;
আমার এ একাদশী তুচ্ছ কাছে তার।

.                           ২৫শে আশ্বিন ১৩০১

.                 ****************                                                      
উপরে   




মিলনসাগর
*
দশমী নিশি


আমার সে নিধি কই ?           আজি ত দশমী, সই!
শুধুহাতে আসিল ফিরিয়া।
দশমি! লইয়া হরি,                 চলে গেল ত্বরা করি,
কোথা আজি আসিল রাখিয়া।
কিছু নাহি বলে গেল,            নিয়ে তাঁরে চলে গেল,
না জানি কোথায় কোন্ দেশে ;
অভাগী একেলা প’ড়ে,           দশমি! কি মনে করে,
আজি পুন দেখা দিলে এসে ?
সকলি ত লয়ে গেছ,            বাকী কিছু না রেখেছ,
তাঁহারি সহিত সবি গেছে।
কি নেবে আমার আর,           যাহা কিছু ছিল সার,
সকলি ত ফুরায়ে গিয়েছে।
রমণীর শিরশোভা,                সিঁথায় সিঁদুর রেখা,
হায়! তাহা গিয়াছে মুছিয়া ;
কত সাধ কত আশা,              কত স্নেহ ভালবাসা,
হায়! সবি গিয়াছে ঘুচিয়া।
পুন কি দেখিতে এলে ?              এই বুকখানি দ’লে,
সকলি ত লয়েছ হরিয়া।
মোর কিছু নাই আর,               শুধু এবে অশ্রু সার,
তাহাও কি যাবে কেড়ে নিয়া ?
না না তা ত পারিবে না,         এ অশ্রু ত ঘুচিবে না,
যত দিন রবে এ পরাণ।
এ উত্তপ্ত অশ্রু মম,                   বহিবে নির্ঝর সম,
---গলিবে কি একটি পাষাণ ?


নিশি!                                                               .
সে দিনো এমনি তর,                সেজেছিলে মনোহর,
তুমি বুঝি দূত স্বরগের।
তাই এসেছিলে নিতে,                   স্বর্গপথ দেখাইতে,
যথায় নিবাস অমরের।
---পূজা করা হল না ত,               তাড়াতাড়ি কেন এত,
পলাইয়া গেলে তাঁরে লয়ে ?
---বিসর্জ্জেছি প্রতিমারে,                পূত জাহ্নবীর নীরে,
বিজয়া দশমী গেছে হয়ে।
পুন তোমা দেখে আজি,               মনে হইতেছে বুঝি,
এসেছ তাঁহার পাশ হ’তে ;---
তাঁহার বিহনে আমি,                  কেমনে দিবস যামী,
যাপিতেছি তাহাই দেখিতে।
এলে যদি তবে এস,                   ক্ষণেক নিকটে বস,
কেমন আছেন তিনি বল।
এ অভাগীরে কি তাঁর,               পড়ে মনে কভু আর,
রয়েছে কি মনে এ সকল ;
সে বৃক্ষ আশ্রয় করি,                 ছিনু সুখে কাল হরি,
ভেঙ্গে গেল কপালের দোষে।
হায় বিধি নিদারুণ,                  একি জ্বালালি আগুন,
এই কি লিখিয়াছিলি শেষে!
না---না তোর দোষ নাই,             আমারি কপাল ছাই,
জন্মান্তরে করেছিনু পাপ।
আজ তারি ফলে হায়!                এতেক যন্ত্রণা পাই,
এত তাই পেতেছি সন্তাপ।
কি আর বলিব নিশা!              প্রাণ হারায়েছে দিশা,
মরিয়া বাঁচিয়া আছি শুধু।
কিছু নাহি ভাল লাগে,                 হৃদয় মরণ মাগে,
বুকেতে আগুন জ্বলে ধূ ধূ !!
বোলো তাঁরে নাম কোরে,      কি করে সে অভাগীরে,
অকাতরে আসিলে ত্যজিয়ে!
যাহারে কোথাও তিল,            রাখিয়া না হ’তে থির,
রাখিতে যে হৃদয়ে ধরিয়ে।
চাহিলে না মুখ তার,              ভাবিলে না এক বার,
কি গতি হইবে তোমা বিনা।
সে ক্ষুদে বালিকা হিয়া,           দলিলে গো কি বলিয়া,
সে অভাগী কিছু তো জানে না।
না না আমি মিছে কেন,           তাঁর দোষ দিই হেন,
চলে যেতে ছিল না তো সাধ।
আমারে জনম তরে,            কাঁদাইতে, জোর করে,
লয়ে গেলে তাঁরে, সেধে বাদ।
সুখেতে থাকুন তিনি,               না হয় সহিব আমি,
যতনা যন্ত্রণা প্রাণ পাবে।
শুধু কাঁদিবার তরে,               এসেছি ধরণী পরে,
কাঁদিয়া জীবন চলে যাবে।

.                                                        ১৫ই আষাঢ় ১৩০১



.                                                 ****************                                          
উপরে   




মিলনসাগর
*
বিধবা কিশোরী

আমার কি যেন ছিল, এখন নাহিক আর ;
তাহারি অভাবে শুধু যেন এই হাহাকার।
থেকে থেকে তারি তরে ওঠে যেন দীর্ঘ শ্বাস,
অশ্রু দেখা দেয় চখে, অধরে মিলায়ে হাস।
হয় ত রয়েছি আমি প্রিয় সখীদের সাথে,
কথোপকথনো মগ্ন বিমল চাঁদিনী রাতে ;
মধুর জ্যোছনা রাশি পড়েছে কোলের পরে,
অবিন্যস্ত চুল লয়ে সমীরণ খেলা করে।
ভেসে আসে ফুল গন্ধ কুসুম কানন হতে,
কে জানে আপন মনে গাহিয়া কে চলে পথে ;
সে আকুল তান তার মরম পরশে মোর,
সহসা হৃদয় উঠে হইয়া আকুল ঘোর।
না ফুরাতে মাঝখানে বাক্যস্রোত থেমে যায়,
ধীরে ধীরে ঘন ঘোর আঁধার পরাণ ছায়!
কি জানি কি মনে পড়ে কিছু ভাল নাহি লাগে,
বুঝিতে পারি না মোর মরমে কি ব্যথা জাগে।

হয় ত কখন আমি দুপুরে নিজন বাসে---
গাহিতেছি আনমনে, বসি জানালার পাশে ;
গাহিতে গাহিতে গান হয়েছি আপনহারা,
ভাবেতে ডুবিয়ে গেছি যেন পাগলিনী পারা।
সহসা ভাঙ্গিল ঘোর একটি পাখীর ডাকে,
কি বলে করুণ সুরে বসি বকুলের শাখে ?
বাতাসের কোলে ধীরে গান মোর মিলে যায়,
পাখীর বিষাদ তানে প্রাণ কেন ব্যাকুলায়!
হাসিরাশি কেন হয় পরিণত অশ্রু ধারে,
মর্ম্মভেদী কেন ওঠে দীর্ঘশ্বাস বারে বারে!
কি যেন গো মনে পড়ে কিছু ভাল নাহি লাগে,
বুঝুতে পারি না মোর প্রাণে কি বেদনা জাগে।


বসন্তের সুপ্রভাতে কখনো কুসুম বনে,
চয়ন করিয়া ফুল গাঁথি বসে শিলাসনে ;
বিহগ বিহগী কত বসিয়া তরুর পরি,---
গাহিছে প্রভাত গাথা সুমধুর তান ধরি’।
প্রভাত কিরণ মাখি কত শত পাখী খেলে---
মেঘহীন সমুজ্জ্বল সুনীল গগনকোলে।


কাঁপাইয়া তরুলতা প্রভাত বসন্ত বায়---
বহিছে, কি যেন ধীরে মোর কাণে কহে যায়।
বুঝিতে পারি না তার সে মৃদু নীরব কথা,
শুধু জেগে ওঠে মোর প্রাণের ঘুমন্ত ব্যাথা।
কি যেন গো মনে পড়ে নাম ত জানি না তার,
কাঁদিয়া আকুল হই বহে চখে শত ধার।
ছড়ায়ে ফেলিয়া দিই কুড়াইনু যত ফুল,
জানি না কুড়ানু কেন---এমনি মনের ভুল।
চিনিতে নারিনু আমিআপনার প্রাণ মন,
কিসের অভাব মোর বলে দেবে কোন জন!

.                                            আশ্বিন ১৩০১

.                 ****************                                                            
উপরে   




মিলনসাগর
*
অনন্ত কালের পরিচয়


মানবসন্তান বলে ভাবি না তোমায়,
.        আমি বুঝি দেবতা বলিয়া ;
স্বরগ সুষমামাখা ও হৃদয় তব,
.        সাধ মোর দেখিতে তলিয়া।

প্রাণ দিয়া পূরাইতে অভাব তোমার---
.        বড় সাধ হয় মোর চিতে,
কিন্তু আমি কোথা পাব সে অমূল্য নিধি,
.        তুমি যাহা চাহ গো পাইতে।

সামান্যা বালিকা আমি, আছে মোর যাহা,---
.        ক্ষুদ্র হৃদি ক্ষুদ্র প্রাণ মন ;
তাই আমি দিছি তোমা, লও বা না লও,---
.        কর কিম্বা না কর যতন।

এ ধরায় যদি কেহ না বুঝে তোমায়,
.        দেয় তব হৃদয়ে আঘাত ;
নাহি পাও স্নেহ কোথা, আমি স্নেহ দিব,
.        আমি দিব বাড়াইয়া হাত।

ঢাকিয়া রাখিব তোমা এ হৃদয় দিয়া,
.        নাহি দিব পরশ করিতে---
পবিত্র ও দেহে তব বিষাদ বাতাস ;
.        প্রেমানন্দ রবে চারি ভিতে।

সমস্ত জগৎ যদি বিরুদ্ধে তোমার
.        মাথা তুলে উঠিয়া দাঁড়ায়,
আমি বুক পেতে দিব জননীর মত,---
.        ---অন্তরাল করিয়া তোমায়।

অবজ্ঞা তাচ্ছিল্য যদি পাই তব কাছে,
.        হাসি মুখে সহিব সকলি ;
হে দেবতা---জানি আমি তোমার নিকটে-
.        এক কণা বালুকা কেবলি।

প্রশান্ত সাগর তুমি প্রেম পারাবার,
.        চলিয়াছ অনন্তের সাথে ;
তীরে আমি বালুকণা, তৃষিত নয়ানে
.        চেয়ে আছি তোমাতে মিশাতে।

বিশ্বরূপী সৌন্দর্য্যের উপাসনা তব,
.        তুমি মম উপাস্য দেবতা ;
তোমাতে দেখিছি বিশ্ব, পাঠ করিয়াছি-
.        প্রকৃতির রহস্য বারতা।

স্বপনের মত যেন অতীত কাহিনী
.        ছায়া সম হতেছে স্মরণ ;
মনে পড়ে তুমি মোর চির জনমের
.        পরিচিত আপনার জন।

কত যুগ জন্মান্তর হয়েছে অতীত
.        সেই এক প্রভাত আলোকে ;
পথে বাহিরিলে তুমি সকলের সাথে,
.        প্রেমময় হৃদয়ে পুলকে।

আমিও তোমার পিছে চলিনু নীরবে,
.        বারেক চাহিলে মোর পানে ;
পড়িতে কি পেরেছিলে কি যে লেখা ছিল---
.        আমার সে আনত নয়ানে ?

আপনার প্রেমে তুমি আপনি বিভোর,
.        তোমার ও প্রেমিক হৃদয় ;
দেখিত সুন্দর সবি প্রেমে মাখামাখি,
.        বিশ্ব শুধু সৌন্দর্য্য নিলয়।

সে সৌন্দর্য্য ধরিবারে পাগলের মত
.        বাহিরিলে একদা প্রভাতে ;
কোমল কুসুম পথ দেখিলে সম্মুখে,
.        দেখিলে অনেক সখা সাথে।

ফুলে যে কণ্টক আছে জানিতে না তাহা ;
.        জানিতে না তোমায় ফেলিয়া---
যাহারা প্রাণের প্রিয়, হৃদয়ের সখা
.        যেতে পারে তাহারা চলিয়া।

বুঝিলে তা এক দিন, দেখিলে চাহিয়া-
.        যারা ছিল কেহ তারা নাই ;
দাঁড়াইয়া আমি শুধু পারশে তোমার,
.        তোমারি আশার গান গাই।

হাত খানি ধীরে ধীরে দিলে বাড়াইয়া,
.        বক্ষে আমি করিনু ধারণ ;
চুম্বিলাম শত বার, রাখিলাম শিরে,
.        প্রেমাশ্রুতে ধুয়ানু চরণ।

কহিনু তোমারি আমি, তুমি যথা যাবে
.        তথা যাব ছায়ার মতন ;
সকলে ত্যজিয়া তোমা যাউক চলিয়া,
.         আমি না ত্যজিব কদাচন।

চলিলে কত না পথ ধরিয়া এ হাত,
.        কত বর্ষ যুগ গেল চলে ;
কবে হল ছাড়াছাড়ি ভুলে গেছি তাহা,
.        আজ পুন কোথা হতে এলে!

পেয়েছ সন্ধান কি গো, চির জনমের---
.        তোমার সে সাধনার ধন ?
অথবা এখনো তুমি ফিরিছ খুঁজিয়া---
.        দিশাহারা খ্যাপার মতন ?

আমিও পাগল আজি হারায়ে তোমায়,
.        সহস্র বাঁধন গেছে টুটে ;
শত বাহু বাড়াইয়া এ হৃদয় মোর
.        কাহারে ধরিতে চায় ছুটে।

আমি এই বুঝিয়াছি প্রেম শুধু সার,
.        এ জগৎ শুধু প্রেমময় ;
প্রেমডোরে বাঁধা বিশ্ব প্রেমে মাখামাখি,
.        প্রেম ছাড়া আর কিছু নয়।

তাই মনে করিয়াছি পরাণ ঢালিয়া---
.        শিখিব করিতে প্রেম সবে ;
অনন্ত শকতিময় সৌন্দর্য্যসাগর,
.        প্রেমের ঈশ্বরে পাব তবে।

.                 ****************                                                            
উপরে   




মিলনসাগর
*