বিনোদিনী দাসী - উনিশ শতকের বাংলা নাটকের সর্বশ্রেষ্ঠ এবং সর্বখ্যাতিমান নায়িকা ছিলেন।
কলকাতার একটি দুস্থ পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯১৩ সালে প্রকাশিত তাঁর আত্মজীবনী “আমার কথা”-
তে লিখেছেন তাঁর মা এবং মাতামহীর কথা। লিখেছেন তাঁর এক বোন ও এক ভাই ছিল যে শৈশবেই
অসুস্থতার কারণে মারা যায়। তাঁর শৈশবে বিয়ে হয়েছিল এবং তাঁরা একসঙ্গে খেলা করতেন।

তিনি বাল্যকালে কিছু দিন বিদ্যালয়ে গিয়েছিলেন। সবকিছু জানা ও পড়ার জন্য তাঁর অদম্য উত্সাহ ছিল।
চলনসই ইংরেজীও তিনি শিখেছিলেন। দেশবিদেশের নানা কাহিনী, সাহিত্য, বিখ্যাত ব্যক্তিদের জীবনী ও
অভিনেতা-অভিনেত্রীদের জীবনী তিনি সাগ্রহে জানা ও পড়ার চেষ্টা করতেন। নিজের মেয়ে শকুন্তলাকে তিনি
বিদ্যালয়ে শিক্ষাদানের চেষ্টাও করেছিলেন কিন্তু তা সফল হয় নি।

ছোটবেলায় গঙ্গাবাই নামের এক বাইজীর কাছে নাচ ও গানের শিক্ষা লাভ করেন। সেই সূত্রেই, আর্থিক
দুরবস্থা কাটানোর জন্য তাঁকে তাঁর পরিবারের থেকে অভিনয় করতে দেওয়া হয়।  

১৮৭৪ সালের ২রা ডিসেম্বর, মাত্র ১২-১৩ বছর বয়েসে তিনি প্রথম মঞ্চে প্রবেশ করেন, “শত্রুসংহার” নাটকে
দ্রৌপদীর সখীর ভূমিকায়। ১৮৮৬ সাল পর্যন্ত গ্রেট ন্যাশনাল, বেঙ্গল, ন্যাশনাল ও স্টার থিয়েটারে তত্কালীন
যাবতীয় শ্রেষ্ঠ নাটকের প্রধান নারী-চরিত্রে অভিনয় ক’রে অসামান্য যশ লাভ করেন। মাত্র ২৩-২৪ বছর
বয়সে তিনি তাঁর খ্যাতি ও ক্ষমতার চরম সিদ্ধির লগ্নে রঙ্গালয়ের সংস্রব চিরতরে ত্যাগ করেন। বিনোদিনী
মাত্র ১২ বছর অভিনয় করেছেন, প্রায় ৮০টি নাটকে ৯০টির বেশী ভূমিকায়। তিনি শেষ অভিনয় করেন
“বেল্লিক বাজার” নাটকে রঙ্গিনীর ভূমিকায়, স্টার থিয়েটারে, ১লা জানুয়ারী ১৮৮৭ তারিখে।

“রূপ ও রঙ্গ” পত্রিকার (১১শ সংখ্যা, ১৩৩১ সাল) সম্পাদকীয় থেকে জানা যায় তখনকার অভিনেত্রীদের যে
সাজবার ধরনের চলন প্রচলিত হয়েছিল তাও এই আদর্শ অভিনেত্রীর অনুকরণে। প্রসাধন বিদ্যায় তাঁর
অসাধারণ নৈপুণ্য এবং অধিকার ছিল। অভিনেত্রীদের মধ্যে সাজবার অনেক খুঁটিনাটি ব্যপার, এমন কি,
“পিনটি” আঁটবার মত বিষয়ও তাঁর কাছ থেকে ধার করে শেখা। বিনোদিনী প্রসাধনী বিদ্যা শিখেছিলেন
বিলাতী থিয়েটারের বই এবং নানা দেশীয় চিত্রকলা থেকে।

তখনকার সাময়িক পত্রিকাগুলি তাঁকে “ফ্লাওয়ার অফ দ্য নেটিভ স্টেজ”, “প্রাইমা ডোনা অফ দি বেঙ্গলি
স্টেজ”, “মুন অফ স্টার কোম্পানি” নামে ভূষিত করে মোটেও অত্যুক্তি করেন নি।    

বিনোদিনী শুধু আত্মজীবনীই লেখেন নি, লিখেছেন কবিতা এবং সেই সময়ের নানা সাময়িক পত্রিকায় নাটক
ও রঙ্গালয় সম্পর্কে পত্রাকারে ধারাবাহিক আলোচনার সূত্রপাতও করেছিলেন। লেখিকা হিসেবে বিনোদিনী
অনেকখানি ক্ষমতার পরিচয় রেখেছেন তাঁর গদ্য ও পদ্য রচনায়। তাঁর গল্প বলার ক্ষমতাও ছিল অসামান্য।
তাঁর প্রথম কবিতা প্রকাশিত হয়েছিল ১৩০২ বঙ্গাব্দে (১৮৯৫) সৌরভ পত্রিকায়। এরপর ১৩০৩ (১৮৯৬) তে
প্রকাশিত হয় তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ “বাসনা” এবং ১৩১২ (১৯০৫) সালে প্রকাশিত হয় দ্বিতীয় কাব্যগ্রন্থ “কনক
ও নলিনী”। এরপর ১৯১০ সালে “নাট্যমন্দির” পত্রিকায় তাঁর আত্মকথা রচনার সূত্রপাত হয়েছিল। নাম ছিল
“অভিনেত্রীর আত্মকথা”। মাত্র দুটি সংখ্যার পর তা বন্ধ হয়ে যায়। । ১৯১৩ সালে প্রকাশিত হয় তাঁর
আত্মজীবনী “আমার কথা”। ১৯৩১-৩২ সালে “রূপ ও রঙ্গ” পত্রিকায় প্রকাশিত হতে শুরু হয় তাঁর রচনা
“আমার অভিনেত্রী জীবন”। এখানেও তা অসমাপ্ত থেকে যায়।

আশ্চর্যের বিষয় এই যে বাংলা নাটক বা সাহিত্যের ইতিহাসে সরাচর বিনোদিনীর নাম উল্লেখ করা হয় না।
বিশেষ করে সাহিত্যের ইতিহাসে একজন আত্মজীবনীকার বা কবি হিসেবে আমরা তাঁকে তেমন করে খুঁজে
পাই না। ১৯৩০ সালে, শ্রী যোগেন্দ্রনাথ গুপ্ত রচিত “বঙ্গের মহিলা কবি” গ্রন্থের পরিশিষ্টে “শ্রীমতী বিনোদিনী
দেবী”-র লেখা “নিহার-মালা” কাব্যগ্রন্থের উল্লেখ রয়েছে কিন্তু নটী বিনোদিনী বা বিনোদিনী দাসীর কোনো
উল্লেখ আমরা পাই না। এটা কি এই জন্যই যে বিনোদিনী বার বার নিজেকে “বারাঙ্গণা” বলে  উল্লেখ
করেছেন! এক “বারাঙ্গণা”কে ভদ্রমহিলাদের সঙ্গে এক পংক্তিতে বসানো গর্হিত অপারাধ,  নাকি তাঁর
কবিতার সৌরভ তখনকার বাঙালী বুদ্ধিজীবী সমাজের নাসিকারঞ্জন করে উঠতে পারেনি!

বিনোদিনীর নাট্যশিক্ষাগুরু ছিলেন নাট্যকার ও
কবি গিরিশ ঘোষ। তাঁর শিক্ষা দিক্ষায় যেমন নটী বিনোদিনী
তাঁর প্রসিদ্ধী লাভ করেছিলেন, ঠিক তেমনই বিনোদিনীর অভিনয় নৈপুণ্যের জন্যই গিরিশ ঘোষের নাটক
মঞ্চস্থের সফলতা বলে অনেকেই মনে করেন। বিনোদিনী নানা সময়ে তাঁর নিজের প্রভাব খাটিয়ে, তাঁর
নাট্যগোষ্ঠির জন্য অর্থসংস্থানও করেছেন। কিন্তু কথা দিয়ে, “স্টার থিয়েটার”কে তাঁর নামে নামকরণ, তাঁরই
চারপাশের সেই মানুষগুলিই করতে দেননি।
গিরিশ ঘোষ চাইলে কি কিছুই করতে পারতেন না! এই সব
আঘাত বিনোদিনীর নাটক ত্যাগ করা মূলে থাকতে পারে!

১৯৮৪ সালে শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংস, “চৈতন্য লীলা” নাটক দেখতে এসে বিনোদিনীর সঙ্গে গ্রীনরূমে গিয়ে দেখা
করে আশির্ব্বাদ করে আসেন। ১৮৮৬ সালে রামকৃষ্ণ পরমহংস দেহরক্ষা করেন। সেই বছরই বিনোদিনী
থিয়েটারে অভিনয় ত্যাগ করেন। এই দুইয়ের মধ্যেও একটা সম্পর্ক ছিল কি না তা নিয়েও বিদ্বজনেরা,
ভাবনা চিন্তার অবকাশ রয়েছে বলে মনে করেন। শ্রীরামকৃষ্ণ পরমহংসের মৃত্যুশয্যায়,  বিনোদিনী হ্যাট-
কোটের ছদ্মবেশে গিয়ে তাঁর সঙ্গে দেখা করে আসেন। স্বামী সারদানন্দের “লীলাপ্রসঙ্গে” এই সাক্ষাত্কারের
বিস্তৃত বিবরণ রয়েছে। বিনোদিনীকে দেখে ঠাকুর নাকি হাসছিলেন।


আমরা
মিলনসাগরে  কবি বিনোদিনী দাসীর কবিতা ও গান তুলে আগামী প্রজন্মের কাছে তা পৌঁছে দিতে
পারলে আমাদের এই প্রচেষ্টা সার্থক মনে করবো।


কবি নটী বিনোদিনীর মূল পাতায় যেতে এখানে ক্লিক করুন        
বিনোদিনী দাসীর কণ্ঠে গান "প্রাণ আর বাঁচে কেমনে" শুনতে এখানে ক্লিক করুন        


উত্স -  "আমার কথা ও অন্যান্য রচনা, বিনোদিনী  দাসী", সম্পাদক সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় , নির্মাল্য আচার্য
.         সহযোগী সম্পাদক শঙ্কর ভট্টাচার্য, ১৪১১ বঙ্গাব্দ, সুবর্ণরেখা, ৭৩, মহাত্মাগান্ধী রোড, কলিকাতা - ৯
  
.         
http://www.indianetzone.com/29/binodini_dasi_indian_actress.htm   
.               
http://en.wikipedia.org/wiki/Binodini_Dasi        




আমাদের ই-মেল - srimilansengupta@yahoo.co.in     


এই পাতা প্রকাশ - ৩০.০৪.২০১৩
...