কবি নীলরতন সেন এর কবিতা
*
ব্রেশ্ ট্ –এর একগুচ্ছ    

কৃপাভ্রষ্ট কবিদের গান
( ব্রেশ্ ট্ থেকে )
( যখন কবিদের দিয়ে ফরমায়েসী কবিতা আর লেখানো হচ্ছিল না )
কবি নীল সেন
“স্বপ্নের সাঁকো পেরিয়ে” কাব্যগ্রন্থ ( ১৯৮৩ ) থেকে নেওয়া


এতকাল ধরে যা পড়ে এসেছ, সবটাই ছন্দে লেখা ;
----বলতে হলো একথা আমাকে
কারণ তোমার জানা নেইকো
কবিতা বস্তুটা কেমন,
কিম্বা কবি হওয়া বলতে কি বোঝাচ্ছে |
সত্যি যদি সেটা বুঝতে
অবশ্যই কর্তব্য বলে গণ্য করতে
আমাদের আর একটু ভালো চোখে দেখার |


আচ্ছা বলো দেখি,
কখনো কি তোমার মনে হয়নি,
কখনো কি অবাক হওনি ভেবে,
বেশ অনেক দিন ধরে কেন
ভালো কবিতা লেখা হয়নি ?
কারণটা অবশ্যই জানো ?
----জানো না ?  বেশ তবে,
আমার উত্তরটাই শোনো |
এককালে কিছু লোক কবিতা পাঠ করতো,
এবং দামও দিতো |
---- অন্তত এটা তো মেনে নেবে ?
মুস্কিল হচ্ছে,
এখন কেউ আর নগদ দামে কবিতা কিনছে না |
----সে জন্যই কবিতা লেখাও বন্ধ একরকম |
কে পড়বে তা নিয়ে কবিদের মাথাব্যথা নেইকো,
ওদের ভাবনা একটাই, কে নগদ দাম দিয়ে কিনবে |
ওরা পয়সা না পেলে লিখবে না |
--- পয়সাটাই তো কেনাবেচার মাধ্যম |


আমাদের জিজ্ঞাস্য হল :
কি এমন অপরাধ করলাম ?
যাদের পয়সা খেয়েছি এতদিন
লিখিনি কি ওদের ফরমায়েস মতো ?
যা কিছু করেছি কবুল
সব তো ঠিক ঠিক মতো পূরণই করেছি |
এখন শিল্পীদেরও গুঞ্জন কানে আসছে |


তাদেরও ছবি নাকি বিকোচ্ছে না |  যদিচ
ওদের মনোরঞ্জক ভাবেই ছবিগুলি আঁকা হয়েছিল | অথচ
কেন যে সমস্তই অবিক্রীত রয়ে গেল !
কি অপরাধ পেলে, বলবে ?  আমাদের কবিতা ছবি
ইদানীং কি জন্যে কেনা কমিয়ে দিলে ?
ওদিকে তো শুনতে পাচ্ছি,
দিনদিনই তোমাদের উদর স্ফীত হচ্ছে !
যখন বাঁচবার সম্বল জুটতো, আমরা কি সর্বদাই
সেই সব গান করিনি,
এই দুনিয়ায় তোমরা যাতে আনন্দ পাও ?
---যেসব গানে তোমরা আয়াস করে পুরোনো সুখ নাও—
পছন্দসই উষ্ণ নারীসঙ্গ,
শরতের চমত্কার বিষর্ণ্ণতা,
ঝর্ণার ঝরঝরানি সঙ্গীত,
আকাশে চাঁদঝরা জ্যোত্স্না,---
আমাদের কবিতা-ছবি তো এ সবেরই অনুসঙ্গ |


মিষ্টি ফলের সুঘ্রাণ সোয়াদে,
ঝরাপাতার শব্দ,
আবার সেই পছন্দের মেয়েমানুষ |
---অনন্তকাল ধরে তোমাদের এ জীবন চলবে |
এ সবেরই গান তো আমরা গেয়েছিলাম |
--- গেয়েছিলাম তোমাদের বিশ্বাসের সব গান | ওদের গতি
ধূলিকণার শেষ যাত্রায় | ওদের গতি
ধূলিকণার শেষ যাত্রায় |  সেখানে
তুমিও একদিন ধূলি হয়ে মিশে যাবে |


নিছক তোমাদের খোশ্ মেজাজের রশদ জুগিয়েছি বলেই
দাম দাওনিকো |
ওগো, স্বর্ণাসনে সুখাসীন বাবুরা !
সেই সব গানের জন্যেই দাম দিয়েছ,
যাতে হতভাগ্য বঞ্চিতদের আমরা ভুলিয়েছি ;
মিথ্যে স্তোকে চোখের পানি তাদের শুকিয়েছি |
তোমরা যাদের বঞ্চিত করেছ,
তাদেরকে সান্ত্বনা দিয়েছ বলেই না
আমাদের গানের দাম দিয়েছিলে !
কিই না দিয়েছি বল ?
তোমাদের কি কখনো করেছি বিমুখ ?
বিনীত করজোড়
.      শুধুমাত্র দাম চেয়েছি |
তোমাদের জন্যে তো সব কুকাজই করেছি !
---সর্বদাই তোমাদের উচ্ছিষ্ট গ্রহণে পেয়েছি সুখ !


রক্ত-পাঁকের গভীর খাদে বন্দী থেকে তোমাদেরি খাঁচায়,
----যূপকাষ্ঠে গলা বাড়িয়ে রেখে,
বারবার চমত্কার সব বুলি
বেরিয়ে এসেছে আমাদেরই কন্ঠ থেকে |
তোমাদের ওই কশাইখানাটাকে
আদর করে আমরা নাম দিয়েছি
.           ভালোবাসার লীলাভূমি !
নির্ভেজাল ইস্পাতে গড়া
.        তোমাদের বিশস্ত সঙ্গী
.           রক্তকলঙ্কিত তরবারি আমরা !
----এ সবই তো ভালো জানো তোমরা |


মনে পড়ছে ?
উপোষী গরীবের ঘাড়ে আরো ট্যাক্সো চাপিয়ে
যে ইস্তাহার বিলি করেছিলে,
----আমরাই তাতে লোভাতুর হাতছানির সুর বসিয়েছিলাম ?
ওদের প্রাণের সবটুকু রস নিঙ্ ড়ে নেবার
মনোহারী কোরাস গেয়েছিলাম |
সরলমনা ওরা তোমাদেরি প্রাপ্য জেনে
.     বাড়তি সেই ট্যাক্সোটা দিয়েছিল |
বাছাই করা শব্দ এনে এনে
অমোঘ কার্যকরী বিষবড়ির মতো
অতি সতর্কতায় ওই সব তরল গানে মিশিয়েছিলাম |
নিরীহ লোকেরা নির্দ্ধিধায় তার সবটাই
.              কন্ঠে ঢেলে নিয়েছিলো |
তারপর একপাল ভেড়া বনে
তোমাদেরই ডাকে পিল্ পিল্ করে বেরিয়ে এসেছিল |


আমরা কবিতা-ছবিতে তোমাদের তুলনা করি
.   তাদের সঙ্গে,---যাদের তোমরা খুব পছন্দ করো |
অর্থাৎ সেই সব নোঙ্ রা লোকের সঙ্গে,
.   যারা নির্লজ্জ স্তুতিবাদ আদায় করতে ভালোবাসে,
.      বুভুক্ষু শিল্পীদের, আর
.         কাঙাল কবিদের কাছ থেকে |
তরবারি মতো শব্দের ধারে
.  তোমাদের শত্রুদের আমরা
.        ঘায়েল করে আসছি বরাবরই |


বল দেখি, তবু হঠাৎ কেন
.    আমাদের বাজারটা এত পড়ে গেল ?
বাবুমশাই, খাবার সামনে সাজিয়ে
.         অত সময় বসে থেকোনাকো |
আমাদের পাওনা উচ্ছিষ্টটাও
.         বাসি হয়ে যাচ্ছে না কি ?
ছবি আঁকবার
কিম্বা স্তুতিমূলক পদ্য় লেখার
.   একটা কোনো দায়িত্ব দাও |
না., ভেবে দেখেছ,
.    আপাতত বদান্যতা বব্ধ রাখাই শ্রেয় ?


সাবধান, বাবুভায়ের দল !
এভাবে আমাদের সমূলে বিনষ্ট করতে পারবে নাকো |
আহা ! যদি তোমাদেরও
.     আমাদের ভাবনাতে আনা যেত |
মাননীয় ভদ্রমহোদয়গণ, মনে রেখো,
এত সস্তায় আজ আমাদের কিনতে পারলেও,
এভাবে আমরা সব নিঃশেষ হবো
.       এমনটি সত্য নয় |


যে কবিতাটা পড়ছ, ( সত্যিই পড়ছ তো ? )
.        ওটা সুরু করেছিলাম
.            স্তবকগুলিকে কিছুটা ছন্দ ও মিল রেখে |
তারপর ভাবলাম,
.  কি দরকার এ যত্নের ?
.                 ----- কে এর মূল্য দেবে ?
শেষটায় হতাশ হয়ে ছেড়ে দিলাম
.                    মিলের প্রয়াস |
তবু লিখলাম | কারণ আমাকে যে লিখতে হবেই  |

( কবিতাটি দ্বিজেন্দ্রলালের আলেখ্যের ছন্দে, অর্থাৎ
প্রতিটি সিলেব্ ল্ একমাত্র গণ্য করে পড়তে হবে | )

.                        *****************             

.                                                                           
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
ব্রেশ্ ট্ –এর একগুচ্ছ    

চরম অত্যাচারের দিনটিতে
( ব্রেশ্ ট্ থেকে )
কবি নীল সেন
“স্বপ্নের সাঁকো পেরিয়ে” কাব্যগ্রন্থ ( ১৯৮৩ ) থেকে নেওয়া


একবার তুমি পরাজিত হলে
আর কি রইল ? ---- রইল
বুভুক্ষা,   তুষার ঝঞ্ঝা এবং
প্রবল বর্ষণ |

কে আর সঠিক পথ দেখাবে ?
ঠিক সেই পুরোনো
বুভুক্ষা আর শীত
পথ দেখিয়ে দেবে |

লোকে কি বলবে না,
এমনটি না ঘটালেই পারত ?
চরম বোঝাটাও চাইবে,
যদি হাল্ কা হওয়া যায় |

যারা নিহত হয়েছে
ওদের কি স্মরণ করাবে ?
যে ক্ষত এখনো সারেনি
সেগুলি ওদের স্মরণ করাবে |

.                 *****************             

.                                                                           
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
ব্রেশ্ ট্ –এর একগুচ্ছ    

প্রভাবশালী এক নেতার অসুখ শুনে
( ব্রেশ্ ট্ থেকে )
কবি নীল সেন
“স্বপ্নের সাঁকো পেরিয়ে” কাব্যগ্রন্থ ( ১৯৮৩ ) থেকে নেওয়া


ওকে ছাড়া কোনো কাজ চলে না |
ওই মানুষটির ভ্রূকুটিতে
.   দুই দুটি সাম্রাজ্য থরহরি কম্পমান |
ওই মানুষটি মারা গেলে
.  তামাম দুনিয়ার লোকে
.   মাতৃদুগ্ধ বঞ্চিত শিশুর মতো
.              অসহায় হয়ে পড়বে |

অপরিহার্য ওই মানুষটি যদি
.       মৃত্যুর সপ্তাহকাল বাদে ফিরে আসে ?
দেখবে, সেটা সাম্রাজ্যে একটা মজুরের কাজও
.                তার জন্যে খালি নেই |

.                 *****************             

.                                                                           
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
ব্রেশ্ ট্ –এর একগুচ্ছ    

একজন উদ্বাস্তুর প্রতি
( ব্রেশ্ ট্ থেকে )
কবি নীল সেন
“স্বপ্নের সাঁকো পেরিয়ে” কাব্যগ্রন্থ ( ১৯৮৩ ) থেকে নেওয়া


শব্দ আর বৃক্ষের মধ্যবর্তী
ওগো গৃহ,
অ-নেক দিন আগে এক উদ্বাস্তু
তোমার দেওয়ালে খোদাই করে লিখেছিল,
‘সত্য হল অখন্ড’
ওগো গৃহ, বলতে পারো
তোমার গায়ে সেই কথাটি
.   এখনো কি অক্ষত রয়েছে ?

.                 *****************             

.                                                                           
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
ব্রেশ্ ট্ –এর একগুচ্ছ    

ভয় পাই  
( ব্রেশ্ ট্ থেকে )
কবি নীল সেন
“স্বপ্নের সাঁকো পেরিয়ে” কাব্যগ্রন্থ ( ১৯৮৩ ) থেকে নেওয়া


সমুদ্রে হাঙ্গরের সঙ্গে যুদ্ধে বিজয়ী হয়েছি,
শ্বাপদসঙ্কুল অরণ্যে হিংস্র বাঘকে ঘায়েল করেছি,
তুচ্ছ ছারপোকার কাছে কিন্তু হেরে গেলাম |
অসহায় আমাকে কত সহজেই ও শোষণ করছে !

.                 *****************             

.                                                                           
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
ব্রেশ্ ট্ –এর একগুচ্ছ    

বেঁচে থাকা
( ব্রেশ্ ট্ থেকে )
কবি নীল সেন
“স্বপ্নের সাঁকো পেরিয়ে” কাব্যগ্রন্থ ( ১৯৮৩ ) থেকে নেওয়া


এটা ভালোই জানা আছে, নেহাৎ ভাগ্যক্রমে
অন্য বন্ধুদের চেয়ে কিছু বেশী দিন আমি বেঁচে রয়েছি |
গত রাতে স্বপ্নে দেখলাম,
আমার মৃত বন্ধুরা বলছে,
.                শেষ পর্যন্ত যোগ্যতমই টিকে থাকে |
শুনে নিজের ওপর এমন ঘৃণা হচ্ছে আমার !

.                 *****************             

.                                                                           
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর
*
ব্রেশ্ ট্ –এর একগুচ্ছ    

পাইপ
( ব্রেশ্ ট্ থেকে )
কবি নীল সেন
“স্বপ্নের সাঁকো পেরিয়ে” কাব্যগ্রন্থ ( ১৯৮৩ ) থেকে নেওয়া


তাড়াতাড়িতে সীমান্ত পেরোতে গিয়ে সব ফেলে আসতে হোলো |
বইগুলো বন্ধুদের বিলিয়ে দিলাম, কবিতাগুলো পরিখায় ছুঁড়ে ফেলে দিলাম
সঙ্গে রইল ধুমপানের পাইপটি |  ভঙ্গ করলাম
উদ্বাস্তুদের প্রতি সেই নির্দেশ : সঙ্গে কিছু না রাখা সবচেয়ে ভালো |

যাকে বিবর্ণ মুখে ফাঁসির মঞ্চের দিকে এগিয়ে যেতে হচ্ছে,
তার কাছে ওই বইগুলোর কি বা মূল্য আছে !
বরং তামাকের থলিটা আর ধুমপানের সরঞ্জামগুলো
অনেক বেশী এখন নির্ভরতার আশ্বাস দিচ্ছে |

.                 *****************             

.                                                                           
সূচীতে . . .    


মিলনসাগর