কবি সব্যসাচী দেবের কবিতা
*
দেখাশোনা
কবি সব্যসাচী দেব

অলস চিবুক ঝুঁকে ছিল রাত্রির আকাশের আধোছায়া ছুঁয়ে,
অন্ধকার চুল ঢেকে দিয়ে ব্যথাতুর চোখ
নেমে গেল আধখোলা বুকের উপর ;

দিগন্তের ভিতর থেকে উঠে আসে মেঘ
মেঘের ভিতর জড়ানো স্বপ্ন
আর স্বপ্নের বুনুনিতে স্মৃতি ;
প্রিয় কোন যুবতীর স্মিতহাস্যে
থেকে যায় নিরুচ্চার ঈষৎ বিষাদ ;
ডিজেলের কটুগন্ধ মুছে দেয় গোধূলির রক্তিম বাসনা |

ঘাসের বুক থেকে ঝরে যায় মধু-----
এই রুক্ষ মৃত্তিকা শুয়ে থাকে বিষের নেশায় |

রাত্রিগুলো গুমরে ওঠে ;  একেকটা বন্ধ্যা রাত্রি
শেষ হয় ক্লান্ত মিলনের বেদনায়,
তারপর মুখ গোঁজে পান্ডুর দিনের কোলে |

মুখের কঠিন ডৌলে কিছু রোদ রেখেছিল ভালোবাসা,
পেঁয়াজ রঙের শাড়ি আঁচলের সীমানায়
বেঁধেছিল দুপুরের উদাসীন বেলা |

যেন কথা ছিল কোথাও যাবার-----
কোনোদিন রক্তাক্ত পায়ের ছাপ খুঁজে খুঁজে
ফিরে পাওয়া যেত ঘর, বিনষ্ট আঙিনা !
নিরুত্তর থেকে যায় মূক প্রহরগুলো,
আনত চিবুকে ফের নেমে আসে ছায়া ;
বাড়ানো হাতের মধ্যে ঝরে পড়ে নিঃশব্দতা আধফোটা শিউলির মতো |

.    শূন্য জলসত্রের পাশে বেজে ওঠে হাহাকার
প্রপাপালিকা নেই-----
কঠিন অ্যাসফল্টে শুধু পড়ে আচে ছেঁড়া কাঁচুলি আর
খোঁপা থেকে ঝরে যাওয়া বাসন্তী পলাশ ;
দীর্ঘ যন্ত্রণায় দুপুর গড়িয়ে আসে বিকেলের নদীর চরে |

বন্ধ কারখানার সামনে মজুরের বউ থালা পেতে ভিক্ষা চায় ;
রক্তিম নিশান ফ্যাকাশে হয়ে ওঠে
রাতজাগা বেশ্যার রঙিন ঠোঁটের মতো ;
ছেলে-ভুলানো ছড়া গাইতে গাইতে চলে যায় ভোটের মিছিল,
পুঁথির পঙ্ ক্তিগুলো কিছুটা বিদ্রূপে আর কিছুটা ব্যথায়
অপলক চেয়ে থাকে-----

দীর্ঘ বুলেভারে পাতা ঝরে এই শেষ ফাল্গুনের দিনে |

বৃষ্টির মেঘের মতো শরীর মৌনও ভাঙে না,
যেন অরণ্যের ছায়ামাখা দুই চোখ জানে শুধু অভিমান ;
ভাসানের তরী চলে যায় শেষবেলার অন্ধকারে |
রাত্রি থেকে ভেসে-আসা জলের কল্লোল দোলা দেয় তটরেখাকে ;
স্তব্ধ সময়ের ভিতর থেকে জেগে ওঠে আর্তি ;
পূর্ণিমার প্রান্ত থেকে উঠে আসে হৃৎপিন্ড-ছেঁড়া চাঁদ ;
ওই রক্তচিহ্ন ছুঁয়ে দুলে ওঠে কোন্ পতাকা !

অস্তলাগা জ্যোত্স্নার হাত থেকে আবির লাগে ভোরের কপালে ;
দিন আর রাত্রির মোহনায় কিছুটা দ্বিধা জড়িয়ে থাকে |

হে প্রিয় যুবতী,
কোন্ প্রান্তে আমাদের দেখাশোনা !

.                 ****************          
.                                                                                     
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর    
*
আগুন-প্রতিমা
কবি সব্যসাচী দেব

কতদিন হলো, আমি তাকাইনি তোমার মুখের দিকে-----

গুমোট বাতাসের মধ্যে
অন্ধকারে হেঁটে যাচ্ছে কেউ ;
বালির ডাঙা যেখানে নেমে আসে জলের কাছে
সেখানে থকথকে কাদার মধ্যে
মরা, শুকনো ডালপালা
আর কালো শিকড়ের ছায়া ;

তোমার দিকে তাকাইনি আমি
নৈঃশব্দ্যের দিকে উড়ে গেছে কয়েকটা ছেঁড়া পাতা
অক্ষরহীন তাদের শরীর থেকে ঝরে যায় মৃত ধ্বনিরা |

সেই নিঃশব্দতার মধ্যে হাত বাড়িয়ে টের পাই
বয়ে যাচ্ছে লাভার স্রোত,
বালিয়াড়ির উপর পায়ের ছাপগুলো চেয়ে থাকে সারারাত,
ডানা ঝাপটায় রাতচরা পাখিরা ;


এখানে এসে দাঁড়াই আমি, এই তপ্ত মাটির উপর ;
দেখি, কেমন করে আকাশ ছুঁতে চায় জলের স্রোত্র
পাথর ছুঁয়ে দেখি জেগে উঠছে আগুন-প্রতিমা ;

আজ এতদিন পর আমি তাকাব তোমার মুখের দিকে |

.                 ****************          
.                                                                                     
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর    
*
আজ ভালোবাসা
কবি সব্যসাচী দেব

আজ শুধু প্রেমের কবিতা লিখি
লিখে যাই পলাশমঞ্জরির কিছু কথা
আর গিরিবর্ত্ম থেকে দেখা বহু নীচে নদীর সংগম
হঠাৎ হাওয়ায় উড়ে-আসা পাতার শিরশির

তুষারচূড়ায় সরে-যাওয়া মেঘচ্ছায়া
.                    দেখতে দেখতে মনে হয়
সেদিনও এমনি চেনা ছিল দু-একটি রক্তবিন্দু
সেদিন মুহূর্ত ছুঁয়ে বলেছিলাম
.                    অন্য-কোনো কথা নয়
.     ঘাসেরও তো আছে বীজ, আছে শীর্ষবিন্দু
আজ শুধু সেইসব কথা বলি
তারপর পাখিদের দীর্ঘ ওড়াওড়ি
.    জলের উপর নেমে-আসা ডানার শব্দ
.           আর অর্কিডের ফুল হাতে
.                  নিস্তব্ধ দাঁড়িয়ে থাকা


যেন এক শতাব্দীও শেষ হয়ে গেছে
.              আমাদের সেই দেখাশোনার পর
হাওয়ার তীক্ষ্ণ শিসে মনে পড়ে
.              আমাদের শেষ কথামালা বেজে উঠেছিল টোড়িতে

সে এক বৃষ্টির সন্ধ্যা, এলোমেলো হাওয়া
.               বারান্দার সামনে নীল অপরাজিতার মুখ
আমাদের প্রথম চুম্বন
.               যেন দীর্ঘ ছায়াপথে ভেসে-আসা অস্ফুট গুঞ্জন
তারপর এই শীত, অশ্রুরেখা ছুঁয়ে থাকে
.                পুরনো তারার আলো

.      অলীক সূর্যাস্তের নীচে জেগে ওঠে রাত্রিস্তব
পাথরের চূড়া থেকে
.               ঝাঁপিয়ে নেমেছে আজ জলস্রোত
শ্যাওলা-জড়ানো পথ দুইপাশে মেলে দেয়
.                              অরণ্যের প্রতিভাস
পাথরের ফাটলে ফাটলে
.               ঘাসের ফ্যাকাশে দাগ ছুঁয়ে
.                             ফোটে তারাফুল
আজ তাই বলি শুধু সেইসব কথা
.       কীভাবে বা ভালোবেসেছিলাম
.       কীভাবে বা আশরীর ভালোবাসা
.                ছিঁড়ে দেয় আজও
.                       দিনাতিপাতের অভ্যাসের জাল

.                   ****************          
.                                                                                     
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর    
*
স্রষ্টা
কবি সব্যসাচী দেব

ভিজে বালি, শিশুটি বানিয়ে তোলে স্তুপ
যেন সে পেয়েছে বর ময়দানবের

ঢেউ এসে ভেঙে দেয় তার অহংকার
ঝাপ্ টা দিয়ে যায় তার সমস্ত শরীরে

অবাক শিশুটি দেখে চেয়ে
তারপর দুই হাতে বালি তুলে নেয়

ঢেউ ফের মুছে দেবে, তবুও সে অন্যমনে আজ
গড়ে তোলে নিজের পৃথিবী

শব্দ তুলে আছড়ে পড়ে ঢেউ
শিশু তাকে ফিরিয়ে দিয়েছে শুধু হাসি

জল তার ছোট্ট দুটি পায়ে
রেখে যায় ফেনা, শাদা ফেনা---

.           ****************          
.                                                                                     
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর    
*
অন্য পৃথিবী
কবি সব্যসাচী দেব

পলাশমঞ্জরী নয়, আবিরের লালও ছিল না
ছোটো দুটি ঠোঁটে ছিল অভিমান মৃদু
বড়োদের অবুঝ পৃথিবী বারবার
বেড়া তোলে, বাঁধতে চায় ছুটির দুপুর

আজ নেই ইশ্ কুলের তাড়া
ভারি ব্যাগ, জলের বোতল
বড়োদের কাজের জগৎ থেকে দূরে, বহুদূরে
খেলাঘরে জেগে থাকে একা
স্বপ্নের আঁচলে মুখ ঢেকে
আশ্বিনের অকেজো দুপুর
এখনি তো ঘুম ভাঙে মায়াবী শহর
কাঠের ঘোড়ার পিঠে লাফ দিয়ে ওঠে
ফ্রকপরা ছোট্ট পুতুল, আর
খোলামাঠে দোলনায় উড়ে যায় এদিক-ওদিক
রোদজ্বলা দিন
আকাশপরীরা নেমে আসে
শিউলিগাছের নীচে তাদের সে ফেলে-যাওয়া হাসি
ফুটে উঠবে সন্ধের মায়াবী আলোয়

বড়োদের বোকা বোকা পৃথিবীতে এইসব খেলার দুপুর
হারিয়েছে কবে
অভিমানী শিশু তাও জানে---

.           ****************          
.                                                                                     
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর    
*
কৃষ্ণা
কবি সব্যসাচী দেব

আমার কোনো শোক নেই, আমার কোনো বিষাদ নেই  |     
হে কুরুবৃদ্ধগণ, আপনাদের নীরবতায় আমার কোনো ক্ষোভ নেই |

পিতামহ ভীষ্ম, ক্ষমা করবেন,
আপনাকে প্রণতি জানাবার স্থিরতা আজ নেই |
আর কর্ণ, তোমার জন্য ঘৃণাও বড়ো বেশি মনে হয় |
আর হে আমার পঞ্চস্বামী, আর্যাবর্ত বিজয়ী বীরশ্রেষ্ঠ অর্জুন,
শক্তিমান ভীম, নকুল, সহদেব আর আপনি ধর্মপুত্র----
আপনারা আমার কৃতজ্ঞ অভিবাদন গ্রহণ করুণ |

আমি সর্বজ্ঞা নই | যজ্ঞভূমের অগ্নি থেকে
আমার জন্ম ; ধর্মাধর্মের ক্ষুরধার পথ আমার অজানিত :
আর্যপুত্র, আপনার বিচার তাই আমার পক্ষে ধৃষ্টতা  |
আপনার কোনো বিচলন নেই, আপনার ধর্ম আপনাকে
রক্ষা করেছে বিকার থেকে---- কৃতজ্ঞতা জানান সেই ধর্মকে |
ভীমসেন, তোমাকে আমি ভালোবাসা দিই নি কখনো,
তাই তো ফিরেও চাই নি  |

শুধু তোমাকে আমার জিজ্ঞাসা ছিল ফাল্গুনি,
ঊর্ধ্বচারী মৎস্যের ছায়ালীন চোখের থেকেও দুর্লক্ষ্য কি
দুর্যোধনের বুক, বলো সত্য করে, প্রেম নয়,
শুধু পৌরুষের আস্ফালনই ছিল পাঞ্চালীর বিজয়ের পটভূমি  ?

কিন্তু মিথ্যা প্রশ্ন :  আমি জানি তোমার কোনো
উত্তর নেই, যেমন নেই কোনো ভালোবাসা |

তোমার শুধু আশা আছে ; কৈশোর থেকে তুমি
জেনে এসেছ বীরভোগ্যা পৃথিবী রূপমুগ্ধা নারী ;
জেনেছ একদিন ধার্তরাষ্ট্রের হাত থেকে ছিনিয়ে নিতে হবে
কৌরব উত্তরাধিকার ; জেনে এসেছ যেখানে যা-কিছু সর্বোত্তম
সেখানেই পৌঁছতে হবে তোমাকে | শুধু এই কুমারী লক্ষ্যের
দিকেই তোমার দৃষ্টি, ধনঞ্জয় | তাই অনায়াসে তুমি সরে যাও
এক নারী থেকে অন্য রমণীতে;  তোমার পূর্বপুরুষেরা যেমন একদা
এক তৃণ প্রান্তরকে নিঃশেষ করে চলে যেতেন বনান্তরে |

এই দ্যূতসভায় দাঁড়িয়ে আমাকে জানতে হলো
নারী শুধু কয়েক প্রহরের বিলাস-সঙ্গিনী  |
মণিময় হার, শতসহস্র তরুণী দাসী, দান্ত মাতঙ্গ,
গন্ধর্বপ্রেরিত অশ্বযূথ আর আমি পান্ডুপুত্রবধূ----
এক পঙ্ ক্তিতে দাঁড়িয়ে আমরা সবাই অপেক্ষায় ;
পিতৃগৃহে যেমন দেখেছিলাম, আহিরিনিরা দূর গ্রাম থেকে
নিয়ে আসে তাদের পসরা---- আর তার উপর ঝুঁকে পড়ে
তেমনই উন্মুখ হয়ে আছে, যারা আমার পতির আত্মীয় ;

আর আমাকে, আমাদের বিলিয়ে দিচ্ছেন যাঁরা,
তাঁরা আমার পঞ্চস্বামী---- বিবাহের মঙ্গলসূত্র হাতে বেঁধে যাঁরা
একদিন আমার উপর নিয়মসিদ্ধ করেছিলেন তাঁদের অধিকার |

না, শুধু এই রত্নমন্ডিত সভাগৃহেই নয়-----
আরো আগে আমাকে জানতে হয়েছিল
আমার কোনো বাসনা নেই, নেই কোনো নিজস্ব ইচ্ছা ;

অর্জুন, প্রথম দেখার মুহূর্তে আমার হৃদয় দিয়েছিলাম তোমাকে ;
অথচ আমার শরীরকে প্রথম আলিঙ্গন করলেন
ঐ মহাভাগ, যাঁর খ্যাতি ধর্মপুত্র বলে  |
ইন্দ্রপ্রস্থের সৌধশিখরে যখন আছড়ে পড়ত
নববর্ষার জলধারা, যখন আমার কামনা ছুঁতে চাইত তোমাকে,
আমার অনুৎসুক দেহকে তখন আকর্ষণ করত অন্য কেউ,
যে আমার স্বামী | বসন্তরজনীতে কিংশুকের প্রমত্ত উল্লাসমুহূর্তে
তোমার ব্যাকুল বাহু টেনে নিত, আমাকে নয়, অন্য কোনো যুবতীকে |
বারেবারে আমাকে সন্তানবতী করেছে পুরুষ, কিন্তু
তারা প্রত্যেকেই আমার আকাঙ্খিত নয় |
কোনো প্রার্থনা নেই আমার | কুরুবৃদ্ধরা বিলাপ করুন ;
জ্যেষ্ঠপান্ডব, প্রহর গুণুন কোন পুণ্যলগ্নে
ধর্মরাজ্য নেমে আসবে মাটিতে ; ভীম, অনুগ্রহ করে স্তব্ধ হও,
নকুল, সহদেব, বিচ্যুত হোয়ো না অগ্রজের প্রতি অটল বিশ্বাসে ;
আর অর্জুন, অন্তঃপুরে যাও, সেখানে তোমার জন্য
স্নিগ্ধ শরীর সাজিয়ে রেখেছে তোমার কোনো প্রেয়সী  |

শোক নয়, লজ্জা নয় ; এই রাজগৃহে দাঁড়িয়ে
আমি জানলাম ------ প্রেম নয়, শ্রদ্ধা নয়, অধিকার নয়,
নারী শুধু প্রয়োজনের | জানলাম, এখনে কোনো
ভেদ নেই ধর্মপ্রাণ যুধিষ্ঠির, শক্তিমান ভীম, প্রেমিক অর্জুন
আর লোলুপ ধৃতরাষ্ট্রনন্দনদের মধ্যে |

প্রতিকার চাইছি না  |
যা শুধু বিলাসের, সেই বস্ত্র ছিনিয়ে নেয় যদি
কোনো দুঃশাসন---- নিক | আমি কাঁদছি না |
চারপাশে ভাসানের ডিঙ্গায় পশুদের উদ্দাম নাচের ভঙ্গি
আমি দেখছি না |
চারপাশে ক্লীবদের অক্ষম বিলাপ
আমি শুনছি না |

ধনুর্বাণ নেই |
আমি ফিরিয়ে আনছি আমার জন্মের স্মৃতি, যজ্ঞের আগুন |

দ্রৌপদী নই, নই পাঞ্চালী, নই ভরতকুলবধূ,
আমি কৃষ্ণা, যজ্ঞাগ্নিসম্ভূতা, শুধু নারী এক |

.           ****************          
.                                                                                     
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর    
*
বরাভয়
কবি সব্যসাচী দেব

ফিরে তাকাব না পুরনো স্মৃতির দিকে
বালিয়াড়ি জুড়ে উড়ে যাক ঝরাপাতা
তোমাকে দেখাব ঢেউয়ের মাথায় নাচা
জ্যোত্স্নার মাঝে কোন্ মায়াফাঁদ পাতা  |

বয়স বেড়েছে শরীরে জমেছে নুন
রঙিন টিভিতে জেনেছি পৃথিবী সুখী
কোলেস্টেরল ঠিকঠাক রাখা গেলে
দু-হাতের মাঝে স্বর্গও দেয় উঁকি |

অনেক তো হলো দৌড়ঝাঁপের খেলা
এবার না হয় বাসা বাঁধি নিরালায়
খোলাবাজারের সুবাদে জমেছে সুদ
গোধূলির দিকে দিন যাবে পায়ে পায়ে  |

ঘরের ভিতর ঝড়ে ওল্টায় সব
বালুচরে দেখি পরীর মাতাল নাচ
মায়াবী ঢেউয়ের মাথায় ভাসতে থাকে
ভাঙা চাঁদ আর আধপোড়া কিছু মাছ |

স্বপ্নমদির ঘুম ভেঙে গেলে দেখি
এলোমেলো হাওয়া উড়িয়ে নিয়েছে পুঁজি
হিশেব মেলে না, নিরুপায় হাতড়াই
ঘর নেই তবে ঠিকানা কোথায় খুঁজি !

ফেরা তো যাবে না অতীতের ভরসায়
বাসা ভাঙে যদি এখন কোথায় যাবে
তোমার দুচোখে তখনো থাকবে আঁকা
অভয় মুদ্রা, ভূমিকম্পের আগে !

.           ****************          
.                                                                                     
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর    
*
জল
কবি সব্যসাচী দেব

আদিম পাথর ভেঙে নেমেছিল জল----
উইলোর কান্নাভেজা ডালগুলো
.           ঝুঁকে ছিল স্রোতের উপরে ;
পিছনে বার্চের শাখা ছায়া মেখে কাঁপে,
সে-কাঁপন থমকে দিয়ে জেগে ওঠে পাহাড়ের নীল  |


পাথরে পাথরে ধাক্কা, জলের অস্থির শব্দে চাপা পড়ে
.           লালচে পাতা, পাপড়ির ঝরে যাওয়া মৃদু শব্দ তুলে  |
ভারি পায়ে চোরবাটো বেয়ে নামে পাহাড়ি কিশোরী
মাথায় ঘাসের বোঝা, চুলে গোঁজা লাল ফুল
.                               ম্লান হয়ে আসে-----
নিভে আসে কাঠের আগুন, রক্তের গভীরে স্বপ্নটুকু
শুক্লা তৃতীয়ার চাঁদ সরে আসে পাহাড়ের দিকে
.                              মায়াবী সংকেতে  |


রাত্রির আকাশে তারা  | কোনো কথা বলে  ?
আদিম পাথর থেকে ঝাঁপ দিয়ে নামে জল নীচে----
অস্পষ্ট সংলাপ আর কিছু গূঢ় গোপনতা বয়ে
জল যায় আরো দূরে,
.           আরো দীর্ঘ জলের সমীপে |

.           ****************          
.                                                                                     
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর    
*
ছিন্ন রাত্রিতে
কবি সব্যসাচী দেব

ছিন্ন রাত্রি জুড়ে বাজে হাওয়ার কল্লোল,
অরণ্যের নৈশ অভিমানরেখা মুছে যায় মেঘের ছোঁয়ায় ;
দৌড়ে-যাওয়া কুয়াশার পিছনে পিছনে
জমাট আঁধার খুলে জেগে ওঠে পূর্ণিমার রাত |


পাহাড়ের বাম সানু খুঁড়ে ওই একদিন উঠেছিল জল---
আজ শুধু পড়ে আছে পাথরের কঠিন গহ্বর |
স্রোত নেই, অন্ধকার নেমে গেছে অনেক গভীরে ;
প্রাচীন পৃথিবী থেকে মাথা তোলে আশ্চর্য সবুজ
রিক্ত কাঠিন্যের চারপাশে |
আকুল প্রার্থনা শুধু জেগে ওঠে আজ----
এসো জল, এসো হাওয়া, বাজো গান বাজো
পাহাড়ের শিখরে শিখরে |


বসন্তপূর্ণিমায় হাওয়া আছড়ে পড়ে অরণ্যের গম্ভীর চূড়ায়----
ছেঁড়া পাতা উড়ে যায় এদিক-ওদিক,
আকুল জ্যোত্স্নার নীচে মধ্যরাতে জ্বলে ওঠে কাঠের আগুন  |


আবিরের দিন কাল, কিছুটা জলের দাগ লেগে থাকে চাঁদের শরীরে |

.                   ****************          
.                                                                                     
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর    
*
তমস্বিনী
কবি সব্যসাচী দেব

অন্ধকারের ভিতর হাত বাড়িয়ে আরো গাঢ়
.                             তমস্বনীকে ছুঁয়ে আছি----
কতদিন হলো !
বুনো হলুদের জঙ্গল থেকে আচ্ছন্ন গন্ধ উঠে আসছিল,
দুপুরের আতপ্ত প্রহর
দুচোখে নামিয়ে আনছিল ঘোর,
তারপর ওই গোধূলির দিকে সরে-যাওয়া ছায়ার দিকে
.                               তাকিয়ে থাকতে থাকতে

আমি দেখে নিই-----
চৈত্রদিনের ফুরিয়ে আসা ;
আর চৈত্রের সঙ্গে চলে-যাওয়া বসন্তকে বিদায় জানতে গিয়ে
আমার শরীর জুড়ে নেমে আসে
ব্যর্থ ঋতুর ভার ;
আমি দিগন্ত খুঁজি, আর সমতলের সীমানা হারিয়ে যায়------
সেই হারানো মানচিত্রের মাঝে
অনেকক্ষণ থমকে থাকে আমার চারপাশের কথা,
আর পাতাঝড়ার শব্দ
আমার হাতের উপর

.                   ****************          
.                                                                                     
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর