কবি নীলরতন সেন এর কবিতা
*
অনিবার্য
“স্বপ্নের সাঁকো পেরিয়ে” কাব্যগ্রন্থের ( ১৯৮৩ ) কবিতা |
(১৯৬৯ এর অগাস্ট মাসে বৌদি মায়া সেন এর চলে যাওয়ার পর লেখা)

'গৌর বসাকের পড়ে রইল ভরন্ত ক্ষেতখামার' -- অমিয় চক্রবর্তী

যদি শেষ মুহুর্তের দ্বিধা নিয়ে
ওই দলটার সঙ্গে না যেতে,
যদিই বা গেলে, বড়ো গাড়িটা ছেড়ে
অলুক্ষুণে ওই জিপটাতে
একটু হাওয়া আর মুক্তি খুঁজতে
না উঠতে !
জিপে, শুনলাম, প্রথম ড্রাইভারের পাশেই বসেছিলে,
সিট্ বদল করে কেন যে একেবারে ডাইনে চলে এলে !
-- নইলে হয়তো দুর্ঘটনাটা এড়াতে পারতে !
আচমকা অন্য গাড়ির ধাক্কায়
যখন ছিটকে পড়লে,
যদি আর দু'গজ দূরে পড়তে !
(পড়তে পারতে তো !)
তাহলে ওই বেসামাল জিপটা আর
চাপা দিতে পারতনা।
অথবা ধাক্কায় জিপটা যদি না ওলটাতো,
যেকোনো একটা 'যদি'
সামান্যের জন্যেও তো তোমায় বাঁচাতে পারতো !
একটাও ঘটলো না। আশ্চর্য !
ঘটনাণ্ডলো পর পর এমনভাবে ঘটে গেল,
যেন তোমাকেই
অনিবার্যভাবে ছিনিয়ে নেবার চক্রান্ত
সাজানো হয়েছিল !

পরিনত যৌবনে
পাকা গিন্নি সেজে
রসিয়ে সংসার করবার ভাবনায় মশণ্ডল ছিলে।
অদৃশ্য বাহকেরা
ড্যাং ড্যাং করে নাচাতে নাচাতে
তোমায় মরণ বাসরের দরজায় নামিয়ে দিয়ে গেল !
অপ্রস্তুত নতুন খেলার অমোঘ আহ্বান এল।

অবোধ শিশু দুটি জানলো,
মাকে স্বর্গে যেতে হলো;
--কিন্তু যে সগ্ গে যাবে বলে ঠাক্ মা
ভাঙা প্যাট্ রা সাজিয়ে বসে আছে
সেখানে মাকেই সবার আগে যেতে হল কেন ?
একে একে সব্বাই যাবে,
ঠাক্ মা-বাবা-কাকু-সব্বাই-
আমরাও একদিন মার কাছে চলে যাব,
তাই না রে, দিদিভাই ?
--কিন্তু এখন রাতে কার পাশে শোবো ?--
অন্ধকারে ভয় করবে যে!

ষোল বছর ঘর করে,
মান-অভিমান-ঝগড়া-আদর-সোহাগে
এক যুবককে প্রৌঢ়ত্বের দরজায় পৌঁছে দিয়ে,
ভরন্ত (না রিক্ত) সংসারে ফেলে রেখে,
আচমকা চলে গেলে !
স্মৃতির আবর্জনা চারপাশে ছড়ানো।

দুটি অসহায় শিশু, বৃদ্ধা মা, --
ওদের লালনের দুর্ভর জোয়াল
কাঁধে চপিয়ে দিয়ে, বিনা নোটিশেই
পাশ থেকে সরে পড়লে।
অথচ, এ মুক্তি তুমি একেবারেই চাও নি।
উনপঞ্চাশী মানুষটার প্রতি নিয়তির
কি নির্মম পরিহাস !

সিঁথিতে সিঁদুরের পুরু প্রলেপ,--
ভাগ্যবতী এয়োতীর চিহ্ন।
বিকালে হাসতে হাসতে
সুস্থ যুবতী জিপে উঠে বসলে,
মর্গে শুয়ে কি দূর্মনা স্বপ্নে রাতটা কাটিয়ে দিলে
নিস্পন্দ দেহটি সকালে এম্বুলেন্সে ফিরে এল।
--ভাগ্যবতী আর কারে বলে !

ক্যামেরাম্যান প্রস্তুত !
দ্রুত অপসৃয়মান রূপের শেষ সাক্ষর ধরে রাখতে হবে।
ক্লিক্ ক্লিক্ ক্লিক্
পায়ে পুরু আলতা,
সারাদেহ ফুলভারে ক্লিষ্ট !
ঘন্টা দিন মাস বছর কেটে যাবে।
স্মৃতির অসংখ্য বুদ্ বুদ্
ফেটে ফেটে ক্লান্ত হয়ে মিলিয়ে যাবে।
বেদনার ক্ষতণ্ডলি ধীরে ধীরে শুকিয়ে যাবে।
সময়ের মলম অব্যর্থ ওষধিতে প্রস্তুত।

মাঝে মাঝে
এমন অপ্রস্তুত ভাবেই
নতুন অভিসারে যেতে হয়।
ভ্যানিটি ব্যাগটা খুলে
ঠোঁটে লিপ্ স্টিক্ বুলিয়ে নেবার
সময়টাও মেলেনা।

ওদিকে চেয়ে দেখো
খোকনের ঠাক্ মা বুড়ি
--নবতি জরা স্থবিরা
দরবিগলিত ধারায় ডাকছেন,
'ঠাকুর মুক্তি দাও, পার কর।'
সংসারশুদ্ধ সবাই 'বল্লালী বালাই'-এর
যাবার দিন ণ্ডনছে।
তিনি এদিকে দিনে দিনে
শৈশব ফিরে পাচ্ছেন।
ছেলে মেয়ে নাতি-নাতনির মৃত্যু
তাঁর অবোধ শিশুমনে যেন
আর তেমন দাগ কাটেনা।
খাওয়া-শোওয়া, প্রাকৃতিক কর্ম
সবেতেই নির্বিকার।
মাঝে মাঝে করুণ কন্নায় ভেঙ্গে পড়েন,
'ঠাকুর পার করো।'
কে ঠাকুর ? কাকে পার করবে ? কোথায় ?
অত শত নবতি শিশুর জানা নেই।

শববাহক শ্মশানযাত্রীরা এবারে প্রস্তুত।
বল হরি। হরি বোল।

.           *****************             

.                                                                           
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
বটুকদাকে
“স্বপ্নের সাঁকো পেরিয়ে” কাব্যগ্রন্থের ( ১৯৮৩ ) কবিতা |

:: ঊর্মিলা বৌদির মৃত্যুর পর
জ্যোতিরিন্দ্র মৈত্র  (১৯১১~১৯৭৭) কে লেখা ::


ব্যস্ততায় চিঠি লেখার সময় পেতেন না,
এখন সারাদিনমান তোমার ছুটি !
রিক্ততার অবসাদে
নিঃসঙ্গ শূন্যতায়
কোনো বাঁধনকেই বাঁধন বলে আর
মনে হয়না তোমার কাছে।
তুমি আজ এত মুক্ত যে,
মুহুর্তেই গলিয়ে যেতে পারো,
অতলে তলিয়ে যেতে পারো,
- এই বিশাল অরণ্যে হারিয়ে যেতেও বাধা নেই।

কিন্তু তাও বলি,
স্মৃতির বোঝাটা কোথায় নামাবে বটুকদা ?
ছোট্ কিটার দিকে তাকাও
নিয়তি আচমকা নিষ্ঠুর হাতে
প্রচণ্ড চড় কশিয়ে
ওকে তোমার কোলে ছুঁড়ে দিয়ে গেল।

যার কাছে মুক্তি চাইছিলে
সে তোমায় আরো শক্ত বাঁধনে বেঁধে দিল।
আসল কথাটা তুমিও জানো, বটুকদা।
পুতুলের সংসার,
মাটির পুতুলণ্ডলো
রোদে-জলে গলবেই।
অনেক দিন বাদে বুকের ব্যথাটা
টন্ টন্ করছে তাই না ?

বয়স বাড়ছে, এত আর সয় না।
অথচ দেখছ তো, সবই সইতে হয়।
ক্ষতটা বিস্মৃতির প্রলেপে
একদিন শুকিয়ে যাবেই।

খাই দাই,
বিছানায় গা এলিয়ে আরাম করি।
বাজারের থলিটা
রান্নাঘরের দাওয়ায় নামিয়ে দিয়ে
ফুলস্পীডে ফ্যানটা চালাই।
-সব ক্লান্তি ভুলতে চাই।

বটুকদা, আর
রিক্ত নিঃসঙ্গ থেকনা।
তাকিয়ে দেখো,
অসংখ্য বুদ্বুদের মাঝে তুমিও ভেসে আছ।
বুদ্বুদণ্ডলো একে একে ফাটবেই।

সাঁকোর বাঁশটা বৃষ্টিতে পিছল হয়েছে।
সাবধানে পার হও-
হাতটা ধর আমার।
বৃষ্টিতে, কাদায়, পায় পায়
সাঁকোটা বেশ পিছল।
তুমি একটু মনস্ক হও, বটুকদা।

.           *****************             

.                                                                            
সূচীতে . . .     


মিলনসাগর
*
জন্মদিনে দিলীপদাকে
কবি নীলরতন সেন
“স্বপ্নের সাঁকো পেরিয়ে” কাব্যগ্রন্থের ( ১৯৮৩ ) কবিতা |


দিলীপদা,
সৌর পরিক্রমার
আরও একটি চক্রপথে প্রবেশাধিকার পেলে তুমি।
প্রকৃতির রাজত্যে সেই এক খেলাই চলছে।
শীত-বসন্ত-বর্ষা-শরত্;
আগমনী আর বিজয়ার প্রবেশ প্রস্থান।
ফুল ফলের একই সম্ভার;
একই পাখির কাকলি।
আমাদের আবর্তন রেখাটিও হুবহু এক।
নিষ্পাপ শিশুর আবির্ভাব,
কৈশোর যৌবনের চপলতা,
গার্হস্থ্য জীবন,
প্রেম-লোভ-ঈর্ষা-নিষ্ঠুরতা
শোক-বেদনা,
অন্ধ সংস্কারের এবং রিপুর দাসত্য।
সৃষ্টির উষা থেকে একই খেলার আবৃত্তি
- প্রকাশের কিছু পার্থক্য ঘটেছে যুগে যুগে।

এই প্রাকৃত চক্রপথে
জ্ঞানের তাপসেরা, ভক্তি ও প্রেমের তাপসেরা
মাঝে মাঝে আলোকবর্তিকা হাতে প্রবেশ করেন।
সেই শিখা কখনো সখনো
প্রাকৃত মানবকের চলনে বলনে
পরিবর্তন এনে দেয়।

তবে প্রায়ই দেখি,
মূঢ়তার পাথরে প্রতিহত হয়ে
সে শিখা হারিয়ে যায়।

তুমি আলোকদিশারী, প্রেম ও
ভক্তিমন্ত্রের তাপস।
নিজে কতটা মুক্ত হলে জানতে চাই না,
বলো, তোমার ভালবাসার ছোঁয়ায়
মানবশিশুদের কোন পরিবর্তন
আনতে পারলে কি?

ভক্তি-প্রেমের বর্তিকাটি অম্লান জালিয়ে রেখে
ঈশ্বরদত্ত কণ্ঠসংগীতের আবাহনী
আরও কিছু কাল আমাদের শুনিয়ে যাও,
লোভ-নিষ্ঠুরতার মূঢ় মোহ থেকে,
ভক্তির প্রেমামৃত বিগলনে,
আমাদে চিত্তশতদল
পঙ্কের উর্ধে তুলে ধর,
জন্মদিনে এই প্রার্থনা জানাচ্ছি, দিলীপদা।


.           *****************             

.                                                                            
সূচীতে . . .     


মিলনসাগর
*
কাছে এসো
কবি নীলরতন সেন
“স্বপ্নের সাঁকো পেরিয়ে” কাব্যগ্রন্থের ( ১৯৮৩ ) কবিতা |


টলটলে উদ্ধত মেঘ
পুব-দখিনে সাগরে-আকাশে মেশামেশি।
নিশ্চয়ই বর্ষার ঢল নেমেছে.--
গাঢ় নীল শান্ত সমুদ্র
দেখ কেমন চিড়বিড়িয়ে উঠছে।
হাওয়ার ঝাপটায় বৃষ্টির আমেজ।
না, --আর বাইরে থেকোনা।
শার্শির কাঁচটা নামিয়ে দাও,
ঘরে এসো।
ছোট্ট কেবিনে বেশ হাত-পা গুটিয়ে
ঘন হয়ে বোসো।

"মাগো, কি ছোট্ট ঘর দেখেছ ?
একটু হাত-পা ছড়ানোরও জায়গা নেই।"

নেইতো বেশ হয়েছে।
শার্শিতে বৃষ্টির চাবুক,
খোলা ডেক্-এ হাওয়ার উদ্দাম দাপাদাপি।
দেখ মুহুর্তে সব শান্ত হয়ে গেল !
দেখ দিগন্ত ছোঁয়া সমুদ্র
চারদিক থেকে কেমন নিজেকে ণ্ডটিয়ে আনল।
আলতো সোহাগের আলিঙ্গনে
তোমাদের খেলনা তরী
এখন খুশিতে কি ডগমগ !
সারাদিনের অস্থির দোলানি এবার শান্ত।

স্নিগ্ধ বাদলের স্পর্শ গায়ে মেখে
মন্থর আবেশে
গরবিনী কেমন জল কেটে
এগিয়ে চলেছে।

কাছে এসে বোসো।
সমুদ্রটা এত বড়ো কেন ?
কিছুতেই তোমাকে কাছে পাইনি এতক্ষণ।
বৃষ্টির আদরে এবার দূরত্ব ঘুচলো
মেঘে সাগরে মাখামাখি !
খেলনা তরী সোহাগে গরবিনী !
ঠান্ডা লেগে যেতে পারে।
শুনছ,
কাছে এসো।
আরও কাছে এসে বোসো।


.           *****************             

.                                                                         
সূচীতে . . .     


মিলনসাগর
*
স্বপ্নের সাঁকো পেরিয়ে
কবি নীলরতন সেন
“স্বপ্নের সাঁকো পেরিয়ে” কাব্যগ্রন্থের ( ১৯৮৩ ) কবিতা |


কাল রাতে
স্বপ্নের সাঁকো পেরিয়ে
অনেক দুরের সেই সবুজ দেশে
আমি তখন অলস পায়ে হাঁটছিলাম।
ঠিক সেই কুল গাছটির তলাতেই দেখা হয়ে গেল।

কি আশ্চর্য!
গাছটা তেমনি দাঁড়িয়ে আছে,
অকাল বর্ষণ স্নাতা
ভিজে মাটি আর সোনালী রোদে
ঝিল্ মিল্ সবুজ পাতার হাতছানিতে
স্বাগত জানালো।


কি আশ্চর্য!
তুমি তিরিশ বছরের ওপারে
(এখনো হাসিতে গালে টোল খায়)
চোখে কৌতুক হেনে
বড়ো বড়ো সবুজ ঘাসের মধ্যে
হাঁটু ডুবিয়ে দাঁড়িয়ে আছ
আমার অপেক্ষায়।

দুটি অকালের কুল ঝরে পড়লো।
কাড়াকাড়ি করে দুজনাতে কুড়িয়ে খেলাম।
তেমনি স্বাদের আশ্চর্য টক-মিষ্টি।

তুমি হাসলে মুক্তো ঝরা হাসি,
গোলাপী গাল রাঙা হয়ে উঠল।
স্বপ্নের সাঁকো পেরিয়ে
অনে দূরের পথে হাঁটতে হাঁটতে,
কাল কেমন আচমকা তোমার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল।


.              *****************             

.                                                                            
সূচীতে . . .     


মিলনসাগর
*
কবিতা পড়তে চাও তো
কবি নীল সেন
“স্বপ্নের সাঁকো পেরিয়ে” কাব্যগ্রন্থের ( ১৯৮৩ ) কবিতা |


কবিতা পড়তে চাও তো
এসো আমার ঘরে |

যখন চাঁপা গব্ধ ছড়াবে,
চাঁদ জ্যোত্স্না ঢালবে,
প্রতিবেশিনীর টি.ভি. থেকে
রবীন্দ্র সঙ্গীত ভেসে আসবে,
তোমরা আমার কবিতা শুনিয়ে যেও |

মিষ্টি প্রেমের কবিতা,
অথবা
রাগী যুবকের জেহাদী ছড়া,
নয়তো
বুড়ো খোকাদের ঘুমপাড়ানী গান,
----আমি সবই ভালবাসি |

এসো আমার ঘরে,
কবিতা শুনিয়ে যেও |

.              *****************             

.                                                                            
সূচীতে . . .     


মিলনসাগর
*
তোমাকে
কবি নীল সেন
“স্বপ্নের সাঁকো পেরিয়ে” কাব্যগ্রন্থের ( ১৯৮৩ ) কবিতা |


তোমার ওপর মাঝে মাঝে কি যে ঘৃণা হয় !
তোমার সঙ্গে বসবাস
কোনো ভদ্রমহিলার পক্ষে সম্ভব মনে করিনা !
উচ্চকিত হাসিতে ঠিক তখনই
আমার অহংকার আর ঘৃণাকে দলে পিষে,
‘ভদ্রমহিলা’র সব গৌরব চুরমার করে, তুমি
এই অসহায় নারীকে তোমার বলিষ্ঠ পৌরুষবলে
.                        উপভোগ কর,
আমি ধীরে ধীরে এক অব্যক্ত বেদনায়-সুখে
.                                 গলে যাই |
মদের তীব্র  গন্ধ  আর  তোমার
.        অশ্লীল উন্মত্ততায়
.        আমার পাকস্থলী থেকে যখন
.            অন্নপ্রাসনের ভাত উঠে আসতে চায়,
---ঠিক তখনই আমার ‘আমি’ কে
.              চূর্ণবিচূর্ণ করে, তুমি
.                আমাকে নিঃশেষ করে,
.                অসহায় ক্লান্ত মানুষটি
.                   কখন একসময় ঘুমিয়ে যাও |

আমি তখন
.   সেই ঘুমন্ত মানুষটার শিয়রে বসে কাঁদি,
.       রাত জেগে তার সেবা করি |
মনে মনে ভাবি,
.   আমি তো অবলা বঙ্গনারী ;
.   সতী-সাবিত্রীর দেশে
.                    এই তো আমার বিধিলিপি |

সকালে ঘুম ভেঙে শান্ত মানুষটি
খবরের কাগজ, এক কাপ চা,
.   সঙ্গে ঘুমায়িত সিগারেট মুখে বসেছ |
কালকের পশুটিকে কোথাও দেখতে পাই না,
বিমর্ষ,  গম্ভীর,  ভাবুক,---অনেক দূরের
.     এ মানুষের মনের নাগাল পাই না |

কি ভাবো এত ?
কি তোমার বিষণ্ণতার কারণ ?
আমায় পাশে রেখে
.       নির্ভরতায় চলতে পারো না কি ?
এ ‘তুমি’ কে ঘৃণা করিনা,  ভালোও বাসিনা,
.   সত্যি বলতে, বোধ হয় ভয় করি |

তুমি আমার ঘৃণা ও ভয় ভেঙে দাও |
এসো পরস্পরকে ভালবাসি |
ভালবাসার সন্তান পৃথিবীতে আমি আমরা |

.              *****************             

.                                                                            
সূচীতে . . .     


মিলনসাগর
*
আসঙ্গ
কবি নীল সেন
“স্বপ্নের সাঁকো পেরিয়ে” কাব্যগ্রন্থের ( ১৯৮৩ ) কবিতা |


চড়ুই দুটিকে আমি ভালোবাসিনা,
কবুতর দম্পতি আমার দুচক্ষের বিষ |
সারা দুপুর ওরা আমায় ভয়ানক জ্বালাতন করে |
ঘুমুতে দেয়না,
টেবলে বসে লিখতে দেয়না,
দুপুরের নির্জনতায় দুদন্ড বসে ভাবতে দেয়না |

কাল দুপুরের ট্রেনে তুমি চলে গেলে |
তোমায় তুলে দিয়ে ষ্টেশন থেকে
.      অলস পায়ে ঘরে ফিরে এলাম |
ঘরটা বড়ো নির্জন |
চড়ুই দুটি কোথাও উধাও,
পায়রা-দম্পতির দেখা নেই |
ঘুমের সাধনায় সারা দুপুর বৃথা কাটলো |
তারপর সন্ধ্যার মুখে
.        এক সময় ওরা ফিরে এলো |
প্রথম পায়রা-দম্পতি :
.        বক্  বকম্  বক্ |
.        ঘরটা গম্ গম্ শব্দে ভরে উঠলো |
তারপর এলো চড়ুই যুগল,
.   চিচ্ চি----চি-হি-----চিচ্ চি |
.     ঘরটা এতক্ষণে যেন প্রাণ পেলো |

শীতল নির্জনতা
.        আমায় গ্রাস করছিল |
শ্বাসরোধ হয়ে যেন তলিয়ে যাচ্ছিলাম |
ওরা আমার প্রাণ ফিরিয়ে দিল |
চড়ুই যুগল এখন আমার খুব প্রিয় |
কবুতর দম্পতিকে এখন আমি ভীষণ ভালবাসি |

.                 *****************             

.                                                                            
সূচীতে . . .     


মিলনসাগর
*
অ্যাক্ সিডেন্ট
কবি নীল সেন
“স্বপ্নের সাঁকো পেরিয়ে” কাব্যগ্রন্থের ( ১৯৮৩ ) কবিতা |


জীবনটাকে ছিনিয়ে নিতে এতই কাছে এসে
দাঁড়িয়েছিলে ;  একবারও তা মনেও পড়েনিকো |
আমরা তখন হাসপাতালে অপারেশনরুমে
এফ-আর-সি-এস সার্জেনকেই ধরে বসেছিলাম
এ সংকটে রক্ষাকর্তা |   মনের থিয়েটারে
কাটাছেঁড়া  করছি,  এবং জুড়ছি  নানাভাবে
একটু  আগেই  ঘটে  যাওয়া  দুর্ঘটনার  স্মৃতি |
ক্ষতমুখের  রক্তঝরা  বন্ধ হলোনাকো |

অপারেশন থিয়েটারের দরজা খুলে গেল ;
সার্জেনের গোমড়া মুখে শতেক জোড়া চোখে
পড়েই  চাই  কি  ভাগ্যলিপি  এলেন  খাতা লিখে |
ভাবলেশহীন |  নন্দী  ভৃঙ্গী স্ট্রেচারবাহী এল |
মুমূর্ষ  বিবর্ণদেহী  যন্ত্রণাকাতরা !
মুখের ওপর অক্সিজেনের মেকী মুখোশ ধরা !

.                 *****************             

.                                                                            
সূচীতে . . .     


মিলনসাগর
*
পশুপতিনাথ
কবি নীল সেন
“স্বপ্নের সাঁকো পেরিয়ে” কাব্যগ্রন্থের ( ১৯৮৩ ) কবিতা |


লিঙ্গরাজ কি ঐশ্বর্যে নিত্যসেবা তব,
দেবদেবী করজোড়ে যাচে কৃপাসুখ ;
ত্রিভুবন নরপতি সতত উন্মুখ
তোমারি বন্দনাগীতে, মুখরিত ভব |
তীর্থগামী নরনারী নানাদেশ ঘুরে
নিত্য আনে ভক্তি-অর্ঘ ওই লিঙ্গমূলে ;
সৃষ্টি-উত্স-রহস্যের যবনিকা খুলে
আহ্বান জানাও দেব সুরে ও অসুরে |

.        তব তীরে, দেখো চেয়ে, বুভুক্ষুর ভীড়,
.        জরারুগ্ন ছিন্নবাস মানব-কঙ্কাল
.        একটি দুটি পয়সা খুঁটি জীবিকা-প্রয়াসী ;
.        বাগমতী পিছে তব ছাপিয়ে দু’তীর
.        কলকন্ঠে বয়ে চলে সতত চঞ্চল
.        নাগরাজ প্রহরিত, ঝরে অশ্রুরাশি |

.                 *****************             

.                                                                            
সূচীতে . . .     


মিলনসাগর