কবি পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় - ছিলেন বাংলা আধুনিক গানের স্বর্ণযুগের প্রখ্যাত গীতিকার-সুরকার।
তিনি জন্ম গ্রহণ করেন হাওড়ার এক বনেদি পরিবারে ১৯৩১ সালের মে মাসের ২ তারিখে, কলকাতায়।
পিতা কান্তিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়, শৈশব থেকেই ছবি আঁকতেন। তিনি সবরকম বাদ্যযন্ত্র বাজানোতে দক্ষ
ছিলেন, গান গাইতেন এবং পত্র-পত্রিকায় কবিতাও লিখতেন। তিনি ছিলেন শান্তিনিকেতনের প্রথম যুগের
ছাত্র। জমিদার পরিবারের এই ব্যতিক্রমী সন্তান, সুদর্শন, সুললিত কণ্ঠের অধিকারী কান্তিভূষণ, বাংলা
ছায়াছবির নির্বাক যুগের নায়ক ছিলেন। তিনি নায়কের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন “শ্রীকান্ত”
ছায়াছবিতে। অভিনয় করেছিলেন “শাস্তি কি শাস্তি”, “নিয়তি” প্রভৃতি ছায়াছবিতেও। এ ছাড়া তিনি
“মহানিশা” সহ বেশ কিছু নাটকেও অভিনয় করেছিলেন। এমন পরিবেশে বড় হয়ে পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় যে
এমন বিশিষ্ট কবি-গীতিকার হবেন তাতে আশ্চর্যের কি আছে!
অজয় ভট্টাচার্য, প্রণব রায়, মোহিনী চৌধুরী, সুবোধ পুরকায়স্থ, শৈলেন রায়ের যোগ্য উত্তরসূরী কবি পুলক
বন্দ্যোপাধ্যায়ের স্কুলজীবন কাটে হাওড়াতেই। গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের মতোই তাঁর গানের সংখ্যা বিপুল।
কলেজ জীবনে স্নাতক হন কলকাতার স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে। পরবর্তিতে বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ শেষ করে
অধ্যাপনা ও আইন ব্যবসায় যুক্ত হয়েছিলেন।
কবিতা লেখার শুরু স্কুলের নিচু ক্লাস থেকেই। ক্লাস ফাইভ কি সিক্স-এ পড়ার সময়ে তাঁর প্রথম কবিতা
প্রকাশিত করা হয় আনন্দবাজার গ্রুপের “আনন্দমেলা” পত্রিকায়। কলেজ জীবনের শুরুতেই তাঁর লেখা গল্প
প্রকাশিত হয় “ভারতবর্ষ” মাসিক পত্রিকায়। স্কটিশ চার্চ কলেজের প্রথম বর্ষে পড়তে পড়তেই তাঁর নাম
আকাশবাণী কলকাতার “গীতিকারদের” তালিয়ায় উঠে গিয়েছিল। কলেজ জীবনে স্নাতক হন কলকাতার
স্কটিশ চার্চ কলেজ থেকে।
সন্ধ্যারাণী, পরেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, স্মৃতিরেখা বিশ্বাস অভিনীত “অভিমান” ছায়াছবিতে প্রথম তাঁর লেখা গান
আত্মপ্রকাশ করে।
তাঁর লেখায় আজকের প্রৌঢ়ত্বে পা দেয়া বাঙালী নস্টালজিয়ায় ভেসে যায। এমন বাঙালী বোধ হয় খুঁজে
পাওয়া যাবে না যাঁর সবচেয়ে প্রিয় বাংলা গানের ঝুড়িতে, অন্তত একটা গান পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা
নয়! মোটামুটি যাটের দশক থেকে বাঙালী পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা গান শুনতে শুরু করেন।
তাঁর লেখা গানে সুর ও কণ্ঠ দিয়েছেন সে সময়ের প্রায় সব প্রখ্যাত সুরকার ও শিল্পীরাই। বাংলা চলচিত্র
জগতের তিনি প্রথম সারির গীতিকার ছিলেন। পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় শুধু গীতিকারই ছিলেন না, তিনি
“প্রান্তরেখা”, “রাগ-অনুরাগ”, “নন্দিতা”, “হারানো প্রাপ্তি নিরুদ্দেশ”, “বন্দীবলাকা”, “নাগপঞ্চমী”, “নাগজ্যোতি”
প্রভৃতি ছায়াছবিতে চিত্রনাট্য ও সংলাপ লিখেছেন। সিনেমার সংলাপ, চিত্রনাট্য ও গান লিখে হিন্দী
ছায়াছবিতে সলীম-জাভেদ সেলেব্রিটির পর্যায় চলে গেলেও পুলুক বন্দ্যোপাধ্যায়কে "কবিতা প্রেমী বাঙালী"
যথাযত মর্যাদাটুকুও দেয়নি!
৭ই সেপ্টেম্বর ১৯৯৯ তারিখের বিকেলে হুগলী নদীতে একটি লঞ্চ থেকে জলে ঝাঁপ দিয়ে তিনি আত্মহত্যা
করেন। তাঁর ব্যক্তিগত জীবনে হতাশা ও নৈরাশ্য কোন পর্যায়ে পৌঁছেছিল, তা সহযেই অনুমেয়। কিন্তু ঠিক
কি কারণে তিনি এই পথ বেছে নিয়েছিলেন, তা কেউ বলতে পারেনি। তাঁর সুইসাইড নোটেও তিনি কোনো
কারণ লিখে যান নি।
পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর আত্মজীবনী “কথায় কথায় রাত হয়ে যায়” তে আক্ষেপের সুরে লিখে গিয়েছেন ...
“আমি আধুনিক গানই লিখতাম। আধুনিক গানই লিখছি আর যতদিন বাঁচব ততদিন এই আধুনিক গানই
লিখে যাব। বাংলা গানের এই গীতিকবিতার উপর কে যে কবে এই আধুনিক লেবেলটি এঁটে দিয়ে গেছেন
তার হদিস আমি কেন, অনেক গবেষকও খুঁজে পাবেন না। রবীন্দ্রনাথের গানকেও সেই যুগের এক ধরণের
আধুনিক গানই বলা হত। পরে রেকর্ড কোম্পানিতে নিধুবাবুর গানের মতো গুরুদেবের গানকেও শুধু একটু
বিশেষিত করা হযেছিল রবিবাবুর গান বলে।
.... আমি কবি ছিলাম কি না জানি না, তবে কৈশোর থেকে বুঝে নিয়েছিলাম, গান লেখা কবিতা লেখারই
একটা অঙ্গ। এখনকার কবিরা আমাদের “গীতিকার” আখ্যা দিয়েছেন। যার ফলে আমরা গীতিকার হয়ে
গেছি কবি হতে পারি নি। আমাদের বাংলা সাহিত্যে যে বইটি নোবেল প্রাইজ পেয়েছে সেটি কিন্তু
“গীতাঞ্জলি”। আমি জানি না কবি প্রেমেন্দ্র মিত্র আর গীতিকার প্রেমেন্দ্র মিত্র সম্বন্ধে এঁদের কি ধারণা?”
খুব বিচিত্র এই বাঙালী জাতি! এমন লেখাপড়া জানা বাঙালী হয়তো খুঁজে পাওয়া দুষ্কর যাঁর জীবনের কোনো
না কোনো সময়ে দু এক লাইন কবিতা লেখেন নি! বাংলা ভাষায় যে পরিমান কবিতার আন্দোলন ঘটে
গেছে, যে পরিমান কাব্যচর্চা চলেছে, তেমনটি বোধহয় ভারবর্ষের আর কোনো ভাষায় দেখা যাবে না। অথচ
আধুনিক যুগে লক্ষ্য করি যে গীতিকারদের কবি হিসেবে স্বীকৃতি দিতে বাঙালী ভীষণ কুণ্ঠা বোধ করেন!
কবি পুলক বন্দ্যোপাধ্যায় একবার বড় আক্ষেপের সুরে বলেছিলেন ... আমি কি কবি নই ?
ব্যাপারটা যেন এমন যে কবিতায় সুর হলেই সেই কবি আর কবি থাকেন না! রবীন্দ্রনাথ বলুন, দ্বিজেন্দ্রলাল
বলুন, রজনীকান্ত বলুন, অতুলপ্রসাদ বলুন, দিলীপ রায় বলুন, নজরুল বলুন, প্রেমেন্দ্র মিত্র বলুন, তাঁরা
আধুনিক (?) যুগের এই বিচিত্র ভেদাভেদের মানসিকতা থেকে বেঁচে গিয়েছিলেন।
আমরা মিলনসাগরে তাঁর গান ও কবিতা প্রকাশিত করে আগামী প্রজন্মের কাছে পৌঁছে দিতে পারলে
আমাদের এই প্রচেষ্টা সার্থক বলে মনে করবো। এই কবিতা ও গানের পাতাই তাঁর প্রতি আমাদের শ্রদ্ধার্ঘ্য।
কবির কথায় ও সুরারোপিত গান শুনতে নিচের লিংকগুলিতে ক্লিক্ করুন।
www.muzigle.com/
www.raaga.com/
পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের লেখা, প্রখ্যাত গায়িকা গীতা দত্তের স্মৃতিচারণের, সৌনক গুপ্তর দ্বারা ইংরেজী
অনুবাদ পড়তে নিচের লিংক-এ ক্লিক্ করুন . . .
www.anmolfankaar.com/
কবি পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়ের মূল পাতায় যেতে এখানে ক্লিক করুন।
.
উত্স: পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, কথায় কথায় রাত হয়ে যায়, আনন্দ, ১৯৯৯
. পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, আমার প্রিয় গান, এ.সি.সরকার এণ্ড সন্স, ১৯৯৫,
. পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, বাহাত্তুরে (৭২টি ছড়ার সংকলন), ১৯৯৬,
. সুজয় বিশ্বাস, এক অবহেলিত গীতিকার, “সকালবেলা” দৈনিক পত্রিকা, ১১.৮.২০১২
আমাদের ই-মেল - srimilansengupta@yahoo.co.in
এই পাতার প্রথম প্রকাশ - ২০০৫
...