ঝড় যেমন ক’রে জানে অরণ্যকে কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত “শুধু আবৃত্তির জন্য” কবিতা সংকলন (২০০৬ ) থেকে নেওয়া |
ঝড় যেমন ক’রে জানে অরণ্যকে . তেমনি ক’রে তোমায় আমি জানি | দুরন্ত নদীর ধারা যেমন ক’রে দেখে . আকাশের তারা ----সেই আমার দেখা | স্থির আমি হই না, আমার জন্যে নয় প্রশান্তির পরিচয় |
কেমন ক’রে আমি বোঝাই আমার ব্যাকুলতা ! . বাতি দিয়ে কি হয় বিদ্যুতের ব্যাখ্যা ? . সাগরের অর্থ মেলে সরোবরে ? একটা মানে আছে পালিত পশুর চোখে, আর একটা মানে বন্য শ্বাপদের বুকে, . বৃথাই এ দুই-এর মিল খোঁজা | আমি থাকি আমার উদ্দামতায় ; . চেয়ো না আমায় বশ করতে, . সহজ করতে |
কে জানে হয়তো আমার জানাই . সত্যকারের জানা | দুলে না উঠলে আকাশের বুঝি . মানে হয় না, পৃথিবীকে নাড়া দিয়ে সত্য করতে হয় |
তুমি আমার আকাশ--- আমার দুরন্ত স্রোতে কম্পমান . তোমার পরিচয় | . তুমি আমার অরণ্য--- . আমার ঝঞ্ঝাবেগের . প্রশ্রয় ও প্রতিবিম্ব |
. হে-ইডি, হাইডি, হাই ! অরণ্য ডাকে ওই---যাই! সিংহের দাঁতে ধার, সিংহের নখে ধার, . চোখে তার মৃত্যুর রোশনাই ! . ---- হে-ইডি, হাইডি, হাই | বন-পথে বিভীষিকা, বিঘ্ন, আমাদেরও বল্লম তীক্ষ্ম! কাপুরুষ সিংহ তো মারতেই জানে শুধু . আমরা যে মরতেও চাই ! .. হে-ইডি, হাইডি, হা-ই !
মেয়েদের চোখ আজ চকচকে ধারালো ; নেচে-নেচে ঢেউ তোলা, নাচের নেশায় দোলা . মিশ্ কালো অঙ্গে কী চেক্ নাই ! মৃত্যুর মৌতাতে বুঁদ হয়ে গেছি সব, . রমণী ও মরণেতে ভেদ নাই ! . হে-ইডি, হাইডি, হা-ই !--- . হে-ইডি, হাইডি, হা-ই ! আমাদের গলায় কই সেই উদ্দাম উল্লাস, . ঘাসের ঘাগরায় দুরন্ত সমুদ্র-দোলা ? . কেমন ক’রে থাকবে ? . আমাদের জীবনে নেই জলন্ত মৃত্যু, . সমুদ্র-নীল মৃত্যু পলিনেসিয়ার ! . আফ্রিকার সিংহ-হিংস্র মৃত্যু ! আছে শুধু স্তিমিত হয়ে নিভে যাওয়া . ---- ফ্যাকাশে রুগ্ন তাই সভ্যতা |
সভ্যতাকে সুস্থ করো, করো সার্থক | . আনো তীব্র, তপ্ত, ঝাঁঝালো মৃত্যুর স্বাদ, . সূর্য আর সমুদ্রের ঔরসে . যাদের জন্ম, . মৃত্যু-মাতাল তাদের রক্তের বিনিময় |
ভরাট-করা সমুদ্র আর উচ্ছেদ-করা অরণ্যের জগতে . কী লাভ গ’ড়ে কৃমি-কীটের সভ্যতা, . লালন ক’রে স্তিমিত দীর্ঘ পরমায়ু . কচ্ছপের মতো ? . অ্যামিবারও তো মৃত্যু নেই | মৃত্যু জীবনের শেষ সার আবিষ্কার . আর . শিব নীলকন্ঠ !
নৌকো কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র ব্রততী বন্দ্যোপাধ্যায় সম্পাদিত “শুধু আবৃত্তির জন্য” কবিতা সংকলন (২০০৬) থেকে নেওয়া |
মনে পড়ে নুলিয়াদের সেই নৌকো, ঢেউএর নাগাল ছাড়িয়ে শুকনো বালির ওপর কাঠের ঠেকো দিয়ে আটকে রাখা মনে পড়ে তারই ওপর গিয়ে বসেছিলাম সেদিন প্রথম রাতে ! কৃষ্ণ পক্ষের দ্বিতীয়া কি তৃতীয়া, চাঁদ উঠতে আর দেরি নেই | সমুদ্রে যেন তারই অস্থির উত্তেজনা, হু হু-করে-বওয়া হাওয়ায় তারই উদ্দাম উদ্বেগ | শুধু বসেছিলাম পাশাপাশি, হাত তো ধরিনি, বলিনিও কিছু | কিই বা বলবো সমুদ্রের চেয়ে ভালো করে ! উদ্দাম হাওয়াতেই ছিলো আমার আলিঙ্গন | ছুঁইনি তাই | মনে কি পড়ে, হঠাৎ নৌকোটা উঠেছিলো দুলে, বুঝি হাওয়ায় বালি সরে গিয়ে কাঠের ঠেকো একটু নড়ে উঠে, কিংবা বুঝি সমুদ্রেরই ডাকে | একটু শিউরে উঠেছিলে হেসে উঠেছিলে তারপর ‘যদি-- ?’ একই প্রশ্ন বুঝি উঠেছিলো দু’জনের চোখে ঝিলিক দিয়ে | যদি নৌকো যায় ভেসে চাঁদ ওঠার ওই থমথমে প্রহরে তরল রাত্রির মতো নীলাগলানো এই সমুদ্রে ! যদি নৌকো ভেসে যায় হঠাৎ সম্ভবের এই কঠিন শাসন কাঠের ঠেকোর মতো ঠেলে ফেলে ! তা কি কখনো যায় ! জানি, জানি এ যে নুলিয়াদের জেলেডিঙি শুধু মাছ ধরতেই জানে | সে নৌকো থেকে নেমে এসেছি, ফিরে এসেছি সেদিনকার সেই সমুদ্রতীরে থেকে বাঁধানো রাস্তার এই শহরে, দেওয়াল-দেওয়া এই ঘরে | তবু জেনো সে নৌকো কেমন করে এসেছে সঙ্গে, জেনো, সে নৌকো চিরদিন থাকবে তৈরি সম্ভবের তীরপ্রান্তে আশায় উদ্বেগে কম্পমান |
ডাকো যদি, যেতে পারি পার হয়ে দুর্লঙ্ঘ্য পরিখা, শেষ-চূড়া-সোপানে আসীন নিতে পারি একবার তোমার তৃপ্তির স্বাদ | ভয় হয় শুধু তোমার আমার প্রিয়-তারা যদি ভিন্ন হয়, দুজনায় অন্য নামে ডাকে !
তুমি আমি দুজনেই চোরাবালি-মগ্ন স্বপ্ন জেনেছি অনেক বানচাল সঙ্কল্পের একই ঘাটে হল ভরাডুবি | তবু ছুটি নিতে পারি কই ? ফিরে ফিরে খেয়া বাই হাটে |
এত ভিড় কিলবিল ক্ষুধা ভয় অন্ধতা তাড়িত এত গোল, দিশাহারা ধূলিধূম্র আকাশ বধির জর্জর হৃদয় তবু কী বিশ্বাসে সব কিছু সয় ? হিজিবিজি এ-প্রলাপ---- এরও হবে প্রাঞ্জল অন্বয় |
এক আকাশ অন্ধকার কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র সাগরময় ঘোষ সম্পাদিত “দেশ” সুবর্ণজয়ন্তী কবিতা সংকলন ( ১৯৮৫ ) থেকে নেওয়া
একটি মানুষের মধ্যে আমি এক আকাশ অন্ধকার দেখেছিলাম |
কতজনের সঙ্গেই ত মিশি, ভালবাসি, ঘৃণা করি, থাকি উদাসীন | তারা সব টুকরো টুকরো আলো উজ্জ্বল কি স্তিমিত |
তাদের চেনা যায়, পড়া যায় মানেও পাওয়া যায় ছাড়াছাড়া | তাদের সঙ্গে পরিচয় দিয়েই জীবনের প্রাঞ্জল পুঁথি প্রতিদিন লেখা | কিন্তু মন নিজের অগোচরে খোঁজে সেই অনাদি আশ্চর্য অন্ধকার সব অভিধান যেখানে অচল, সব নামতা নিরর্থক |
সেই এক আকাশ অন্ধকার আমি পেয়েছিলাম একবার পথে যেতে কোন এক স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে দুপুর রোদে গাড়ির জন্যে দাঁড়িয়ে দুটি অতল চোখের মধ্যে |
সে পুরুষ কি নারী কেউ যেন জানতে না চায়, জানতে না চায় কী তার বয়স | সে সময়ের অতীত, যৌনতার ঊর্দ্ধে | তার অন্ধকার ত না-এর শূন্যতা নয়, নীহারিকা-গর্ভ এক রহস্য-নিবিড়তা |
সত্তার গহনে এই অন্ধকার যদি লুপ্ত হয়, আমাদের সাজানো শহর আর সফল জীবন ত শুধু পরিসংখ্যানের অঙ্ক |
এত খণ্ড খণ্ড আলোর জটলায়, এত মাপজোকের দুনিয়ায় সেই অন্ধকার বয়ে বেড়াবার মানুষ কি সব ফুরিয়ে গেল !
‘সেথা তুমি পূর্ণ ছিলে’ কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র কল্লোল পত্রিকা ১৩৩১ ফাল্গুন, ১১শ সংখ্যার কবিতা। অরুণ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত “কল্লোল কবিতা সমগ্র” (২০১৬) থেকে নেওয়া |
সেথা তুমি পূর্ণ ছিলে আপনাতে আপনি মগন, আনন্দের স্পন্দহীন নিশ্চল গগনে ; তাই বুঝি সৃজিলে আমারে কাঁদিবার লাগি | কাঁদিবার সাধ, তাই তুমি মোর সাথে ছোট হবে, লুটাবে ধূলায়, আঘাত করিবে আপনারে,-- মূঢ় অবিশ্বাসে আবার ভাসিবে আঁখিনীরে !
সেথা তুমি পূর্ণ ছিলে,-- শুধু সেথা ছিল না ক’ আঁখিজল, বিরহ বেদনা আর উষ্ণ দীর্ঘশ্বাস | আমার মাঝারে তাই এমন করিয়া কাঁদ ; কাঁদ এত রূপে ! অকারণে কাঁদ একবার জীবনের তীরে নামি চিহ্নহীন বালুচরে ; পুনঃ কাঁদ প্রেয়সীর, প্রেয়সীর লাগি— বার বার দুরন্ত যৌবনে ; তার পর সমস্ত জীবন ধরি’ সংশয়ে, দ্বিধায়, দ্বন্দ্বে বঞ্চনায়, আঘাতে ও হতাশা, কাঁদ এত রূপে | নিখিল ভুবন ভরি’ খেলিতেছ কাঁদিবার খেলা অনাদি অতীত কাল ধরি’ | বিস্ময়ে চাহিয়া দেখি সে খেলায় মাতি কোথায় নেমেছ তুমি মোর সাথে, জঘন্য পাপের মাঝে, বীভত্স ক্ষুধায়, অসহ্য গ্লানির পঙ্কে, পুতি-গন্ধভরা, অচিন্ত্য কলুষে হীনতায় |
মোর সাতে পাপী হলে বুকে তুলে নিলে মোর তাপ মোর সাথে দুর্বহ ব্যথার বোঝা স্কন্ধে নিলে তুলে, পিশাচ সেজেছে মোর সাথে কুটিল, নির্মম, ক্রূর, নৃশংস, নির্দয় ; বিস্ময়ে চাহিয়া দেখি, আর বসে রই স্তব্ধ হয়ে ভয়ে ও বিস্ময়ে--- তোমার কান্নার খেলা অপরূপ, অদ্ভুত, ভীষণ বুদ্ধির অতীত ! যত কান্না ধরণীতে ; তার মাঝে তুমি কাঁদ এই শুধু জানি--- আর ধন্য আপনারে মানি |
“সৃষ্টির প্রথম প্রাতে বিধাতার মনে যে কথাটি ছিল সঙ্গোপনে“ কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র কল্লোল পত্রিকা ১৩৩১ ফাল্গুন, ১১শ সংখ্যার কবিতা। অরুণ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত “কল্লোল কবিতা সমগ্র” (২০১৬) থেকে নেওয়া |
. এস নারী, . আজ তব কানে কানে, . কই কথা প্রাণে প্রাণে ;--- . সৃজন-রহস্য-কথা . ----নিখিলের আদিম বারতা | . যৌবনের মায়ালোকে, অনাদি ক্ষুধার সেই অনির্বাণ জ্বালা নিয়ে চোখে, এস নারী, আরো কাছে এস, বুকে বুক রেখে শুধু ক্ষণিকের তরে মোহভরে, ভালবেসো | . চুপে চুপে যে কথাটি . শিখাইছে মাটী . প্রতি নবাঙ্কুরে, . ইঙ্গিতে যে কথাটিরে গ্রহতারা বলে ঘুরে ঘুরে . আলোকের অর্ধস্ফুট সুরে, . সৃষ্টির প্রথম প্রাতে বিধাতার মনে . যে কথাটি ছিল সঙ্গোপনে, . সে গোপন বারতাটি কবির প্রকাশ এস নারী, এল আজ জীবনের দখিনা-বাতাস | . মুখে নয়, শুধু বুকে বুক দিয়ে নয়, ব্যঞ্জনা-ব্যাকুল সর্ব অঙ্গ মোর, মন প্রাণ দিয়ে . শিখাইব সে রহস্য প্রিয়ে ! . জানিবার দূরন্ত আগ্রহে তোমার ও-দেহের মাঝে শোণিতের বন্যাবেগ বহে ! যৌবন-সুষমা তব, এ যে সেই বাসনার ভাষা ! এরি মাঝে জেগে আছে নিখিলের অনির্বাণ আশা ! . এই তব হেঁয়ালি ভাষায় . সৃষ্টির কামনাখানি নবরূপে ফুটে পুনরায় | . ভয়ঙ্কর ভুখে , এস নারী, এই তব তনুলতা নিষ্পেষিয়া বুকে . কই মোর রহস্য-বারতা ; জন্মে জন্মে এ দেহের প্রতি অণু-পরমাণু মাঝে বহিয়া এনেছি যেই কথা, সে বাণী সুগন্ধ করি অগণন ফাল্গুনের সুরভি নিশ্বাসে, রঞ্জিয়া বিচিত্রবর্ণে, সিক্ত করি’ সঙ্গীতের আনন্দনির্য্যাসে . রূপে, রসে, অপরূপ করি’ . কই ধীরে,---দেহমন, এ জীবন, ----উঠুক শিহরি ! . হে প্রিয়া আমার,--- . তবু যদি আরো কিছু রয়ে যায় বাকি, . অসমাপ্ত যায় কিছু থাকি, . হাস্যে তব, লাস্যে তব, ছলনায়, কৌশলে, কলায়, সৌন্দর্যের ইন্দ্রজালে মুগ্ধ করি’ দুলাইয়া আবেগ-দোলায় . ধাঁধিয়া কটাক্ষপাতে, বাঁধিয়া অচ্ছেদ্য মায়াফাঁসে, সমস্ত চেতনা হরি’ মগ্ন করি’ আলিঙ্গনে, কুহক-বিলাসে . উদ্ ভ্রান্ত করিয়া মোরে করিয়া বিহ্বল, . লুটে নিও সকল সম্বল !