নতুন যে গানখানা বুধবারে শিখেছি। ... কে বলেছে “পিলু”, ---দূর!! “মিশ্র-কানেড়া” সুর! গানের খাতায় এর স্বলিপি লিখেছি।
প্রথম লাই যার, “---ওগো নেয়ে করো পার গোধূলির রাঙাধূলি রঙিয়েছে নবপট!” ....এ গানটি ভালো গায় আমাদের তৃষা রায়? ধ্যেৎ! সে তো গায় ওটা ভুল সুরে,---ছায়ানট!
আচ্ছা ও সব থাক্! এসো আজ পড়া যাক্ “চিত্রাঙ্গদা”খানা। বহুদিন পড়ি নি। রবি ঠাকুরের বই সে পেলে কি কথা কই? মুখ বুজে ঘরে থাকি, এক পা’ও নড়ি নি।
নাও, পড়ো গোড়া থেকে শুনি কোলে মাথা রেখে, রোসো রোসো, খোঁপাটাকে নিই আগে বাগিয়ে! ও কি বেয়াদপি! --- যাও!! পড়া শুরু করে দাও খুনসুটি ক’রে কেন মিছে তোলো রাগিয়ে!!
. ************************* . সূচীতে . . .
মিলনসাগর
|
আরো এক ছড়া বড় মালা নেবো, দু ছড়া ছোটোও দাও !
( স্বগত )
সেজে যাবো ফুলে আজ রাতে, খুলে সোনার অলঙ্কার ;
খোঁপায় মালাটি জড়িয়ে না দিলে মনটি ওঠে না তার !
সব চেয়ে বড় বেলের গোড়েটি তাকেই পরাবো ; জানি
বলবে সে হেসে---"আমায় এ বেশে মানায় না মোটে রাণী !
যূথী-সুকুমার তনুতে তোমার ভালো সাজে ফুলহার
তুমি পরো সবি---" নিজে কি না কবি, কথায় হারানো ভার !
বলতে দেবো না কোনো কথা আজ, মুখে চাপা দেবো হাত ;
বলবো---"বাগানে বসি গিয়ে চলো---বড়ো সুন্দর রাত !"
আমি জানি তার মনের খবর ফুল কত ভালোবাসে !
ফুলশয্য়ার স্মৃতিটি এখনো মনে হলে হাসি আসে |
সারা রাত ধ'রে বারে বারে মোরে ফুলে সে সাজিয়েছিল
শেষে ভোরবেলা ছেড়ে ফুল খেলা কবিতায় মন দিল
ঝরাফুলগুলি যত্নে সে তুলি চেলির উড়ুনি ভ'রে
পাদুটি আমার ঢেকে দিল তার অর্ঘ উজাড় ক'রে !
মধুর ছন্দে কতো আনন্দে শোনালো কবিতা প'ড়ে,
সব মনে নেই ; তবে আমাকেই মানুষ প্রতিমা গ'ড়ে
বন্দনা-গাথা ভরা তার খাতা---কত যে প্রেমের স্তব---
শোনালো কে জানে ! শুধু এলো কানে চাপাহাসি কলরব
ননদে জায়েতে ছিল আড়ি পেতে সারারাত জেগে দ্বারে---
ওর তো সেদিকে ছিল না খেয়াল, উন্মাদ একেবারে !
মা-গো ! যতোবার মনে পড়ে তার সেই সব পাগলামি
আজো লজ্জায় মাথা নুয়ে যায় ! ওঁর কি যোগ্য আমি ?
মনোমতো ক'রে অঞ্জলি ভ'রে পারিনি যে দিতে তাঁকে
সেই অভিমানে গেছিলেন চ'লে কবে সেই বৈশাখে !
বছর ঘুরেছে ; এত দিনে তাঁর পড়েছে আমায় মনে |
তখন ছিলুম লাজে জড়োসড়ো প্রথম বিয়ের কনে
ভালো ক'রে কথা পারতুম নাকো কইতে মুখটি ফুটে
ওঁর খাছে গেলে সারা বিশ্বের লজ্জা আসতো জুটে |
সে তো বুঝলে না | ভাবলে আমার লাগেনি বরকে ভালো |
সুন্দরী আমি, ঘৃণা করি তাঁকে, রং কিনা তার কালো !
অবুঝ ! বুঝতো, এই চোখ দুটি পেতো যদি একবার---
আমার নয়নে কী ভালো লেগেছে নবশ্যাম রূপ তার
ভাবছো কী এতো ? হ্যাঁগো ফুলওয়ালা ! দাম কত ব'লে ফ্যালো !
আমার যা খুশী ? দুঃর ! তা কী হয় ? বলো কতো ? বেলা গ্যালো !
আমি বড়লোক ? রাজরাণী ? বটে ! যা খুশী দিলেই নেবে ?
জয় জয়কার করবে আমার ? নাম মনে রেখে দেবে ?
হাসালে দেখচি ! আচ্ছা, তা হবে, তবু, বলো কত হলে
এ মালা আমাকে বেচে তুমি আজ খুশী হয়ে যাবে চ'লে ?
বড়োটার দাম ছ'আনা পড়বে ? ফাউ দিলে এ দু'গাছা ?
আচ্ছা নিলুম | "রাণী" ব'লে তুমি ডেকেচো যখন বাছা
ষোলো আনা মন খুশীতে ভরেচে | নাও, এ টাকাটি ধরো,
কাল এনো ফের ভালো ফুল ঢের, মালাও নতুনতর!
. *************************
. সূচীতে . . .
মিলনসাগর
প্রিয় সখী অপরাজিতা দেবী (১৯৬১ সালে প্রকাশিত বিজনকুমার চট্টোপাধ্যায় সংকলিত কাব্যসংকলন ঐকতান থেকে নেওয়া)
এবারের ছুটিতে তুমি নাকি উটীতে
|
আসার আগে
রাধারাণী দেবী
"চাই বেলফুল-চাই চাঁপাফুল-ভালো ভালো ফুল চাই-"
অ খোকন, শোন, ফুলওয়ালাটাকে ছুটে ডেকে আন ভাই !
ওঠ ওঠ ওরে! মিছে খেলা ক'রে করিস কাজের ক্ষতি......
ভালোবাসা অপরাধ
রাধারাণী দেবী
ভালোবাসা অপরাধ হয় যদি---হেক্।
হাসি মুখে দণ্ড তার লব শির পাতি।
ভালোবাসা মোহ শুধু? শুধু মিথ্যা স্তোক---?
সে মোহেই মগ্ন হয়ে রব দিবারাতি!
ভালোবাসা ভুলে যায় রীতি-নীতি-জাতি ---?
যাক্, তাহে ক্ষতি নাহি, নাহি মানি শোক।
ভালোবাসা --- ক্ষণিকের দীপ্ত মায়া-বাতি?---
তবু দগ্ধ হব বরি সেই প্রেমালোক।
ভালো যে বেসেছি --- প্রাণ পরিপূর্ণ তায়!
ব্যর্থ বা সার্থক হোক্---কিবা আসে যায়!
দুখ-অশ্রু বেদনায় যদি মম প্রেম
অবসান লভে কভু মরণের বুকে,
তবুও আমি যে আজ ভালোবাসিলেম---
জন্মান্ত সার্থক হবে এরি স্মৃতি সুখে।
. *************************
. সূচীতে . . .
মিলনসাগর
ননদিনী
অপরাজিতা দেবী
বললেই রাগ করবে তোমরা
নীল মিনে করা দু-ভরি ভোমর
ইয়ারিং ছিল ন-বৌয়ের কানে।
হারালো সেদিন কোথায় কে জানে।
. শুনছি আবার বেড়িয়ে শালকে
. মেজবৌ নাকি এসেছে কালকে
. খুঁইয়ে খোঁপার সাপ কাঁটাটাকে---
. কথা বলবার জো নেই তো তাকে!
কেউ ভাল কিছু বললেই ডেকে
ফোঁস করবেন তিন ঘর থেকে!
মাথার কাঁটাটা গেল, নেই সাড়?
জানে ফের হবে --- নেই কোন চাড়।
. নিত্যি গায়ের গয়না হারানো,
. সোনার জিনিষ ভাঙা বা সারানো
. এ কি অলক্ষ্মী ডেকে আনা নয়?
. বল যদি এটা তবে দোষ হয়!
ভাববে ননদ বজ্জাত বড় ---
দোষ কিছু পেলে বকতেই দড়!
যা বলি, বলি তা ভালোর জন্যে!
তোমরা না বোঝ বোঝে তা অন্যে।
. *************************
. সূচীতে . . .
মিলনসাগর
দ্বিতীয়পক্ষ আষাঢ়
কবি অপরাজিতা দেবী
ফণীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ভারতবর্ষ পত্রিকার, কার্তিক ১৩৪৭ (নভেম্বর ১৯৪০)
সংখ্যায় প্রকাশিত।
আষাঢ় আকাশ ধূসর মেঘের
. ধোসায় অঙ্গ মুড়িয়া,
দ্বিতীয়পক্ষ গৃহিণীরই মতো
. দিয়াছে কান্না জুড়িয়া।
অর্থাৎ কিনা---সে আঁখিজলের
. কারণাকারণ নেই তো,
এই রোদ-হাসি চিক্ মিক্---পুনঃ
. বিপুল অশ্রু এই তো!
অন্ধকারেও ঠিক্ দেখেছে বজ্র আলোর ফুল
কবি অপরাজিতা দেবী
শরত্চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের প্রয়াণে, অপরাজিতা দেবী নামে লেখা কবিতা, ফণীন্দ্রনাথ
মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত "ভারতবর্ষ" পত্রিকার, ফাল্গুন ১৩৪৪ (মার্চ ১৯৩৮)
সংখ্যায় প্রকাশিত হয়। সেই সংখ্যাতেই রাধারাণী দেবী নামেও তিনি শরত্চন্দ্রকে শ্রদ্ধা
নিবেদন করেছিলেন, কিন্তু কবিতায় নয়।
অন্ধকারেও ঠিক্ দেখেছে বজ্র আলোর ফুল!
তোমার দেখায় তোমার জানায় হয়নি কোথাও ভুল।
অন্তরেরি অন্তরালের অন্তরঙ্গ প্রিয়,---
আমরা তোমায় তাই মেনেছি একান্ত আত্মীয়।
. অপরাজিতা দেবী।
. *************************
. সূচীতে . . .
মিলনসাগর
বৌদিদি
কবি অপরাজিতা দেবী
ফণীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত "ভারতবর্ষ" পত্রিকার, আশ্বিন ১৩৪১ (অক্টোবর ১৯৩৪)
সংখ্যায় প্রকাশিত।
ছোট্ ঠাকুরপো! ছোট্ ঠাকুরপো! ও ভাই কবি শুনছো কি?
দ্যালের গায়ের ক্যালেণ্ডারের মেমের দন্ত গুণছো কি?
মিলছে নাকো পদ্য বুঝি তাই কি তুমি চিন্তিত?---
আমার কথা শুনলে তোমার আটকাবে না কিঞ্চিৎ-ও।
. দিচ্ছি শোনো যুক্তি শুভ
. পদ্য যাতে মিলবে ধ্রুব ;
ছন্দ নিয়ে দ্বন্দ্ব তোমার বন্ধ হবে সন্দ নেই!---
মন্দাকিনীর সঙ্গে --- বুঝ্ লে? সাজলে চেলী চন্দনেই।
আহা-হা-হা চটছো কেন? মন্দা মোটেই মন্দ নয়!
ও-ও বুঝেচি! প্রেমের ঠাকুর সকল দেশেই অন্ধ হয়!
কুন্দ কো ভাই পছন্দ? . . . তা’ খুলেই পষ্ট বল্লে কোন্!
তাই তো ভাবচি কেনই ভাষার হঠাৎ এত উদাস মন!!
. গন্ধ-বিহীন কুন্দমালা
. ভরলো কবির প্রাণের ডালা ;---
মন্দারই সে মাস্তুতো বোন্,--- রংটি একটু ফরসা বই
এমন কি আর গুণ আছে তার?---কাব্যি বুঝবে ভরসা কই?
ঐ য্যাঃ! . . .চা’টা জুড়িয়ে গ্যালো! হালুয়া হোলো ঠাণ্ডা হিম!
কলম ছেড়ে খাও তো আগে! পদ্য রাখো ঘোড়ার ডিম!!
উঠ্ লেনাকো? . . . শীঘ্রি ওঠো! . . . নইলে খাতা ছিঁড়চি এই!
আমার সঙ্গে পারবে জোরে?--- এমন সাধ্যি তোমার নেই!
. হালুয়া কেন এমন কালো?---
. ---ফেললে গালে লাগবে ভালো।
বানিয়েছি যে নতুন গুড়ে! একটু না হয় মুখেই দাও!
কাট্ লেট কি ঝাল লেগেছে?---রাই মেখোনা, অমনি খাও!
শ্যামকে বলি চা দিক্ তোমায় গরম গরম আরেক কাপ্!
হালুয়া টুকুন সব খাওয়া চাই।---নৈলে তোমার নেইকো মাপ!
হ্যাঁ এক কথা!---শুন্ চি আজকে প্লাজায় হচ্ছে “লাভ্ প্যারেড”
যাচ্চো?---সত্যি? উচিত্ নয়কো! ---কারণ তোরা আন্ ম্যারেড।
. বউদিদিদের সঙ্গেতে নাও,---
. এই পয়েতেই বৌ যদি পাও!!
জানোই তো ভাই আমরা হলুম প্রজাপতির আপন জাত্!
খরচটা নয় দিচ্চি আমিই।---ওম্ মা! অমনি পাত্ ছো হাত্!!
. *************************
. সূচীতে . . .
মিলনসাগর
নতুন মা
কবি অপরাজিতা দেবী
ফণীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ভারতবর্ষ পত্রিকার, শ্রাবণ ১৩৪০ (আগস্ট ১৯৩৩)
সংখ্যায় প্রকাশিত।
হেসে হেসে গেলো পেটে খিল্ ধরে--ব্বাপ্!!
একরতি ছেলে ওই এ কী তার দাপ্!
হাত পা তো কচি ফুল, নড়বড়ে ঘাড়,
সারা বিছানাটা তবু করে তোলপাড়!
ওগো---ওগো! শীগগির এসে দেখে যাও!
রাখো বাপু লেখাপড়া! এসো মাথা খাও!
আবার এসেছে আষাঢ়
কবি অপরাজিতা দেবী
ফণীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত "ভারতবর্ষ" পত্রিকার, আষাঢ় ১৩৪০ (জুলাই ১৯৩৩)
সংখ্যায় প্রকাশিত।
রাত থেকে কাল নেমেছে বাদল, হাতে নেই কোনো কাজ।
পড়শীর বাড়ী মেয়ের বিয়েতে নেমন্তন্য আজ॥
বাড়ীর কর্ত্তা বিদেশে আছেন ; ছেলে-পুলেগুলো সব
বেলাবেলি সেজে গিয়েছে বে বাড়ী, ঘরে নেই কলরব॥
নির্জ্জন বাসা স্তব্ধ নিরালা, একেবারে চুপচাপ।
একঘেয়ে সুরে কাণে আসে শুধু বৃষ্টির ঝুপঝাপ॥
হেঁসেল ঘরের শিকল বন্ধ, নেই আজ হাঁড়ি ঠেলা।
বহুদিন বাদে বাতায়নে তাই বসেছি বিকেল বেলা॥
আকাশ হয়েছে মলিদা রংয়ের,---তারি পানে চেয়ে আছি।
আজো বাতায়নে বসেছি আবার, সেই আমি সেই ‘রুণু’।
কানে বাজে সেই বসা নটীর নূপুরের রুণু ঝুণু॥
চিকণ সবুজ পাহাড়ের গায়ে বৃষ্টি ধারার চিক
স্ফটিক-পদ্দা দিয়েছে টাঙিয়ে দেখি চেয়ে অনিমিখ॥
ছিন্নপত্র
কবি অপরাজিতা দেবী
ফণীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত "ভারতবর্ষ" পত্রিকার, কার্তিক ১৩৩৯ (নভেম্বর ১৯৩২)
সংখ্যায় প্রকাশিত।
সহসা তোমার চিঠি পেয়ে হাতে চৈতালী রাতে চমক লাগে!
সত্যি?---রাণুদি! তোলেনি এখনো? সত্যি কি ‘রুণু’ স্মরণে জাগে?
চুত-মুকুলের গন্ধে আকুল দখিনা-বাতাস ব্যাকুল আজি!
নবযৌবনা ধরণী পরেছে কবরী বেড়িয়া কুসুমরাজি!
ঋতুরাজ এসে পরিচিতবেশে চিরচেনা হেসে দাঁড়ালো দ্বারে!
তারি সাথে এলো তোমার লিখন বহুদিন পরে শৈল পারে!