নলবনের ধার দিয়ে পানবরোজের পাশ দিয়ে গঞ্জের স্টীমারের আলো--- আলো পড়েছে ঘোলা জলে রামধনুর মতো রামধনুর মতো এই রাত্রিরবেলা। ধানক্ষেত ভাসিয়ে জল গড়ায় নদীতে স্টীমারের তলায় আমাদের অভাবের মতো ঠিক আমাদের কপালের মতো। আমাদের পেটে তো ভাত নেই পড়নের কাপড় নেই খোকার মুখে দুধও তো নেই এক ফোঁটাও তবু কেন এই গঞ্জ হাসিতে উছলে ওঠে ? তবু কেন এই স্টীমার শস্যতে ভরে ওঠে ? আমাদের অভাবের নদীর উপর দিয়ে কেন ওরা সব পাঁজরকে গুঁড়িয়ে যায় ?
শোনো, বাইরে এসো, বাঁকের মুখে পরাণ মাঝি হাঁক দিয়েছে শোনো, বাইরে এসো, ধান বোঝাই নৌকা রাতারাতি পেরিয়ে যায় বুঝি খোকাকে শুইয়ে দাও। বিন্দার বৌ শাঁখে ফুঁ দিয়েছে। এবার আমরা ধান তুলে দিয়ে মুখ বুজিয়ে মরবো না এবার আমরা প্রাণ তুলে দিয়ে অন্ধকারে কাঁদবো না এবার আমরা তুলসীতলায় মনকে বেঁধে রাখবো না।
বাঁকের মুখে কে যাও, কে ? লণ্ঠনটা বাড়িয়ে দাও লণ্ঠনটা বাড়িয়ে দাও! আমাদের হাঁকে রূপনারায়ণের স্রোত ফিরে যাক আমাদের সড়কিতে কেউটে আঁধার ফর্সা হয়ে যাক আমাদের হৃৎপিণ্ডের তাল দামামার মতো ঝড়ের চেয়ে তীব্র আমাদের গতি। শাসনের মুগুর মেরে আর কত কাল চুপ করিয়ে রাখবে ? এসো, বাইরে এসো--- আমরা হেরে যাবো না আমরা মরে যাবো না আমরা ভেসে যাবো না নিঃস্বতার সমুদ্রে একটা দ্বীপের মতো আমাদের বিদ্রোহ আমাদের বিদ্রোহ মৃত্যুর বিভীষিকার বিরুদ্ধে---
এসো, বাইরে এসো আমার হাত ধরো পরাণ মাঝি হাঁক দিয়েছে।
আবার ঘোর আঁধির ঘোরে হারিয়ে গেল গান আমার উজাড় বিষে সর্বনেশে পাথুরে রাত পথের ধারে শব্দ ম়ৃত অনাদৃত চোখের জলে অধিকৃত আমার দেশ। গোরের পাশে বৌ কথা কও, কোথায় বৌ।
সুতানটীর গাঁয়ে গাঁয়ে রূপকথার গান ওরে সাঁওতালের গান : গেল কোথায় কাহ্নু সিধুর মান ?
কোথায় আমি কোথায় আমি উল্কিপরা অন্ধকারে বন্দী সময় ; রাত্রিদিন শবের বাঁধে স্রোতের মুখ বন্ধ, হঠাৎ ঘূর্ণি ফেরে। বাপের বাড়ির পথের মতো হিজিবিজি ভবিষ্যতে ডুকরে ওঠে কান্না বোবা।
গাঁয়ে গাঁয়ে সুতানটীর রূপকথার গান ওরে রূপকথার গান : গেল কোথায় নীল চাষীর প্রাণ ?
হায় রে দেশ চোখের মণি কনকশালী ধানের দেশ আমার যত ভালোবাসা কসাইঘরে, আমার যত হৃদয়গত, পারুলডাল ভাঙলো কে ও ? ও ভাই চাঁপা দাও না সাড়া, --- বেনো জলে ভাসলো সবই, দাও না সাড়া!
রূপকথার গাঁয়ে গাঁয়ে সুতানটীর গান ওরে রুপকথার গান : গেল কোথায় তীতুমীরের জান ?
আবার ফিরে পাবো নাকি ডাগর রাতে শিশির ঝরা শব্দ আর জোড়া দিঘির হাঁসের ডাক, আম-জামের ছায়ার নীচে বাঘবন্দী ডুরেশাড়ি চোখ মেলতে, পাব কি না বজ্রশিখা মেঘের জটা সাতমানিক ?
তখন রোয়া শেষের বেলা বিলের দিকের চেয়ে দেখল ছেলে দাঁড়িয়ে আছে ফলসা-রঙা মেয়ে জোয়ার-লাগা নদীর মতো ভরাট কূলে কুল হাসিতে তার ভাব লেগেছে মেঘবন্যা চুল তখন রোয়া শেষের বেলা দেখলো ছেলে চেয়ে দাওয়ার খুঁটি দু’হাতে ধ’রে স্বপ্ন দেখা মেয়ে।
বুকের মধ্যে ঢেকির পাড়, বাজল দূরে শাঁখ নদীর বুকে শুনতে পেল চোদ্দ জয়ঢাক চমক দিয়ে বললে তারে, “কনে, চন্দ্রহার গড়িয়ে দেব পৌষ-পারবণে। নদীর কাছে দান চাইলাম, তোমায় পেলাম, বৌ তুমি আমার পদ্মবিলের মৌ।”
আকাল এল দপদপিয়ে, মাঠ শুকিয়ে কাঠ, এধারে লাশ ওধারে লাশ, লাশ ঢেকেছে মাঠ। বাঁশের কোঁড় ঘাসে মুখো গুগলি শামুকে, পেট জরে যায়, পেট জ্বলে যায় চলতে শালুকে, লক্ষ্মীর পো ভিক্ষে মাঙে ভিক্ষে মাঙে দোরে কে দেবে ভিখ্, ভিখিরি সব, কে দেবে ভিখ্ তোরে, বললে ছেলে, “দশার সঙ্গে হল রে বিয়ে, বৌ তুমি আমার চাকের ভেতর লুকিয়ে থাকা মৌ।”
ফলসা-বরণ দীঘল মেয়ে বললো দু’-চোখে তার অঝোরে জল গললো “আশ্বিন যায় কার্তিক আসে মা লক্ষ্মী গর্ভে বসে সাধ খাও বর দাও গো লক্ষ্মী তুমি বাঁচাও তোমার পো।”
তখন ছেলে বললে তার কানে : “কাজের জন্যে যাব অন্যখানে।”
হাওয়ার সাথে ছুটছে পথে, “দুমুঠো ভাত দাও” তুফান যেন আছাড় মেরে চূর্ণ করে নাও বরের ভিটে আঁকড়ে ছিল তখনও সেই মেয়ে শাঁকচুন্নি পথের দিকে এক নিমেষে চেয়ে।
কোথায় মেয়ে ফলসা-রঙা মেঘবন্যা চুল হাসিতে যার দুলতো ধান চোখে লাগতো ভুল পেটের জ্বালায় সেই যে মেয়ে গলায় দড়ি দিল বরের দেওয়া কাজললতা তখন চুলে ছিল আর ছিল না কেউ মরণ এল তলল পিঠে ‘সাঁড়াসাঁড়ি’র ঢেউ।
কী করে বাঁচলে তুমি ? তুমি কি শিরায় সঞ্চয় করেছ আদিম আগুন পৃথিবীর অন্ধকার গর্ভ থেকে এনেছ উজ্জীবনের গান শস্যের প্রান্ত থেকে হরিৎ স্বপ্ন, ছিনিয়ে নিয়েছ পাখির কণ্ঠ থেকে সুরের সন্মোহন তাই কি তুমি বিষ-নীল পাঁকে শান্ত শ্বেতপদ্ম ?
তোমার দিকে তাকাতে পারিনি মাথা নিচু করে বললাম তুমি জয়তী, তুমি বেঁচে থেকো।
আমি অসম্পূর্ণ ; আমি দূর থেকে দেখি প্রত্যয়ের তারা তুমি সোহাগা আকাশে নিচে ফেন-চূড় ঢেউ-এর আঘাতে ক্ষুব্ধ সাগর আমি ডুবুরী, আমি রুক্ষ নীল শব্দের সাগরে জুব দিয়ে যাই ; যদি পাই কথার মানিক এই অপরাজিতা আকাশের তলায়, তবে শান্ত নম্র গলায় বলব নাও, জয়তী, আমার ভালোবাসার দান আমায় ধন্য করো।
অনেক সময় ভাবি ; আমি কে ? কোথায় আছি ? অনেক সময় সার্কাসের ভাঁড়ের মতো খেলা দেখাই আর কেউ হাসছে না দেখে নিজেই হেসে উঠি।
কৈশোর যৌবন কেটেছে আকালে দাঙ্গায় দুচোখ ভ’রে দেখেছি জীবনের সর্বনাশা রূপ সেই সব দৃশ্য আজ কত ম্লান ব’লে মনে হয়।
হাজার হাজার মৃত্যু অনাহার কান্না কোটি কোটি বিকৃত বিলাপ, বেকারের আত্মরতি আমাকে স্পর্শ করে না।
বন্দেমাতরমের নামে, ইনকিলাবের নামে, ছা-পোষা জীবনের নামে শবের উপর দাঁড়িয়ে ফিটফাট বাবু, কূট তর্ক করি চোখের সামনে খুন ও ধর্ষণ দেখে মুখ ফিরিয়ে নি কিংবা মন্ত্রির মতো শিঙা বাজিয়ে ছুটি ভোজসভায় আকাল-নাশক বক্তৃতা দিতে ভারতে শাশ্বত আত্মা অথবা আধুনিকতার মর্ম বোঝাতে।
কিছুই আমাকে স্পর্শ করে না আর অনেক সময় ভাবি : আমি কে ? কোথায় আছি ?
এই সব মূল হীন শিকড়ের তুমুল তোলপাড়ে উলঙ্গ প্রেতের ক্যাবারে নৃত্যে অথবা বোধহীন রেকর্ড-প্লেয়ারের গর্জনে আমি এতকাল অশুভ পচা মাংস, দানবের নৈবেদ্য হয়ে গেছি।
বন্ধুরা বলে, ও সব ভাবিস নে, পাগল হবি পাগল হওয়ার চেয়ে শয়তান হওয়া অনেক ভালো।
ও যেখানে পড়ে আছে রক্তপদ্ম ফুটেছে সেখানে। জনহীন রাজপথ সংজ্ঞাহীন ট্রামের লাইন ও পাশে নিষ্প্রাণ বাড়ি জড়সড় অন্ধকার মুখে কয়েকটা পুলিশ ট্রাক, হেলমেট, রাইফেল জীপ, একটা শেলের শব্দ, মাটি ফেটে ধোঁয়ার নাগিনী পাক খেয়ে উঠে পড়ে, শূন্যে দোলে চক্রময় ফণা। রক্তাক্ত সে শুয়ে আছে পৃথিবীর সান্ত্বনার কোলে।
ওখানে রয়েছে শুয়ে গুলিবিদ্ধ একটা মানুষ বুকে তার রক্তপদ্ম মুখে তার চৈত্রের পলাশ অঙ্গ জুড়ে শান্ত নদী যন্ত্রণার গোলাপবাগানে তাকে ঘিরে গাছ পাখি বসন্তের প্রকৃতি আকাশ।
একটা হত্যার রক্তে ভেসে গেল শহরের মুখ চমকে নিভলো আলো। তারপর ঘন অন্ধকারে তার খোলা চোখে এল আস্তে আস্তে ভোরের আকাশ সেই চোখে চোখ রাখে এত সাধ্য ছিল না খুনীর।
ও যেখানে শুয়ে আছে সেখানেই জয়ের সম্মান সেখানেই সূর্য ওঠে, সেখানেই জেগে থাকে ধান।