ওদের তো দুঃখ নেই ? তুমি কেন দুঃখ শব্দ বলো ?
এই দ্যাখো পথপ্রান্তে ঘনশ্যাম শোভন বনানী
প্রান্তরের বুক ঢেকে ইতস্তত বকুলজারুল
এদেরও শ্রাবণ মাসে কোনো দুঃখ নেই |
তোমারও যৌবন, কন্যা, পল্লবিত, দর্পিত, সবুজ
তুমি ক্লান্তিহরা হও ; শ্যামচ্ছায়া, স্বপ্নিল, শীতল----
পথিককে ছায়া দাও |
গাছের কি ক্লান্তি আছে ? গাছ শুধু আশ্রয় সাজায় |
তুমি তরুর মতো, তুমিও তৃণের মতো হও |
. দুঃখ শুধু পুরুষের ক্ষত----
তুমি তাতে যৌবনের প্রলেপ লাগাও |
যুবতী নারীর ওষ্ঠে ‘দুঃখ’ শব্দ মানায় না বস্তুতঃ
ও বড়ো কঠিন শব্দ, ওতে দাবী শুধু পুরুষের
তোমরা তো সুখ নেবে, সুখ দেবে, সুখের পসারী
সমর্থযৌবনা বরনারী
রৌদ্র জল বায়ু মাটি শূন্যের সমান দরকারী----
সুন্দরী, মোহনবাঁশি ওষ্ঠাধর রুক্ষ অভিযোগে
গরীব দুঃখীর মতো দীনহীন বিবর্ণ কোর না,
ওই আলোচনা থাক | ওসব সংসারী শাড়ি খুলে
এখানে সন্ধ্যায় এসো পাতা, পাখি, নদীর মতন
তোমরা কবিতা হবে, তোমারই কবির সম্পদ
অমন তীব্রতা কেন, চোখে-মুখে মেঘছায়া কই ?
দৃষ্টিতে মদিরা ঢালো,
পিপাসার্ত অঞ্জলি পেতেছে, বেলা যায়,
ওসব অপ্রিয় কথা এ সন্ধ্যায় নয় প্রিয়সখী,
গার্হস্থ্য প্রমাদগুলি কবি নয় গৃহস্থকে বোলো---
আজ শুধু স্তুতি হোক যৌবনের, শ্রাবণসন্ধ্যায়
তোমার আধখানা সোনা,
এমনই রহস্যময়ী হয়ে থাকো মৌন নীলিমায়
চোখে চোখে কথা হোক মন-গড়া দ্বীপে,
কবিতে এবং কবিতায় |
. *************************
. সূচিতে...
মিলনসাগর
প্রথমেই সিধে ওঠে না, গোড়ায় একটু আঁকেবাঁকে
তাল নারকেল খেজুর টেজুর দু-একখানা
পামজাতীয় একলসেঁড়ে উচ্চাকাঙ্ক্ষী
উদ্ভিদ্ ভিন্ন | কিন্তু
তাদের শেকড়গুলো নেড়ে চেড়ে দেখেছেন কি ?
বলুন তো মাটির নিচে গিয়ে
তাদের সোজাসুজির জারিজুরি খাটে কিনা ?
উঁহু, সেখানে তেনাদের ভেন্ন মূর্তি !
নদীর কথা বাদই দিচ্ছি---
এই আমাদের মহদাশয় সমুদ্রের কথাটাই ধরুন,
একখানা ঢেউও কি সে সিধে পাঠায় ?
আর এই যে পূজ্যপাদ হিমালয়
তাঁর কোন্ খানটা সোজা মশাই ?
তুচ্ছ বাতাস, ঈশ্বরের ফুঁ-----
সেও খুব সোজা ধায় কি,
ক্ষণে ক্ষণে দিক্ পালটায় |
আমি সামান্য মানুষ
আমি কি করে সোজা বলব,
সোজা চলব ? হাঁটতে গেলেই
ডান পাটা একটু ডাইনে হেলে পড়ে
বাঁ পা-খানা বাঁয়ে হেলে যায়
সেই ছেলেবেলা থেকে
ঢের চেষ্টা করে দেখেছি মশাই
কিছুতেই নাকের সোজা হাঁটতে পারিনে |
একে কি আপনি ভন্ডামি বলবেন ?
আমাকে কি বলবেন
দুমুখো সাপ ?
দেখুন দাদা
দুটো জিনিস কেবল সোজাসুজি চলে :
-----আকাশ ফুঁড়ে বিষ্টি
-----আর চক্ষু ফুঁড়ে জল |
আর, একখানা কথাই কেবল
সোজাসুজি বলা যায় :
-----মিথ্যে |”
. *************************
. সূচিতে...
মিলনসাগর
দারুণ আশ্চর্য হন : ‘এ আবার কোথা
থেকে এলো ? এতো হাসিখুশি প্রাণী
আমিই কি গড়েছি কখনও ? আমি নইলে
এই মেয়ে কার হাতে গড়া ?’ আশ্চর্য,
কি মাত্সর্য, তা ঈশ্বরই জানেন |
যখনই আমাকে তুমি ভালোবাসো
( হা ঈশ্বর ! ) এমনকি ঈশ্বরও ? যখনই
আমাকে তুমি | যখনই | আমাকে |
২
ভালোবাসা, তুমি কেবলি কি গাঢ় দুঃখ
কেবলি কি নীল রক্ত জমাট ললাটে
ভালোবাসা, তুমি শির-ছেঁড়া স্রোত, উষ্ণ
এসো ভালোবাসা, তবুও দাঁড়াও কবাটে |
তবুও তোমারি জন্য আগল মুক্ত
তবুও তোমারি জন্য সাজানো শয্যা
এসো ভালোবাসা , কুক্ রি চালাও শিরাতে
কৃপণের মতো কী হবে জমিয়ে লজ্জা ?
ঝরে যাক কিছু উষ্ণতা বড়ো রাস্তায়
নর্দমাক্ত কর্দমাক্ত রক্তে
লেগে থাক কিছু প্রামাণ্য শেষচিহ্ন
তোমারই ত্রস্ত অবিশ্বস্ত ভক্তের |
৩
যদি চেয়ে থাকি কিছু ছায়া, কিছু স্পর্শ
যদি চেয়ে থাকি কিছু উষ্ণতা নয়নের---
যদি চেয়ে থাকি কিছু তারল্যদীপ্ত
মৃদু মুহূর্ত, নক্ষত্রের আলোতে----
থাকতেই পারে এতটুকু চাওয়া ন্যায্য
মৃত্যুর কাছে পাওনা জীবত্কালটার
কতই তো কিছু ঘটে চলে নিতিনিত্য
যা চাওয়ার কথা কখনো ভাবোনি স্বপ্নেও
যদিও জানো না আপ্রভাত নিশিলগ্নে
কখন কী ঘটে কে আসে কে যায় জীবনে
যার দ্বারে গিয়ে ভেবেছিলে নেবে ভিক্ষে
সে এসে দাঁড়ায় বাটি-হাতে দোরগোড়াতে !
তবুও তো চাই কিছু কিছু জিৎ ইচ্ছের ?
চাইবো তো কিছু জন্মান্তরী স্পর্শ ?
আছে ইন্দ্রিয় যতদিন, থাক্ তীব্র
তৃণের সঙ্গে সূর্যকরের সাক্ষাৎ---
৪
‘ভালোবাসা, তুমি সুদূর শঙ্খচিল’----
বলে কেউ তোকে উড়িয়ে দিয়েছে আকাশে
‘ভালোবাসা, তুমি দাঁড়ে বসা কাকাতুয়াটি’
বলে কেউ তোকে শে কলে বেঁধেছে দালানে
‘ভালোবাসা ,তুমি বহুকাল গৃহহারা’
বলে কেউ তোকে তাড়িয়ে দিয়েছে রাস্তায়
ভালোবাসা তুমি কবিদের কথা শুনো না
এসো ভালোবাসা, পা ধুয়ে বোসো এ পিঁড়িতে
এখানে তোমার চেনা ভিটে সাতপুরুষের |
৫
ভালোবাসা, তুমি ছিলে বটে অদ্বিতীয়
ছিলে বটে রাজা, প্রবলপ্রতাপ সম্রাট---
এখন তোমার মাথাটা গিয়েছে বিকিয়ে---
ল্যাংটার নেই বাপপাড়ে ভয়, জানো তো !
এসো ভালোবাসা, বোসো এইখানে সোফাতে-----
চা খাবে ? পাখাটা বন্ধ করে দি ? জানালা ?
শরীর গতিক ভালো তো ? চাকরিবাকরি ?
তারপর ? বড়ো শীত পড়ে গেল অকালে |
৬
আমার চাওয়া কি তবে খুব বেশি ছিল ?
চেয়েছি কেবল দুটি চোখ, আর কিছু নয়
ভোর নয়, সন্ধ্যা নয়, মধ্যরাত্রি নয়----
অন্নবস্ত্র ছাদ নয় স্মরণ মনন কিছু নয়
মুহূর্তের মনোযোগ, পরের মুহূর্তে মুছে যাওয়া----
মাত্র এই---- আমার চাওয়া কি তবু
খুব বেশি ছিল ?
. *************************
. সূচিতে...
মিলনসাগর
ভীষণ তর্জনী তুলে সংস্কার গড়েছে সংঘাত |
এবার হয়েছি স্বস্থ, সম্পূর্ণযৌবনা রাজনারী
হয়েছি পুত্রের মাতা, আত্মনিষ্ঠ, স্বপুণ্যে সবল-----
এবার পুরাও তৃষ্ণা, হে বরদ ! এসো হে ধ্বন্তারি
--আর ভাসাবো না জলে পুণ্যলব্ধ জরায়ুর ফল !
হে কাশ্যপ, মহাদ্যুতি, পুনর্বার প্রণতি তোমায়
অগ্নিবর্ণ, তেজোময়, সর্বপাপঘ্ন পুত্র চাই !
. *************************
. সূচিতে...
মিলনসাগর
. মাথার উপর ছত্র ধরে এই বোশেখের
. আগুন ঢাকছে ? এই মাঠটা, ওই গাছটা ?
. আগের মতন ? ওরা ভাবছে-----“
খ------ “ওরাই জানে | এই ঘাসেরা, এই পাতারা----
. অবাধ্য এক পাগলা সেপাই বুকের মধ্যে
. তেমনি খাড়া | ডিউটি খতম্ পয়সা হজম
. পাগলা তবু নেয় না ছুটি, যায় না বাড়ি,
. দেয় পাহাড়া | ঝম্ ঝমাঝম্ বাজিয়ে লাঠি
. গৃহস্থদের নিচ্ছে সাড়া | ক্লান্তিহারা |”
ক----- “পাগড়ী মাথায়, দুই পায়ে বুট, ঠুকছে লাঠি, ঠুকছে লাঠি,
. পরের সেপাই কখন্ হাজির পাগলা তবু নেয়না ছুটি
. যায় না বাড়ি কেবল হাঁটে প্রহর হাঁকে | এ এক জ্বালা |”
খ------ “বুকের মধ্যে দুই সেপাইয়ের অনাদ্যন্ত সে-পায়চারী
. গেরস্তকে জাগিয়ে রাখার মরণ বাঁচন সেই প্রণালী
. ওরাই শুধু শুনতে জানে, ওই ঘাসেরা, ওই পাতারা |”
ক ------- “তুমিই বলো, ভুল শুনেছে ? সিঁড়ির মাথায় সেই
. লন্ঠন জ্বলছে না কি ? সারাটা রাত, সারাজীবন ,
. আজও তেমন, তারার মতন ? তুমিই বলো, জ্বলছে না কি ?”
খ-----------“ আমি তো ঠিক আগের মতন ঘরভরা লোক তবু আমার
. নিজস্ব সেই একলা চোখে তোমার দিকে আজও তেমন
. মরণবাঁচন তাকিয়ে থাকি | সেই তাকানো তোমার বুকে
. যায় কি না-যায়, এই ঘাসেরা এই পাতারা ঠিক
. দেখে নেয় | তুমিই বলো, ভুল দেখে কি ?”
ক--------- “তোমার পায়ের শব্দ আজো তেমনি করেই
. বুকের মধ্যে শালপিয়ালের চাঁদনী রাতের আদুড় মাঠের
. রাতপাখিদের কান্না বাজায়----- রাত্রি ভরে |
. শুনতে তুমি পাও বা না পাও এই পাতারা
. এই ঘাসেরা ঠিক শুনে নেয় | তুমিই বলো, ভুল শোনে কি ?”
খ -------- “বুকের মধ্যে পাগলা সেপাই
. পায়ের তলায় এই ঘাসেরা-----“
ক--------- “মাথার ওপর সেই পাতারা
. তার ওপর ঐ সন্ধ্যাতারা-----“
খ------- “ভাবছে বুঝি আগের মতন আজও তেমন----“
ক--------- “ভুল ভাবে কি ?”
খ--------- “তুমিই বলো ?”
ক-----------“ তুমিই বলো !”
. *************************
. সূচিতে...
মিলনসাগর
ওই ওষ্ঠে, ও-অধরে,
ও কী উচ্চরণ করো
ওসব পারি না শুনতে
চিনি-আলু-কেরোসিন-
এ-সবই বাস্তব, কিন্তু
কতকাল পরে দেখা,
উদ্বেগ-উত্কন্ঠা নিয়ে
পশ্চিমের আলো এসে
সোনার সীতার মতো
প্রসঙ্গ বদল করো, এ
তার চেয়ে এসো হাতে
ওই দ্যাখো সূর্য ডোবে
আকাশের নীবিবন্ধে
ঝুমঝুম ঝাঁক বেঁধে না
কোথায় যাত্রার শুরু
কী হবে ওসব ভেবে,
সূর্য, নদী, বলাকার স
তোমরও নয়নভঙ্গে
উচ্চারণ
নবনীতা দেব সেন
কোয়ো না |
উল্টো-সোজা
নবনীতা দেব সেন
ভালোবাসা
নবনীতা দেব সেন
১
ধ্বান্তারিং সর্বপাপঘ্নম্
নবনীতা দেব সেন
দুই গৃহস্থ, পাগলা সেপাই
নবনীতা দেব সেন