বুকের গহিনে তবুও গোপনে
সব্যসাচী গোস্বামী

হোক না পৃথিবী গদ্যময়
চরাচর নৈঃশব্দময়
ভয়ের দু’চোখ যতই দেখাক
শাসনের সন্ত্রাস
বুকের গহিনে তবুও গোপনে
কবিতার বসবাস।

যতই ভাঙবে হাড়পাঁজর
পিঠে ভাঙো লাঠি, নাকে গাজর
পিছমোড়া করে হাতের শেকলে
            বজ্র আঁটুনি টান
বুকের গহিনে তবুও গোপনে
            শেকল ভাঙার গান।

বুকে ওঠে জমে দীর্ঘশ্বাস
চোখের কোণেতে মেঘলা বাতাস
আঁধার ঘনিয়ে চারিদিকে ঘোর
            অমাবস্যার রাত
বুকের গহিনে তবুও গোপনে
            দারুণ বৃষ্টিপাত।

.     ******************     
.                                                                               
সুচিতে...   


মিলনসাগর
কবি সব্যসাচী গোস্বামীর কবিতা
*
জঙ্গলমহল
সব্যসাচী গোস্বামী

শিরায় শিরায় বাজনা বাজে
হৃদয়ে ঝঙ্কার
শাল-পিয়ালের ফাঁকে ফাঁকে
ধনুকে টঙ্কার।

হাতে শেকল, পায়ে শেকল
পিঠে শেকলের জ্বালা
মগজ তবু মুক্ত, সকল
দরজা জানলা খোলা।

পিঠের উপর চাবুক নামে
এক, দুই, তিন...
বিবেক বলে আমায়, তুই
আজন্ম স্বাধীন।

শরীরে ব্যথা, হৃদয়ে ব্যথা
রাত ঘুমে ঘোর জ্বর
বাঁচার মতো বাঁচ, নইলে
লড়াই করে মর!

.     ******************     
.                                                                               
সুচিতে...   


মিলনসাগর
*
তখন বরং শুনতে বোসো
সব্যসাচী গোস্বামী

মুখে আমার গণতন্ত্র
মন্ত্রতন্ত্র কতই না,
কাজের ক্ষেত্রে আমার কিন্তু
সাবধানী চোখ সতর্ক।
তেমন বেশি তম্বি করলে,
লোহার শেকল পরাই পা’য়।
পেয়াদা আছে, সান্ত্রী আছে
জেলহাজতও কমতি নয়।
এবং আছে স্তাবক কবি,
কলমপেষা সাংবাদিক
নিষেধাজ্ঞার পাঁচিল ঘিরে
রাখলে তোমায় বাঁচায় কে?
প্রশ্ন তবু তুলবে জানি,
কিন্তু কোথায় শোনার লোক?
লোহার খাঁচার নির্জনতায়
কোথায় কাব্য? কই কবি?
ভৈরবী রাগ তখন বরং
শুনতে বোসো প্রাণ খুলে।

.     ******************     
.                                                                               
সুচিতে...   


মিলনসাগর
*
লন্ডননামা
সব্যসাচী গোস্বামী

ক্যাবিনেটে মন্ত্রী আছে,
রাজভবনে হাতি।
পথেঘাটে বিরাজমান
তিনমুখওলা বাতি।

উন্নয়নের চমক আছে,
বিশ্বায়নের তত্ত্ব।
গরিবগুর্বোর জন্য আছে
কাঁঠালের আমসত্ত্ব!

গণতন্ত্রের মুখোশ আছে,
গলা টেপার হাত।
টিভির চ্যানেল বানিয়ে দেবে
দিনকে মধ্যরাত।

নাটক আছে, ফাটক আছে,
আছে একুশে আইন।
নিন্দুকদের কানটি মলে
না হয় দেবো ফাইন।

ঝুলিটি আমার ফাঁকা, তবুও
ঋণের জন্য ঘি।
ভূত আমার পুত এবং
পেত্নী আমার ঝি!

থানায় থানায় পুলিশ আছে,
আস্তিনেতে অস্ত্র।
যত্রতত্র প্রয়োগ হবে
চাইলে অন্নবস্ত্র।

কোলকাতাটা সেকেলে ভীষণ,
স্বপ্নে আছে লণ্ডন।
উপনিবেশ মনটা খাঁটি,
দেশপ্রেমটা ভণ্ড।

.  ******************     
.                                                                               
সুচিতে...   


মিলনসাগর
*
বাবা’কে
সব্যসাচী গোস্বামী

এই তো তুমি বইয়ের ভিতর বিভোর
সবার সঙ্গে থেকেও নিসঙ্গতায়
কবিতাগুলো লুকোয় বুকের খাঁজের
দীর্ঘশ্বাসে, চোরা বিষন্নতায়।

তুলির টানে ফোটাও বিমূর্ততা
এইতো তুমি রঙের জাদুকর
ভালবাসার শষ্যভরা মাঠে
দাঁড়িয়ে থাকা আমাদের ঈশ্বর।

.      ******************     
.                                                                               
সুচিতে...   


মিলনসাগর
*
২৪শে নভেম্বর২০১৩
সব্যসাচী গোস্বামী

বুকের পাঁজর জ্বালিয়ে দিয়ে
বানিয়ে ছিলে সেই যে মশাল
সেই মশালের ফুলকিগুলো
এখনো জ্বলে আনাচ কানাচ।

এখনো মানুষ স্বপ্ন দেখে
বুক চিতিয়ে প্রবল বাঁচার
ইচ্ছেগুলো ছটফটিয়ে
আছড়ে পড়ে লোহার খাঁচায়

রঙিন মোড়ক মুখোশগুলোয়
মুখ লুকোনর মওকা বুঝে
ধূর্ত শ্বাপদ নেকড়েগুলোর
লকলকে জিভ রক্ত খোঁজে

কালনাগিনী ঠিক ঢুকে যায়
সুরক্ষিত লোহার ঘরেও
তবুও মানুষ লড়াই করে
স্বপ্নটাকে জাপটে ধরে।

স্বপ্ন বুকে জাগিয়ে দিয়ে
বিদায় নিলে প্রিয় সাথী
ফুলকিগুলো কুড়িয়ে বুকের
আগুন ফুলের মালা গাঁথি।

.      ******************     
.                                                                               
সুচিতে...   


মিলনসাগর
*
রাতচড়া পাখিটার নামে
সব্যসাচী গোস্বামী

রাতচড়া পাখি এক
বসে এসে দূরের দেয়ালে
যেখানে নরম রোদ লেগে থাকে
প্রতিদিন শীতের সকালে।
রোদের যেখানে শেষ
সেখান থেকেই শুরু
নিষেধের দীর্ঘতর ছায়া
ছায়ার ভিতরে জমে দীর্ঘশ্বাস,
মুক্তির স্বপ্ন, নাকি
কুহকিনী মায়া!
স্বপ্নের নানা রঙ, নানা রূপ,
ভিন্ন ভিন্ন স্বাদ
কখনো তা চোরাবালি
কখনো তা ফুল, পাখি, চাঁদ।
কখনো তা রক্তে মাংসে
ঘামে ভেজা মাটির পৃথিবী,
কখনো তা যন্ত্রনার
কখনো তা স্পর্ধার একাকার ছবি।
কখনো তা শষ্যক্ষেত
কখনো তা ধু-ধু মাঠ, খাঁ খাঁ
কখনো তা সন্ত্রাসের রক্তে ভেজা
বারুদের পোড়া গন্ধ মাখা।
কখনো তা মসৃন
কখনো তা ঘাত প্রতিঘাত
কখনো তা হেঁটে চলা
একা একা অনিঃশেষ রাত।
রাত মানে একাকিত্ব
সারি সারি নিঃশব্দ তালা বন্ধ দ্বার
রাতচড়া পাখিটির দু’ডানায় ভর করে
চুপিচুপি নামে অন্ধকার।
অন্ধকারের পেটে
জেগে ওঠে দাঁত নখ,
রক্তচোষা জোঁক,
অবৈধ লেনদেন,
মুখোশের নীচে থাকা
হিংস্র লোলুপ দৃষ্টি,
দূরের পাচিলে বসে
সবই দেখে রাতচড়া চোখ।
বাইরে মুক্ত পাখি
আমাদের বেঁচে থাকা
একাকিত্বে খাঁচার ভিতর
কল্পনায় ভর করে অবিরাম
উড়ে চলা দেশ দেশান্তর।
কল্পনার দেশ নেই, গন্ডি নেই
নেই কোনও নিষেধের সীমা
আছে শুধু রঙ তুলি চুপকথা
বুকের গভীরে আছে হৃদয় প্রতিমা।
সে হৃদয়ে জমা আছে
একমাঠ ভালবাসা
সুজলা সুফলা।
তারই হাত ধরে ধরে
গ্রাম থেকে গ্রামান্তর চলা
যে গ্রাম মুক্ত গ্রাম
নেই কোনও নিষেধের খাঁচা
বুক ভরে শ্বাস নিয়ে
শিরদাঁড়া টান করে বাঁচা।
সে গ্রামে ভিক্ষান্ন নেই, দু’টাকার চাল
দুঃশাশনে জেগে থাকে ঘরে ঘরে
মৌসুমি-টুম্পা কয়াল।
যে গ্রাম আপাতঃ শান্ত
পিঠে নিয়ে কশাঘাত, চাবুকের দাগ
বুকের ভিতর যার ইজ্জতবোধ আর
ছাই চাপা আগুনের রাগ।
সে আগুম তুলে নিয়ে
দু’হাতে ভরাই অঞ্জলী
ভোরের নরম রোদে
ভরে ওঠে কল্পনার রঙ,খাতা,তুলি
কল্পনারা ডানা মেলে
উড়ে যায় গ্রাম থেকে গ্রামে
হৃদয়ের নাম রাখি
রাতচড়া পাখিটার নামে।

.      ******************     
.                                                                               
সুচিতে...   


মিলনসাগর
*
সলিটারি সেল
সব্যসাচী গোস্বামী

নিষেধের পাচিল ছুঁয়ে নেমে আসে
বিষন্ন বিকেল,
আলো নিভে আসে। আকাশটা বিবর্ণ, ফিকে।
এখানে ফিসফিস করে কথা বলে
বাচাল বাতাস ।
দেয়ালের কান ফুড়ে মাথা তোলে
অশ্বত্থের অসহায় পাতা।
বুকের ভিতর ভাঙে
অস্থিরতার চোরা ঢেউ।
সন্দেহ বুকে নিয়ে হৃদয়ের নির্জণে
চুপি চুপি আসে কেউ।
সময়ের বুকে জমে একাকিত্ব
চাপা অভিমান।
এখানে জীবন মানে নির্বাসন,
একাএকা বয়ে চলা অতীত গরিমা।
এলোমেলো বয়ে চলা দিনগুলি
একঘেয়ে। গতানুগতিক।
হিসেবের শেষে পড়ে থাকে লাভ
লোকসান ক্ষয়ক্ষতি।।
ক্যালেন্ডারের পাতা থেকে খসে পড়ে
একেকটা পুরোনো তারিখ।
ভোরের স্বপ্ন নিয়ে জেগে থাকে সলিটারি সেল,
লোহার গারদ। সারিসারি।

.      ******************     
.                                                                               
সুচিতে...   


মিলনসাগর
*