যেন কথা ছিল কোথাও যাবার----- কোনোদিন রক্তাক্ত পায়ের ছাপ খুঁজে খুঁজে ফিরে পাওয়া যেত ঘর, বিনষ্ট আঙিনা ! নিরুত্তর থেকে যায় মূক প্রহরগুলো, আনত চিবুকে ফের নেমে আসে ছায়া ; বাড়ানো হাতের মধ্যে ঝরে পড়ে নিঃশব্দতা আধফোটা শিউলির মতো |
. শূন্য জলসত্রের পাশে বেজে ওঠে হাহাকার প্রপাপালিকা নেই----- কঠিন অ্যাসফল্টে শুধু পড়ে আচে ছেঁড়া কাঁচুলি আর খোঁপা থেকে ঝরে যাওয়া বাসন্তী পলাশ ; দীর্ঘ যন্ত্রণায় দুপুর গড়িয়ে আসে বিকেলের নদীর চরে |
বন্ধ কারখানার সামনে মজুরের বউ থালা পেতে ভিক্ষা চায় ; রক্তিম নিশান ফ্যাকাশে হয়ে ওঠে রাতজাগা বেশ্যার রঙিন ঠোঁটের মতো ; ছেলে-ভুলানো ছড়া গাইতে গাইতে চলে যায় ভোটের মিছিল, পুঁথির পঙ্ ক্তিগুলো কিছুটা বিদ্রূপে আর কিছুটা ব্যথায় অপলক চেয়ে থাকে-----
দীর্ঘ বুলেভারে পাতা ঝরে এই শেষ ফাল্গুনের দিনে |
বৃষ্টির মেঘের মতো শরীর মৌনও ভাঙে না, যেন অরণ্যের ছায়ামাখা দুই চোখ জানে শুধু অভিমান ; ভাসানের তরী চলে যায় শেষবেলার অন্ধকারে | রাত্রি থেকে ভেসে-আসা জলের কল্লোল দোলা দেয় তটরেখাকে ; স্তব্ধ সময়ের ভিতর থেকে জেগে ওঠে আর্তি ; পূর্ণিমার প্রান্ত থেকে উঠে আসে হৃৎপিন্ড-ছেঁড়া চাঁদ ; ওই রক্তচিহ্ন ছুঁয়ে দুলে ওঠে কোন্ পতাকা !
অস্তলাগা জ্যোত্স্নার হাত থেকে আবির লাগে ভোরের কপালে ; দিন আর রাত্রির মোহনায় কিছুটা দ্বিধা জড়িয়ে থাকে |
গুমোট বাতাসের মধ্যে অন্ধকারে হেঁটে যাচ্ছে কেউ ; বালির ডাঙা যেখানে নেমে আসে জলের কাছে সেখানে থকথকে কাদার মধ্যে মরা, শুকনো ডালপালা আর কালো শিকড়ের ছায়া ;
তোমার দিকে তাকাইনি আমি নৈঃশব্দ্যের দিকে উড়ে গেছে কয়েকটা ছেঁড়া পাতা অক্ষরহীন তাদের শরীর থেকে ঝরে যায় মৃত ধ্বনিরা |
সেই নিঃশব্দতার মধ্যে হাত বাড়িয়ে টের পাই বয়ে যাচ্ছে লাভার স্রোত, বালিয়াড়ির উপর পায়ের ছাপগুলো চেয়ে থাকে সারারাত, ডানা ঝাপটায় রাতচরা পাখিরা ;
এখানে এসে দাঁড়াই আমি, এই তপ্ত মাটির উপর ; দেখি, কেমন করে আকাশ ছুঁতে চায় জলের স্রোত্র পাথর ছুঁয়ে দেখি জেগে উঠছে আগুন-প্রতিমা ;
আজ শুধু প্রেমের কবিতা লিখি লিখে যাই পলাশমঞ্জরির কিছু কথা আর গিরিবর্ত্ম থেকে দেখা বহু নীচে নদীর সংগম হঠাৎ হাওয়ায় উড়ে-আসা পাতার শিরশির
তুষারচূড়ায় সরে-যাওয়া মেঘচ্ছায়া . দেখতে দেখতে মনে হয় সেদিনও এমনি চেনা ছিল দু-একটি রক্তবিন্দু সেদিন মুহূর্ত ছুঁয়ে বলেছিলাম . অন্য-কোনো কথা নয় . ঘাসেরও তো আছে বীজ, আছে শীর্ষবিন্দু আজ শুধু সেইসব কথা বলি তারপর পাখিদের দীর্ঘ ওড়াওড়ি . জলের উপর নেমে-আসা ডানার শব্দ . আর অর্কিডের ফুল হাতে . নিস্তব্ধ দাঁড়িয়ে থাকা
যেন এক শতাব্দীও শেষ হয়ে গেছে . আমাদের সেই দেখাশোনার পর হাওয়ার তীক্ষ্ণ শিসে মনে পড়ে . আমাদের শেষ কথামালা বেজে উঠেছিল টোড়িতে
সে এক বৃষ্টির সন্ধ্যা, এলোমেলো হাওয়া . বারান্দার সামনে নীল অপরাজিতার মুখ আমাদের প্রথম চুম্বন . যেন দীর্ঘ ছায়াপথে ভেসে-আসা অস্ফুট গুঞ্জন তারপর এই শীত, অশ্রুরেখা ছুঁয়ে থাকে . পুরনো তারার আলো
. অলীক সূর্যাস্তের নীচে জেগে ওঠে রাত্রিস্তব পাথরের চূড়া থেকে . ঝাঁপিয়ে নেমেছে আজ জলস্রোত শ্যাওলা-জড়ানো পথ দুইপাশে মেলে দেয় . অরণ্যের প্রতিভাস পাথরের ফাটলে ফাটলে . ঘাসের ফ্যাকাশে দাগ ছুঁয়ে . ফোটে তারাফুল আজ তাই বলি শুধু সেইসব কথা . কীভাবে বা ভালোবেসেছিলাম . কীভাবে বা আশরীর ভালোবাসা . ছিঁড়ে দেয় আজও . দিনাতিপাতের অভ্যাসের জাল
আমার কোনো শোক নেই, আমার কোনো বিষাদ নেই | হে কুরুবৃদ্ধগণ, আপনাদের নীরবতায় আমার কোনো ক্ষোভ নেই |
পিতামহ ভীষ্ম, ক্ষমা করবেন, আপনাকে প্রণতি জানাবার স্থিরতা আজ নেই | আর কর্ণ, তোমার জন্য ঘৃণাও বড়ো বেশি মনে হয় | আর হে আমার পঞ্চস্বামী, আর্যাবর্ত বিজয়ী বীরশ্রেষ্ঠ অর্জুন, শক্তিমান ভীম, নকুল, সহদেব আর আপনি ধর্মপুত্র---- আপনারা আমার কৃতজ্ঞ অভিবাদন গ্রহণ করুণ |
আমি সর্বজ্ঞা নই | যজ্ঞভূমের অগ্নি থেকে আমার জন্ম ; ধর্মাধর্মের ক্ষুরধার পথ আমার অজানিত : আর্যপুত্র, আপনার বিচার তাই আমার পক্ষে ধৃষ্টতা | আপনার কোনো বিচলন নেই, আপনার ধর্ম আপনাকে রক্ষা করেছে বিকার থেকে---- কৃতজ্ঞতা জানান সেই ধর্মকে | ভীমসেন, তোমাকে আমি ভালোবাসা দিই নি কখনো, তাই তো ফিরেও চাই নি |
শুধু তোমাকে আমার জিজ্ঞাসা ছিল ফাল্গুনি, ঊর্ধ্বচারী মৎস্যের ছায়ালীন চোখের থেকেও দুর্লক্ষ্য কি দুর্যোধনের বুক, বলো সত্য করে, প্রেম নয়, শুধু পৌরুষের আস্ফালনই ছিল পাঞ্চালীর বিজয়ের পটভূমি ?
কিন্তু মিথ্যা প্রশ্ন : আমি জানি তোমার কোনো উত্তর নেই, যেমন নেই কোনো ভালোবাসা |
তোমার শুধু আশা আছে ; কৈশোর থেকে তুমি জেনে এসেছ বীরভোগ্যা পৃথিবী রূপমুগ্ধা নারী ; জেনেছ একদিন ধার্তরাষ্ট্রের হাত থেকে ছিনিয়ে নিতে হবে কৌরব উত্তরাধিকার ; জেনে এসেছ যেখানে যা-কিছু সর্বোত্তম সেখানেই পৌঁছতে হবে তোমাকে | শুধু এই কুমারী লক্ষ্যের দিকেই তোমার দৃষ্টি, ধনঞ্জয় | তাই অনায়াসে তুমি সরে যাও এক নারী থেকে অন্য রমণীতে; তোমার পূর্বপুরুষেরা যেমন একদা এক তৃণ প্রান্তরকে নিঃশেষ করে চলে যেতেন বনান্তরে |
এই দ্যূতসভায় দাঁড়িয়ে আমাকে জানতে হলো নারী শুধু কয়েক প্রহরের বিলাস-সঙ্গিনী | মণিময় হার, শতসহস্র তরুণী দাসী, দান্ত মাতঙ্গ, গন্ধর্বপ্রেরিত অশ্বযূথ আর আমি পান্ডুপুত্রবধূ---- এক পঙ্ ক্তিতে দাঁড়িয়ে আমরা সবাই অপেক্ষায় ; পিতৃগৃহে যেমন দেখেছিলাম, আহিরিনিরা দূর গ্রাম থেকে নিয়ে আসে তাদের পসরা---- আর তার উপর ঝুঁকে পড়ে তেমনই উন্মুখ হয়ে আছে, যারা আমার পতির আত্মীয় ;
আর আমাকে, আমাদের বিলিয়ে দিচ্ছেন যাঁরা, তাঁরা আমার পঞ্চস্বামী---- বিবাহের মঙ্গলসূত্র হাতে বেঁধে যাঁরা একদিন আমার উপর নিয়মসিদ্ধ করেছিলেন তাঁদের অধিকার |
না, শুধু এই রত্নমন্ডিত সভাগৃহেই নয়----- আরো আগে আমাকে জানতে হয়েছিল আমার কোনো বাসনা নেই, নেই কোনো নিজস্ব ইচ্ছা ;
অর্জুন, প্রথম দেখার মুহূর্তে আমার হৃদয় দিয়েছিলাম তোমাকে ; অথচ আমার শরীরকে প্রথম আলিঙ্গন করলেন ঐ মহাভাগ, যাঁর খ্যাতি ধর্মপুত্র বলে | ইন্দ্রপ্রস্থের সৌধশিখরে যখন আছড়ে পড়ত নববর্ষার জলধারা, যখন আমার কামনা ছুঁতে চাইত তোমাকে, আমার অনুৎসুক দেহকে তখন আকর্ষণ করত অন্য কেউ, যে আমার স্বামী | বসন্তরজনীতে কিংশুকের প্রমত্ত উল্লাসমুহূর্তে তোমার ব্যাকুল বাহু টেনে নিত, আমাকে নয়, অন্য কোনো যুবতীকে | বারেবারে আমাকে সন্তানবতী করেছে পুরুষ, কিন্তু তারা প্রত্যেকেই আমার আকাঙ্খিত নয় | কোনো প্রার্থনা নেই আমার | কুরুবৃদ্ধরা বিলাপ করুন ; জ্যেষ্ঠপান্ডব, প্রহর গুণুন কোন পুণ্যলগ্নে ধর্মরাজ্য নেমে আসবে মাটিতে ; ভীম, অনুগ্রহ করে স্তব্ধ হও, নকুল, সহদেব, বিচ্যুত হোয়ো না অগ্রজের প্রতি অটল বিশ্বাসে ; আর অর্জুন, অন্তঃপুরে যাও, সেখানে তোমার জন্য স্নিগ্ধ শরীর সাজিয়ে রেখেছে তোমার কোনো প্রেয়সী |
শোক নয়, লজ্জা নয় ; এই রাজগৃহে দাঁড়িয়ে আমি জানলাম ------ প্রেম নয়, শ্রদ্ধা নয়, অধিকার নয়, নারী শুধু প্রয়োজনের | জানলাম, এখনে কোনো ভেদ নেই ধর্মপ্রাণ যুধিষ্ঠির, শক্তিমান ভীম, প্রেমিক অর্জুন আর লোলুপ ধৃতরাষ্ট্রনন্দনদের মধ্যে |
প্রতিকার চাইছি না | যা শুধু বিলাসের, সেই বস্ত্র ছিনিয়ে নেয় যদি কোনো দুঃশাসন---- নিক | আমি কাঁদছি না | চারপাশে ভাসানের ডিঙ্গায় পশুদের উদ্দাম নাচের ভঙ্গি আমি দেখছি না | চারপাশে ক্লীবদের অক্ষম বিলাপ আমি শুনছি না |
ধনুর্বাণ নেই | আমি ফিরিয়ে আনছি আমার জন্মের স্মৃতি, যজ্ঞের আগুন |
দ্রৌপদী নই, নই পাঞ্চালী, নই ভরতকুলবধূ, আমি কৃষ্ণা, যজ্ঞাগ্নিসম্ভূতা, শুধু নারী এক |
আদিম পাথর ভেঙে নেমেছিল জল---- উইলোর কান্নাভেজা ডালগুলো . ঝুঁকে ছিল স্রোতের উপরে ; পিছনে বার্চের শাখা ছায়া মেখে কাঁপে, সে-কাঁপন থমকে দিয়ে জেগে ওঠে পাহাড়ের নীল |
পাথরে পাথরে ধাক্কা, জলের অস্থির শব্দে চাপা পড়ে . লালচে পাতা, পাপড়ির ঝরে যাওয়া মৃদু শব্দ তুলে | ভারি পায়ে চোরবাটো বেয়ে নামে পাহাড়ি কিশোরী মাথায় ঘাসের বোঝা, চুলে গোঁজা লাল ফুল . ম্লান হয়ে আসে----- নিভে আসে কাঠের আগুন, রক্তের গভীরে স্বপ্নটুকু শুক্লা তৃতীয়ার চাঁদ সরে আসে পাহাড়ের দিকে . মায়াবী সংকেতে |
রাত্রির আকাশে তারা | কোনো কথা বলে ? আদিম পাথর থেকে ঝাঁপ দিয়ে নামে জল নীচে---- অস্পষ্ট সংলাপ আর কিছু গূঢ় গোপনতা বয়ে জল যায় আরো দূরে, . আরো দীর্ঘ জলের সমীপে |
অন্ধকারের ভিতর হাত বাড়িয়ে আরো গাঢ় . তমস্বনীকে ছুঁয়ে আছি---- কতদিন হলো ! বুনো হলুদের জঙ্গল থেকে আচ্ছন্ন গন্ধ উঠে আসছিল, দুপুরের আতপ্ত প্রহর দুচোখে নামিয়ে আনছিল ঘোর, তারপর ওই গোধূলির দিকে সরে-যাওয়া ছায়ার দিকে . তাকিয়ে থাকতে থাকতে
আমি দেখে নিই----- চৈত্রদিনের ফুরিয়ে আসা ; আর চৈত্রের সঙ্গে চলে-যাওয়া বসন্তকে বিদায় জানতে গিয়ে আমার শরীর জুড়ে নেমে আসে ব্যর্থ ঋতুর ভার ; আমি দিগন্ত খুঁজি, আর সমতলের সীমানা হারিয়ে যায়------ সেই হারানো মানচিত্রের মাঝে অনেকক্ষণ থমকে থাকে আমার চারপাশের কথা, আর পাতাঝড়ার শব্দ আমার হাতের উপর