কবি মৃত্যুঞ্জয় সেনের কবিতা
*
লেট লতিফের গল্প    
কবি মৃত্যুঞ্জয় সেন

এক নির্মম অভিমানে ওর সমস্ত দরোজা বন্ধ, অলুক্ষণে সময়
রাজকন্যার নিত্য সহচরীদের অলস ছুটি, স্তব্ধ বাতাস ;
এখন কোথায় চলেছো লেট লতিফ ?
ভোরের সোনাসূর্য যখন দিগন্তে উদ্ভাসিত লয়ে রঙীন নক্সা আঁকতো
সলজ্জ বাসনার যন্ত্রণা তোমাতে প্রসারিত হতো
হিজিবিজি সংলাপে তুমি শিহরিত, সত্তাহীন, মৌন স্মৃতিমগ্ন
তখনি বোঝনি কেন প্রতি শরীর কোন না কোন এক রহস্যালতায় জড়িয়ে থাকে
মাটির প্রতিমা কখন অশরীরী রূপ ধরে দুশন করে প্রতি প্রাণে ?
নিজেকে নিয়ে এ তোমার কিসের বাজি ধরা, অস্ত্রহীন নীরব যুদ্ধ, লেটলতিফ।
তছনছ করো তোমার পর্বত চূড়ায় রাখা প্রগাঢ় বিশ্বাস।
প্রত্যেকের জীবনের জন্যে, সুখের জন্যে এই এত দীর্ঘ পৃথিবী,
দেহকে প্রিয়মুখী করতে সব মানুষের আছে প্রয়োজন।

.                   *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
অতল সরসীতে    
কবি মৃত্যুঞ্জয় সেন

চিরকাল সময় আর মানুষের মধ্যে অসম লড়াই চলছে
লড়াই দেখতে দেখতে সূর্যের চেয়ে বড় হড় নক্ষত্রের কথা ভাবা হচ্ছে
ভাবা হচ্ছে পুরুষ পাখির পিঠে ডিম রেখে অধৈর্য ভ্রমণের অর্থগুলি
অর্থগুলির বিশ্লেষণ হচ্ছে মানব সভ্যতার খুঁটিনাটি গতি ও বহর নিয়ে

যদু বংশের দার্শনিকরা কৌতুকের সঙ্গে একটা বড় ফোঁড় তুলেছে
সেই অসম লড়াই এর মধ্যে বিবেকের পা পড়েছে গোবরে
অপরিসীম ক্ষুধায় ভেঙে পড়ার উফক্রম উচ্চারণের পর্বগুলি
জীবনগুলো কি তবে শূন্য হাতে ফিরে আসবে ধর্মতলায়

ওই জগৎ নিয়ে তবু উল্লসিত হয়ে আলোচনার বিস্তার নামে
বঁধু হে, কর্মযোগিনী হয়ে সরাসরি নেমে পড়ো এই বোধানন্দের সুরকূলে
জীবনের বহু সঙ্গীত পঙ্গপালে খেয়ে গেল বলে আর বিলাপ নয়
পরনো বসতবাড়ি থেকে সকল অভিমানকে করো আশ্রয়হীন
প্রকৃত অর্থে এই লড়াই অতল সরসীতে শুধু মুখ দেখার।

.                   *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
অসময়ের গল্প    
কবি মৃত্যুঞ্জয় সেন

যাযাবরী মানুষ ছিনিয়ে নিয়েছে জাতকের ছক,
জিওল সেই ছক হারিয়ে মানুষ অন্ধকার সুড়ঙ্গে ঢুকেছে
সুখী হতে এখন আর মানুষকে উন্মুখ হয়ে ভ্রমণ করতে হয় না
এখন খুশীমত রভ মিলিয়ে ছাউনি গড়া যায় যত্রতত্র
চাইলেই ফেলা যায় মধুমালার অঙ্গে গোপন ছাপ
কারণ ফলন্ত ফলের ডালপালা ভেঙে এনেছে মানুষ

মানুষ এখন যে কোনো উদাহরণের মত সুখী

এখন অতীতে স্বপ্ন দেখে বৃথায় সময় কাটানোর দুঃখ
এখন লজ্জার মুখে প্রতিমা-সৌন্দর্য বসানো
এখন সব ঘোড়দৌড়েই জয়
এখন দুঃখ পেলেই ঈর্ষা
দুঃখ মানে ছলনা
দুঃখ পেলেই বাড়তি লাভ
এখন দুঃখ ভালবাসা নয়

অসময়ে মানুষ এখন বড় সুখী
দুধকলা খেয়ে সে এখন বড় হচ্ছে

.       *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
সবিনয় নিবেদন    
কবি মৃত্যুঞ্জয় সেন

সবিনয় নিবেদন, বাবুমশাই গো।
আমার কাগজ-পত্তর খুলে দেখুন নিশ্চয়ই পাবেন
বড় বিশ্রিরকমের হিসেবের গোলমাল
ওসব গণ্ডগোল তো বুড়ি মাগীর ছাবালি হবার মতো
দুচারটে বড়ি খেয়ে পেটের গণ্ডগোল তবু তো সারে
কিন্তু এসব নয়
কারণ, সোনার যৌবন বারো হাত হলে
তের হাতে পরিপূর্ণ নেশায় আমার টালমাটাল প্রত্যয়

কেবল আপনার সঙ্গেই তাল মেলাতেই মেলাতেই
বাবুমশাই গো, আমার মুখের রঙ কতবার পাল্টালুম
তবু আপনি মুখোশের আড়ালে থেকে গেলেন
মনে হচ্ছে আপনি কোনদিন মেয়েমানুষের গর্ত থেকে বেরুতে পারবেন না

অথচ যাত্রাদলের অধিকারীর এখন এদিকে আসার সময় হল
ঝুলে পড়া অণ্ডকোষতলা লোক নিয়ে সে বিব্রত
তার সামনে পুরুষ মানুষের বস্ত্রহরণ দেখতে আপনার ভালো লাগবে ?

তাই আপনার কাছে সবিনয় নিবেদন, বাবুমশাই গো,
আমার ডায়লগগুলো পাল্টে পুল্টে দেবার সুযোগ দিন
তরবারি উঁচিয়ে বলি,
রে রে রে, দূর হ’ তোরা। দে মাঝির হাত পা খুলে,
ও গান গাইতে দাঁড় টানুক

.                *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
ইতস্তত ঘোরার গল্প    
কবি মৃত্যুঞ্জয় সেন

কোথায় লুকানো আছে অস্ত্রশস্ত্র, গভীর বঞ্চনা
কোন্ মাঠে দৌড়াতে হয় শীর্ষ পদকটির জন্যে,
প্রেমের নকশা আঁকতে গেলে কি রঙ কোথায় লাগে,
লোডশেডিং থেকে বাঁচার জন্য কে কি বলছে---
এ সবই মনে রাখতে হয়, রাখিও। তাই একরাশ ভাবনা আসে,
রাত জেগে মেলাতে থাকি,
কে কি বলেছিলেন, কাকে কি বলতে হবে,
কি কি করতে হবে, কখন কবে

শহর থেকে বনে, বন থেকে জঙ্গলে, শ্মশান থেকে বাড়ী,
সিগারেট থেকে মদ, মদ থেকে স্বপ্নে,

এর মাঝে লিণ্ডসে স্টীটে নৈশ পাহারাদারকে ধরলাম
একাডেমী পুরস্কার প্রাপ্ত কবিকে পাকড়াও করলাম
চুরুটসেবী যতীনবাবুকে বললাম
মরা মানুষের খাটিয়াতে চড়লাম
মাও মার্ক্স পড়লাম
সুন্দরীদের বাগান থেকে কমলালেবু পাড়লাম
ইতস্তত ঘুরলাম
এক নম্বর গেট, দশ নম্বর দরোজা, দক্ষিণে-পশ্চিমে
সর্বত্রই দেখলাম,
মানুষ মানুষকে টুকরো টুকরো অহঙ্কার বিলোচ্ছে

.                *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
দ্বিতীয় প্রার্থনা    
কবি মৃত্যুঞ্জয় সেন

নির্জন নদীঘাটে নৌকা বাঁধা দেখলেই
আমি একটা ছোট্ট ভ্রমণ
.                      সেরে নিই
ত্রস্ত কোনো বাদামী হরিণ দেখলে
আমি বুঝতে পারি জীর্ণ সাঁকোয়
.                দাঁড়ানো মানুষের গভীরতা ;
ধূসর মেঘে সেঁটে দেয়া কোনো পাখি দেখলে
আমি মাস বছর যুগ অতিক্রান্তের
.                হিসেব করতে বসি
কাউকে যৌবনের রামায়ণ নাড়াচাড়া করতে দেখলে
আমি জন্ম মৃত্যুর শন্ শন্ শব্দ
.                শুনতে পাই,
কোনো প্রবাদ পুরুষের দেখা পেলে
প্রশ্ন করে ফেলি, সব ছেড়েছুড়ে কতক্ষণ
.                আর বেহালা বাজাবেন

এসব স্বপ্নের তোরঙ্গে রাখা অপারগ গান
ঘষা কাচের ওপিটে ঝলসানো চোখ দেখে
.                অন্ধ সিরদাসের দ্বিতীয় প্রার্থনা।

.                *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
রূপান্তর   
কবি মৃত্যুঞ্জয় সেন

বয়সের সঙ্গে সন্ধি করি
জীবনকে ছোঁয়ার জন্যে
দিন চলে যায়
রাত আসে
দিন আসে না

.   *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
সুন্দরবনের গল্প    
কবি মৃত্যুঞ্জয় সেন

কাহাক স্ত্রী কাহার সাথে পালাইয়া যায়
জানিতাম না, জানাইত সুবল
কোন্ জমিতে কত ফসল ফলে
জানিতাম না, জানাইত সুবল
বৃষ্টিতে কাহারা ঠাঁইহীন
জানিতাম না, জানাইত সুবল
গোপন বেদনায় কাহাকে আত্মহত্যা করিতে হইল
জানিতাম না, জানাইত সুবল
কেন বাঘের পেটে সুবল যাইল
জানিতাম, বলিতে পারি না

.   *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
ওখানে কেরে    
কবি মৃত্যুঞ্জয় সেন

তুই বলেছিলিস আমার বুকে আসে সমুদ্রের বাতাস
ছিন্নভিন্ন করে দিতে পারবো যে কোন বর্ণাঢ্যবাগান
যদি সে গোলাপ ফোটাতে ব্যর্থ হয়
আমার বাহুতে আছে হাজার বজ্রের শক্তি
যে কোন শিল্পের প্রদর্শনী কাঁপিয়ে দিতে পারবো
যদি সে শয়তানের হৃদয়ে ভালোবাসার বীজ বুনতে না পারে
যদি সে মাতাল মনের ভালোবাসার দরোজা খুলে না দেয়
তুই বলেছিলিস আমার হৃদয়ে আছে সহস্র যোজন পথ
সে যে কোন স্বর্গের দিকে সকলকে পৌঁছে দিতে পারে

এখন তুই তোর বুড়ো আঙুল মুখে ঢুকিয়ে বসে আছিস
স্নান সেরে কাপড় পরতে-ই ভুলে গেছিস
তোকে আর কি বলবো!

বেড়ালোর এঁটো এখন জড়ো করার কাল
কোথাও আনন্দের কথা শুনলে
আমার গা বিরমি বিরমি করে
আমার তখন দারুণভাবে ভিজতে ইচ্ছা করে

দাঁড়া, ওখানে কেরে
এসব কথা শুনছিস
আর দেয়ালে সময়ের অনভ্যস্ত দাগ কাটছিস

.   *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
কলম্বাসের ভূগোল    
কবি মৃত্যুঞ্জয় সেন

উত্তাল সমুদ্র নয়, আছে আলোর দেশ কোথাও
.                আছে মুক্তিদাতা বুক পলাশ রঙের মত---
এসব কলম্বাসের পাহাড়-চূড়ো ধ্যান ; কলম্বাসের কোন
দরোজা নেই, জানালা নেই
কলম্বাস যুগ যুগ ধরে ভ্রমণ-উট হয়ে যাযাবর।

দ্যুলোকে ভূলোকে উপচে উঠলো কত
রগড়ে চারিপাশ দেখা হলো
চমকলাগা বলিদ্বীপের মেয়ে, শোনা হলো
উদ্বোধন-মন্ত্র, ফেরিওয়ালার বাউল গান ;
মিললো না সেই ডানামেলা ক্যারাভান, এ দিগন্তে, ও দিগন্তে।
কলম্বাস, এ সময়ে তুমি কোথায় ?
তুমি কি পথ হারাইয়াছো ?

আকাশবাণী কলকাতা, খবর পড়ছি দেবদুলাল বন্দ্যোপাধ্যায়। কলমবাসকে
ঘিরে রহস্য ঘনীভূত হচ্ছে। তিনি এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেছেন, পৃথিবী
তো গোল নয়, সহযোগিতার হাতের মত দীর্ঘ। অমল বিমল কমল এবং . . .
এর জগৎ থেকে হিস্তৃত। কারণ বহুদিন হলো আমরা যাত্রা করেছি, এখনো
তীরভূমির দেখা পেলাম না, পৌঁছানো গেলো না এখনো ওপারের কোন
শস্যক্ষেতে। তিনি বলেছেন, পৃথিবী সন্ন্যাসীর কমণ্ডুলুর মত সুদীর্ঘ। আমরা
যেখান থেকেই শুরু করি না কেন পুনরায় ফিরে আসতে পারি না সেখানে।

.                          *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর