স্বপ্ন না কি প্রতারক ! তবু আমি স্বপ্ন দেকি গভীর আবেশগ্রস্ত দিনে ; ঘুমের ভিতরে কিংবা জেগে আধো জেগে একা, জনতার ভিড়ে দেখি ---- মানুষের চোখের শূন্যতা আর সেরকম নেই, ক্রমশ উজ্জ্বল দীপ্ত স্বপ্নময়, যে রকম শৈশবে দেখেছি ; পা দুটি কেমন স্রোত ঠেলে ঠেলে ভেসে যাচ্ছে অনির্ভার, সর্বস্ব খোয়ানো---- হাত দুটি উত্তোলিত, তাতে নেই ভাঙা সান্ কি নিঃস্ব আঁকিবুকি ; কোথাও দেখেছে না কি প্রতিশ্রুতি সমাজের রাষ্ট্রের নারীর সন্তানের কাছে, বহু পথ ঘুরে অবশেষে ? এ কোন মানুষ ? ক্লান্তি অবসন্নতার সীমাহীন খানখন্দ পার হয়ে শেষে দেখেছে দূষণমুক্ত নদী----- অবগাহনের উচ্ছল আরাম ? পাড়ে পাড়ে শস্য শিশু ঝুঁকেপড়া মেয়েদের বিশ্রাম, সেখানে মানুষের ঘরবাড়ি সুস্থির শান্তির কোলে ঘুমিয়ে রয়েছে ?
ঘুমের ভিতরে কিংবা জেগে কিংবা আধো জেগে স্বপ্ন দেখি : কলকাতার পথে সেইসব উচ্ছিন্ন মানুষ আর মানুষ নামীয় কঙ্কালেরা কোন মায়ামন্ত্র বলে অদৃশ্য হয়েছে., আর তারাই মেতেছে কার্ণিভালে ; প্রশস্ত পথের পাশে রঙিন ম্যানসান, পার্কে সুবেশা যুবতী---- একদিন ডালহৌসির গলাপিচে শতছিন্ন চটি ফেলে রেখে আদ্যন্ত নৈরাশ্য নিয়ে বাড়ি ফিরে ভেবেছে মৃত্যুর কথা, মাঝরাতে জেগে দেখেছে, আকাশে কোনো তারা নেই পরিবর্তে বোবা আর দুঃখী শূন্যতা রয়েছে !
এখন পার্কের ঘাসে সেও প্রতীক্ষায় বসে, চুল ওড়ে, শিশুদের দিকে দু’হাত বাড়িয়ে কিছু স্বপ্ন ধরে, আর কিছু স্বপ্ন দেয় ছুঁড়ে |
আমাদের মাঝখানে সবুজ প্রান্তর পড়ে আছে--- আর কিছু নেই | অথচ আমরা কত দূরে, এই মাঠ পেরুলেই যেতে পারি কাছে ছেলেবেলাকার মতো | মনে হয় ভারি শেকলের বোঝা পায়ে নিয়ে ছুট দিতে পারব না ; জটিল শেকড়ের বাঁধনে রয়েছি |
ক্রমশ ধুসর হয়ে যাচ্ছে মুখ, পরিচিত শরীর তোমার | আমাদের ভাষাব্যবহার দেখে মনে হয় শব্দ তার . হারিয়েছে অর্থ ও ব্যঞ্জনা ; একে অপরের দিকে চেয়ে থাকি ঘাতকের নিষ্পলক ঘোলাটে চোখের সংকেত ছড়িয়ে | আর কিছু ?
কারা গন্ধ শুঁকে শুঁকে আসে পিছু পিছু ? দেখি না মুখের রেখা, চোখের দৃষ্টির অর্থবহ দ্যুতিবিকিরণ | সব কিছু অপরিচয়ের অন্ধকারে ডুবে যেতে থাকে | কার ডাকে সাড়া দেব ? ছুটে যাব প্রান্তর পেরিয়ে ইচ্ছে মতো ?
কথা নয় ; যেন পশু হয়েছে আহত---- ক্রুদ্ধ গোঙানির স্বর শুনি ; বুঝে নিই ----- আমাদের ভাষা হৃদয়ের তারা থেকে নয় ; সভ্যতার অর্থ আজ ক্রম অবক্ষয় মানবিক বোধ ও বিস্ময় থেকে দূরে সরে গেছে | ভালোবাসাবাসি অর্থহীন, বাসি |
সময়কে বলি : সময় ! তুমি, ওই পথে যাও ওইখানে স্থির হয়ে বসো যেমন বসে, দুঃখ যেমন দেহের পাশে ছায়া, যেমন মরণ আমি এখন এইখানে এই পাথরে ফুল ফোটাব এই পাথরে মন্ত্র এইখানে খোদাই করব নাম শব্দে-শব্দে দুলিয়ে দেবো নাভিমূল বাতাসে বাতাসে ভ্রূণবীজ
আমি পাহাড়ে আঘাত করে খুলে দেব প্রস্রবণ নীলিমার দিকে হাত তুলে স্পর্শ করব মাটিকে চোখের মণিতে সূর্য জ্বেলে জ্বালিয়ে দেব ঘরের প্রদীপ |
এক একটা দিন মনে হতে থাকে সব চলে গেল . সব চলে গেল ; এক একটা দিন দেখি কারা দূরে নদীর ওপারে . সাজাচ্ছে চিতা ; সারাদিন ধরে ঝুপ্ ঝুপ্ পাড় ভাঙার শব্দ . কান পাতলেই ; সারা বনটাই চষে ফেলি তবু কোনখানে নেই জনক দুহিতা !
এক একটা দিন মেঘ ও রৌদ্রে শৈশব থেকে . ছুটে আসে হাওয়া ; হু হু করে বুক, কীসের অসুখ বুঝি না . মেঘেরা ঝুঁকে পড়ে নীচে ; গগন ঠাকুর মৃত্যু সিরিজ সাদা কালো রঙে . এঁকে যায়, আর---- ঘুঘু ডাকে অস্ফুট স্বরে, বলে---- . শুরু হল যাওয়া, শুরু হল যাওয়া |
আমি ভূতগ্রস্ত এক সম্মোহিত শব্দের শিকারি ; আজন্ম তাড়িত আত্মা ; অস্থির অশান্ত, সিদ্ধবাক্ ; যে তীক্ষ্ম আঘাত করে, আমি পায়ে নত হই তারই, যদি সে পোড়ায়, আমি পায়ে নত হই তারই, যদি সে পোড়ায়, আমি পুড়ে পুড়ে হয়ে যাই খাক্ এবং উদ্ভূত ছাই ভ’রে রাখি শব্দের কলসে | স্রোতে ভেসে যেতে যেতে সে খুঁজে ফিরছে খড়কুটো, ভাঙন-ভঙ্গুর পাড়ে দাঁড়িয়ে, নিজেরই মুদ্রাদোষে টেনে তুলি তাকে, ---- নেই আমারই আশ্রয়, চাল ফুটো | আমার পায়ের নীচে অনন্ত গহ্বর মুখ মেলে প্রতীক্ষায় ; তার চাওয়া সামান্যই, খেতে চায় দেহ ; জ্বলন্ত শরীর নিয়ে আমি ছুটি দর্পিত পা ফেলে ; কখনও দিগন্ত জুড়ে হাত পাতি বিশাল সস্নেহ, সেই হাতে ভিক্ষাপাত্র, প্রেম আর মৃত্যুর ভিখারি |
ঈশ্বরের কথা খুব মনে হয় আজকাল, আর মনে পড়ে তোমাকে | তুমি নও ঈশ্বরের প্রতিদ্বন্দ্বী, নও অনন্তের | তুমি এই ব্যক্তবিশ্বের সামান্যা, শুধু --- অসামান্য আমার কল্পনায়, আমার সত্তায় সংলগ্ন অরূপের বর্ণোদ্ভাস ; রঙে রেখায়, রক্তের স্পন্দনে সে এক দৈবী উদ্ভাসই মেনো |
পঞ্চাশ পার হয়েছি, চুলে ধরেছে পাক, আমি আজকাল অবলীলায় শুনতে পাই . শূন্যে ঝুলম্ত ঘন্টার ধ্বনি ; দেখতে পাই সেই . অদৃশ্য ঘড়ির কাঁটার অবিরাম সঞ্চরণ, শুনতে পাই . নৈঃশব্দ মন্থিত কান্নার শব্দ ; আর আমার প্রিয়তম ইন্দ্রিয়গুলি, . ওরা ক্রমশই হয়ে উঠছে প্রখর আর অনুভূতিময় |
ভেবেছিলাম এই পড়ন্ত রোদে মিলিয়ে যাবে . তোমার মহিমান্বিত দৈবী উপস্থিতি ; হয়তো ফিরে তাকাব অভ্যেসে . দাঁড়াব না তার টানে ; এবার দেব ছুটি তোমাকে, আর তা চিরকালের মতো ; এই রকমই শপফ ছিল আমার | আর দেখলাম তুমি রয়েছো আমার আঠারো বছরের শরীরটাকে জড়িয়ে, আমি বয়ে বেড়াচ্ছি তো আমার একটাই শরীর, যেমন একটাই আকাশ --- ঝড় উঠলেই মনে হয় কত অচেনা, মেঘের দিনে দুরলোকের আভাস আনে বহন ক’রে | আর এই চির পরিচিত মাটি, সেও কেমন বদলে যেতে থাকে, দিনদিন বদলে যায় | তুলতুলে মাটি কখন হয় পাথর, আর তার বুকে ফণিমনসার কাঁটা ফোটে পায়ে আবার ঘাসের মসৃণতা দুঃখ দেয় ভুলিয়ে | অথচ তুমি রয়েছ তেমনই ; জড়িয়ে আছ আমার আঠারো বছরের শরীরটা |
আমি স্থির হতে পারছি না | ভাঙছে শরীর, আর ছড়িয়ে দিচ্ছি শিকড়গুচ্ছ যতোদূর আঁকড়ে ধরতে পারি | ছিলাম এক আর হয়েছি বহু---- ভাঙতে ভাঙতে বীজ যেমন অনন্য হয়ে ওঠে একটি গাছ --- এক স্বতন্ত্র উত্স থেকে পরিণাম |
তুমি রয়েছ উত্সে জেনো ক্ষণজীবিতের পূর্ণতা; মেতে মেতে ফিরে ফিরে দেখছি তোমাকে |
এইমাত্র যে শালিকটি উড়ে গেল পশ্চিমের দিকে ওর পাখার ছায়া সরে যেতে দেখলাম ধুলোয় ; বাতাস এল উদাসীন আবেগ কাঁপিয়ে আর উড়িয়ে নিয়ে গেল ছায়া মাখা ধুলোকেই ; সে সাজলো রাজা ; একটি পালকও আর পড়ে রইল না ধুলোয় |
পথ ভাঙতে ভাঙতে আমি এসেছি এইখানে | আমার তরতাজা শরীরটা এখন ক্ষয়িষ্ণু শিলা যেন, তার উপরে আছড়ে পড়ছে নোনা জলের ঢেউ, জলের দাঁত দিনরাত্রি খাচ্ছে কুরে কুরে আমি টের পাচ্ছি ; আর তখনো আমার রক্তে তোমার দৈবী মুখ কাঁপছে তিরতির ক’রে,
আজ আমি যখন ভাবছি ঈশ্বরের কথা, ভাবছি তোমার কথাও | সেই আমার উষ্ণীষ পরা প্রথম অশ্বারোহী দিনগুলো ছটফটিয়ে তারার দেশে পাড়ি দিতে চাইত একদিন, আমি ছিলাম চালচুলোহীন রাজপুত্র, স্বপ্ন ছিল তরোয়াল ; প্রাণ ধারণে প্রাণান্ত, তবু স্বপ্ন ছিল আমার হাতের মুঠোয়, আমার হাতের---- |
আমি বাঁচতে চাইলাম তোমাকে প্রতিদিনের তুচ্ছতায়, তুমি ভয় পেলে | আমি ছিলাম তখন ফুটোফাটা ডিঙি নৌকোর মাঝি, কে হবে চরণদার ? তুমি ভুলে গেলে পরস্পরের আত্মার সৌগন্ধ্য আর তার বিনিময়ে মুহূর্তগুলি ; তুমি বিছিয়ে দিলে সাদা চাদর আমার স্বপ্নগুলোর উপর ; ঠান্ডা মেঝের উপর পড়ে রইল শ্বেতগোলাপের পাপড়ি ইতস্তত মিথ্যে প্রেমের স্মারক চিহ্ন হয়ে |
আজও মাঝে মাঝে সরিয়ে ফেলি চাদর আর দেখি আমার মৃত স্বপ্নগুলির শরীর হয়েছে কিনা বিকৃত | দেখি, ওরা যেমন ছিল তেমনি আছে ; আমার স্পর্শের প্রতীক্ষায় ঘুমিয়ে আছে যেন ; স্পর্শ পেলেই চোখ মেলবে, আবার উঠবে জেগে |
কিছু প’ড়ে থাকে, কিছু খুঁটে খায়., কিছু ঠোঁটে ক’রে পাখি উড়ে যায় কোন্ দিকে ? এইভাবেই আমাদের থাকা কিংবা না-থাকা ফুরোয় ? রাখি বা না রেখে যাই দিনপঞ্জী লিখে, অলৌকিক পাহাড়ের সোনার চুড়োয় সূর্য বসে, নেমে যায় খাদে |
সুবাতাস ভারী ক’রে কেউ কেউ দারুণ আহ্লাদে--- পৃথিবীর রাজপথ গলিপথ জুড়ে রাজকীয় আলোর প্লাবন দেখে যায়, পায় চরিতার্থ জীবনের সুখ |
আমাদের পিঠে যদি আছড়ে পড়ে আলোর চাকুক ---- খুঁটে খাওয়া জীবনের এই পরিণাম ভেবে দুঃখ পাই, দিই ছানাদের ঠোঁটে তুলে কাকড়ি দানার অবশেষ |
কুড়োনো খড়ের ঘরে নেমে আসে আলোর আবেশ, শব্দ ক’রে ভেঙে পড়ে পার, ঘূর্ণি ওঠে, ওঠে জলস্রোত ; একদিন এইখানে মাটি ও মানুষ ছিল, তার কোনো চিহ্ন রেখে যায় নদী ?
ইতিহাসকাল থেকে পুরাণ অবধি কিছু প’ড়ে আছে, কিছু খুঁটে খায়, পালক ছড়িয়ে কিছু ঘাসে চিহ্ন রেখে চলে গেছে ; সেই অন্তর্ভেদী শূন্যতার হা হা শব্দ চৈত্রের বাতাসে |