কবি নন্দলাল বসু - জন্মগ্রহণ করেন বিহারের মুঙ্গের জেলার হাভেলি খড়গপুরে। পিতা পূর্ণচন্দ্র বসু
এবং মাতা ক্ষেত্রমণি দেবী। পিতা ছিলেন দারভাঙ্গা মহারাজের খড়গপুর তহশিলের ম্যানেজার। নন্দলাল
ছিলেন পাঁচ ভাইবোনের মধ্যে তৃতীয়। তিনি নাকি তাঁর মার কাছ থেকেই তাঁর শিল্পীসত্তা পেয়েছিলেন।
শৈশব থেকেই তিনি দুর্গা, গণেশ, হাতি, ষাঁড় প্রভৃতির মূর্ত্তি বানাতে শুরু করেন, বিভিন্ন উত্সব ও মেলায়
প্রদর্শনের জন্য। রঙীন ছবির প্রতি তাঁর এত আকর্ষণ ছিল যে তিনি তাঁর পড়ার বইয়ের মধ্যে রঙীন ছবি
খুঁজে বেড়াতেন। স্কুলে নোট লেখার বদলে তিনি একমনে ছবি আঁকতেন।

১৮৯৭ সালে ১৫ বছর বয়সে তাঁকে কলকাতায় পাঠানো হয় পড়াশোনা জন্য। প্রথমে ভর্তি হন সেন্ট্রাল
কলেজিয়েট স্কুলে। পরে ভর্তি হন জেনারেল অ্যাসেমব্লি কলেজে, এফ. এ. ( ফার্স্ট আর্টস ) পরীক্ষার জন্য।
কিন্তু তাঁর মন থাকতো ছবি আঁকার দিকে। তাই এফ.এ. পরীক্ষায় কৃতকার্য হতে না পেরে ভর্তি হন
মেট্রপলিটান কলেজে। এবারেও তাঁর পাশ করা হয়ে ওঠেনি।

১৯০৩ সালে তাঁর বিয়ে হয় সুধীরা দেবীর সঙ্গে, যাঁর বয়স তখন ছিল মাত্র ১২ বছর। ১৯০৭-০৮
 সালে
তাঁদের প্রথম সন্তান, গৌরী দেবীর জন্ম হয়। ১৯০৫ সালে তাঁর শশুর মশায়, প্রকাশচন্দ পালের কথামত তিনি
কমার্স পড়বার জন্য ভর্তি হন প্রেসিডেন্সী কলেজে। এখানেও তিনি পড়ায় মন দিতে পারতেন না তাঁর ছবি
আঁকার জন্য। এই সময়ে তিনি তাঁর এক ভাই অতুল মিত্রের কাছ থেকে মডেল ড্রইং, সস পেইনটিং ইত্যাদি
শিখতে লাগলেন। তিনি ইউরোপীয় পেইনটিংও আঁকার চেষ্টা করতেন যার মধ্যে ইউরোপীয় শিল্পী
রাফায়েলের বিখ্যাত ছবি “ম্যাডোনা” উল্লেখযোগ্য। ভারতীয় শিল্পী রাজা রবি ভার্মার ছবির দ্বারা প্রভাবিত
হয়ে তিনি আঁকলেন “মহাশ্বেতা”। এমনি সময়ে তাঁর, শিল্পাচার্য
অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ছবি দেখার সুযোগ
আসে। অবনীন্দ্রনাথকেই গুরু মেনে তাঁর মত ছবি আঁকায় মন দেন। একদিন তাঁর আঁকা কিছু ছবি
 নিয়ে,
বন্ধু সত্যেনকে সঙ্গে করে, দেখা করেন অবনীন্দ্রনাথের সঙ্গে। সেই সাক্ষাত্কারের সময় সেখানে উপস্থিত
ছিলেন কলকাতার গভমেন্ট আর্ট কলেজের অধ্যক্ষ ই.বি. হাভেল। তাঁর আঁকা ছবি দেখে সবাই বিস্মিত হন।
অবনীন্দ্রনাথ নন্দলাল বসুকে শিষ্য করে নেন। শুরু হয় সুদীর্ঘ গুরু-শিষ্য পরম্পরা।  

শুরুতে তাঁর শিল্প-শিক্ষা গুরু ছিলেন হরিনারায়ণ বসু এবং ঈশ্বরী প্রসাদ। পরে
অবনীনদ্রনাথ তাঁর আঁকা-
শেখার ভার নিজের হাতে তুলে নেন। নন্দলাল প্রায় পাঁচ বছর অবনীন্দ্রনাথের কাছে শিক্ষা গ্রহণ করেন।
তিনি এবং সুরেন্দ্রনাথ গাঙ্গুলী, এই দুইজনই ছিলেন অবনীন্দ্রনাথের মন্ত্রশিষ্য। একথা অবনীন্দ্রনাথ নিজেই
স্বীকার করে গেছেন।

নন্দলাল বেতাল পঞ্চবিংশতীর গল্পের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলেন। সেখান থেকে তিনি আঁকেন “সতী”। ১৯০৭
সালে “দ্য ইন্ডিয়ান সোসাইটি অফ ওরিয়েন্টাল আর্ট” প্রতিষ্ঠিত হয়। তাঁরই একটি প্রদর্শনীতে নন্দলাল তাঁর
ছবি “সতীর চিতায় আরোহণ” প্রদর্শিত করেন। তিনি ৫০০ টাকার একটি পুরস্কারেও ভূষিত হন। এই টাকা
দিয়ে তিনি শিল্পী প্রিয়নাথ সিংহের সঙ্গে বেরিয়ে পড়েন ভারত-ভ্রমণ করতে। ঘুরে দেখেন গয়া, বারাণসী,
আগ্রা, দিল্লী, মথুরা ও বৃন্দাবন। তিনি চাইতেন যে তাঁর ছবি আপামর জনসাধারণের ঘরে শোভা পাক। তাই
তিনি ছবি এঁকে এঁকে তা মাত্র চার আনায় বিক্রী করতে শুরু করেন বানুপুরে। এই খবর পেয়ে অবনীন্দ্রনাথ
স্বয়ং বানুপুর গিয়ে সব ক’টি ছবিই কিনে নেন।

অবনীন্দ্রনাথ প্রমুখদের শুরু করা, কলকাতা ও শান্তিনিকেতন কেন্দ্রিক “বেঙ্গল স্কুল অফ আর্টে”-এর নন্দলাল
বসু ছিলেন এক বিশিষ্ট শিল্পী।

অবনীন্দ্রনাথ এবং ই.বি. হাভেল ছাড়াও, স্বামী বিবেকানন্দের মন্ত্রশিষ্য ভগিনী নিবেদিতার দ্বারাও তিনি
প্রভাবিত হয়েছিলেন। ভগিনী নিবেদিতা, আচার্য জগদীশচন্দ্র বসুর সঙ্গে কলকাতায় এসে নন্দলালের ছবি
দেখেন এবং তাঁকে অজন্তার গুহা-চিত্র আঁকার পরামর্শ দেন। সেই কথামত নন্দলাল, লেডি হ্যারিংটন, শিল্পী
অসিতকুমার হালদার ও সমরেন্দ্র গুপ্তর সঙ্গে মিলে গোয়ালিয়র গিয়ে অজন্তার গুহাচিত্র আঁকার কাজ সম্পন্ন
করেন। ভগিনী নিবেদিতার মৃত্যুতে নন্দলাল বলেছিলেন যে তিনি অভিভাবকহীন হলেন। ভগিনী নিবেদিতাই
তাঁকে রামকৃষ্ণ পরমহংস এবং
স্বামী বিবেকানন্দকে চিনিয়েছিলেন।

রবীন্দ্রনাথও নন্দলালকে নানাভাবে প্রভাবিত করেছিলেন। নন্দলাল রবীন্দ্রনাথের বহু বইয়ের প্রচ্ছদ ও
অলঙ্করন করে দিয়েছিলেন, যার মধ্যে আপামর
 বাঙালীর অতি পরিচিত এবং প্রিয় “সহজ পাঠ”-এর  
বইগুলি। নন্দলাল ১৯২২ সালে শান্তিনিকেতনের কলাভবনের অধ্যাক্ষ পদে বহাল হয়েছিলেন। তিনি
রবীন্দ্রনাথের বিভিন্ন নাটকের মঞ্চসজ্জা করে দিতেন। ১৯২৪ সালে তিনি রবীন্দ্রনাথের সঙ্গে চীন, জাপান,
মালয় ও বর্মা ভ্রমণ করেছিলেন। ১৯৩৪ সালে তিনি
রবীন্দ্রনাথের সাংস্কৃতিক দলের সঙ্গে সিলোন (শ্রীলঙ্কা)
ভ্রমণ করেন। এখানে উল্লেখযোগ্য এই যে রবীন্দ্রনাথ সেবার সদলবলে শ্রীলঙ্কার তালাইমান্নার থেকে
ভারতবর্ষের ধনুষ্কোডিতে ফিরেছিলেন একটি যাত্রিবাহী স্টীমারে করে। এই ওয়েবসাইট, “মিলনসাগর”-এর
 
পরিচালক মিলন সেনগুপ্তর সৌভাগ্য হয়েছিল ১৯৮৬ সালে সেই জাহাজটিতেই চীফ ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ
করার।

নন্দলাল বসুর মধ্যে স্বদেশী ভাবনা ছিল পুরো মাত্রায়। ১৯৩০ সালে ডাণ্ডি লবন আন্দোলনে গান্ধীজীর
গ্রেপ্তারের পরে নন্দলাল সাদা-কালোয় চলমান গান্ধীজীকে এঁকেছিলেন লাঠি হাতে, যা কিনা অহিংস-
আন্দোলনের আইকনে পরিণত হয়। ১৯৩৭ সালের জাতীয় কংগ্রেসের হরিপুরা সমাবেশের
 যাবতীয়
পোস্টার তিনি গান্ধীজীর অনুরোধে এঁকে দিয়েছিলেন।

স্বাধীনতার পরে প্রথম প্রধানমন্ত্রী জহরলাল নেহেরুর অনুরোধে, নন্দলাল তাঁর ছাত্রদের নিয়ে ভারতীয়
সংবিধানের অলঙ্করণ করে দিয়েছিলেন, এঁকে দিয়েছিলেন ভারতরত্ন এবং পদ্মশ্রীর মত ভারত সরকারের
বিভিন্ন পুরস্কারের নকশা।

দিল্লীর ন্যাশনাল গ্যালারি অফ মডার্ন আর্টে নন্দলাল বসুর ৭০০০ কাজ সংরক্ষিত রয়েছে। ১৯৫৪
 সালে
ভারত সরকার তাঁকে পদ্মবিভূষণে ভূষিত করে। বিশ্বভারতী তাঁকে “দেশীকোত্তম” উপাধিতে ভূষিত করে।
কলকাতার অ্যাকাদেমি অফ ফাইন আর্টস তাঁকে রজত জয়ন্তী পদকে সম্মানিত করে। ১৯৬৫ সালে তিনি
এশিয়াটিক সোসাইটি অফ বেঙ্গল থেকে পান “দ্য ট্যাগোর বার্থ সেন্টেনারি মেডেল”।

নন্দলাল বসু যে পরিবেশ এবং যে সব মানষের সংস্পর্শে সারা জীবন কাটিয়েছিলেন, তাতে
 আমরা
আশ্চর্যই হতাম যদি তিনি একটিও কবিতা না লিখতেন। কবি
নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী ও কবি সরল দে
সম্পাদিত “পাঁচশো বছরের কিশোর কবিতা” সংকলন থেকে আমরা
মিলনসাগরে  কবি নন্দলাল বসু রচিত
একটি কবিতা পেয়ে এখানে তুলে দিতে পেরে ধন্য বোধ করছি।

উত্স - http://en.wikipedia.org/wiki/Bengal_School_of_Art     
.              
http://en.wikipedia.org/wiki/Nandalal_Bose     
.              
http://www.bdbiography.com/Nandalal-Bose.php      
  

কবি নন্দলাল বসুর মূল পাতায় যেতে এখানে ক্লিক করুন।    


আমাদের ই-মেল -
srimilansengupta@yahoo.co.in     


এই পাতার প্রথম প্রকাশ - ১২.১.২০১৪  

...