ওকে দেখেছিলাম ( হেন্ রী ফ্রানসিস নাইটের ভাব অবলম্বনে ) কবি নীল সেন “স্বপ্নের সাঁকো পেরিয়ে” কাব্যগ্রন্থ ( ১৯৮৩ ) থেকে নেওয়া
ওকে দেখেছিলাম ছোটবেলায়, . টগ্ বগে মিষ্টি মেয়েটি | --- যেন ভোরের স্নিগ্ধ আলোয় . সকালের আভাস | ---- কিংবা শরতের শিশিরকণা | তখন ওর সারাদিনের খেলার সাথী ছিল, . হলুদ নীল প্রজাপতি, . আর রঙ্-বেরঙের ফুল | তাদের মতোই লঘু মেজাজ, আর . সহজ চলন ছিল ওর |
আবার যেদিন দেখলাম . তখন ও অষ্টাদশী তন্বী, টাট্ কা লাবণ্যে ঝল্ মল্ করছে . মন আর মুখশ্রী | কন্ঠে সংগীতের মূর্ছনা, . বুঝি চাঁদের সুধা ঝরছে | ও এখন সবার ঈর্ষা কুড়োয়, . গৌরব বাড়ায় শুধু এক জনার |
কয়েক বছর কেটে গেল | . ওকে দেখলাম, পূর্ণ প্রস্ফূটিতা . পুষ্প এখন ফলভারে আনতা | গরবিনী মায়ের আসনে বসেছে, . কোলে ওর তাজা ফুলের মতো শিশু | অনিমেষে চেয়ে রইলাম, . আরও ---আরও সুন্দরী হয়ে উঠেছে ও | আর একবার মাত্র দেখা হয়েছিল | . সেদিন ও শেষ শয়ানে শায়িত. . স্বর্গের দ্যুতি চোখে মুখে ছড়িয়ে পড়েছে, . ঈশ্বর পাশে এসে বসেছেন | কোনো অভাব আর ওকে দুঃখ দেবেনা, কোনো ভয়ের কাছে আর ওকে নতজানু হতে হবেনা | আমার চোখে . এবারেই ও সবচেয়ে সৌন্দর্যময়ী হয়ে উঠেছে |
অগীত গান ( মেরিডিথের একটি কবিতার ভাববলম্বনে ) কবি নীল সেন “স্বপ্নের সাঁকো পেরিয়ে” কাব্যগ্রন্থ ( ১৯৮৩ ) থেকে নেওয়া
শুক্ নো ঘাসের কোনো গান নেই ; তবু ওরা গান করে | যখন ওদের পাশ কাটিয়ে চলে যাই, বুকের ভেতর ওদের গান শুনি | মনের একটি তার ওরা ছুঁয়ে যায় ; হৃদয়ের গোপন গভীরে, কি এক বেদনার সুর ওরা জাগিয়ে তোলে | শুক্ নো ঘাসের গুঞ্জন আমি শুনতে পাই ; সারাক্ষণ আমার বুকের মাঝে ওরা গান করে |
হিমেনেথের একগুচ্ছ কবি নীল সেন “স্বপ্নের সাঁকো পেরিয়ে” কাব্যগ্রন্থ ( ১৯৮৩ ) থেকে নেওয়া
১ আমি তো আর আমি নই, আমি সে,-- যে আমারই পাশে হাঁটছে আমার অলক্ষে , তাকে কখনো প্রায় দেখে ফেলি কখনো বা বেমালুম ভুলে যাই | কথা বললে যে আমি নীরব শান্ত হয়ে থাকে, ঘৃণা করলে যে আমি আমায় ক্ষমা করে, আমি যেখানে যাইনি সেখানেও সে হাঁটে, আমার মৃত্যুর পর সে ঋজু হয়ে দাঁড়িয়ে থাকে |
২ বন্ধু, আমার কাছে তুমি পৌঁছুতে পারবেনা | ব্যাকুলতা আর পাগলামি নিয়ে তুমি আসবে , কিন্তু আমি তার আগেই চলে যাব |
এবং সে যে কি ভয়াবহ নিঃসঙ্গতা ! সব কিছু পিছনে ফেলে এসেছ শুধু আমার কাছে পৌঁছুবে বলে |
এবং সে যে কি হতশ্রী অতল শূন্যতা ! ---- আমিই ভরে তুলেছিলাম দুঃখের মাঝখানে, কিছু না ভেবেই, বন্ধু |
তুমি সেদিন থাকবেনা, বন্ধু --- সম্ভবত আমি ফিরে আসব পৃথিবীতে কিন্তু তুমি তখন চলে গেছ, একমাত্র বন্ধু আমার |
৩ যে শক্তিটুকু অবশিষ্ট ছিল শেষ দুটি হাসির রেখায় আমায় উপহার দিয়ে গেছ | তারপর মুক্তি নিয়েছ, যে মুক্তি তুমি চাওনি কখনো |
৪ একটি যেন গোলাপ তুমি . পাপড়ি খুলে খুলে হৃদয় তব দেখতে গিয়ে . পাইনি দেখা তার | অবাক চোখে দেখছি যে আজ . ভূধর সাগর ছেয়ে, সেই প্রাণেরই প্লাবন এলো . তাকিয়ে থাকা ভার |
৫ চিনতে ভুল হয়নি পথে তোমার পায়ের ছাপ পড়েছে যে ! বুকের মধ্যে তোলপাড় ; উন্মাদ হয়ে তোমায় খুঁজি সারা দিনমান ; --- যেমন ভক্ত কুকুর খোঁজে প্রভুকে | তুমি ততক্ষণে চলে গেছ | তোমার পদধ্বনি বুকের মধ্যে তোলপাড় করে | খোঁজার শেষ নেই. এই পথ কোথায় কতদূরে তোমায় নিয়ে গেছে |
৬ ঘুম সাঁকের মতো | আজ থেকে কাল, এপার থেকে ওপার . পৌঁছে দেয় | নীচে প্রবহমান স্বপ্ন-জলোচ্ছ্বাস |
৭ কি আশ্চর্য আমরা দুজনা আর আমাদেরই যুগল চৈতন্য, দেখতে দেখতে চারজনা হয়ে উঠলাম আমরা |
৮ ছুটোনা, আস্তে চল | তোমার কাছেই যে তোমাকে পৌঁছতে হবে | আস্তে চল, ছুটোনা | তোমার নবজাতক, . ওই চিরন্তনী . তোমার নাগাল পাবে না যে |
৯ যদি তাড়াহুড়ো কর সময় তোমার আগে ছুটবে, . পলাতকা প্রজাপতির মতো | যদি ধীরে সুস্থে চল . সময় তোমায় অনুসরণ করবে . অনুগতা প্রিয়ার মতো |
১০ আমি এখানে এসেছি কিন্তু আমার কান্নাকে . ফেলে রেখে এসেছি যে ! --- সেই সাগরপারে সে . কাঁদছে | আমি এখানে এলাম কিন্তু তোমার কোনো কাজেই লাগব না, . হৃদয়কে যে ফেলে এলাম . সেখানে | আমি এখানে এসেছি কিন্তু তুমিতো চিনতে পারবে না আমাকে | . আমার আত্মা যে সেখানে . কাঁদছে |
১১ কবিতা আমার মোহিনী প্রিয়া | নিভৃত মনের সুখের খেলায় গৃহকোণে ওকে লুকিয়ে রাখি | তপ্তমদির প্রেমের স্বপনে দুজনায় শুধু বিভোর থাকি |
১২ তোমার কন্ঠে আমার গান ফুটুক যে গান কখনো গাওয়া হয়নি | তুমি এখনো তো কিছুই বলনি কিছুই বলা হয়নি আমার |
১৩ আজ রাতে দরজা খুলে রাখো ও আসবে | কিন্তু ও যে মৃত | দেখো, ঠিক আসবে আজ রাতে | সব দরজা-জানালা খুলে রাখো | যদি চেহারাটা চিনতে পারি, বুঝতে পারি, পরে তুলে নিতে পারে আমাদের | ক্ষণিকের মৃত্যুতে . যদি বা বেঁচে উঠতে পারি | খুলে দাও, সব দরজা-জানালা খুলে দাও | গভীর নীল এই রাতে সে বুঝি এলো, আমাদের রক্তে তার আসবার স্পন্দন জাগলো | ফুল যেমন মুক্তি খোঁজে . তারার কাছে, ও আজ এলো আমাদের মুক্তিদূত হয়ে |
১৪ রক্তিম সায়রে দুটি হাঁস পাশাপাশি সাঁতার কাটছে--- আমারো রক্তে বেদনার সন্তরণ | রক্তিম হাওয়ায় দুটি গোলাপ পাশাপাশি দুলছে— আমারো রক্তে বেদনার আলোড়ন | রক্তিম আকাশে দুটি পাখি পাশাপাশি ছুটছে— আমারো রক্তে বেদনার শিহরণ |
১৫ ওজন তার ঠিকই রইল ! পাল্লার একটা দিক পাঁকে ডোবানো, অপর দিকটা আকাশে উঠছে |