প্লাবিত অম্বর গীত তরঙ্গে
শত শত বেদ অমরগণ তপনে
বর্ষিত কুসুমাঞ্জলি যুগ চরণে |
কাব্য জগৎময় পূজিত জননী
অদ্য তব স্তব নাদিত ধরণী
শত নর যাচিত শতাশ ভাব
বিদ্যা কবিতা সঙ্গীত হার |
কি তব সকাশে চাহিব আর
ফলিত স্বকর্মে যাচন ভার
প্রার্থনা পুরিত আংশিক তপনে
পরাংশ সাধিত নর হৃদি যতনে |
মোহবশে নর সৎপথ ভ্রষ্ট
কম হৃদি বৃত্তি মুকুলে বিনষ্ট
আত্ম ছলন কৃত মন দুখ ভার
মাতঃ সে সব বিপদ নিবার ||
. ****************
. সূচীতে . . .
মিলনসাগর
. হেলেনা বিটপী কুসুমভারে
হেথা এক ফুল পড়েছে হেলায়
. ঢলিছে শিশির পল্লব তরে
কাঁদে যথা শিশু আদরে ভাসায়
. জননী বদন নয়ন জলে
চম্পক কামিনী মালতী মল্লিকা
. হাসে চারিদিক বিটপী পরে
বিকশিত কত কম শেফালিকা
. দোলে ধীরে ধীরে সমীর ভরে,
কুমুদ কহ্লার শোভে নদী জলে
. তীরে তরুবর সে ছবি হেরে
উল্লাসে তটিনী সাজি ফুল দলে
. প্রবাহিয়া যায় মধুর স্বরে
রচিনু যতনে কুসুমের হার
. বসি নদীতীরে বিটপীতলে
ফুলহার লয়ে ফিরিনু আবার
. পরাতে সে মালা কাহার গলে ||
. ****************
. সূচীতে . . .
মিলনসাগর
ঙ্গ
কবি রাজশেখর বসু
বেলাবন্ধনে পঙ্গু
সাগর মাগিল সঙ্গ |
বারতা পাইয়া তুঙ্গে
লম্ফে নামিল গঙ্গা |
ভঙ্গী দেখিয়া রঙ্গে
হাসিয়া ডাকিল বঙ্গ----
এই পথে এস গঙ্গা,
মিলিবে তোমার সঙ্গী ||
. ১৯৩৯
. ****************
. সূচীতে . . .
মিলনসাগর
নিশীথ গগন যদি উজ্জ্বল পট হ’ত, চন্দ্র তারকা মসীবিন্দু,
চাহিয়া দেখিত কেবা তুচ্ছ তারার কণা, কেবা বন্দিত কালো ইন্দু ||
. ... / ৯ / ৪৩
. ****************
. সূচীতে . . .
মিলনসাগর
সরস্বতী
কবি রাজশেখর বসু
ফুল্ল কমল দল মানস সরসে
শেলীর The Question হইতে অনুকৃত
কবি রাজশেখর বসু
ভ্রমিতে ভ্রমিতে হেরিনু স্বপন
দুলালের গল্প
কবি রাজশেখর বসু
দুলাল নামে একটি ছেলে পটোলডাঙ্গায় বাস,
একদিন সে লুচি দিয়ে পটোলভাজা খেলে |
পাকা পাকা পটোল তাতে ক্যাঁচর ক্যাঁচর বিচি,
বিচি খেয়ে মুখ বেঁকিয়ে দুলাল বলে --- “ছি ছি,
রইব না আর কোলকাতাতে পটোলভাজার দেশে,
যাচ্চি আমি পন্ডিচেরি মাদ্রাজীদের মেসে |”
এই না ব’লে টিকিট কিনে দুলাল তাড়তাড়ি
কটকেতে চ’লে গেল সেজপিসীর বাড়ি |
ভাবেন তখন দুলালচাঁদের তিন-নম্বর পিসে---
উড়ের দেশে এ ছেলেটির বিদ্যে হবে কিসে |
অনেক খুঁজে মাষ্টার পেলেন, নামটি বাঞ্ছা ঘোষ,
নাকটা একটু থ্যাব্ ড়া-পানা, এই যা একটু দোষ |
বললে দুলাল--- “আপনার সার নাকটা কেন খাঁদা ?
আপনি যদি পড়ান আমার বুদ্ধি হবে হাঁদা |”
বাঞ্ছানিধি হতাশ হয়ে ফিরে গেলেন ঘরে,
নাক-লম্বা গোবর্ধন এলেন দু-দিন পরে |
দুলাল বলে ---- “আপনার সার খাঁড়ার মত নাক,
নাকের খোঁচায় শেষে আমার বুদ্ধি ছিঁড়ে যাক !”
গোবর্ধন বরখাস্ত হলেন চাকরি থেকে,
পিসে তখন ব’লে দিলেন চাপরাসীকে ডেকে----
জলদি লে আও এসা মাষ্টার নাক নেই যার মোটে,
কটক পুরী দিল্লী লাহোর যেখান থেকে জোটে |”
চাপরাসীটা পাগড়ি বেঁধে বন্দুক ঘাড়ে ক’রে
অনেক দেশে দেখলে খুঁজে একটি বছর ধ’রে
তার পরেতে ফিরে এসে বললে ----“ হুজুর সেলাম,
নাক নেই যার এমন মানুষ কোথ্বাও না পেলাম |
কিন্তু অনেক চেষ্টা ক’রে দুলালবাবুর তরে
ধরেচি এই ওস্তাদকে মহানদীর চরে |
নাকের বালাই নেই, কিন্তু আওয়াজটি এঁর খাসা,
শিখিয়ে দিতে পারবেন খুব উর্দু ফার্সী ভাষা |”
চাপরাসী তার লাল বটুয়ার মুখ করলে ফাঁক,
অবাক হয়ে শুনলে সবাই গুরুগম্ভীর ডাক |
আস্তে আস্তে বেরিয়ে এল লম্বা দুটো ঠ্যাং,
বটুয়া থেকে লাফ দিলে এক মস্ত কোলা ব্যাং |
ব্যাং বললে--- “আরে রে দুলাল পড়বি আমার কাছে |”
কোথায় দুলাল ? লেপের ভেতরে ঐ যে লুকিয়ে আছে |
দুলালচাঁদের রকম দেখে কষ্ট পেয়ে মনে,
ব্যাং বেচারা পালিয়ে গেল খন্ডগিরির বনে |
দুলাল তখন ইষ্টিশানে গিয়ে এক্কেবারে
কোলকাতাতে রওনা হ’ল পুরী-প্যাসেঞ্জারে |
পটোলডাঙ্গায় দু-তিন বছর হয়ে গেল শেষ,
বিস্তার বই পড়লে দুলাল, বুদ্ধি হ’ল বেশ |
কিন্তু হঠাৎ একদিন তার খেয়াল হ’ল মনে---
“এখানে নয়, পড়ব আমি শান্তিনিকেতনে |”
ভালমানুষ হলেও দুলাল বড়ই জেদী লোক,
যা চাইবে করবেই তা যেমন ক’রেই হোক |
ছোটকাকার সঙ্গে দুলাল জিনিস-পত্র নিয়ে,
শান্তিনিকেতনের ক্লাসে ভর্তি হ’ল গিয়ে |
ইংরিজী আর বাংলা কেতাব পড়লে একটি রাশ,
পাটীগণিত ব্যাকরণ আর ভূগোল ইতিহাস |
দিনুঠাকুর শিখিয়ে দিলেন গানের অনেক সুর,
তাকাগাকি শিখিয়ে দিলেন কায়দা যুযুৎসুর |
নন্দলালের কাছে দুলাল আঁকতে শিখলে ছবি,
আর সমস্ত যা যা আছে শিখিয়ে দিলেন কবি |
অনেক রকম শিখলে দুলাল শান্তিনিকেতনে,
গায়ে হ’ল ভীষণ জোর আর অসীম সাহস মনে |
গোমড়া-মুখো মাষ্টার যাঁর সদাই হাতে বেত,
নাকে কথা বলেন যাঁরা -- ভূত পেত্নী প্রেত,
পা-ফাটা সেই কানকাটা যে থাকে খেজুর গাছে,
ছোট ছেলের কান ধ’রে যে যখন-তখন নাচে,
বাঘ ভালুক সাপ ব্যাং আর ভিমরুল আর বিচ্ছু ----
এসব দেখে দুলালের আর ভয় করে না কিচ্ছু |
কারণ, দুলাল জানে ওরা সবাই জুয়োচ্চোর,
আর, দুলালের সাহস আছে, গায়ে ভীষণ জোর |
তারপরেতে বোশেখ মাসের তেসরা রবিবারে,
ঠিক দুপুরবেলা যখন ভূতে ঢেলা মারে,
সকল দিক নিঝুম যখন রোদ্দুরে কাঠফাটে,
জুজুর খোঁজে দুলাল গেল তেপান্তরের মাঠে |
জুজু তখন ঘুমুচ্ছিল ভিজে গামছা প’রে ;
সাড়া পেয়ে বেরিয়ে এল ষাঁড়ের মূর্তি ধ’রে---
কাঁধের ওপর মস্ত ঝুঁটি, শিং দুটো খুব লম্বা,
দৌড়ে এসে ঘাড় বেঁকিয়ে ডাক ছাড়লে ---হম্বা |
তেড়ে গিয়ে বললে দুলাল--- “শোন্ রে জুজু হাঁদা,
চেহারা তোর ষাঁড়ের মতন, বুদ্ধিতে তুই গাধা |
যুযুৎসুতে শিক্ষা আমায় দিলেন তাকাগাকি,
জুজুর বুদ্ধি নিয়ে আমার সঙ্গে লড়বি নাকি ?
শিং ধ’রে তোর দুমড়ে লাগাই যদি চাড়,
হুমড়ি খেয়ে পড়বি তখন ওরে গর্দভ ষাঁড় |
আমার সঙ্গে লড়তে এলি মুখ্খু কে তুই রে ?
জানিস, আমি পটোলডাঙার দুলালচন্দ্র দে |”
ফটাস ক’রে ষাঁড়ের তখন পেটটা গেল ফেটে,
ভেতর থেকে বেরিয়ে এলেন মানুষ একটি বেঁটে |
পরনে তাঁর পেন্টুলুন হ্যাট কোট নেকটাই,
হাতে একটি নিরেট খাতা চামড়ার বাঁধাই |
বুকের ওপর দশটা মেডেল, ফাউন্টেন পেন ছ-টা,
হাত-ঘড়িতে কেবল দেখেন বাজল এখন ক-টা |
দুলাল জানে ভদ্রলোকের সঙ্গে ব্যবহার ;
সবাই জানে আরব দেশে আছে শহর মক্কা |
‘এতদ’ ছিল ‘ঢক্কা’ --- হ’ল সন্ধি এতড্ ঢক্কা |”
জুজু বলেন ---- “ভুল করনি বেশী জবাবেতে ;
শিখতে যদি আমার কাছে ফুল-নম্বর পেতে |
মন দিয়ে খুব পড় খোকা, যাচ্চি আমি আজ ;
সেনেট-হলে আমার এখন আছে একটু কাজ |”
দুলাল বলে --- “থামুন মশাই, অনেক সময় পাবেন |
এই গরমে দুপুরবেলা রোদে কোথায় যাবেন ?
এই বারেতে আমার পালা, বলুন দেখি সার---
এই চারটে কোশ্চেনের ঠিক ঠিক আনসার ---
রাবণ-রাজার দশ মুন্ডু, নড়বড়ে বিশ হাত,
কেমন ক’রে বিছানাতে হতেন তিনি কাত ?
গঙ্গা-নদী মহাদেবের জটায় করেন ঘর,
ভিজে চুলে শিবের কেন হয় না সর্দি জ্বর ?
সে কোন্ ঘোড়া ডিম পাড়ে যে বাচ্চার বদলে ?
ভূতের যিনি বাবা তাঁকে সক্কলে কি বলে ?”
ঘাড় চুলকে জুজু বলেন --- “তাইতো খোকা তাইতো,
জানতে তুমি চাচ্চ যে-সব, আমার মনে নাইতো |
আচ্ছা, তুমি দিন আষ্টেক থাক চক্ষু বুঁজে
বিস্তর বই আছে আমার, দেখব “আমি খুঁজে |”
দুলাল বললে--- “দুও মশাই, হেরে গেলেন, দুও |
দরকারী যা সে-সব খবর জানেন না একটুও |
বলচি শুনুন --- টুকে নিন সার আপনার খাতাটিতে,
কাজে লাগবে ভবিষ্যতে সভায় স্পীচ দিতে |---
রাবণ-রাজার পাগড়ি ঘিরে ন-টা সোলার মাথা,
আঠারোটা কাঠের হাত জামার সঙ্গে গাঁথা |
শুতেন খুলে পাগড়ি জামা, নকল মুন্ডু হাত,
অনায়াসে বিছানাতে রাবণ হতেন কাত |
মাথায় মেখে বেলের আঠা আর ঘুঁটের ছাই,
শিবের জটা ওয়াটার-প্রুফ, সর্দির ভয় নাই |
পক্ষীরাজ ঘোটকের পক্ষীরাণী যিনি,
অন্য অন্য পাখীর মতন ডিম পাড়েন তিনি |
সকল ভূতের বাবা যিনি আবাগে তাঁর নাম,
তাঁর শ্রাদ্ধে হয়ে থাকে খুবই ধুমধাম |”
জুজু মশাই বলেন তখন--- “হার মানলুম খোকা,
তুমিই হ’লে পন্ডিত, আর আমিই হচ্চি বোকা |”
এই-না ব’লে মাটির ওপর ছ-বার লাথি ঠুকে