কবি সব্যসাচী দেবের কবিতা
*
কোণার্কে
কবি সব্যসাচী দেব

রাত্রিশেষে চাঁদ ঝুঁকে ছিল  ঝাউগাছের মাথায়----
অল্প হাওয়ায় পাতার কাঁপন, আর
সাইকেল রিক্সার সামনে থমকে গিয়েছিল
.                         একটা কাঠবিড়ালি |
আধোছায়া ভেঙে বালিয়াড়ি বেয়ে
.                        গড়িয়ে নামে আলো,
পুণ্যার্থীর বিশাল জনতা সমুদ্র আড়াল করে
.                        জয়ধ্বনি দেয়  |


ফিরে আসি, ভেসে-যাওয়া নৌকা আর
.                        জলের অস্থিরতা পিছনে রেখে
ফিরে আসি, দুপায়ে জলের দাগ আর
.                        নোনা বাতাসের কামড় নিয়ে
ফিরে আসি, সমুদ্র আর মানুষের শিল্পের
.                        মাঝখানে বেড়ে-ওঠা
.                                   সময়ের প্রান্তর পেরিয়ে |


নিথর রথের চূড়া, চাকায় লেগেছে কিছু স্থবিরতা
দেবতার মুখে ছায়া নামে ;
সূর্য উঠে আসে মধ্য-আকাশে
দেখি রৌদ্রের প্রখর্য সরিয়ে দিয়েছে সব
.                        ব্যস্ত পর্যটকদের

এই দগ্ধ দুপুরবেলায়
পাথরে জেগেছে শুধু অভিমান---

.                 ****************          
.                                                                                     
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর    
*
মৃত্যুতিথি জন্মদিন
কবি সব্যসাচী দেব

এই কি জীবন, যখন জন্মদিনের শিরায় শিরায়
.               জড়িয়ে আছে মৃত্যুতিথির মেঘ !
মাটি থেকে উঠে-আসা কটু গন্ধ
.               আমার জেগে থাকার উপর ছড়িয়ে দিচ্ছে বিষ !
আর ওই তো আজ ভেঙে পড়ছে পাথর
শিকড় পর্যন্ত উপরে আসছে ঝুরি-নামানো গাছ
খাদের নীচ থেকে উঠে-আসা কুয়াশা
.               ঢেকে দিচ্ছে আমাদের স্মৃতিস্বপ্ন  |


এইখানে আমার যাত্রা শুরু------কোন্ দিকে  !
হাঁ-করা সময়ের সামনে দাঁড়িয়ে দেখি
তোমার মুখ অন্ধকারে ঢাকা-----
সেখানে শুধু কৃষ্ণাচতুর্দশীর কয়েকটি পঙ্ ক্তি |


ওখানে কেঁপে উঠছে কোন্ দীর্ঘশ্বাস !
আঁকড়ে ধরি ফাটল থেকে বেরিয়ে-আসা
.                                       ধারালো ঘাসের মুঠি-----
তোমার অঞ্জলিতে ক্ষতমুখ থেকে ঝড়ে পড়ে রক্ত |
খুব দেরি হয়ে যায় আমার |
.              তোমার দিকে তাকিয়ে জেনে নিই
শুরু করতে হবে চলা----- কুয়াশা ছিঁড়ে
.                                বেজে উঠছে হাওয়ার করতালি,
আর লম্বা গাছগুলোর মাথায় একটা একটা করে
.                                মশাল জ্বেলে দিচ্ছে তারারা |


এই তো জীবন, এখন মৃত্যুতিথির ভিতর থেকে
.           জেগে উঠছে জন্মদিনের গান---

.                 ****************          
.                                                                                     
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর    
*
কুয়াশায়
কবি সব্যসাচী দেব

সূর্যাস্তের কাছে প্রণতি জানিয়েছিল শরীর,
এখন মিলিয়ে যাচ্ছে তার স্পর্শ |
এবার আলো জ্বলে ওঠার সময়
তারাদের ভিড় করার সময় |

খস্ খস্ শব্দ তুলে শুকনো পাতার উপর
দৌড়ে যায় মেঠো ইঁদুর-----

আজ তবে আমরা অন্ধকারের কথা বলি
বলি সেইসব যুদ্ধের কথা
সেইসব নিঃশব্দ রক্তপাতের পর
.                           শিশির ঝরার কথা |

এখন রাত্রিকুসুমের ফুটে ওঠার সময়----
ঠোঁটের উপর নেমে আসে তৃষ্ণার্ত ঠোঁট ;
মুহূর্তগুলো থমকে যায় সেখানে |
এখন আমরা বলি তার ভিতর থেকে উঠে-আসা
জলকণা আর প্রত্যাখ্যানের কথা-----
আর সব কথামালা ছুঁয়ে থাকে
.                                  শস্যের পিপাসা  |

অন্ধকার ঘরগুলো থেকে গান বেজে ওঠে
ও আমার চাঁদের আলো----

কুয়াশার দীর্ঘ মিছিল হেঁটে যায়
.                           মৃত্যুশিবিরের দিকে |

.                 ****************          
.                                                                                     
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর    
*
নীরবতা
কবি সব্যসাচী দেব

তোমাকে ছুঁতে পারিনি
হাত বাড়িয়েছিলাম মেঘলা দিনের বুকের ভিতর থেকে-----


মাঝখানে রয়ে যায় নীরবতা |


সেকি কথা ছিল না বলে
নাকি শব্দের শরীর থেকে
ঝরে পড়েছিল পুরনো সঞ্চয় !

কোথায় তুমি ! আমার দিকচিহ্নহীন জিজ্ঞাসা
খুঁজে বেড়ায়-----

এখানে হা হা করা মাঠ শূন্য বুক নিয়ে পড়ে থাকে
কী করে পেরোব তাকে !
কী করে হেঁটে যাব ভুখমিছিলের পাশে
হেঁটে যাব তোমার দিকে !

কথা বলতে গেলে উঠে আসে গোঙানি---
এ নিয়ে কি ধরতে পারব তোমার হাত !


কত রক্তাক্ত মুখের স্তব্ধতা পেরিয়ে
এসে দাঁড়াই তোমার কাছে----
কথা নেই | মাঝখানে খেলে যায় ভোরের বাতাস

তোমাকে ছুঁয়ে থাকে
আমাকে ছুঁয়ে থাকে----
নীরবতা  !

.                 ****************          
.                                                                                     
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর    
*
যেন জন্মান্তর
কবি সব্যসাচী দেব

শীতরজনীর ঔসাস্য লেগে ছিল
তখনো
তোমার ঠোঁটে

হাল্ কা রোদ নেমে পড়েছে বারান্দায়

বিষণ্ণ ঘর পেরিয়ে
তুমি হেঁটে আসছিলে
সে-দিকে

তোমার চিবুকে মাঝে মাঝে
নক্ শা এঁকে যাচ্ছে আলো
শীতরাত্রির স্মৃতি বয়ে
তুমি হেঁটে আসছ

তোমার বুকে দুলে উঠেছে
যেন জন্মান্তর |

.     ****************          
.                                                                                     
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর    
*
নারী তুমি
কবি সব্যসাচী দেব

তোমার কঠিন মুখে
লেগে ছিল
রোদের লাবণি আর হিমের নিষ্ঠুরতা

শুকনো ডালগুলো শোনায়
পাতা ঝরার খবর

অন্ধকারে শুয়ে
নদী অপেক্ষা করে
বৃষ্টি আর পাথরের গল্পের জন্য

তার কুয়াশাঢাকা বুক থেকে
একটু হাওয়া উঠে এসে
আঁচল উড়িয়ে নেয়
তোমার শান্ত মুখে

আলোয় ছেয়ে যায় অর্ধেক আকাশ

.         ****************          
.                                                                                     
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর    
*
যাওয়া
কবি সব্যসাচী দেব

স্পর্শে কেঁপে ওঠে তোমার মুখ

হাড়ের ভিতর সেঁধিয়ে গিয়েছিল শীত
এখন পাথর ভেঙে গড়িয়ে নামছে চোখের জল

এসো, যাই
অন্ধকারে অঞ্জলি ভরে দিয়ে চলে গেল স্রোত

চলো
ওইদিকে সমুদ্র, ওইদিকে সূর্যের প্রথম উদ্ ভাস ---

.                ****************          
.                                                                                     
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর    
*
গান
কবি সব্যসাচী দেব



অনেক গল্প বলার ছিল আমাদের ;  অনেক উত্ফুল্ল রাত্রি
.                                আর আরক্তদিনের গল্প
শুরু হয়েছিল অলস ভঙ্গিতে ; শরীরে খেলে যাচ্ছিল
.                                গ্রীষ্মমন্ডলের আলো
তারপর জ্বলে উঠল দিন ; টর্চার-চেম্বার থেকে ভেসে-আসা চিত্কার
.                                ছড়িয়ে গেল ছুঁচ-বেঁধানো বাতাসে
শুকনো খড়গুলো ঘূর্ণি হাওয়ায় উড়ে গেল এদিক-ওদিক
সব গল্প ছুঁয়ে রইল খরার চিহ্ন  |




আমাদের গল্প ফুরিয়ে যায় খরায় ;
হলুদ পাতার গুঁড়িয়ে যাওয়ার শব্দ ঘুরতে থাকে মাথার মধ্যে
চামড়ায় কামড় বসায় নোনা হাওয়া

নদীর মৃত গর্ভ থেকে উঠে আসে ধুলো আর শামুকের খোলা




খাঁ খাঁ মাঠ ; ফাটল থেকে বেড়িয়ে আসে পোকারা

শুকনো কুয়োর পাশে পালক ছড়ানো
বাতাস চিরে উঠে আসে গোঙানি




একটি গানের জন্য জেগে থাকা অনেকক্ষণ

বাসটার্মিনাসে দুলে উঠেছিল মেঘলা আলো
মধ্যজুলাইয়ের বিকেল গড়িয়ে যাচ্ছিল আলতো পায়ে
.    কোনো গান বাজেনি এখনো ---- কথা রাখেনি কেউ


বিকেলের ফ্যাকাশে সূর্য টলে যাচ্ছে গঙ্গার দিকে
অন্ধকারের দিকে সরে আসছে জনপদ---- বৃষ্টি নামবে




কথা রাখেনি কেউ, এই উদাসীন শহর
আজ গানহীন
ঝুঁকে আছে মাতাল ভঙ্গিতে

ছেঁড়া শব্দের টুকরো ছড়িয়ে থাকে এলোমেলো




সারাদিন শরীরে জড়িয়ে ছিল খরার দাগ

নিঃশব্দে বৃষ্টির কাছে ঝরে যাচ্ছে চরণগুলি
আজ মেঘ | আজ আষাঢ়ের প্রথম দিবস  | পথে পথে
.                                  ঝরে যায় কদমের রেণু




তোমার সমস্ত গান সরে আসে গোধূলির দিকে
হাঁসের ডানায় রক্ত লাগে, জলের চূড়ায়
.                                  আগুনের তীব্র শিখা
ওই ঘরে-ফেরা শিশুটির গাঢ় অভিমান
ছুঁয়ে বাজে কোন কথামালা




রাত্রি এল ! শরীর ছুঁয়েছে ঘুম |  মেঘে মেঘে আকাশ আড়াল

আমাদের শেষ-না হওয়া গল্পগুলো
স্বপ্নে জেগে উঠতে চায়
খরার ক্ষতরেখা বুকে নিয়ে


আজ গান এল না ; না-শোনানো সেই গান---

.                ****************          
.                                                                                     
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর    
*
মেঘবিকেলে
কবি সব্যসাচী দেব

মেঘবিকেলে পশ্চিম আকাশ থেকে
.                                বিদায়বেলার আলো
এসে ছুঁল সিঁড়ির প্রান্তে দাঁড়িয়ে-থাকা
.                                ওই স্তব্ধ মুখ
আবছায়া বারান্দা থেকে ভেসে আসে
.                                টুকরো কথা আর
হঠাৎ-গেয়ে-ওঠা গানের একটি কলি


মৃত্যু আর চুম্বনের মাঝখানে উড়ে গেল
.                               একটি ঝরাপাতা

.                ****************          
.                                                                                     
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর    
*
চোখের জলের কাছে
কবি সব্যসাচী দেব

আজ ভুলে গেছি সেইসব রাত্রিস্তব,
তোমার চোখের পাতায় নেমে-আসা
.                         মেঘভাঙা তারা
আর বৃষ্টির মধ্যে ঢুকে-পড়া পুরনো দীর্ঘশ্বাস
যেন আমাদের যা-কিছু চেনাজানা,
.                         সে শুধু স্মৃতির সঙ্গেই

এই নিষ্ঠুর এপ্রিল, দুপুরশেষের হল্ কা
.                    শুষে নিচ্ছে শ্রীময়ীর লাবণ্য
আর তাকে ঘিরে ধরছে কোল্ড ক্রিমের
.                              বিজ্ঞাপনের ভিড়
মাথার ভিতর তাল তাল কুয়াশা
এখানে কোনো রূপকথা নেই,
আমাদের রূপকথায় কখন যেন
.                        নেমে এসেছে মুশোশপরা সুপারম্যান
এখন আমরা অলৌকিক বিস্ফোরণের অপেক্ষায় থাকি
কখন রোবটসুন্দরীর তীব্র রশ্মিতে ছিঁড়ে যাবে
.                                                 ট্রাফিক-জ্যাম


কোনো কিছুই ঘটে না, ছায়াপথের আলো এসে
.                    কাঁপিয়ে দেয় না কালো পরীর ডানা
এপ্রিল নিষ্ঠুর থেকে নিষ্ঠুরতর----- বর্ণহীন আকাশে শুধু
মাথা তোলে হাইরাইজ
ফিরে আসি------- তোমার চোখের পাতায় মুখ রাখি
আর একফোঁটা জলের ছোঁয়ায় শুনতে পাই
.                           বয়ে-যাওয়া নদীর কলোচ্ছাস

.                ****************          
.                                                                                     
সূচিতে . . .     



মিলনসাগর