কবি নিবারণ পণ্ডিত - কবি নিবারণ পণ্ডিত জন্ম গ্রহণ করেন অবিভক্ত বাংলার ময়মনসিংহ জেলার,
কিশোরগঞ্জ মহকুমার সগড়া গ্রামে। তাঁদের পরিবার কৃষিনির্ভর ছিলেন কিন্তু পিতা ভগবানচন্দ্র তাঁর পণ্ডিত
উপাধি পেয়েছিলেন শিক্ষকতা করার জন্য।
কিশোরগঞ্জের রামানন্দ স্কুলে সপ্তম শ্রেণী অবধি প্রড়াশুনা করেন। কবির, মাত্র ১০ বছর বয়সে পিতার মৃত্যু
হওয়াতে তাঁকে বিড়ি বেঁধে আয় করে সংসার চালাতে হতো। ছোট বয়সেই তিনি গ্রাম্য গান ও
কবিতা রচনা করতে পারতেন। তাই গায়ক ও বাদকরা তাঁকে দলে নিয়ে যেতেন। গ্রামীন গানের আসরের
গায়কদের তিনি গোপনে গান লিখে দিতেন। কিশোর বয়সেই তিনি গান রচনায় সিদ্ধহস্ত হয়ে যান এবং
বিশেষ করে প্রশ্নোত্তরমূলক গানের আসরে তাঁকে দলে নিয়ে যাবার জন্য কাড়াকাড়ি পড়ে যেতো।
কবির আত্মকথনে জানা যায় যে শুরুর দিকে তিনি প্রেম ও ভক্তিরসের গান রচনা করলেও, অতি অল্প বয়স
থেকেই, রূঢ় বাস্তবের সম্মুখীন হয়ে, তাঁর চিন্তাজগতের পরিবর্তন হতে থাকে এবং ক্রমে তিনি মানুষের প্রতি
অন্যায়, অবিচার, অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে থাকেন, দুর্নীতিপরায়ণ সমাজের ওপরতলার মানুষদের
স্বরূপ উদ্ঘাটন করতে থাকেন তাঁর গানের মধ্য দিয়ে। ঠিক এইরকম সময়ে কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে তাঁর
যোগাযোগ হয়।
১৯৪১ সালে ঢাকার হিন্দু-মুসলমানের দাঙ্গা তিনি গান রচনা করেন। ১৯৪৩ সালের ভয়াবহ মন্বন্তরে বহু লক্ষ
মানুষ অনাহারে মারা যান। এই সময়ের রচিত গানে কবি সাম্যবাদী সমাজ প্রতিষ্ঠার আহ্বান করেন। ১৯৪৫
নাগাদ গারো পাহাড় এলাকায় হাজং উপজাতি কৃষকদের টংক প্রথা বিরোধী আন্দোলনে রচনা করেন গান।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের পরে তিনি পূর্ব পাকিস্তানেই থেকে যান। পাকিস্তান সরকারের আনা কৃষি-বিলের
বিরুদ্ধে গান লিখে পুস্তিকা ছেপে তা কৃষকদের মাঝে গিয়ে গাইতে থাকেন। এর ফলে কবি সরসরি প্রশাসনের
নজরে পড়ে যান। ১৯৫০ সালের জানুয়ারিতে তিনি ধরা পড়েন আনসার বাহিনীর হাতে এবং
তাঁর হাজতবাস শুরু হয়। কারাগারে অকথ্য অত্যাচার সহ্য করার পর অবশেষে ছাড়া পান ১৯৫০ সালের
প্রথম দিকে। কবি হেমাঙ্গ বিশ্বাসকে একটি পত্রে লিখেছিলেন, . . .
“সতর মাস অজ্ঞাতবাসে থাকার পর পাকিস্তান সরকারের দশম হামলায় আমি ধরা পড়ি ও নোয়াখালির কুখ্যাত গোলাম সারোয়ারের
হাতে পড়ি। তারপর বন্ধু, জার্মান ও জাপানি ফ্যাস্স্টদের পৈশাচিক অত্যাচারের যে সকল নির্মম কাহিনি কাগজে
পড়িতাম, বাস্তক্ষেত্রা তাহার সম্মুখীন হইলাম এবং মৃত্যুর জন্যই প্রস্তুত হইলাম। সকাল ৮টা হইতে সন্ধ্যা পর্যন্ত দেহের উপর বিভিন্ন
প্রকারের অত্যাচার চলিল। কখনো জ্ঞান ছিল, কখনো ছিল না। অবশেষে একটি ছোট্ট কুঠরীতে রেলিং-এর সাথে হাত পা বাঁধিয়া
মাংসপিণ্ডের মত ফেলিয়া রাখা হইল।...”
মুক্তি পেয়েই তার কয়েকদিনের মধ্যেই একবস্ত্রে, রিক্ত হস্তে তিনি ছোট-বড় নয়জনের পরিবার
নিয়ে ভারতে চলে আসেন। এই সময়ে তিনি ও তাঁর পরিবার অর্ধাহার অনাহারে দিন কাটাতে থাকেন।
ভারতে এসে উদবাস্তুদের দুর্দশার কথা লেখেন “বাস্তুহারার মরণকান্না” গ্রন্থে। ১৯৫১ সালের ২১শে এপ্রিলে
কোচবিহার শহরে খাদ্যের দাবিতে মিছিলের উপর পুলিশের গুলিতে পাঁচজন মারা যান। তিনি লেখেন
“খাদ্যের বদলে গুলি” নামক গ্রন্থ। ১৯৫২ সালের স্বাধীন ভারতের প্রথম নির্বাচন উপলক্ষ্যে লেখেন “ভোট
বৈতরণী কাব্য”। ১৯৫৪-৫৫ সালে পশ্চিমবঙ্গ বিধানসভায় জমিদারি ক্রয় আইন ওবং ভূমি সংস্কার ও
জরীপের উপর কয়েকটি বিল ও ধারা সংশোধিত হয়। এই আইন ও বিলগুলির অর্থ সরলভাবে
ব্যাখ্যা করে কৃষকদের জন্য “জমিদারি ক্রয় আইনের সারমর্ম”, “নয়া আইনের ধারা” ও “জরিপ ও ভূমি
সংস্কার” নামে পরপর তিনটি গ্রন্থ প্রকাশ করেন। ১৯৫৫-৫৬ সালে বঙ্গ-বিহার সংযুক্তিকরণের জন্য বিল এলে
সারা পশ্চিমবঙ্গ প্রতিবাদ আন্দোলনে গর্জে ওঠে। এই সময়ে তিনি রচনা করেন “বাংলা মায়ের ডাক” গ্রন্থটি।
এরপর রচনা করেন দীর্ঘ গান “টসার কবিতা” ও ১৯৫৭ সালে সাধারণ নির্বাচন উপলক্ষ্যে রচনা করেন “ভোট
বৈতরণী চটকা”। এর পর রচনা করেন “পুণ্ডিবাড়ীতে পুলিসের লাঠিচালনা”, “কুচবিহার হাসপাতালে রোগীর
চক্ষু উধাও---ঘটনা ও রচনা”, “তোর্ষানদী ভাঙ্গার গান”, “নীল বিদ্রোহের জারীগান”। ১৯৬২ সালে আসামে
“বঙ্গাল খেদা”-র প্রতিবাদে রচনা করেন “সেই দিনগুলির কথা” প্রভৃতি গান ও কবিতা।
এরপর অসুস্থতার কারণে আর তার স্কোয়াড নিয়ে ঘোরাঘুরি করতে পারতেন না। কিন্তু ১৯৮০সাল অবধি
বহু ছোট গান রচনা করে গেছেন। ওই সব গান তিনি কোচবিহারে পল্লীগায়কদের নিয়ে গঠিত শিল্পীদলকে
মহড়া দিয়ে প্রস্তুত করাতেন এবং তাঁরাই মূলত সেই গন পরিবেশন করতেন। তিনি সাধ্যমত ওই সব
অনুষ্ঠানে উপস্থিত থাকতেন।
১৯৭৮ সালে ভারতীয় গণনাট্য সংঘের তরফ থেকে তাঁকে সম্মানিত সদস্য পদ দেওয়া হয় এবং জীবনের
শেষ দিন পর্যন্ত তিনি গণনাট্য সংঘের সদস্য ছিলেন। পশ্চিম বঙ্গের বামফ্রন্ট সরকার দ্বারাও তিনি সম্বর্ধিত
হয়েছিলেন (কবে, কি ভাবে, তা আমাদের জানা নেই)।
১৯৭৬ সালে কবি হৃদরোগে আক্রান্ত হন। চিকিত্সার ফলে কিছুটা সুস্থ হলেও ১৯৭৯ সালে তিনি দুরারোগ্য
ক্যানসার রোগে আক্রান্ত হন। কলকাতায় দীর্ঘ সময় ধরে চিকিত্সা চলে। ১৯৮৪ সালের ১লা নভেম্বর,
কোচবিহারের ডাউয়াগুড়ি-কলেরপাড় এলাকায়, নিজের বাড়ীতে কবির জীবনাবসান হয়।
পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সংগীত আকাদেমি দ্বারা ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত “লোককবি নিবারণ পণ্ডিতের গান” এর
লেখক কঙ্কণ ভট্টাচার্যর মতে কবি নিবারণ পণ্ডিতের রচিত গানের সংখ্যা প্রায় ৩০০। কবির প্রথম জীবনের
গানগুলি রক্ষা করার ব্যাপারে তিনি উদাসীন ছিলেন। তাই তা কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে। পূর্ব পাকিস্তান
থেকে চলে আসার পথে তাঁর নিজস্ব গানের খাতাটিও হারিয়ে যায়। স্বাধীনতার পর রচিত গানগুলির
অধিকাংশই সংগৃহিত করা হয়েছে। ১৯৪৫ সালে ময়মনসিংহ জেলার প্রগতি লেখক ও শিল্পী সংঘ ১৯৮২
থেকে ১৯৮৫ সালের মধ্যে রচিত লোকগীত নিয়ে “লোকসঙ্গীত” নামে একটি সংকলন প্রকাশিত করেছিল।
সেখান থেকেও কবির কিছু গান পাওয়া গেছে।
কবি বাংলার বিভিন্ন অঞ্চলের প্রায় ২২টি সুর নিয়ে কাজ করেছেন। পূর্ববঙ্গের ময়মনসিংহ ও উত্তরবঙ্গের
কোচবিহার, জলপাইগুড়ি ও আসামের গোয়ালপাড়ার অধিকাংশ সুর তাংর গানে রকমফের ব্যবহৃত
হয়েছে। ভাটিয়ালি, জারি, সারি, ঘোষার সুর, বিভিন্ন ধরনের ছড়ার সুর, টপ্পা, কীর্তন, কয়েক ধরনের কবির
সুর, একাধিক রকমের পুঁথিপড়া সুর ভাওয়াইয়া, চটকা, উভয়বঙ্গের নানা ধরণের বাউল সুর ইত্যাদি তিনি
ব্যবহার করেছেন।
আমরা মিলনসাগরে কবি নিবারণ পণ্ডিতের কবিতা তুলে আগামী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে পারলে
আমাদের এই প্রচেষ্টাকে সার্থক মনে করবো। নিবারণ পণ্ডিতের জন্ম শতবর্ষে, তাঁর প্রতি এটাই আমাদের
শ্রদ্ধার্ঘ্য।
কবি নিবারণ পণ্ডিতের মূল পাতায় যেতে এখানে ক্লিক করুন।
উত্সঃ কঙ্কণ ভট্টাচার্য, লোককবি নিবারণ পণ্ডিতের গান, পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য সংগীত আকাদেমি, ১৯৮৬
আমাদের ই-মেল - srimilansengupta@yahoo.co.in
এই পাতা প্রকাশ - ২৩.০৪.২০১২
...