কবি সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা
*
ভাগ্যলক্ষ্মী
কবি সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়

তুমি এলে উত্সবের আনন্দ-মুখর এক রঙীন সন্ধ্যায়
.                 সন্ধ্যামণি রজনীগন্ধায়
.   আবরিয়া তনুখানি, লীলায়িত আনন্দের খনি,
.      আমার নয়ন-আগে দাঁড়ালে যখনি
.      ভরিয়া সুবর্ণ-ঝাঁপি কল্যাণের পঞ্চশষ্য দিয়া,
.                 তখন কাঁপিল মোর হিয়া
.                 অজানিত আশঙ্কায় ;
মর্ম্মের সহস্র তন্ত্রী ব্যথিয়া উঠিল বেদনায় !

তুমি এলে, তারি সাথে এল প্রিয়ে, সংসারের নিষ্ঠুর সংঘাত !
.      তরুণ অরুণ-দীপ্ত যৌবনের নির্ম্মল প্রভাত
.              দীর্ঘ        শ্বাসে হ’য়ে এল ম্লান ;
.              আমার সমস্ত প্রাণ
.      বক্ষ-পঞ্জরের দ্বারে ছিন্নপক্ষ বিহঙ্গম সম
.              তোমারি-সকাশে প্রিয়তম,
.           ছুটে যেতে লুটে প’ল বার বার,
.           তবু দেখা পেল না তোমার !

.                 বসন্তের শুভ আগমনে
যে ফুল ফুটিয়াছিল মর্ম্মতলে নিকুঞ্জ-কাননে ;
.      কুঁড়ির মাঝারে তার ফুটিবার বেদনা গভীর,
.             সারাদিন ব’য়ে গেল দখিনা-সমীর,
.             ব্যর্থ হ’ল আসা-যাওয়া তার |

.                হৃদয়ের রুদ্ধ বেদনার
মর্ম্মছেঁড়া করুণ-কাহিনী, ব্যক্ত হ’ল ভ্রমর-গুঞ্জনে,
.              ভুঞ্জি মধু ক্ষণে ক্ষণে
.     প্রলুব্ধ করিয়া ফুলে বাড়াইল বিরহের ব্যথা ;
.              হৃদয়-মাধবী-লতা
.            এতটুকু পেল না আশ্রয়,
.            কলি বুঝি ফুটিবার নয় |
বসন্ত বিদায় নিল শুষ্ক কলি দীর্ণ কিশলয়ে
.      হৃদয়-শোণিত-লেখা স্মৃতি-রেখা রাখি দিগ্বলয়ে !

তুমি এলে, সঙ্গে করে নিয়ে এলে অফুরন্ত হাসির সম্ভার
.         নিমেষে উল্লসি-উঠা সমুদ্রের তরঙ্গ অপার ;
.     দুলিয়া ফুলিয়া উঠি ধেয়ে এলে কল কল কল,
.              রৌদ্র-তপ্ত বালু-তটে-তল
.              ব্যগ্র বাহু আলিঙ্গনে ঘিরি’
.     ক্লেদসিক্ত ম্লান দেহে মুহূর্ত্তে পাথারে গেলে ফিরি
.            বুকে নিয়ে আঘাত নির্ম্মম |

.             প্রাণের অধিক প্রিয়তম
.      একান্ত নিকটে এসে হয়ে গেছ নিতান্ত সুদূর,
.      নিয়ে এলে হাসি রাশি, রেখে গেলে ক্রন্দনের সুর
.              অনন্ত এ সমুদ্র বেলায় |

.                   শ্রান্ত দীর্ঘ অবেলায়
.             শুধু শুনি বেদনার বাঁশী------
.       রজনীর অন্ধকার ঢেকে দেয় দিবসের হাসি |
.       তুমি এলে শিরে বহি পরিপূর্ণ পূজার থালিকা,
.                  যে নব মালিকা-----
.       নিরালায় বসি তুমি সযতনে রচিলে সুন্দরী,
.                  আপনার লাবণ্য-মাধূরী
.       প্রতি পুষ্পে মাখাইয়া তার, দিলে মোর গলে,
.                  তখন কি জানিতে সরলে,
.       কোরকে কোরকে তার কীট জাগে অতি ভয়ঙ্কর---
.                  বিদীর্ণ করিয়া নিরন্তর
.       এনেছিলে শ্রেষ্ঠ অর্ঘ্য অন্তরের শেষ-নিবেদন
.       সঙ্গে ক’রে ফিরে গেলে মর্ম্ম-ছেঁড়া গভীর বেদন |

.                     *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
বিড়ম্বনা
কবি সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়


তোমার গলে দিইছি মালা
.              সেই ত আমার লজ্জা,
অগ্নিমরু-মরীচিকায়
.              হায় রে বাসরশয্যা  !

ফোটা ফুলের দলে দলে
.               কাঁটার জ্বালা তীক্ষ্ণ,
তোমার সিঁথেয় দিলাম চিতার
.               ছাই----সধবার চিহ্ন |

বিয়ের চেলী রঙিন হ’ল
.               দীর্ণ বুকের রক্তে,
ধূপের ধোঁয়া করলে আঁধার
.               দীপান্বিতা নক্তে |

হায় রে যুগল প্রাণের মিলন
.               হায় বরণের অর্ঘ্য,
মুগ্ধ আঁখির স্নিগ্ধ জ্যোতি
.               হায় হৃদয়ের স্বর্গ !

হায় রে আমার মনের মানিক
.               হায় হৃদয়ের রত্ন,
কলুষহরা জলুষভরা
.               কি জানি তার যত্ন |

ওরে আমার ফুলবাগিচার
.              ফুলের সেরা পদ্ম,
ওরে আমার চাঁদনী রাতের
.              জ্যোত্স্না অনবদ্য !

ওরে আমার মুকুল বনের
.              বকুল বুকের গন্ধ
ওরে আমার নিশিভোরের
.              উতোর হাওয়া মন্দ !

ওরে আমার সাগর-বেলায়
.              কুড়িয়ে-পাওয়া শুক্তি,
স্বপন-ছোঁয়ার মোহন মায়া
.              অরূপ রতন মুক্তি !

তোমার রূপের মুগ্ধ আঁখির
.              সে কি ব্যাকুল দৃষ্টি,
মন-চাতকের আকুল তৃষায়
.              বচনসুধার বৃষ্টি !

নখের ডগায় বহ্নিশিখায়
.              জ্বলছে রূপের দীপ্তি,
বাহুর পাশে বক্ষে বেঁধে
.              কি সে গভীর তৃপ্তি !

অধর ‘পরে অধর-পরশ
.              ক্ষেপায় শিরা মজ্জা,
অথির বুকের থির সাগরে
.              হায় রে শেষের শয্যা  ||

.           *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
অভাগ্য
কবি সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়

দুর্যোগ নিশি পোহালে সূর্য উঠেছে আকাশ পটে
সেই সূর্যের অপূর্ব আলো পড়েছে কখনো চোখে ?
আলোকের স্নেহ উপচিয়া পড়ে ধরণীর দেহ তটে
শুনেছ কখনো কার সে মন্ত্র জাগায় সর্ব লোকে ?

মেঘে ঢাকা ছিল স্তব্ধ আকাশ, নিরুদ্ধ নিঃশ্বাসে
ধরণী গণিছে রাতের প্রহর কখন প্রভাত হবে,
নিবু নিবু দীপ, কম্পিত শিখা জ্বলে তবু আশ্বাসে
যে প্রভাত এলে নীড়হারা পাখি জেগে ওঠে কলরবে ?

সেই সে প্রভাত আলোর ঝরণা যতদূর দেখা যায়
প্রাণের আবেগে ধ্যান-গুহা হতে যেন বাহিরিয়া আসে,
আঁধারের প্রাণী বাহিরে আসিয়া এ উহার পানে চায়
পূবালি হাওয়ায় চেতনা ফিরিছে সচকিত উচ্ছ্বাসে  |
আলোর ছন্দে সূর্য শুনায় নব জীবনের গান
সবুজ পাতার শিরায় শিরায় জেগে ওঠে শিহরণ,
মনে হয় যেন পৃথিবী আজিকে করেছে প্রাতঃস্নান
মুছে গেছে গ্লানি দেহে জাগিয়াছে পুলক-সঞ্চরণ |

সেই সে প্রভাত তোমার মনের আঁধার অন্তরালে
ফুটে ওঠেনিক সম্ভাবনার নূতন পাপড়িগুলি ?
নব কিশলয় মেলেনিক দল মনের শুষ্ক ডালে
ভগ্ন আশার নব মঞ্জরী বাতাসে ওঠেনি দুলি ?

তোমার নয়নে সূর্যের আলো দিল না তাহার শিখা
দীপ্ত দিবার ইঙ্গিত তব জীবনে দিল না ধরা
দুখের রাত্রি একান্তে বসি লিখিল ভাগ্যলিখা
ইহ জনমের অদৃশ্য লিপি সে কি তমসায় ভরা ?

.                *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
হৃদয়-মাল্য
কবি সাবিত্রীপ্রসন্ন চট্টোপাধ্যায়

ফিরে চাও বালা, আমার এ মালা তুমি ভাল করে’ তুমি পরখ কর,
ক্ষণ-মিলনের এ শুভ লগনে অন্তর-দীপ তুলিয়া ধর!
.                ভাল করে’ দেখ সে দীপ-আলোকে
.                এ ফুল কখনো পড়েছে কি চোখে,
বাসনার নব দলগুলি তার রঙীন হয়েছে নবীনতর!

কত আশা করে’ গেঁথেছি এ মালা জীবনের সাধ পরাব গলে,
পরশে তাহার কাঁকিয়া উঠিলে কি ব্যথা জাগিল মরম-তলে ?
.                নয়ন-মোহন ভোরের স্বপন
.                অন্তরপুরে ছিল কি গোপন,
আজিকে সহসা ভুলে-যাওয়া গান মনে পড়ে’ গেল নয়ন-জলে!

এমন জ্যোত্স্না!---কাছে সরে’ এস, বাহু-বন্ধনে জড়ায়ে রাখি’---
জীবন-মরণ রাঙাইয়া দিবে করপল্লবে রঙীন রাখী---।
.                বুকে মাথা রাখ, চোখ তুলে চাও,
.                চুমায় চুমায় ভূবন ভুলাও,
মিলন-সন্ধ্যা মন্থর হোক্ তব অলকের গন্ধ মাখি’।

তনু-দেহ তব কেন শিহরায় তপ্ত বুকের পরশ লেগে,
পরশ-বিধুর বিগত দিনের মলিন মাধুরী উঠে কি জেগে ?
.                তোমার দীর্ঘনিশ্বাস বায়
.                মালার এ ফুল যদি বা শুকায়,
তব মালঞ্চে কবি-মালাকর ফুলদল লবে আবার মেগে।

আমার এ মালা দিই নি কাহারে গাঁথা মালা মোর গিয়েছে ঝরি’---
পথে পথে তোমা খুঁজিতে আবার তুলেছি পুষ্পপাত্র ভরি’ ;
.                কত চেনা মুখে পড়িয়াছে আলো,
.                হয়তো কাহারে লাগিয়াছে ভালো,
কেহ হাসিয়াছে নিকটে আসিয়া কেহ বা দাঁড়াল দু’বাহু ধরি’!

এ মালা তাই তো লুকায়ে রাখিনু বুকের আড়ালে জানে নি কেহ,
পুষ্প-পরাগে করে’ প্রসাধন জানে না তাহারা ফুলের স্নেহ।
.                আমারে চাহিল, চাহিল না মালা,
.                জানে না তাহারা ফুলের কি জ্বালা,
তাই তো তোমারে খুঁজি বারে বারে পথে পাব বলে’ ছেড়েছি গেহ।

আপনা বিলাতে যদি দেখা দিলে শেফালি বনের পুষ্পরানী,
আজি কোজাগরী, হে প্রেম-নাগরী, শরমে দিও না ঘোমটা টানি।
.                ব্যথা জান বলে’ তোমারে জানাই
.                মম জীবনের কত বেদনাই,
তোমারে জানাই ধূলি-বিমলিন বিফল মালার মরম-গ্লানি।

মখ পানে চেয়ে যদি কথা কও দেখিবে সেথায় আরতি করে
এ দুটি তৃষিত নয়ন-প্রদীপ কম্পিত শত শঙ্কা ভরে ;
.                চির-রহস্যে ঢাকা আলো ছায়া
.                তারই মাঝে তুমি লভিয়াছ কায়া,
দিনু শরতের অশ্রুধারায় হৃদয়-মাল্য তোমারি করে।

.                *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর