কবি বিনোদিনী দাসীর কবিতা
*
একটি গোলাপ
( বাসনা )
কবি নটী বিনোদিনী

কার তরে ফুটেছে লো গোলাপ সুন্দরী
.         কে তোরে আদর করে
.         কে রাখে হৃদয় পরে
কার জন্য ছড়াতেছ রূপের মাধুরী  ||

বল কার আদরেতে তুমি আদরিণী
.         কে তোমায় ভালবাসে
.         কার সুখ-সাধ আশে
পরেছ সুন্দর সাজ ওলো সোহাগিনী  ||

কিবা কথা বল্ তোর সমীরণ সনে
.         দুলে দুলে ঢলে ঢলে
.         হেসে হেসে গলে গলে
আদরে সোহাগ ভরে আনন্দিত মনে  ||

জাননা কি চিরকাল থাকে না আদর
.         আজি প্রফুল্লিত মনে
.         মিশায়ে সোহাগ সনে
যার কথা কহিতেছ আনন্দ অন্তর ||

দুই দিন পরে তুমি দেখিও আবার
.         তোমার সে প্রাণধন
.         আনন্দে বিভোর মন
অন্য ফুলে করে পান মধু আনিবার ||

এখন আদরে তোর হৃদয়ে ধরেছে
.         কালি নাহি রবে ঘোর
.         ভাঙ্গিবে স্বপন তোর
দেখিবি অন্যের প্রেমে সোহাগে  মজেছে ||

ত্যজি তোর ভালবাসা ভুলেছে সকল
.         কাঁদিলে না ফিরে চাবে
.         সাধিলে না কথা কবে
কমল হৃদয়ে সার হবে অশ্রুজল ||

.           *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
হৃদয়রত্ন
( বাসনা )
কবি নটী বিনোদিনী

এস হে হৃদয়ে এস হৃদয়রতন  |
অনন্ত শূন্যেতে সদা করি অন্বেষণ ||

বাসনা বিবশ আজি খুঁজিয়া তোমায় |
তাইতে কাতর প্রাণ স্মরণ যে চায় ||
জ্ঞানময় চিদানন্দ চৈতন্যস্বরূপ ||
বিরাজিত আছে যাঁর প্রতি লোমকূপ ||
হেরিব কোথায় সেই বিশ্বের চেতন |
পরমাত্মা জীবাত্মায় কোথায় মিলন ||
যোগময় কোন যোগে নিদ্রায় মগন  |
স্বরূপ চৈতন্য কোথা আছে অচেতন ||
ব্রহ্মময় ব্রহ্মরূপ কেমন মহিমা  |
উত্পত্তি বা লয় যাহা কোথা তার সীমা ||
কালস্রোতে ভেসে গিয়ে মিশে কোন জলে |
কালের মিশ্রিত জল স্থিতি কোন স্থলে ||
কোথা সে অনন্ত যার অন্ত নাহি পাই |
কোথা জ্ঞানরূপ যাতে আপন হারাই ||
যাহাতে উত্পত্তি হয় তাহাতেই লয়  |
কেমন আধার তাহা দেখি সাধ হয় ||

.           *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
আর একবার
( বাসনা )
কবি নটী বিনোদিনী

একদিন এ জীবনে চাহি দরশন  |
ইহাই জানিবে মম শেষ আকিঞ্চন ||
স্মৃতির বিষম জ্বালা সহি অনিবার |
মধুময় বাক্যে তোষ আর এক বার ||
ফুলের সুবাস সহ কোথা গেছ ভেসে |
ঘুমঘোরে আছ কোন জোছনার দেশে ||
দূর কাননের কোলে পাখী যেন গায় |
সেইরূপ স্মৃতি মম তোমারে জাগায় ||
মম দরশন-আশে বিজন কাননে  |
একাকী থাকিতে তুমি আপনার মনে ||
দুই তিন যদি এভাবে যাইত |
তবু অসন্তোষ হৃদে স্থান না পাইত ||
মম আগমন শব্দ শুনিলে শ্রবণে |
বিমল আনন্দ তব ভাতিত নয়নে ||
দূর হতে যেন মম আহ্বানের তরে |
নয়নের জ্যোতিঃ তব আসিত ঠিকরে ||
নীরব বাসনাপূর্ণ হৃদয় তোমার |
এ জীবনে দেখি সাধ আর একবার  ||
কত দিন কত নিশি অভিমান ভরে |
থাকিতাম শুধু তোমা কাঁদাবার তরে ||
ক্ষণেকের তরে যদি চাহিতাম হাসি  |
ভাসিত আনন্দকণা অশ্রুসনে আসি ||
স্বর্গীয় শোভায় তব নয়ন ভরিত |
মূর্ত্তিমতী ক্ষমা যেন নয়নে উদিত ||
হেরে সে স্নেহের ছায়া বিমল বদনে |
অনুতাপ উপজিত আপনার মনে ||
আর একবার তুমি তেমন করিয়া |
দেখা দেও সেইরূপ মধুর হাসিয়া ||
বহুদিন শুনি নাই সে মধু বচন |
বহু দিন দেখি নাই উজ্জ্বল নয়ন ||
বহু দিন পাই নাই প্রাণের আদর |
বহু দিন হেরি নাই সরল অন্তর ||
বহু দিন হারায়েছি প্রেমের চুম্বন |
বহু দিন ছিঁড়িয়াছে হৃদয় বন্ধন ||
এখন হৃদয় মন পাগল আমার |
আর একবার দেখি এই শেষবার ||

.           *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
কে বা গায়
( বাসনা )
কবি নটী বিনোদিনী

.        নীরব নিশীথ মাঝে কে ওই গাইছে রে ?
গাইছে দুঃখের গান               সমীরণে মিশে তান |
.        ধীরে ধীরে স্বর-মালা ভাসিয়া যাইছে রে
.        নীরব নিশীথ মাঝে কে ওই গাইছে রে ?
.        শ্রান্ত ক্লান্ত স্বর ওই গগনে মিশায়,
প্রফুল্লতা নাহি স্বরে,                 তথাপি যে সুধা ক্ষরে
.       সুখস্বাদ অবসান নিরাশ আশায়
.       বসিয়ে বিজনে দেশে কেবা ওই গায় ||

.          বিস্বাদেতে মাখা ওই সঙ্গীত সুন্দর
দিগন্ত ব্যাপিয়া ধায়,                যেন সে জানাতে চায়
.          প্রত্যেক লহরী তার অশ্রুবারিময়
.          সমীরণে ডাকি যেন দুঃখকথা কয় ||

.          প্রফুল্লতা কভু যেন ছিল এই স্বরে
আজি সে উত্সাহ নাই ,            হৃদয় হয়েছে ছাই ;
.          প্রতিবর্ণ প্রতিছত্র আবরণ করে
.          শীতের শিশির মাঝে যেন ডুবে মরে ||

.          পূর্ণ না হইতে যেন মনের বাসনা
ভেঙেছে হদয় তার,                 আশা বাসা নাহি আর
       সংসারে তাহার কিছু নাহিক কামনা
.          ধীর ভাবে শিখিয়াছে সহিতে যাতনা  ||

.          যেন সে মরম গাঁথা মরমে লুকোয়
অতটুকু হৃদে তার,                    সহে যে দারুণ ভার
.           আপনার প্রাণে সদা লুকাইতে   চায়
.           তাই সেই মৃদু তানে সুধা ভেসে যায় ?

.                   *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
আবার চাঁদ
( বাসনা )
কবি নটী বিনোদিনী

.      শশি রে সুন্দর সাজ কে দিয়েছে তোরে |
ভাল বাস ভাল বাসি,               আনন্দ সাগরে ভাসি
.      বুক ভরা মুখ ভরা ঐ হাসি হেরে ;
.      জুড়াতে প্রাণের জ্বালা কে শিখাল তোরে ||


.      চাঁদ রে শুধাই তোরে বল একবার |
এমন মধুর প্রাণ,                    সুধা ভরা কাণে কাণ
.      অঙ্কিত করেছ কেন কলঙ্ক রেখায়
.      এতরূপে হৃদি কালী ঢাকা নাহি য়ায় ||

.      বল শশি ! কি বেদনা প্রাণেতে তোমার
কেন ও হৃদয় মাঝে,                কলঙ্কের রেখা সাজে
.      কি আঘাতে ভেঙ্গেছে ও নির্ম্মল হৃদয় |
.      ( আহা ) না জানি হৃদয় তব কত ব্যথা সয় ||
.      আমারে বলিতে শশি ! দোষ নাহি কিছু
সমব্যথী হলে পরে,                 বেদনা জানায় তারে
.      ব্যথিত হৃদয় তার হয় যে সান্ত্বনা
.      শশি রে মনের দুঃখ আমায় বল না  !

.      একটি কালীর দাগে এত তব যাতনা
দেখ এ হৃদয় মাঝে,                 কত শত দাগ সাজে
.      দেখ কত শিখিয়াছি সহিতে বেদনা |
.      শশি রে মনের দুঃখ আমায় বল না ||

.                   *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
স্বপ্নে আশা
( বাসনা )
কবি নটী বিনোদিনী

.         একদিন ঘুমঘোরে দেখিনু স্বপন  |
.         ফুটিছে সুবর্ণ পদ্ম সলিল শোভন ||
পূজিতে বাসনা করি,              যতনে করেতে ধরি,
.         তুলিনু সে স্বর্ণপদ্ম মানসমোহন |
.         আচম্বিতে ইষ্টদেব হলো অদর্শন ||

.         বলে গেল যেন ফিরে আসিবে আবার |
.         যতনে লইবে মম এই উপহার ||
সেই রূপ সেই থেকে,              দিন গুনি একে একে,
.         এলো গেল কতদিন সে তো এলো নাই |
.         কোথায় রয়েছে ভুলে সংবাদ না পাই ||

.         আগে যদি জানিতাম আসিবে না আর |
.         আসি বলে যেতে হয় সেই যাওয়া তার ||
তা হ’লে কি ফুল লয়ে,            থাকিতাম পথ চেয়ে,
.          তুলিয়ে কি এই পদ্ম মৃণাল হইতে |
.          দিতাম কি মৃণালেরে সলিলে ডুবিতে ||

.          উঠেছে আকাশে রবি প্রবলপ্রতাপে |
.          শুকায় বিমল পদ্ম আতপের তাপে ||
তথাপি রয়েছে ঘোর,              ভাঙ্গে নি স্বপন ঘোর,
.          ডুবিল যে মৃণালিনী তাপিত অন্তরে |
.          পুড়িল নলিনী বালা উষ্ণ রবিকরে ||

.          এলো দিন গেল চলে সকল নিবিল |
.          ছায়া সম স্বপ্ন কথা মনেতে রহিল ||
কেটে গেল যুগান্তর,                তবু কেন এ অন্তর,
.          আসে আসে এই আশা ছাড়িতে নারিল |
.          কত দিন হয়ে গেল আশা না পূরিল ||

.                   *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
ওরে আমার খুকি মাণিক
( বাসনা )
কবি নটী বিনোদিনী

.         নেচে নেচে খেলা করে ওরে যাদুধন
নেচে নেচে তালি দিয়ে,          এস যাদু মা বলিয়ে,
.         জুড়াক আমার প্রাণ হেরিয়ে বদন |
.         ওরে মোর খুকুরাণী অমূল্য রতন ||

.         কত সুধা ধরে রাণী  ও কোচি অধরে
তালি দিয়ে নেচে চল,             কোটি চাঁদ ঝল মল,
.         কনক কিরণ কণা পড়ে ঝরে ঝরে |
.         অনিমেষে হেরি তবু প্রাণ নাহি ভরে ||

.         কি দিয়ে গড়েছে বিধি কিসে প্রাণ ভরা
চাঁদের ঘুমান হাসি,                 তোমার অধরে আসি,
.         ফুলের কমল কায় আবরণ করা |
.         মধুর মাধুরীময় প্রাণমনহরা ||

.         বল দেখি এত সুধা কোথা তুমি পাও
ক্ষুদ্র ও হৃদয়খানি,                   সুধা রসে পূর্ণ জানি,
.         দুঃখিনী মায়েরে কত যতনে বিলাও |
.         আমি কেন যেবা চায় তারে তুমি দাও ||

.         ননীর পুত্তলি মম ওরে খুকুরাণী
কত জন্ম পুণ্য ফলে,                ও চাঁদ পেয়েছি কোলে,
.         জুড়ায় তাপিত প্রাণ হেরি মুখখানি |
.         আমার দুধের মেয়ে ওরে পুঁটি রাণী ||

.         কত কথা কও রাণী আধ আধ স্বরে
মা মা বলি ছুটি ছুটি,               এস রাণী গুটি গুটি,
.         কতই সুন্দর হাসি খেলে ও অধরে |
.         কোটি কোটি শশী যেন একত্র বিহরে ||

.             কত জ্বালা ভুলি রাণী হেরি চাঁদ মুখ
যখন গলাটি ধরে,                   মা বোলে ডাক আদরে,
.        মনেতে পড়ে না আর সংসারের দুঃখ |
.        মরুভূমি মাঝে তুমি স্বরগের সুখ  ||

.        শত কোটি নমি আমি শ্রীহরির পায়
তাঁহার কৃপার বলে,                তোমারে পেয়েছি কোলে,
.        দয়া করে দীর্ঘজীবী করুন তোমায় |
.        করযোড়ে নমে দাসী,  এই ভিক্ষা চায় ||

.                   *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
কোথা গেলি
( বাসনা )
কবি নটী বিনোদিনী

আয়রে প্রাণের পাখি
হৃদয় মাঝারে তোরে লুকায়ে রাখি
গহন কানন মাঝে
কোথা তুই হারাইয়া যাবি
হৃদয় বিহঙ্গ তুই মোর
পথ কোথা পাবি ||
চিরদিন বাঁধা ছিলি
হৃদয় পিঞ্জরে;
আজিকে কেন রে পাখি
গেলি তুই উড়ে |
বড় যে যতন কোরে
রেখেছিনু হৃদ্ পিঞ্জরে
বলনা তুই কেমন কোরে
পলাইয়ে গেলি |
মনের মতন সাধের পিঞ্জর
আবার কোথায় পেলি ||
বাঁধা ছিলি প্রেমশিকলে
কেমনে তা ফেল্লি খুলে
ক’ইতিস কত প্রেম কথা
সব কি তুই গেলি ভুলে
অজানা অচেনা দেশে
কেমনে বেড়াবি ||
মনের মতন সাধের শিকল
আবার কোথায় পাবি ||
হৃদয় পিঞ্জরে তুই
থাক্ তিস সদা সুখে
বল দেখিরে প্রাণের পাখি
উড়্ লি কোন দুঃখে |
সাধ করে দিয়েছিলি ধরা
সাধ করে উড়্ লি
সাধ করে যে গড়্ নু খাঁচা
শূন্য করে গেলি ||

.  *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
শকুন্তলা
( বাসনা )
কবি নটী বিনোদিনী

রাখ একটি বচন
ক’রো নাকো আঁধার জীবন
না হয় ফিরায়ে দাও
সে প্রেম মিলন |
নির্জ্জন কানন মাঝে
বসিয়ে বকুল তলে
সোহাগে ধরিয়ে হাত
বলেছিলে প্রাণনাথ
এস প্রিয়ে বাঁধি তোমা
প্রেমের বন্ধনে |
হৃদয়ে হৃদয়ে মিলে
নিঠুর সংসার ভুলে
এস খেলি দুইজনে
সুখের স্বপনে |
সাক্ষী থাক লতাগণ
আর মলয় পবন
গোলাপ মালতীফুল
আর এই তরুমূল
গগনবিহারী  ঐ
বিহঙ্গিনীগণ |
গগনে হাসিছে তারা |
চাঁদে ঢালে সুধা ধারা
দেহ প্রিয়ে অধীনেরে
প্রেমের চুম্বন ||
বিনিময়ে নাও এই
দেহ প্রাণ মন |
সেই ত তটিনী কূল
সেই সব বনফুল
সেই ত গগনে শশী
সেই তরুতলে বসি
বিষাদে মলিন কেন
বিমল বদন |
নয়নে সে জ্যোতি কই  !
অধরে সে হাসি কই
আজি অবনত কেন
উজ্জ্বল নয়ন  ||

.  *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর