নগরের পথে পথে দেখেছ অদ্ভুত এক জীব ঠিক মানুষের মতো কিংবা ঠিক নয়, যেন তার ব্যঙ্গ-চিত্র বিদ্রূপ-বিকৃত ! তবু তারা নড়ে চড়ে কথা বলে, আর জঞ্জালের মত জমে রাস্তায়-রাস্তায়। উচ্ছিষ্টের আস্তাকূড়ে ব'সে ব'সে ধোঁকে আর ফ্যান চায়।
রক্ত নয়, মাংস নয়, নয় কোন পাথরের মতো ঠান্ডা সবুজ কলিজা। মানুষের সত্ ভাই চায় সুধু ফ্যান; তবু যেন সভ্যতার ভাঙেনাকো ধ্যান ! একদিন এরা বুঝি চষেছিল মাটি তারপর ভুলে গেছে পরিপাটি কত-ধানে হয় কত চাল; ভুলে গেছে লাঙলের হাল কাঁধে তুলে নেওয়া যায়। কোনোদিন নিয়েছিল কেউ, জানেনাকো আছে এক সমুদ্রের ঢেউ পাহাড়-টলানো।
অন্ন ছেঁকে তুলে নিয়ে, ক্ষুধাশীর্ণ মুখে যেই ঢেলে দিই ফ্যান মনে হয় সাধি এক পৈশাচিক নিষ্ঠুর কল্যাণ ; তার চেয়ে রাখি যদি ফেলে, পচে পচে আপন বিকারে এই অন্ন হবে না কি মৃত্যুলোভাতুরা অগ্নি-জ্বালাময় তীব্র সুরা ! রাজপথে এই সব কচি কচি শিশুর কঙ্কাল--মাতৃস্তন্যহীন, দধীচির হাড় ছিলো এর চেয়ে আরো কি কঠিন ?
সাদা মেঘগুলো ভেসে চলে যায় . কোনো তাড়া কোনো কাজ নেই। জল নেই আর জ্বালাও নেইক . কোনো রং কোনো সাজ নেই।
পাহাড়ের গায়ে মঠের চূড়োটা ছাড়িয়ে, মেঘগুলো যায় নীল দিগন্তে হারিয়ে। মঠ থেকে বাজে ঘন্টা মনটা কেমন করে, মঠের মাঝের বুড়ো সাধুটিরে থেকে থেকে মনে পড়ে।
মেঘের মতন সাদা চুল তার, . গোঁফ দাড়ি সাদা ধবধবে, মুখে লেগে আঝে প্রাণের হাসির . ফেনাই বুঝি বা হবে। পাথুরে সিঁড়ির ধারে বসে থাকে . মনে হয় কোনো কাজ নেই। প্রীতির জারকে জরে’ জরে’ যেন . মনে আর কোনো ঝাঁজ নেই। ঢিলে কোঁচকানো মুখখানি তার, . মনে শুধু কোনো ভাঁজ নেই।
কেউ যদি তারে শুধায় কখনো, . এ হাসি কোথায় পেলে ? সাধু হেসে বলে,--- পেয়েছি হৃদয় . আঁখি জলে ধুয়ে ফেলে। যো-মেঘ ঝড়ের তাড়া খেয়ে ফিরে . কালো হয়ে নেমে আসে, নিজেরে উজাড় করে’ ঢেলে সে-ই . সাদা হাসি হয়ে ভাসে।
আমি কবি যত কামারের কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র কবির প্রথম প্রকাশিত কাব্যগ্রন্থ “প্রথমা”-র (১৯৩২) কবিতা। সুকুমার সেন সম্পাদিত “বাংলা কবিতা সমুচ্চয়” ১ম খণ্ড থেকে নেওয়া |
আমি কবি যত কামারের আর কাঁসারির আর ছুতোরের, . মুটে মজুরের, . --- আমি কবি যত ইতরের !
আমি কবি ভাই কর্মের আর ঘর্মের ; . বিলাস-বিবশ মর্মের যত স্বপ্নের তার ভাই, . সমর যে হায় নাই !
মাটি মাগে ভাই হালের-আঘাত, . সাগর মাগিছে হাল, পাতালপুরীর বন্দিনী ধাতু . মানুষের লাগি কাঁদিয়া কাটায় কাল, দুরন্ত নদী সেতুবন্ধনে বাঁধা যে পড়িতে চায়, . নেহারি আলসে নিখিল মাধুরী . সময় নাই যে হায় !
জাফ্ রি-কাটানো জানালায় বুঝি . পড়ে জ্যোত্স্নার ছায়া, প্রিয়ার কোলেতে কাঁদে সারঙ্গ . ঘনায় নিশীথ মায়া | দীপহীন ঘরে আধো-নিমীলিত . সে দুটি আঁখির কোলে, বুঝি দুটি ফোঁটা অশ্রুজলের . মধুর মিনতি দোলে | সে মিনতি রাখি সময় যে হায় নাই, বিশ্বকর্মা যেথায় মত্ত কর্মে হাজার করে . সেথা যে চারণ চাই !
আমি কবি ভাই কামারের আর কাঁসারির . আর ছুতোরের, মুটে মজুরের, . ----আমি কবি যত ইতরের |
কামারের সাথে হাতুরি পিটাই . ছুতোরের ধরি তুরপুন, কোন্ সে অজানা নদীপথে ভাই . জোয়ারের মুখে টানি গুণ ! পাল তুলে দিয়ে কোন সে সাগরে, . জাল ফেলি কোন দরিয়ায় ; কোন্ সে পাহাড়ে কাটি সুড়ঙ্গ, . কোথা অরণ্য উচ্ছেদ করি ভাই কুঠার-ঘায় | সারা দুনিয়ার বোঝা বই আর খোয়া ভাঙি . আর খাল কাটি ভাই, পথ বানাই, স্বপ্ন বাসরে বিরহিণী বাতি . মিছে সারারাতি পথ চায়, . হায় সময় নাই !
ফেরারী ফৌজ কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত “শুধু আবৃত্তির জন্য” কবিতা সংকলন থেকে নেওয়া |
নীলনদীতট থেকে সিন্ধু-উপত্যকা, সুমের, আক্কাড আর গাঢ়-পীত হোয়ংহোর তীরে, বার বার নানা শতাব্দীর আকাশ উঠেছে জ্বলে, ঝলসিতে যাদের উষ্ণীষে, সেই সব সেনাদের চিনি, আমি চিনি ; ---সূর্যসেনা তারা রাত্রির সাম্রাজ্যে আজো সন্তর্পণে ফিরিছে ফেরারী | মাঝরাতে একদিন বিছানায় জেগে উঠে বসে, সচকিত হয়ে তারা শুনেছে কোথায় শিঙা বাজে, সাজো সাজো, ডাকে কোন্ অলক্ষ্য আদেশ | জনে জনে যুগে যুগে বার হয়ে এসেছে উঠানে , আগামী দিনের সূর্য দেখেছে আঁধারে গুঁড়ো গুঁড়ো করে সারা আকাশে ছড়ানো | সহসা জেনেছে তারা, এই সব সূর্য-কণা তিল তিল করে, বয়ে নিয়ে যেতে হবে কালের দিগন্তে, রাত্রির শাসন-ভাঙা ভয়ংকর চক্রান্তের গুপ্তচর-রূপে | এক একটি সূর্য-কণা তুলে নিয়ে বুকে, দুরাশার তুরঙ্গে সওয়ার দুর্গম যুগান্ত-মরু পার হবে বলে, তারা সব হয়েছে বাহির | সুদূর সীমান্ত হায় তারপর সরে গেছে প্রতি পায়ে পায়ে ; গাঢ় কুজ্ঝটিকা এসে মুছে দিয়ে গেছে সব পথ ; ভয়ের তুফান-তোলা রাত্রির ভ্রূকুটি হেনেছে হিংসার বজ্র | দিগ্বিদিক-ভোলানো আঁধারে কে কোথায় গিয়েছে হারিয়ে | রাত্রির সাম্রাজ্য তাই এখনো অটুট ! ছড়ানো সূর্যের কণা জড়ো করে যারা জ্বালাবে নতুন দিন, তারা আজো পলাতক, দলছাড়া ঘুরে ফেরে দেশে আর কালে | তবু সূর্য-কণা বুঝি হারাবার নয় | থেকে থেকে জ্বলে ওঠে শাণিত বিদ্যুৎ কত ম্লান শতাব্দীর প্রহর ধাঁধিয়ে কোথা কোন্ লুকানো কৃপাণে ফেরারী সেনার | এখনো ফেরারী কেন ? ফেরো সব পলাতক সেনা | সাত সাগরের তীরে | ফৌজদার হেঁকে যায় শোনো | আনো সব সূর্য-কণা রাত্রি-মোছা চক্রান্তের প্রকাশ্য প্রান্তরে | ---- এবার অজ্ঞাতবাস শেষ হলো ফেরারী ফৌজের |
বেনামী বন্দর কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র কল্লোল পত্রিকার ভাদ্র ১৩৩২ (সেপ্টেম্বর ১৯২৫) সংখ্যায় প্রকাশিত। অরুণ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত “কল্লোল কবিতা সমগ্র” থেকে নেওয়া |
. মহাসাগরের নামহীন কূলে . হতভাগাদের বন্দরটিতে ভাই . জগতের যত ভাঙ্গা জাহাজের ভীড়, . মাল ব’য়ে ব’য়ে ঘাল্ হ’ল যারা . আর যাহাদের মাস্তুল চৌচির, . আর যাহাদের পাল পুড়ে গেল . বুকের আগুনে ভাই, . সব জাহাজের সেই আশ্রয়-নীড় |
কূলহীন যত কালাপাণি ম’থি লোনা জলে ডুবে নেয়ে, ডুবো পাহাড়ের গুঁতো গিলে আর ঝড়ের ঝাঁকুনি খেয়ে, যত হায়রাণ্ লবেজান্ তরী বরখাস্ত্ হ’ল ভাই পাঁজড়ায় খেয়ে চিড়্, মহাসাগরের অখ্যাত কূলে হতভাগাদের বন্দরটিতে ভাই সেই অথর্ব ভাঙ্গা জাহাজের ভীড় |
দুনিয়ার কড়া চৌকিদারী যে ভাই হুঁশিয়ার সদাগরী, হালে যার পানি মিলেনাক আর, তারে যেতে হবে চুপে সরি | কোমরের জোর কমে গেল যার ভাই, ঘুণ ধরে গেল কাঠে আর যার কল্ জেটা গেল ফেটে জনমের মত জখম হ’ল যে যুঝে, সওদাগরের জেঠিতে জেঠিতে খাতাঞ্জিখানা ঢুঁড়ে কোন দপ্তরে ভাই খারিজ তাদের নাম পাবেনাক খুঁজে |
মহাসাগরের নামহীন কূলে, হতভাগাদের বন্দরটিতে ভাই সেই সব যত ভাঙ্গা জাহাজের ভিড় | শির-দাঁড়া যার বেঁকে গেল আর দড়াদড়ি গেল ছিঁড়ে কব্জা ও কল বেগ্ ড়াল অবশেষে, জৌলস গেল ধুয়ে যার আর পতাকাও প’ড়ে নুয়ে জোর গেল খুলে, ফুটো খোলে আর রইতে যে নারে ভেসে, তাদের নোঙর নামাবার ঠাঁই দুনিয়ার কিনারায় যত হতভাগা অসমর্থের নির্বাসিতের নীড় |