কবি নরবাহাদুর লামা-র জন্ম ৭ই অক্টোবর ১৯২৯ সালে | জন্মস্থান দুগুনা গ্রাম, পোঃ তোপানী
ভানসার, ছোটথানা - কোদারি আড্ডা, জেলা- চৌতারা আড্ডা , ১নং পূর্ব নেপাল | তার পিতার নাম স্বর্গত
গেলুং লামা এবং মাতার নাম স্বর্গতা কাসাংমুলমিনী | কবির ছোটবেলার নাম ছিল মিংমা ছিরিং |
কবির ঠাকুরদা ও বাবা-কাকারা সেখানকার সম্ভ্রান্ত জোতদার ছিলেন | সেই সময় গোটা নেপাল রাষ্ট্রেই
একটাও পাঠশালা ছিল না | যার জন্য সমগ্র নেপালবাসী অশিক্ষিত, নিরক্ষর ছিলেন | ঠিক এই সময় একজন
রাজপুত ভারতে এসে লেখাপড়া শিখে নেপালে ফিরে গিয়ে সেখানে লোক ঠকানোর ব্যবসায় নামে | কবির
ঠাকুরদার নিরক্ষরতা ও সরলতার সুযোগ নিয়ে সুকৌশলে সাদা কাগজে টিপ সই নিয়ে, কয়েক লক্ষ টাকা
মিথ্যাদেনার দায়ে, কোটি টাকার স্থাবর-অস্থাবর সম্পত্তি ৬০-৭০ জন গুন্ডার সাহায্যে জোরপূর্বক লুটে
নিয়ে গিয়ে কবির পরিবারকে পথের ভিখারী করে দেয় | তাই নিজেদের জীবন রক্ষার তাগিদে, গোটা
পরিবার ছিন্ন-ভিন্ন হয়ে যায় |
কবি নরবাহাদুর লামা ৮ বছর বয়সেই গৃহত্যাগ করেন, কয়েক বছর চরম কষ্টে কাটানোর পর ১৯৪৪ সালে
দার্জিলিং-এ আসেন এবং সেখানে নানান প্রতিকুলতার মধ্যেও নেপালী ভাষা লিখতে ও পড়তে শেখেন |
সেখান থেকে ১৯৪৬ সালে পি. গুরুং নামে একজন ফুড্ ডিপার্টমেন্টের ল্যান্ড পেট্রোল অফিসারের বয়ের
কাজ নিয়ে শিলিগুড়িতে আসেন | এরপর ১৯৪৮ সালে শ্রী রবীন ক্ষেত্রী মহাশয়ের প্রচেষ্টায় ফুড ডিপার্টমেন্টের
ল্যান্ড-পেট্রোলম্যানের চাকুরি পান | বদলি হয়ে তিনি যে ক্যাম্পে গেলেন সেখানে অফিসার হিসাবে
পেয়েছিলেন যশোহর নিবাসী শ্রী অশ্রুকুমার মিত্র মহাশয়কে | কবি, অফিসার মিত্র মহাশয়ের কাছে ৫ মাস
বাংলা ও ইংরাজী ভাষায় লেখাপড়া শেখার সুযোগ পেয়েছিলেন |
কবি ১৯৫০ সালে বালুরঘাটে পুলিশে যোগদান করেন | ব্যারাকপুর থেকে ট্রেনিং শেষ করে আবার বালুরঘাট
পুলিশ লাইনে আসেন | সারাদিন সরকারী ডিউটি সেরে অবসর সময়ে একজন সিনিয়র শিক্ষিত সহকর্মী শ্রী
বিজয় রায়ের কাছে বাংলা ও ইংরাজী শিখেছিলেন মাসিক ৩০ টাকার বিনিময়ে | কিন্তু ১মাস পরেই শ্রী
বিজয় রায় আই বি তে বদলী হয়ে গেলেন যথারীতি কবির পড়াশুনায় দাঁড়ি পরল | কবি কিন্তু এখানেই থেমে
থাকেন নি | নিজের প্রচেষ্টায় অক্লান্ত পরিশ্রম করে তিনি বাংলা ভাষার চর্চা করে গেছেন |
১৯৫২-৫৩ সালে সহকর্মী বন্ধু বাঁকুড়া জেলা নিবাসী শ্রী সনাতন সরদারের কাছে বাংলা কবিতার বিষয়ে জ্ঞান
অর্জন করেন এবং তারই প্রেরনায় ১৯৫৫-৫৬ সালে বাংলা কবিতা লেখা শুরু করেন | এরপর কবি নিজের
চেষ্টায় ফটোগ্রাফি শিখতে শুরু করেন | জেলা পুলিশের নানা রকম প্রয়োজনীয় ফটোর কাজ কবি করে
দিতেন | ফটোগ্রাফীর কাজ করে তিনি পুলিশ অফিসারদের কাছ থেকে প্রভুত সন্মান পেয়েছিলেন | ১৯৬৫
সালে আন্তর্জাতিক পুলিশ ফটোগ্রাফী প্রতিযোগিতায় টোকিও (জাপান) থেকে সান্ত্বনা পুরস্কার পান | এরপর
১৯৬৭ সালে সি. আই. ডি ফটো সেকশনের অফিসার ইনচার্জ মাননীয় ডি. পি. রায়ের কাছ থেকে প্রশংসাপত্র
পেয়েছিলেন | কবি ১৯৬৫ সালে , সি আই ডি অফিসে ইনডোর টুর্নামেন্টে জাতীয় দাবা এবং অকশন ব্রীজ
প্রতিযোগিতায় চাম্পিয়ন হয়েছিলেন |
নেপালী ভাষীর মানুষ হয়েও বাংলা ভাষায় কবিতা লিখে তিনি কবি হিসাবে অনেক সন্মান পেয়েছেন |
বিশ্বজননী মাদার টেরেজার আশীর্বাদ, আশাপূর্ণা দেবীর মত মহান লেখিকার আশীর্বাদ ও শুভেচ্ছাবার্তা,
বাবা সাহেব ডঃ আম্বেদকর ফেলোশিপ পুরস্কার | আশাপূর্ণা দেবী কবির প্রথম কাব্যগ্রন্থ “শান্তির কবচ”
(১৯৮৬) -এর ভূমিকা লিখেছিলেন | ১৯৯০ সালে আন্তর্জাতিক নজরুল সেন্টার থেকে আন্তর্জাতিক নজরুল
পুরস্কার পান | ১৯৯৮ সালে অল ইন্ডিয়া মুসলিম আকাডেমির পক্ষে একাডেমি সন্মান পান | পশ্চিম বঙ্গের
তত্কালীন রাজ্যপাল শ্রী গোপাল কৃষ্ণ গান্ধী কবিকে পত্র দ্বারা সন্মানিত করেছিলেন | প্রতিবেশী দেশ
বাংলাদেশ থেকেও তিনি প্রভুত সন্মান পেয়েছেন | এছাড়া তিনি অনেক পুরস্কার ও সন্মানে সন্মানিত
হয়েছেন |
বাংলাকে ভালবেসেছেন সর্বান্তকরণেই! এমনকি বিবাহ করেছেন বাংলার মেয়ে রত্না দেবীকে | তাঁদের দুই
মেয়ে ভারতী ও বাসন্তী এবং এক ছেলে মুন্না | বড় মেয়ে ভারতীর বিয়ে হয়েছে বাঙালী ছেলে পরিতোষ
ঘোযের সাথে | পুত্র মুন্না ও ছোট মেয়ে কে নিয়ে কবি বর্তমানে অবসর জীবন কাটাচ্ছেন দক্ষিণ কলকাতার
বোড়াল-এ |
তাঁর প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে “শান্তির কবচ”(১৯৮৬), “অমৃতে অনল প্রথম ও দ্রিতীয় খণ্ড”
(২০০২), “বাংলা কে মনে রেখে” (২০০৭), “সবার তরে” (২০১০) |
জন্মসূত্রে নেপালী হয়েও বাংলার প্রতি তার ভালবাসা অকৃত্রিম | সেই ভালোবাসাকে পাথেয় করেই কবি
নরবাহাদুর লামা বাংলায় কবিতা লিখে চলেছেন | সহজ ভাষা, সরল অলংকরণ, ঠিক যেন কবির স্বভাবের
প্রতিফলন | বাংলাকে ভালোবেসে কবিতার জন্য নিজেকে সমর্পণ করার এমন ঊদাহরণ খুব একটা পাওয়া
যায় না | বিশ্বমানবের কল্যানে কবির কাছ থেকে আমরা আরও কবিতা আশা করি | সবশেষে আমরা
কবির দীর্ঘায়ু কামনা করি |
আমরা আনন্দিত এই জন্য যে কবি তাঁর কিছু কবিতা আমাদের ওয়েবসাইটে তোলার অনুমতি দিয়েছেন |
কবির সঙ্গে যোগাযোগের ঠিকানা -
গ্রাম - ঘোষপাড়া, বোড়াল, থানা - সোনারপুর, জেলা - দক্ষিণ ২৪ পরগণা, কলকাতা - ৭০০১৫৪
চলভাষ - ৯১৯৮৩৬৬৮০৮৪৯, ৯১৯৮৩১৬০৭৯৫৬
উত্স:
২৪শে অক্টোবর ২০১০ তারিখে, কবির সঙ্গে সাক্ষাত্কার, তাঁর বাসভবনে | মিলনসাগরের পক্ষে
সাক্ষাত্কারটি নিয়েছিলেন মানস গুপ্ত এবং মিলন সেনগুপ্ত |
আমাদের যোগাযোগের ঠিকানা :-
srimilansengupta@yahoo.co.in
...