বৃদ্ধ গুরুর প্রতি শিষ্যের আর্জি কবি নীল সেন “স্বপ্নের সাঁকো পেরিয়ে” কাব্যগ্রন্থের ( ১৯৮৩ ) কবিতা |
তোমারি ঢাক সবাই মিলে পেটাচ্ছি দিন-রাত ; তাতেও তোমার ভরে না মন ? তোমার গুণের নামাবলীই পরেছি গায় ; তবু বলছ রেগে, ঠিক মতো গুণ গাইছি না কো কভু ! আমরা নাকি তোমার যতো গুণ-ব্যাখ্যায় পদে পদেই চলেছি ভুল করে | নিজের ঢাক এবারে তাই নিচ্ছ তুলে নিজের কাঁধেই |
তা হলে, আমরা এখন নিচ্ছি বিদায় | মনে রেখো, আত্মপ্রচার রয়ে সয়েই জমে ভালো | কখন কোথায় ছাইচাপা কোন্ কলঙ্কের দাগ উঠবে ফুটে, দেখবে তখন, ঢাকবার আর পাবে নাকো সুযোগ সেটার |
বয়েস হ লো | ধর্মে-কর্মে মন দেওয়াটাই এখন ভালো ; ভাবছ কি গো ? ---বেড়াল-তাপস বলবে সবাই ? বলুক না কো ! তবু জেনো, না খোঁচালে সাত-পুরোনো তোমারো সেই কাসুন্দি কেউ ঘাটবে না কো |
বলছি, শোনো, ভালো মনেই, সবার কানে তোমার সুনাম পৌঁছে দেবার দায়িত্বটা, আমাদের, এই শিষ্যদলের হাতেই এখন পুরোপুরি ছেড়ে দিয়ে তুমি, প্রভু , বিশ্রাম নাও |
গুরুগিরির এই তো কর্ম | ভালোমন্দ আকাম-কুকাম, কত শত করতে হলে সারা জীবন ! এবার গুরু অবসর নাও |
কবিতাগুচ্ছ কবি নীল সেন “স্বপ্নের সাঁকো পেরিয়ে” কাব্যগ্রন্থের ( ১৯৮৩ ) কবিতা |
১ মাঝে মাঝে আমার কান্না আমি শুনতে পাই | . কত কাল হয়ে গেল তোমায় ছেড়ে এসেছি | . ভয় লাগছে, . এবার ঘরে ফিরলে হয়তো, . হয়তো তুমি আমায় চিনতেই পারবে না | ২ সোনামণি, . এ সংসারে এনে . তোকে আমি কষ্টই দিয়েছিলাম | . কথা দিচ্ছি, . আর একবার ফিরে আয়, . এবার তোকে আর দুঃখ পেতে দেব না, . আঁচল আড়ে সব দুঃখের ঝড় থেকে তোকে বাঁচাবে | . আর একবার আমার ঘরে ফিরে আয় সোনামণি |
৩ এ আমাদের এক মজার লুকোচুরি খেলা | . যখন ওকে প্রায় ধরে ফেলি, . বাঁধন আল্ গা করে . খিল্ খিল্ হেসে একছুটে পালিয়ে যায় | . বক্ লে অভিমানে ঠোঁট ফোলায় . আদর করলে পাকা গিন্নি সেজে . আমাকেই বকাঝকা করতে থাকে | . ক্ষণেক্ষণেই ওকে পেয়ে হারাই, . হারিয়ে ফিরে পাই | ৪ লালসার শিকার হতে চায়নি বলে . ওকে তোমরা বাঁচতে দিলে না | . এখন কাঁটা-ছেঁড়ার প্রহসনে আর কি প্রয়োজন বল ? . মৃতের প্রতি শ্রদ্ধা রাখো | . মনে রোখো, একদিন . তোমার জীবনের ওপরও যবনিকা পড়বে |
সম্পাদক মশাইকে হবু কবির নিবেদন কবি নীল সেন “স্বপ্নের সাঁকো পেরিয়ে” কাব্যগ্রন্থের ( ১৯৮৩ ) কবিতা |
সেই একই বাঁধাগৎ বুলিটা এবারেও তাহলে বলছেন,— আপনার কাগজে একটুও ঠাঁই নেই ? সম্পাদক মশাই, শুনুন, . এবং জানুন, কবির স্বীকৃতি না পেলে অন্তত আমাদের কিছু এসে যায় | দেখুন, . হবু কবিরা সবাই চায় . একটু নাম-কাম ; . ----নইলে আগাম . কি জন্যে এতটা তদ্বির করছি ? . ----আপনাদের কিঞ্চিৎ নেক্ নজর কাড়তে, . একে ওকে ধরছি ?
তবু আপনাদের মন গলছে না, . সিদ্ধান্ত টলছে না, নিরুত্সাহে আমাদেরও লেখনী চলছে না | কেউ কি নিভৃতে একবারও আপনাদের . খবরটা বলছে না, যে এক আধটা কবিতা ছাপতে, ছাপার অক্ষরে নামটা দেখতে, রোজকার সিগারেট-খরচা বাঁচিয়ে, মাঝে মধ্যে চাক্ রে দাদাদের পকেট হাতিয়ে, আমরা কিছু চাঁদাও তুলে দিতে রাজি আছি | শুধু, পরস্পর আর একটু কাছাকাছি . আসতে চাই : . এবারে তাই, . সনির্বন্ধ অনুরোধ, . একটু কাছে ডেকে নিন, . আমাদেরও এক-আধটা চান্স দিন |
জন্মদিনে মধুসূদনের সমাধিতে কবি নীল সেন “স্বপ্নের সাঁকো পেরিয়ে” কাব্যগ্রন্থের ( ১৯৮৩ ) কবিতা |
কতকাল ঘুমিয়ে আছ ! জীবনে বড়ো বেশি ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলে | কিন্তু তোমার দ্বিতীয় সত্তা ? ---ছায়ার মতো তোমায় অনুসরণ করতে করতে সে-ও কি ক্লান্ত হয়েছিল ?
হিমশীতল সমাধিতে শুয়ে কখনো জেনেছ কি, জীবনের সব প্রগল্ ভতা, সমস্ত কলুষতা, কামনা-বাসনা, ক্ষোভ আর হতাশা পেরিয়ে, এখন তুমি শুভ্র সুন্দর পবিত্রতার স্মৃতিসৌরভে রূপান্তরিত ! তোমার নিজেরই তৈরি সুরভিত স্মৃতিমন্দিরে, দেখো আজ, অগণিত যাত্রীর ভিড় | মগ্নচৈতন্যে তার কোনো সাড়াই জাগছে না কি ?
জীবনকে আকন্ঠ ভোগ করতে চেয়েছিলে | সে তোমার অকালে নিঃশেষ করে সমাধিতে শুইয়ে রেখে গেল তোমার বিশ্বস্ত কবিসত্তা, ছায়ানুগামিনী দ্বিতীয় চৈতন্য, --যাকে কোনদিন তেমন আমল দিতে চাওনি, সে তোমার যশের মন্দির আজ সুরভিত করে রেখেছে |
চক্কোতি মশাই এখন--- কবি নীল সেন “স্বপ্নের সাঁকো পেরিয়ে” কাব্যগ্রন্থের ( ১৯৮৩ ) কবিতা |
চক্কোতি মশাই এখন সাবধানী মানুষ | দামড়া বেকার ছেলেটা পকেট হাতিয়ে পয়সা নিয়ে সিগারেট খায় ; জেনেও বকেন না | মেয়েটা বেপাড়ার এক বখাটে ছেলের সঙ্গে প্রেম করছে, জেনেও না বোঝার ভান করেন ; গিন্নির মুখঝাম্ টায় একটুও মুখ বেজার করেন না | এমন কি বাড়ির ঝিটা পালিয়ে গেলে, ছুটির দিনে তাঁকে উনুন ধরাতে, মাছ কুটতেও সাহায্য করেন |
অবশ্য মাসকাবারে মাইনের টাকাটা তাঁর হাতে তুলে দিতে গিয়ে কয়েকটা টাকা সরিয়ে রাখেন | ওই টাকাতে সন্ধ্যেবেলা একটু নেশা করেন | না, কোনো মারাত্মক নেশা নয় | গিন্নি কেন, তাসের আড্ডার বন্ধুরাও ধরতে পারেন না | মুখে দুটি এলাচদানা নিয়ে ঠিক ন’টায় বাড়ি ফেরেন |
তারপর তাহার প্রাত্যহিক পাওনা কিছু নালিশ, বকুনি, উপদেশ | শুনতে শুনতেই একসময় ঘুমিয়ে পড়েন | সকালে চায়ের কাপ নামিয়ে রেখেই বাজার, তারপর মাথায় দু’মগ জল ঢেলে, দুটি নাকে-মুখে গুজে, আটটা-কুড়ির লোকাল ধরা | দশটার মধ্যে ডালহৌসি পৌঁছোনো চাই | সওদাগরী অফিস, যেমন টাকা দেয় তেমনি খাটিয়ে নেয় | তবু বেশ নিরাপদ, শান্ত জীবন | কোনো ঝুট্-ঝামেলায় থাকেন না | অনেক দেখে, ঠেকে, শিখে, এখন সাবধান হয়ে গেছেন চক্কোতি মশাই |
আলাপ কবি নীল সেন “স্বপ্নের সাঁকো পেরিয়ে” কাব্যগ্রন্থের ( ১৯৮৩ ) কবিতা |
আপনারা সত্যিই ভাগ্যবান | এই তো দুদিন আগেও হাওয়া আর টিপ্ টিপ্ বৃষ্টি ! কি কনকনে ঠান্ডা ! এখন নীল আকাশে ঝলমল করছে রোদ | জানলার বাইরে তাকিয়ে দেখুন, জাকারান্দা ফুলের কি সমারোহ | লাজুক ক্যামেলিয়া সবে পাপ্ ড়ি মেলেছে | না, রডোডেনড্রন্ এখন পাবেন না | সকালে এক চক্কর ওয়ার্ড লেকে বেড়াচ্ছেন তো | সন্ধ্যেটা ক্লাবঘরে রঙীন টি.ভি দেখুন, বারে বসুন,--- নইলে আমাদের, --- এখানকার বাঙালী বন্ধুদের ঘরে চলে আসুন | চায়ের সঙ্গে উষ্ণ আড্ডা, রবীন্দ্র সঙ্গীত ; কিংবা কয়েকটা বছর পিছনে ফেলে আসা সেই বাঙালী নিধনের দুঃস্বপ্নের দিনগুলির স্মৃতিচারণ | দেখবেন, চমত্কার কেটে যাবে সময়টা |
এলিফ্যান্ট ফল্ স্ , শিলঙ পিক্, গল্ ফ্ কোর্স, হায়দরী পার্ক,-- -হ্যাঁ , সব একে একে দেখে নিন | ----ও, গতবারেই সেরে ফেলেছেন সে সব ? তাহলে, এবারে সময় করে একদিন ‘চেরা’টা ঘুরে আসুন | মশ্ মাই-এর ফল্ স্ আর কেভ্ ভালো লাগবে আপনাদের | ওখানকার রামকৃষ্ণ মিশনটাও বেড়িয়ে আসবেন | সেবারকার বাঙালী বিতাড়ন পর্বে ওদের ওপরও খুব হামলা গেছে | ---- শুনবেন সে সব কাহিনী মহারাজদের মুখে |
না না, বড়াপানিতে আর আলাদা করে যেতে হবে না | শহরে আসবার সময় একবার তো দেখেছেন | নাব্ বার মুখে আর একবার না হয় ভালো করে দেখে নেবেন | তবে হ্যাঁ, মাছ ধরার নেশা থাকলে একটা দিন কাটিয়ে আসতে পারেন ওখানে | এখন দিন কয়েক এখানেই আরামে কাটিয়ে যান | ভূভারতে এমন চমত্কার পাহাড়ি শহর আর পাবেন না | জানেন তো, সাহেবরা বলতো, স্কট্ ল্যান্ডকেও নাকি হার মানায় শিলঙ সুন্দরী |
সময় করে দু’একটি সন্ধ্যা পুলিশবাজার আর বড়োবাজারটা ঘুরে আসুন | অল্পস্বল্প মার্কেটিং করুন | সৌখিন কিছু বাঁশ ও বেতের কারুশিল্প সমতলের আত্মীয়-বন্ধুদের জন্যে নিয়ে যান |
ঠিকই শুনেছেন | লোকজন শীতের ভয়ে এখন ধীরে ধীরে নীচে নেমে যাচ্ছে | তবে আপনারা যেন, এমন সোনাঝরা মিঠে রোদ, সবুজ গাল্ চে বিছানো লন্ , ঘরে ফায়ারপ্লেসের ওম্—এসব ছেড়ে তড়িঘড়ি পালাবেন না | জমিয়ে শীত নাবতে আরও হপ্তা দু’তিন দেরি আছে |
কি বলছেন ? ভীড় বাড়লে ফেরার টিকিট মেলা ভার হবে ? না, সে ভয় করবেন না | এখন বোয়িং ছাড়াও, প্রতিদিন ঢাউস্ এয়ার বাস চলছে গৌহাটি-কলকাতা হয়ে দিল্লী অবধি | তিনশো কুড়িটা করে সীট থাকে | এ.সি সেন কোম্পানীকে বলে রাখুন | টিকিট ঠিক পেয়ে যাবেন |
এখন, শিলঙ যাকে বলা চলে, ঠিক পরিণত যৌবনা | যখন এসে পড়েছেন, ওর উষ্ণ অভ্যর্থনায় প্রসন্নমনে সাড়া দিন | আরও কয়েকটা দিন কাটিয়ে যান এই শিলঙ্ ক্লাবে |