যদি শেষ মুহুর্তের দ্বিধা নিয়ে ওই দলটার সঙ্গে না যেতে, যদিই বা গেলে, বড়ো গাড়িটা ছেড়ে অলুক্ষুণে ওই জিপটাতে একটু হাওয়া আর মুক্তি খুঁজতে না উঠতে ! জিপে, শুনলাম, প্রথম ড্রাইভারের পাশেই বসেছিলে, সিট্ বদল করে কেন যে একেবারে ডাইনে চলে এলে ! -- নইলে হয়তো দুর্ঘটনাটা এড়াতে পারতে ! আচমকা অন্য গাড়ির ধাক্কায় যখন ছিটকে পড়লে, যদি আর দু'গজ দূরে পড়তে ! (পড়তে পারতে তো !) তাহলে ওই বেসামাল জিপটা আর চাপা দিতে পারতনা। অথবা ধাক্কায় জিপটা যদি না ওলটাতো, যেকোনো একটা 'যদি' সামান্যের জন্যেও তো তোমায় বাঁচাতে পারতো ! একটাও ঘটলো না। আশ্চর্য ! ঘটনাণ্ডলো পর পর এমনভাবে ঘটে গেল, যেন তোমাকেই অনিবার্যভাবে ছিনিয়ে নেবার চক্রান্ত সাজানো হয়েছিল !
অবোধ শিশু দুটি জানলো, মাকে স্বর্গে যেতে হলো; --কিন্তু যে সগ্ গে যাবে বলে ঠাক্ মা ভাঙা প্যাট্ রা সাজিয়ে বসে আছে সেখানে মাকেই সবার আগে যেতে হল কেন ? একে একে সব্বাই যাবে, ঠাক্ মা-বাবা-কাকু-সব্বাই- আমরাও একদিন মার কাছে চলে যাব, তাই না রে, দিদিভাই ? --কিন্তু এখন রাতে কার পাশে শোবো ?-- অন্ধকারে ভয় করবে যে!
ষোল বছর ঘর করে, মান-অভিমান-ঝগড়া-আদর-সোহাগে এক যুবককে প্রৌঢ়ত্বের দরজায় পৌঁছে দিয়ে, ভরন্ত (না রিক্ত) সংসারে ফেলে রেখে, আচমকা চলে গেলে ! স্মৃতির আবর্জনা চারপাশে ছড়ানো।
দুটি অসহায় শিশু, বৃদ্ধা মা, -- ওদের লালনের দুর্ভর জোয়াল কাঁধে চপিয়ে দিয়ে, বিনা নোটিশেই পাশ থেকে সরে পড়লে। অথচ, এ মুক্তি তুমি একেবারেই চাও নি। উনপঞ্চাশী মানুষটার প্রতি নিয়তির কি নির্মম পরিহাস !
সিঁথিতে সিঁদুরের পুরু প্রলেপ,-- ভাগ্যবতী এয়োতীর চিহ্ন। বিকালে হাসতে হাসতে সুস্থ যুবতী জিপে উঠে বসলে, মর্গে শুয়ে কি দূর্মনা স্বপ্নে রাতটা কাটিয়ে দিলে নিস্পন্দ দেহটি সকালে এম্বুলেন্সে ফিরে এল। --ভাগ্যবতী আর কারে বলে !
ক্যামেরাম্যান প্রস্তুত ! দ্রুত অপসৃয়মান রূপের শেষ সাক্ষর ধরে রাখতে হবে। ক্লিক্ ক্লিক্ ক্লিক্ পায়ে পুরু আলতা, সারাদেহ ফুলভারে ক্লিষ্ট ! ঘন্টা দিন মাস বছর কেটে যাবে। স্মৃতির অসংখ্য বুদ্ বুদ্ ফেটে ফেটে ক্লান্ত হয়ে মিলিয়ে যাবে। বেদনার ক্ষতণ্ডলি ধীরে ধীরে শুকিয়ে যাবে। সময়ের মলম অব্যর্থ ওষধিতে প্রস্তুত।
মাঝে মাঝে এমন অপ্রস্তুত ভাবেই নতুন অভিসারে যেতে হয়। ভ্যানিটি ব্যাগটা খুলে ঠোঁটে লিপ্ স্টিক্ বুলিয়ে নেবার সময়টাও মেলেনা।
ওদিকে চেয়ে দেখো খোকনের ঠাক্ মা বুড়ি --নবতি জরা স্থবিরা দরবিগলিত ধারায় ডাকছেন, 'ঠাকুর মুক্তি দাও, পার কর।' সংসারশুদ্ধ সবাই 'বল্লালী বালাই'-এর যাবার দিন ণ্ডনছে। তিনি এদিকে দিনে দিনে শৈশব ফিরে পাচ্ছেন। ছেলে মেয়ে নাতি-নাতনির মৃত্যু তাঁর অবোধ শিশুমনে যেন আর তেমন দাগ কাটেনা। খাওয়া-শোওয়া, প্রাকৃতিক কর্ম সবেতেই নির্বিকার। মাঝে মাঝে করুণ কন্নায় ভেঙ্গে পড়েন, 'ঠাকুর পার করো।' কে ঠাকুর ? কাকে পার করবে ? কোথায় ? অত শত নবতি শিশুর জানা নেই।
ব্যস্ততায় চিঠি লেখার সময় পেতেন না, এখন সারাদিনমান তোমার ছুটি ! রিক্ততার অবসাদে নিঃসঙ্গ শূন্যতায় কোনো বাঁধনকেই বাঁধন বলে আর মনে হয়না তোমার কাছে। তুমি আজ এত মুক্ত যে, মুহুর্তেই গলিয়ে যেতে পারো, অতলে তলিয়ে যেতে পারো, - এই বিশাল অরণ্যে হারিয়ে যেতেও বাধা নেই।
কিন্তু তাও বলি, স্মৃতির বোঝাটা কোথায় নামাবে বটুকদা ? ছোট্ কিটার দিকে তাকাও নিয়তি আচমকা নিষ্ঠুর হাতে প্রচণ্ড চড় কশিয়ে ওকে তোমার কোলে ছুঁড়ে দিয়ে গেল।
যার কাছে মুক্তি চাইছিলে সে তোমায় আরো শক্ত বাঁধনে বেঁধে দিল। আসল কথাটা তুমিও জানো, বটুকদা। পুতুলের সংসার, মাটির পুতুলণ্ডলো রোদে-জলে গলবেই। অনেক দিন বাদে বুকের ব্যথাটা টন্ টন্ করছে তাই না ?
বয়স বাড়ছে, এত আর সয় না। অথচ দেখছ তো, সবই সইতে হয়। ক্ষতটা বিস্মৃতির প্রলেপে একদিন শুকিয়ে যাবেই।
জন্মদিনে দিলীপদাকে কবি নীলরতন সেন “স্বপ্নের সাঁকো পেরিয়ে” কাব্যগ্রন্থের ( ১৯৮৩ ) কবিতা |
দিলীপদা, সৌর পরিক্রমার আরও একটি চক্রপথে প্রবেশাধিকার পেলে তুমি। প্রকৃতির রাজত্যে সেই এক খেলাই চলছে। শীত-বসন্ত-বর্ষা-শরত্; আগমনী আর বিজয়ার প্রবেশ প্রস্থান। ফুল ফলের একই সম্ভার; একই পাখির কাকলি। আমাদের আবর্তন রেখাটিও হুবহু এক। নিষ্পাপ শিশুর আবির্ভাব, কৈশোর যৌবনের চপলতা, গার্হস্থ্য জীবন, প্রেম-লোভ-ঈর্ষা-নিষ্ঠুরতা শোক-বেদনা, অন্ধ সংস্কারের এবং রিপুর দাসত্য। সৃষ্টির উষা থেকে একই খেলার আবৃত্তি - প্রকাশের কিছু পার্থক্য ঘটেছে যুগে যুগে।
এই প্রাকৃত চক্রপথে জ্ঞানের তাপসেরা, ভক্তি ও প্রেমের তাপসেরা মাঝে মাঝে আলোকবর্তিকা হাতে প্রবেশ করেন। সেই শিখা কখনো সখনো প্রাকৃত মানবকের চলনে বলনে পরিবর্তন এনে দেয়।
তবে প্রায়ই দেখি, মূঢ়তার পাথরে প্রতিহত হয়ে সে শিখা হারিয়ে যায়।
তুমি আলোকদিশারী, প্রেম ও ভক্তিমন্ত্রের তাপস। নিজে কতটা মুক্ত হলে জানতে চাই না, বলো, তোমার ভালবাসার ছোঁয়ায় মানবশিশুদের কোন পরিবর্তন আনতে পারলে কি?
ভক্তি-প্রেমের বর্তিকাটি অম্লান জালিয়ে রেখে ঈশ্বরদত্ত কণ্ঠসংগীতের আবাহনী আরও কিছু কাল আমাদের শুনিয়ে যাও, লোভ-নিষ্ঠুরতার মূঢ় মোহ থেকে, ভক্তির প্রেমামৃত বিগলনে, আমাদে চিত্তশতদল পঙ্কের উর্ধে তুলে ধর, জন্মদিনে এই প্রার্থনা জানাচ্ছি, দিলীপদা।
কাছে এসে বোসো। সমুদ্রটা এত বড়ো কেন ? কিছুতেই তোমাকে কাছে পাইনি এতক্ষণ। বৃষ্টির আদরে এবার দূরত্ব ঘুচলো মেঘে সাগরে মাখামাখি ! খেলনা তরী সোহাগে গরবিনী ! ঠান্ডা লেগে যেতে পারে। শুনছ, কাছে এসো। আরও কাছে এসে বোসো।
তোমাকে কবি নীল সেন “স্বপ্নের সাঁকো পেরিয়ে” কাব্যগ্রন্থের ( ১৯৮৩ ) কবিতা |
তোমার ওপর মাঝে মাঝে কি যে ঘৃণা হয় ! তোমার সঙ্গে বসবাস কোনো ভদ্রমহিলার পক্ষে সম্ভব মনে করিনা ! উচ্চকিত হাসিতে ঠিক তখনই আমার অহংকার আর ঘৃণাকে দলে পিষে, ‘ভদ্রমহিলা’র সব গৌরব চুরমার করে, তুমি এই অসহায় নারীকে তোমার বলিষ্ঠ পৌরুষবলে . উপভোগ কর, আমি ধীরে ধীরে এক অব্যক্ত বেদনায়-সুখে . গলে যাই | মদের তীব্র গন্ধ আর তোমার . অশ্লীল উন্মত্ততায় . আমার পাকস্থলী থেকে যখন . অন্নপ্রাসনের ভাত উঠে আসতে চায়, ---ঠিক তখনই আমার ‘আমি’ কে . চূর্ণবিচূর্ণ করে, তুমি . আমাকে নিঃশেষ করে, . অসহায় ক্লান্ত মানুষটি . কখন একসময় ঘুমিয়ে যাও |
আমি তখন . সেই ঘুমন্ত মানুষটার শিয়রে বসে কাঁদি, . রাত জেগে তার সেবা করি | মনে মনে ভাবি, . আমি তো অবলা বঙ্গনারী ; . সতী-সাবিত্রীর দেশে . এই তো আমার বিধিলিপি |
সকালে ঘুম ভেঙে শান্ত মানুষটি খবরের কাগজ, এক কাপ চা, . সঙ্গে ঘুমায়িত সিগারেট মুখে বসেছ | কালকের পশুটিকে কোথাও দেখতে পাই না, বিমর্ষ, গম্ভীর, ভাবুক,---অনেক দূরের . এ মানুষের মনের নাগাল পাই না |
কি ভাবো এত ? কি তোমার বিষণ্ণতার কারণ ? আমায় পাশে রেখে . নির্ভরতায় চলতে পারো না কি ? এ ‘তুমি’ কে ঘৃণা করিনা, ভালোও বাসিনা, . সত্যি বলতে, বোধ হয় ভয় করি |
তুমি আমার ঘৃণা ও ভয় ভেঙে দাও | এসো পরস্পরকে ভালবাসি | ভালবাসার সন্তান পৃথিবীতে আমি আমরা |
অ্যাক্ সিডেন্ট কবি নীল সেন “স্বপ্নের সাঁকো পেরিয়ে” কাব্যগ্রন্থের ( ১৯৮৩ ) কবিতা |
জীবনটাকে ছিনিয়ে নিতে এতই কাছে এসে দাঁড়িয়েছিলে ; একবারও তা মনেও পড়েনিকো | আমরা তখন হাসপাতালে অপারেশনরুমে এফ-আর-সি-এস সার্জেনকেই ধরে বসেছিলাম এ সংকটে রক্ষাকর্তা | মনের থিয়েটারে কাটাছেঁড়া করছি, এবং জুড়ছি নানাভাবে একটু আগেই ঘটে যাওয়া দুর্ঘটনার স্মৃতি | ক্ষতমুখের রক্তঝরা বন্ধ হলোনাকো |