কাক ও কুকুরের মাঝে এ শহর কবে যে কলকাতা হল শুনি সেও প্রায় তিন তিন শতকের পার তবে ক্লাবহাউসের মাটি ফুঁড়ে উঠে আসা তিন হাজার বছরের পুরোনো কঙ্কাল হয়তো-বা কোনো না বলা ইতিহাসের কথা বলে সমস্ত শহর জুড়ে কাকেদের ওড়াওড়ি উঠছে নামছে ঘেঁটে দিচ্ছে সব সারারাত জুড়ে সারমেয় সন্ত্রাসের শেষে খুব ভোরবেলা, ডাস্টবিনে তিনটি কুকুর পাহারা দেয় সদ্যোজাত মানুষের শিশু তখন কুকুর খবরের হেডলাইন হয় মানুষের প্রণম্য হয় তখন হেড হেঁট করে হেঁটে যায় মানুষ “ পুরোটাই কাকতালীয় “ অবশ্য বলে কেউ কেউ কাক ও কুকুরের মাঝে কেটে গেল কত দীর্ঘকাল কখনও কাকের বেশে, কখনও কুকুরের মত
সারারাত ট্রাক চলে তারপর ভোর হয় দু’ একটা থ্যাঁতলানো কুকুরের দেহ নিয়ে জেগে ওঠে শহর দাঁত মাজে মুখ ধোয় তখন কয়েকটি কাক এসে নামে শবের কিনারে তখন কয়েকটি ট্রেন এসে লাগে শহরের গায়ে
বেলা বাড়ে শহরে শহর বাড়ে দৃশ্যের পাশে দৃশ্য জড়ো হয় দৃশ্য এসে দৃশ্যকে ঠোকরায় এক ম্যাটাডোর ভর্তি খবর আসে কিছু মৃত অনেকে আহত বাকিরা আত্মহত্যাপ্রবণ রুগী জাগে ভিখিরি জাগে মল্লিকঘাটে জেগে ওঠে ফুল চোখ মুখ নাড়িভুড়ি পায়ুদ্বার ধীরে ধীরে মিলেমিশে একাকার হয়ে যেতে থাকে
আর কত নেমে যাবো নীচে কতটা পতন হলে পেয়ে যাবো শেষ মেট্রো ঠিক অতঃপর সরীসৃপকথা মাটি, জল, সুরঙ্গ সুরঙ্গ গোপন ক্ষতের মত জল দেয়াল পেরিয়ে এলে কতটা প্রাকৃতিক হবো এই পাতাল প্রবাহে এরপর গুহামুখ খোলে প্রতীক্ষিত প্লাটফর্ম শীত্কার্ ছুটে এসে ছিটকে ছিটকে ফ্যালে থকথকে আঠালো ----মানুষ অন্ধকার খুঁড়ে খুঁড়ে ছুটে চলে আলোর হাইফেন বৃত্তাকারে বৃত্তাকারে বৃত্তাকারে তবে কি বৃত্তেরও গন্তব্য থাকে ? সব পোকা বাড়ি ফেরে ? সব কেঁচো ? চলন্ত ট্রেনের ভেতরেও তো কেউ কেউ উল্টোদিকে হেঁটে যায় দ্রুত
আমাদের চির চেনা শহরটা কোনোদিন যে উড়তে পারবে আমরা অনেকে তা ভাবতেও পারিনি অথচ দেখুন কয়েকটি মাত্র ডানা শহরের শরীরে জুড়ে দিতেই এক আশ্চর্য উড়ান তখন জানালার ধারে গিয়ে বসি তীব্র হাওয়ায় ভেসে যাচ্ছে আগামী দিনের কত স্বপ্ন ইস্তাহার আশেপাশে রঙবেরঙের ডানা মেলে উড়ে যাচ্ছে কমবয়সী ছেলেমেয়েরাও এমনকি উঁচু উঁচু বাড়িগুলো শূন্যের ওপর ভর দিয়ে বেমালুম দাঁড়িয়ে রয়েছে সন্ধ্যার আকাশে ঝুলে থাকা রেষ্টুরেন্টে জ্বলে ওঠে নরম রঙিন আলো একটা প্রায় অসম্ভব অবয়বকে সত্যি সত্যি ছুঁয়ে দেবে বলে আমাদের এই প্রিয় শহরটা উড়ে চলেছে প্রাণপণে তখন জানালা দিয়ে তাকাই নীচের দিকে আর চমকে দেখি আরেকটা শহর নোংরা স্যাঁতস্যাঁতে ঘিঞ্জি অন্ধকার ও গরিব ফ্যালফ্যাল তাকিয়ে রয়েছে আমাদের দিকে শুধু কয়েকটি হাফল্যাংটো ছেলেমেয়ে আমাদের শহরের হাওয়াপাইপটা যা ওই নীচ পর্যন্ত নেমে গেছে সেটা ধরে টানাটানি করছে প্রবল আরে আমরা পড়ে যাবো যে আমরা যারা হালকা নরম স্বচ্ছ ও ভঙ্গুর আর এভাবে কি আমরা উড়তে পারবো বেশীদিন আমাদের কি বহুদূর উড়ে যাওয়া হবে
শহর পাগল হয়ে গেল কালিঝুলি মেখে ল্যাম্পপোস্টের নীচে বসে পড়ে হঠাৎ হাসে কাঁদে পাশব চীত্কারে ভরিয়ে তোলে চারপাশ সেই চীত্কারে মিছিলে মিছিলে ঢাকে পথ মোড়ে মোড়ে টিন--এজ বুক বিস্ফোরিত হয় গ্লোসাইনবোর্ডের নীচে দাঁড়িয়ে একা একা কথা বলে যে যুবক গূঢ় কোনো অন্ধকার খুঁজে নেবে বলে যে মহিলা মেট্রোর সুড়ঙ্গে হেঁটে গেছে দু’মাইল তাদের সঙ্গী হতে ছয়তলা থেকে ঝাঁপ দেয় কিশোরী শহর পাগল হয়ে গেলে স্কুল ফেরত বাচ্চাকে পিষে দিয়ে বাস পুড়িয়ে চৌরাস্তায় উলঙ্গ হয়ে হাসে মাঝরাতে ম্যানহোলেরা ঢাকনা খুলে বেচে দেয় ধূলোঝেড়ে উঠে দাঁড়ায় জেব্রা-ক্রসিং ভবঘুরে ষাঁড় তাকে তাড়া করে ফেরে ষাঁড়ের পিছনে ছোটে চ্যানেল যোদ্ধারা শহর পাগল হয়ে গেলে হাওড়া ব্রিজের মাথায় উঠে বসে থাকে চুপ তারপর ঢাক বাজাতে বাজাতে নাচতে নাচতে বিসর্জনে যায়
শহরটা কাত হয়ে এপাশে শুয়েছে এখানেই হয়তো কোথাও পড়ে আছে আমাদের ব্ল্যাকবক্স পতনের কারণসমূহ সেই সব পতন যা ঊর্ধ্বমুখী ভাসমান আকাশবিচারী এখানে পুকুর ছিল একদিন খালবিল ধানজমি ঝোপ ও জঙ্গল এখন বহুতল ঘিরে ঘিরে যে আলো ওপরে উঠছে আর যেসব আলোরা মসৃণ রাস্তা দিয়ে ছুটে গেছে তারা কোনো অন্ধকার নয় প্রকৃত এক অন্ধত্বের কথা বলে গ্লোসাইন বোর্ড থেকে নেমে মোবাইল নারী ধাপার মাঠের দিকে চলে গেলে দূরে দূরে এবং আরো দূরে ছোটো ছোটো গ্রামের ইশারা অতল বধিরতায় ডুবে যায় সেইখানে যাবো একদিন বাস থেকে রুবী হাসপাতালের কাছে নেমে হেঁটে হেঁটে চলে যাবো একটা মাদুর পেতে বসবো উঠোনে মাথায় ঘোমটা টানা কোনো বউ মরচে ধরা ট্রাঙ্ক খুলে ব্ল্যাকবক্স হাতে সামনে দাঁড়ালে ভীষণ চমকে উঠে হয়তো বলবো আমি কিছুই দেখিনি জানো শুনিনি কিছুই দলবদ্ধ হেঁটে যাওয়া লালদাগ ছাগলের ভিড়ে এই ভোরের শহরে আমিও তো হেঁটেছি কতদিন পাশাপাশি স্বাস্থ্যোদ্ধারে
হঠাৎই আমাদের পাড়ার গলিটা বড় রাস্তা ছেড়ে দৌড়োতে লাগল প্রাণপণে বস্তুত এত জোরে এ গলিকে দৌড়োতে আমরা প্রায় কেউই কখনও দেখেনি আচমকা একটা চারতলা বাড়ি পথরোধ করে দাঁড়াতেই গলিটা চট করে ঘুরে গেল বাঁদিকে আবার মুহূর্তে ডানদিকে ঘুরে দৌড় দিল সোজা স্বভাবত কয়েকটি জানালা উড়ে গেল এ বাড়ি ও বাড়ি দু’একটি ব্যালকনিও ডানা ঝাপটালো খুব উল্টোদিক থেকে পুলিশের গাড়ি আসতেই গলিটা দুভাগ হয়ে সরে গেল দুই পাশে এই খানেএসে আমাদের একটা বিরতি নেওয়া ভাল কেননা পুলিশের সামনে কিংবা পিছনে বলে কিছুই হয় না পুলিশ একটি শক্ত ও মসৃণ দন্ডবিশেষ দন্ডটি কখনও বড়ো হয় কখনো -বা ছোটো বড়ো হতে হতে বড়ো হতে হতে এত বড়ো হয়ে যায় যে খুব সহজেই আটকে ফ্যালে জল স্থল অন্তরীক্ষ পায়ুদ্বার আবার কখনও ছোটো হতে হতে এত ছোটো হয়ে যায় যে খালি চোখে দন্ডটিকে দেখাই যায় না তখন মানুষ দন্ডটির অস্তিত্ব নিয়েই সন্দিহান হয়ে পড়ে যাইহোক যা বলছিলাম গলি ছুটে যাচ্ছে কখনও ডাইনে কখনও বাঁয়ে পুলিশ ও পলাতক পলাতক ও পুলিশ তার মাঝে এ শহর ক্রমাগত লুকোচুরি খেলে যায়
আজকাল ঠুকে ঠুকে খেলি এক দুই বড়জোর তিনরান কদাচিৎ বাউন্ডারি মেরে দিলে ওপারে বল কুড়োতে গিয়ে দেখি ধানজমি নীলাকাশ দূরে নদী ছায়াঘেরা কুঁড়েঘর ছোটোছোটো বেশ ঘোর লেগে যায় হালকা হাওয়ায় গাছের পাতায় ঝড়মড় পূর্বজন্মের স্মৃতি মত সব মনে ভাসে তাই বলে রাতে থাকি না কখনও কি বিকট অন্ধকার যেন গিলে খেতে আসে তার চেয়ে বড়ো ভয় যদি ফোঁস করে ফণা তোলে বি পি এল কার্ড
যতদূর চোখ যায় ই-মেল প্রান্তর ডাউনলোড করি সূর্যোদয় প্রাণ হাতে নিয়ে ছুটে চলে রঙিন ইঁদুর কত সংবাদ উড়ে আসে উড়ে যায় মায়াবী জানালায় ফুটে ওঠে তোমার মুখ আবহাওয়ার পূর্বাবাসের মতো--- অনির্ণীত আমি কি ঠিক তোমাকেই খুঁজছিলাম ? তবু কথা শুরু হয় সমস্ত কথোপকথনের শেষে বুঝি আমাদের কোনো জাদু ডানা নেই নিতান্তই গোবেচারা মানুষ গোধূলি আলোয় তোমার বিষণ্ণ মুখ মিলিয়ে যায় আবার ইঁদুর ছুটে চলে প্রাণপণে মাঝে মাঝে আলো জ্বলে তার গায়ে অর্ন্তজাল থেকে বেরিয়ে প্রকান্ড অজগর সবার অজান্তে ---নিঃশব্দে আমাকে সম্পূর্ণ গিলে সামনের দিকে চেয়ে থাকে স্থির নীলপর্দা শব্দবমি করে সূর্য় ডুবে যায়
ফ্লাইওভারের থেকে তীব্র বেগে নেমে আসা গাড়ি জ্যামজটে থেমে গেলে কেমন একটা বিষণ্ণতা গ্রাস করে এ শহরের তিন হাজারেরও বেশী গাছ কেটে ফেলার স্মৃতি মনে ভিড় করে আসে পাশাপাশি দুইজনে বহুপথ যেতে যেতে কত কত কথা এফ- এম-এর মতো বেজে যায় অথচ ভেতরে নির্বাক হয়ে আছি বহুকাল উজ্জ্বল পোশাকের নীচে আমাদের শরীর কবে মরে গেছে নিজেও জানি না ফ্লাইওভারের নীচে রাস্তা তার নীচে মাটি তারও গভীরে যে শিকড়গুলি থেকে গেল পাশাপাশি ----মৃত কোনো এক বৃষ্টিদিনে তুমুল অরণ্যের স্বপ্ন নিয়ে যদি জেগে ওঠে সবাই একসাথে আমাদেরও কি পূনর্জন্ম হবে সেইদিন
বনসৃজন---সেও এক জটিল রাজনীতি মানুষ জানে না সেইকথা, গাছ হাড়ে হাড়ে জানে
তিনি ঠিক কবে কোথা হতে রিক্সা চড়ে এই স্ট্যান্ডে এসে নেমেছিলেন জানা নেই তবু যে তিনি থেকে গেলেন অশেষ সৌভাগ্য তাই মোমবাতি ও ধূপ আনন্দে জ্বলে ওঠে বাস, মিনিবাস ট্যাক্সি এবং অবাধ্য অটোরাও প্রণাম জানায় তাঁকে কত মানুষ জন্মায় কত ভগবানও জন্মায় এই পোড়া দেশে ভক্তিরসে গলি মোড় চটচটে হয়ে ওঠে ধুলোধোঁয়া মাখা কাটাফল বিতরিত হয় গ্লেজ টাইলস প্রণামীর থালা যুগপৎ চমকায় অন্তরালে অদৃশ্য হাতেরা খেলা করে দেবতাও চমকে চমকে ওঠে ভয়ে এ জীবন পাঁইটের মায়া গুরু সবেতো কলির সন্ধে শুরু ঢাকেঢোল তালেগোল বল শনি শনিবোল
বাসের মাথায় চড়ে তোমাদের শহরে এলাম ঝাঁকার ভেতরে গাদাগাদি হয়ে সব ঝিমিয়ে গিয়েছে অনেকেই তবু হাওড়ার ব্রীজ দেখলাম, ভিক্টোরিয়া, জাদুঘর পথে ভোর হল প্রথম আলোর দিকে তাকিয়ে সবাই হই হই করে উঠলাম বাসের ঘুমন্ত লোকেরা বিরক্ত হতে আমাদের দলে সবচেয়ে যে বড়ো বুড়ো----রেট কম ঝাঁকা থেকে মুখ বাড়িয়ে বলেছিল ভোরের প্রথম আলো সবসময়ই মহৎ সম্ভাবনার কথা বলে আর এখন তার মুন্ডহীন ধড় দোকানদারের পায়ের নীচে শেষবারের মত কেঁপে কেঁপে উঠছে আর কলোসিয়াম থেকে উঠে আসা দর্শকেরা সেই দৃশ্য চেটে নিচ্ছে চোখে মারো কাটো আরো মাংস চাই রক্তস্রোত আরো আবু ঘ্রাইবের নৃশংসতা নিয়ে কারা যেন কেঁদেছিল খুব
গণধর্ষণের পর শহরটি ধ্বংস হয়ে যায় শহরের শেষতম অটোটি ধরে ----আমরা কয়েকজন মাঝরাতে পালাতে পালাতে ----- গ্লোসাইনের আলো খুবলে নিয়েছিল অটোচালকের চোখ তবু সে চালিয়ে যাচ্ছিল নিখুঁত রাস্তায় দাঁড়ানো উলঙ্গ পাগলীটা বিকট হাসছিল অটোর ভেতরে বসে আমরা আতঙ্কে চুপ শীতল চাহনি ছাড়া পরস্পরকে আর কিছু দেওয়ার ছিল না অন্ধকার বাড়িগুলি থেকে বন্ধ দোকানগুলি থেকে শেষ আর্তনাদও মুছে গিয়েছিল অনেকক্ষণ ফুটপাতে পড়েছিল অসংখ্য মৃতদেহ ছড়িয়ে ছিটিয়ে অথচ ওদের দেখে মনে হয়েছিল সবাই ঘুমন্ত আমরা পেরিয়ে যাচ্ছিলাম শেষ পুলিশ স্টেশন, শেষ বাস টার্মিনাস শেষ চায়ের দোকান ল্যাম্পপোস্টের আলোগুলিও শেষবারের মতো জ্বলে যাচ্ছিল আর চলেই যাচ্ছিল অটো চলছিল চলছিল ----কতদূর শহর ধ্বংস হয়ে গেলে একটা অটো যতদূর যেতে পারে ----ঠিক ততদূর
এখানে আপনি পাচ্ছেন ছোট ছোট আধুনিক ভয় এবং সুদৃশ্য মিথ্যাচার | আপনার ছোট ফ্ল্যাটের পক্ষে মানানসই ঘৃণার কার্পেট বিষণ্ণতার বনসাই, প্রকাশ্য দিবালোকে নিকষ অন্ধকার | আপনার অতিপ্রিয় সিন্থেটিক শিশুর জন্য একটি প্রতিযোগিতা সমৃদ্ধ স্কুলবাস ও বড় বড় ঈর্ষার ফানুস্ | এছাড়াও আপনি পাচ্ছেন একটি আশ্চর্য ব্যালকনি যেখানে দাঁড়ালেই ভীষণ এক পতনের শব্দ আপনার কানে এসে লাগছে | ভয় পাবেন না | জানেনতো পতনশীল বস্তুর কোনো ওজন থাকে না |
একদিন আমাদের বাড়ির চারকোণে চারটি চাকা লাগানো হল আর গড়গড়িয়ে চলতে শুরু করল বাড়ী যেন একটা একতলা বাস সামনের ঘরটা ড্রাইভার-কেবিন বাবা ড্রাইভার মা কনডাকটর যাত্রী--দুজন, আমি আর বোন বড় বড় রাস্তা আর বড় বড় রাস্তার বাঁক পেরিয়ে একসময় একটা বিশাল নদীর সামনে তাহলে কী হবে কোনো সনস্যা নেই বাড়িটা তখন স্টিমার আমরাও মাটি থেকে নদীতে রান্নাঘরটা যেন ইঞ্জিনরুম, মা’-র দায়িত্বে হুস্ হাস্ ধোঁয়া উঠছে, বাবার হাতেপ্রপেলার যাত্রী ---সেই দুজন, আমি আর বোন, তারপর একসময় বাড়িটা এরোপ্লেন, আমি পাইলট উড়তে উড়তে একেবারে মেঘের দেশে সেখানে দেখা হল এক পরীর সাথে তাকে তুলে নিলাম, সে হয়ে গেল এয়ারহোস্টেস যাত্রী---তিনজন, মা, বাবা আর বোন | প্লেন উড়ছে, এয়ারহোস্টেস জানাল প্লেন ভারী হয়ে গেছে আমি দেখলাম, তাই তো কারোকে নেমে যেতে হবে কে নামবে এয়ারহোস্টেস বলল কেন বোন বোন, নেমে যাও সে একটা বিষণ্ণ দৃষ্টি নিয়ে দরজায় দাঁড়াল, আমার একটু কষ্ট হল এয়ারহোস্টেস তাকে ঠেলে ফেলে দিল আবার উড়ছে প্লেন যথারীতি এয়ারহোস্টেস জানাল প্লেন এখনও ভারী কিন্তু আমরাতো চারজন তাতে কী, বাড়ী যে এখন এরোপ্লেন আমি দেখলাম তাই তো কিন্তু কে নামবে, মা না বাবা এয়ারহোস্টেস বলল কেন, দুজনেই দুজনেই ! নিশ্চয়ই বাড়িটা তো এখন বাস নয়, স্টিমারও নয় ওদিকে মা বাবা কিছুতেই নামবে না আমার একটু কষ্ট হল কিন্তু কিছু করার নেই অতএব ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিতে হল ব্যাস, বাড়িটা আর এখন প্লেন নয়, মুহূর্তে রকেট আকাশ ছাড়িয়ে, পৃথিবী ছাড়িয়ে একেবারে মহাকাশে আমি আর পরী দুই মহাকাশচারী ভেসে চলেছি দূরে, বহুদূরে শুধু রকেট অক্সিজেন কমে আসছে |
মালগাড়ীর হুইসিল্ বিকট স্তব্ধতার দিকে বেঁকে গেলে ছায়া ছায়া গাছেরা অসংখ্য হাতপালা বাড়িয়ে শনাক্ত করলো আমাদের | প্রতিটি পাথরের ওপর অঙ্কিত অদৃশ্য শিলালিপি জানিয়ে দিলো মানুষের অনধিকার চর্চা | পাহাড় | জঙ্গল | লালমাটি | ম্যালেরিয়া | ক্যামেরার লেন্সে নিশ্চিহ্ন সব আদিবাসী গ্রাম | প্রতিটি পাতাল কন্যার নিষ্পলক চোখের মণিতে থমকে আছে যুদ্ধ | রেললাইন এতকিছু জানা নাবলেই প্রতিটি নিথর নিতম্ব জড়িয়ে ডুকে গেছে সভ্যতার মিথ্যাভাষ্যের দিকে | এত শোক এত নীরবতা পালন ----মাইলের পর মাইল---সুমিত আমরা কি ফিরতে পারবো কোনোদিন |
স্টেশন মাষ্টার নেই | এই সুযোগে সব রেললাইন জঙ্গলে পালাচ্ছে | দেড়হাজার ফিট ওপরে মদ ও বৃষ্টিতে সম্পূর্ণ ভিজেছি | অশ্রাব্য গালাগালি দিয়ে পেট ছুটে গেছে একটা খাবারহীন দোকানের দিকে | প্রতিশ্রুতি ছাড়া সূর্য ডোবার আগে সে আর কিই বা দিতে পারে | বেড়াতে এলে নাকি এসব হয় | শঙ্কু দার্শনিক হয়ে উড়ে গেলো দূরের পাহাড়ে| পাহাড়ের ওপর আকাশ | আকাশে কালো কালো হাতি | কিছু একটা ঘটবে মনে হয় | ধীরে ধীরে মাথার ভেতরে অন্ধকার নামে | কে যেন বলে ওঠে ঐ যে গেষ্ট হাউসের দারোয়ান | বিশ্বাস কর্ সুমিত জীবনে এই প্রথম আমি দেবদূত দেখলাম |
মাথার ওপর তারামাঠ | শুরু হোলো খেলা | ঐ যে রোহিণী | ঐ তো লুব্ধক | বাল জানো তুমি | কিরি মানে জঙ্গল | বুরু মানে হাতি | মেয়েটা হাসতে হাসতে বললো দেবতা | দেবতারা হাতি না হাতির দেবতা | জানতে চেয়ে হেচ্ কি তুলে মহুয়ার গেলাসে ডুবে গেলো শঙ্কু | ওকে বাঁচাতে আমরাও | তিনটে লাশ ভেসে উঠলো বিকেল পাঁচটায় | খেতে বসে মনে পড়লো মুরগীটা আমাকে দেখে হাস্ ছিলো | মানুষ মূলতঃ লুঠেরা | ওপরে কিরিবুরু, মেঘাতুবুরু, ওখানে পাহাড় খুবলে আকরিক | লোহা, দিনরাত, রাতদিন, ওয়াগনদের টেনে নিয়ে যায় ইঞ্জিন | পেছনে গুপ্তচর মেঘ | গাছেরা পাতা ঝরিয়ে রেখে দিচ্ছে হিসেব, কেন | কেন | বাংলোর বারান্দায় হঠাৎ খুব শীত করছে আমার |
টানেল পেরোতেই শরীরে পরে নিলাম শহর, মালগাড়ীকে টান্ ছে কলকাতা | প্রতিটি ওয়াগনের গায়ে এখন বীভত্স কারচুপির গন্ধ | কেঁচো খুড়লেই অনেক সাপ | প্রতিটি চূড়ান্ত বাঁকেই মানুষ অশ্লীল | ক্যাটওয়াকে সরে যাচ্ছে নদী, দুধারে অসংখ্য মিস্ ওয়ার্ল্ড | দূরে বহুদূরে সেজে উঠ্ ছে সব বিরক্তি | ধুলো ঘাম, হাই উঠছে | ঘুম পাচ্ছে খুব | ছায়া ছায়া বিকেলের ভেতর সুমিত ----কে যেন---শঙ্কু----কোথায় যেন আমরা---- কি সব ভাবছিলাম |
কোনো অলৌকিক ভোর নয় কার্বন কার্পেটমাড়িয়ে এইতো আজও আমরা ইস্কুলে এসেছি দিদিমণি আপনি এখন ইতিহাস পড়াচ্ছেন, ভূগোল, গণিত আর স্কুলগেটে দাঁড়িয়ে থাকা আমাদের দলবদ্ধ মায়েরা বেশ্যার মতন হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়ছে এ-ওর গায়ে অথচ দিদিমনি আপনি যদি এখন ব্ল্যাকবোর্ডে দু-একটি তারা আঁকতেন এপ্রনগন্ধী দেয়ালগুলি থেকে উড়িয়ে দিতে পারতেন ফুল ও পাখী সিলিং থেকে নামিয়ে আনতে পারতেন ছোট্ট একটি ঝরণা আসলে এই যে স্কুলব্যাগ ব্যাগের অন্তর্গত অন্ধকার সেখানে সযত্নে রাখা একটি রিভলবার সবাই আপনাকে ভালবাসা ও শ্রদ্ধা জানিয়ে এবং আমরা তো জেনে ফেলেছি অফিসের পথে যেতে যেতে ভীড়বাসে এখন আমাদের প্রিয় ও গম্ভীর বাবারা কিভাবে ঝুঁকে পড়্ ছে মহিলাদের গায়ের ওপর তাই পেছনের বেঞ্চ থেকে অভ্রান্ত লক্ষ্যে ছুটে যাচ্ছে বুলেট সবই আপনাকে ভালবাসা ও শ্রদ্ধা জানিয়ে সামনের বেঞ্চে বসা মেয়েদের মাথা টপ্ কে সেইসবমেয়েদের যাদের হাত ধরে একদিন বেড়াতে যাবো ভিক্টোরিয়ায়, লেকে তারপর একটু আড়ালে অন্ধকারে ঘন হয়ে প্লীজ দিদিমনি শুনুন সবই আপনাকে ভালবাসা ও শ্রদ্ধা জানিয়ে অথচ সেইসব দিনে আপনি কিন্তু কোথাও নেই কেননা ঐ অভ্রান্ত লক্ষ্যে ছুটে যাওয়া বুলেট এবং আপনি যন্ত্রণায় চেপে ধরেছেন আপনার বুক আপনি শেষ অবধি শুনতে পাচ্ছেন ক্লাসজোড়া হাততালির শব্দ সবই আপনাকে ভালবাসা ও শ্রদ্ধা জানিয়ে অথচ দিদিমনি দেখুন কত সহজেই আপনি ব্ল্যাকবোর্ডে আঁকতে পারতেন দু-একটি তারা এই ক্লাসঘরে নামিয়ে আনতে পারতেন মেঘ ও রোদ্দুর এই মেঝের ওপর বুনে দিতে পারতেন সবুজ ঘাস আর সেই অলৌকিক ভোরে অভিশাপ মুক্তি ঘটতো আমাদের পাখীর পালকের মতো প্রজাপতির ডানার মতো ভালবাসায় মুড়ে আপনিহয়তো পড়াতেন অন্য এক পৃথিবীর ইতিহাস, ভূগোল ও গণিত |
কিনু গোয়ালার পাশের গলিটাই আমাদের মুখশ্রীতে বটগাছ, শনি ঠাকুর, রিক্সাস্ট্যান্ড কানাইদার চায়ের দোকান | এ গলির জ্যামিতি অদ্ভুত, আবহাওয়া বিভিন্ন, কোনো ঘরে ঝড়, কোনো ঘরে বৃষ্টি কোনো ঘরে শুধুই ঠান্ডা বারোমাস আবার কোথাও প্রচন্ড গ্রীষ্ম, খরা ফুটিফাটা মাঠ | তবে কোনো ঘরেই পরিচ্ছন্ন আকাশ নেই | এখানে ছাদের অ্যান্টেনায় লটকে থাকে হাওয়া ঠিকে ঝি এর মতো রোদ আসে বাড়িতে বাড়িতে ছিচ্ কে চোরের মতো জ্যোত্স্না মাঝে মাঝে পুলিশের গাড়ী এসে মুন্ডুহীন যুবকের লাস কুড়িয়ে নিয়ে যায় যে মুন্ডু খোওয়া গেছে এক অদৃশ্য গেন্ডুয়া খেলায় কোনো কোনো রাতে এ গলির যুবতীরা বাড়ি ফেরে পঞ্চপান্ডবরা সুযোগ বুঝে শকুনির দলে ভিড়ে যায় বিভীষণের বাড়ীর একতলায় রাম আর রাবণ পাশাপাশি থাকে ওদের মধ্যে কোনো যুদ্ধ হয় না কারণ সীতা তো শিখেছে এক আশ্চর্য বিদ্যা কিভাবে একই সাথে হওয়া যায় রামের ঘরণী আর রাবণের রক্ষিতা এ গলির আনাচে কানাচে কত রাধাকৃষ্ণের লীলাকীর্তন ডাস্টবিনে অবৈধ সন্তানের শব বহুদিন আগে একদল যুবক এক অসম্ভব ক্রোধ নিয়ে এ গলি থেকে বেরিয়েছিলো আর ফেরেনি | এ ছাড়া এ গলির কোনো ইতিহাস নেই | তবে একটা ভবিষ্যৎ আছে এ নিশ্চিত, অমোঘ, অনিবার্য ধ্বংসের |
ট্রেন চলে গেলে কী পড়ে থাকে ট্রেন চলে গেলে পড়ে থাকে একটা খালি প্ল্যাটফর্ম খালি প্ল্যাটফর্মে খালি কাগজের ঠোঙাদের হাওয়ার সাথে ঘুরে বেড়ানোর স্বাধীনতা একটা ভবঘুরে পাগল, দুটো ভিখিরি জুতো পালিশের বাক্স হাতে উদাসী বালক কুকুরের অসহ্য গা চুলকানো, কাকেদের খোঁটাখুঁটি কোণের চায়ের দোকানে ছোট জটলা ট্রেন চলে গেলে পড়ে থাকে একরাশ বিরক্তি, অযথা রাগ আর অনেকটা সময় পড়ে থাকে নিঃসঙ্গ পদচারণা আর একটা খালি বেঞ্চি নিজেকে নিয়ে নিজেরই সাথে বসার
ওখানে কোনো ষ্টেশন রোড নেই ওখানে একটা হঠাৎ কালিবাড়ি ওখানে কোনো অচেনা লোকের সাথে দেখা হয় না রাস্তায় ওখানে ভিড়ের ভেতর হারিয়ে যাওয়া নেই আয়েত্রীর পাশে এ নগর ধীরে গায়েত্রী পৃথিবীর কোণে বড় সন্তর্পনে নিজেকে নিয়ে নিঝুম হয়ে থাকা কোনো শহরের আকাশে এত নক্ষত্র দেখিনি আগে ওখানে একটা সযত্ন বেঁচে থাকা আছে আর অন্ধকারে মুখ ঢেকে কিছু রিক্সার বর্ডারের দিকে চলে যাওয়া |
খোড়াখুড়ি শেষ-----হাতে যা ঠেকলো সে লাশ আমার নয় ভেবে ঘুরে দাঁড়াতেই ছুটে এলো সব ব্যবহৃত কন্ ডোম্ মিথ্যাচার, ভুল বানানের প্রেমপত্র দৃগ্ধ আঙুলে উল্টে গেলো হলুদ অভিধানের পাতা তবু এ লাশ আমার নয় ভেবে কম্পিউটার স্ক্রীনে মেমারী থেকে তুলে আনি মায়ের মুখ, গৃহস্থালী, নুন লঙ্কা ফেনাভাত দীঘির জলে বটের স্তশ্ধ ছায়া, কুহুডাক অথচ মাঝরাতে নিঃশব্দে ডোরবেল বেজে ওঠে প্রতিটি শিরায় শিরায় ঢুকে পড়ে তদন্ত কমিশন্ শাপগ্রস্তের মতো উঠে দাড়াই, হাঁটি কে যেন ধমকে ওঠে খোড়ো আবার খোড়ো খুঁড়তে খুঁড়তে --------সারাজীবনের অবিশ্বাস খুঁড়তে খুঁড়তে --------সারাজীবনের ঘৃনা খুঁড়তে খুঁড়তে খুঁড়তে খুঁড়তে নেমে আসে ধস্------আমার সারাজীবনের মৃত্যু আমি ভয়ে চীত্কার করে উঠি আর ফিস্ ফিস্ করে বলি তবু এ লাশ আমার নয় |
উত্সব শেষে সবাই ফিরে গেছে একে একে শুধু আমরা কজন মা দাদা ভাই----এই ছয়জন নেশার আচ্ছন্নে রয়েছি ভেসে চেতনায় এক অচেনা সুর আমাদের কোথাও যাওয়ার নেই আমাদের জায়গা নেই কোনো দেশে তাই এই আশ্চর্য ঘরে এক অমোঘ নিয়মে শুয়ে আছি আর কিছু পরে এক অন্য পরিচয়ে পরিচয়হীন হবো বলে পান্ডবরা তখন সুড়ঙ্গপথে বহুদূর |
চলো যাই এ যাওয়াটা অন্যরকম হবে এ যাওয়াটা অন্যসব যাওয়ার মতো নয় রেলওয়ে বুকিং অফিসের সর্পিল লাইন জিনিসপত্র বাঁধাছাঁদা, ট্রাভেলার্স চেক্ দরজা জানালার ছিট্ কিনি তালাগুলি বার বার টেনে টেনে বাড়ীটা খালি রইল একটু দেখো ট্যাক্সিতে হাত নাড়তে নাড়তে----- না ঠিক সেরকম নয় এ যাওয়াটা শুধু যাওয়ার জন্যই যেতে হবে বলেই যাওয়া কোনো স্থাপত্য কীর্তির গূঢ় শিল্পকলা জঙ্গলের দভীর গোপন পাহাড়ের উদাসীন বিশালতা বা সমুদ্রের উদ্দাম ঢেউ-এর টানে নয় হোটেলের ঘরের দৈর্ঘ্যপ্রস্থ বাথরুমের সবিধা অসুবিধা নীচের রেষ্টুরেন্টের খাওয়া খরচ নয় একেবারেই নয় এ যাওয়াটায় শুধু চলে যেতে হয় যেখানে পা ফেললাম পথ সেখান থেকে শুরু হোলো যেদিকে তাকালাম সেদিকেই নিসর্গ রচনা হোলো যেখানে ক্লান্ত হয়ে বসলাম সেখানেই বিশ্রামাগার
অনেকটা এভাবেই
মনে আছে সেই হরিদ্বারে
দুই বন্ধু ঝগড়া করেছিলো পাহাড়ে চড়ে
জানিস তোকে ঠান্ডা করে দিতে পারি, আমি চেতলার ছেলে অপরজন বলেছিলো যা যা দেখা আছে আমিও তিলজলার আসলে হাজার হাজার মাইল দূরে সেই পাহাড়ের ওপর চড়েও ওরা চেতলা আর তিলজলাতেই থেকে গিয়েছিলো এভাবে নয় নির্ভার যেতে হবে আকাশের ভেলা মেঘের মত ভেসে ঘনতায় ঝরে নিজেকে নিঃস্ব করে অর্বুদ বিন্দুতে মাটি ছোঁওয়া ঝরণার সাবলীলতার সাথে মিশে নদী দাবিহান্ অক্লান্ততায় দুকূল ছুঁয়ে চলে যাওয়া যেভাবে মহাবিশ্বের প্রতিটি তারা অতিক্রম যোজন অন্ধকার যে নিয়মে কিশোরী হয়ে ওঠে ঋতুমতী সে নিয়মে যেতে হবে এ যাওয়ার এটাই নিয়ম যাবে যেতে কি পারবে যদি না পারো যদি কখনও কোনোদিন না পারো তাহলে জানবে----ভালোবাসোনি শুধুমাত্র ভালোবাসার জন্য কারোকে কখনও ভালোবাসোনি |