কবি সচীন্দ্রনাথ সেন-এর কবিতা
যে কোন কবিতার উপর ক্লিক করলেই সেই কবিতাটি আপনার সামনে চলে আসবে।  www.milansagar.com
*
নব জলদূত       
কবিতাটি একাধিকজনের দ্বারা একাধিকবার দেখে লেখা হয়েছে | তার মধ্যে অনেক অন্তর
রয়েছে | তাই যতটা উদ্ধার করা সম্ভব হয়েছে ততটাই আমরা এখানে তুলে দিয়েছি |

দিনান্তে বিদায়ী ক্লান্ত কর্মচারী গণে
একা আছি খাপালের কাছারি প্রঙ্গণে |
এ হেন সময় দেখি চাহি ঊর্দ্ধপানে
সজল কাজল মেঘ উড়িছে গগনে |
রিরহী যক্ষের কথা আসিল স্মরণে
১লা আষাঢ় আজ পড়ে গেল মনে |
হঠাৎ মেঘের ডাক শুনিনু অদ্ভূত
ব্যাসের বারতা বলি আমি মেঘদূত |
মেঘদূত মুখে শুনি ব্যাসের বচন
বন্ধুর বিরহে হ'লো মন উচাটন |
তখনি ফিরিব দেশে ভাবিতেছি মনে
দেখিলাম বৃষ্টিধারা যেতেছে দক্ষিণে |
দূত রূপে তারে আমি ব্যাসের আলয়ে
পাঠাইব মনে ইহা স্থির করে লয়ে
তখনি বলিনু তারে ওহে বারিধারা
ক্ষণেক দাঁড়ায়ে যাও করিও না ত্বরা |
তুমি তো চলেছ সোজা দক্ষিণের মুখে,
থেমে থেমে যাবে তুমি কত দেশে দিকে |
আমার একটি যদি কর উপকার,
চিরকাল কেনা রব নিকটে তোমার |
জলদূত রূপে আজ বরিনু তোমারে,
দয়া করে এক বার থেম মূলঘরে |
পথ তব জানা আছে প্রতিবার যাও,
ব্যাসদেবে ব'লো ইহা মোর মাথা খাও |
কত লোক বসে আছে তব পথ চেয়ে,
লাঙ্গল চষিবে তারা নব জল পেয়ে |
কাজেই তোমার কিছু হবেইত দেরী,
হোক তাহে ক্ষতি নাই, যেও দয়া করি |
ব'লো তুমি ব্যাসদেবে মম সমাচার,
পড়ে আছে মন মোর নিকটে তাহার |                    
সূচিতে ফেরত
সোজা পথে যাবে তুমি, তবু দেই বলে,
বিপথে যাবে না যাতে কভু পথ ভুলে |
মধুমতী পার হয়ে বিল পথ ধরি
নোমসের নানা দেশ পিছনেতে ছাড়ি |
অগ্রসর হবে তুমি দক্ষিণের পানে
দেখিবে কৃষক বধু চলিয়াছে স্নানে |
ছোট ছোট গ্রামগুলি ছবির মতন
আসে পাশে পড়ে তব জুড়াবে নয়ন |
ঝক ঝকে আঙ্গিনায় উলঙ্গ শিশুরা
কচি দাঁতে ছুটাইছে হাসির ফোয়ারা |
কৃষকেরা ক্লান্ত দেহে হাল গরু লয়ে
ফিরিয়া আসিছে সবে আপন আলয়ে |
এই রূপে কত দৃশ্য পড়িবে আঁখিতে
ভুল করে যেন কোথা প'ড়োনা ফাঁকিতে |
কেঁদো ও গামলা আদি বড় বিল গুলি
চিত্রায় আসিবে তুমি পিছনেতে ফেলি |
বেনে খালি কল কলে গ্রামগুলি ছাড়ি
এইবার কালীগাঙ্ দিয়ে এসো পাড়ি |
সেনেদের ঝাউগাছ দূরে দেখা যাবে
মূলঘর বলে তুমি উহারে চিনিবে |
এখন সে বিলে তুমি আসিয়া পড়িলে
মূলঘরে পৌঁছিবে সেটা পার হলে |
তানতুন ডাক্তারের কোঠাবাড়ী ছাড়ি
পশ্চিমে দেখিবে তুমি আমাদের বাড়ী |
সে বাড়ীর পথে তুমি একটু চলিয়া
"ভাল আছি" এই কথা যাইবে বলিয়া |
বকুলতলার ঘাটে মাধবীর মাতা
থাকিলে বলিও তুমি আমার বারতা |
বিকালে ধুইতে গাত্র মাধবীর সনে
হয়ত থাকিতে পারে তখন সেখানে |
বলো তারে ফিরিতেছি দিন দুই পরে
মাধবী ও কনিষ্কেরে রেখ শান্ত করে |
আমি জানি আছে তারা পিত্রালয়ে সবে
ব্যাসের ভাষণে বুঝি ওখানেই হবে |
তার পরে চলে এসো পুনঃ ভর দিয়া
দক্ষিণে দীঘির কোণে নামিবে আসিয়া |
দেখা দিয়ে দেল খোলা চলে এস ছাড়ি
রাস্তার দক্ষিণে দেখ সেনেদের বাড়ী |
সেথায় শচীন সেন আসে বসে ঘরে
ডেকে বোল যাইতেছি দিন দুই পরে |
সেথা হতে পশ্চিমে অগ্রসর হয়ে
ডান দিকে নরেনকে যেও ডাক দিয়ে |
সে হয়তো রত আছে সুখ আলাপনে
ভিতরে বসিয়া প্রিয় পরিজন সনে |                      
সূচিতে ফেরত
ডেকে তারে বলে যেও তুমি দয়া করে
ছুনন ফিরিছে গ্রামে দিন দুই পরে |
সব কথা সে সময় পাইবে শুনিতে
এখন অধীর যেন হয়না কিছুতে |
মাখনের বাড়িটাই ব্যাসের আলয়
ত্রিলোচন চতুষেপাঠী ঐ দেখা যায় |
এখন ব্যাসের কিছু দেই পরিচয়
যাহাতে সহজে তুমি চিনিবে উহায় |
বিরাট বিপুল তনু নাই গোঁফ দাঁড়ি
স্থুলোদর বস্ত্রসনে করিয়াছে আড়ি |
সুভাষী ও সরগড়ন নিটোল গড়ন
শুভ্র উপবিত গলে শ্যামল বরণ |
এ হেন বেদব্যাস পণ্ডিত সুবেশ
বোধহয় চিনিতে তারে হবেনাক ক্লেশ |
হয়তো দেখিবে তাঁরে মধ্য আঙ্গিনাতে
পাশে পত্নী ক্ষীণাঙ্গিনী পাখা লয়ে হাতে |
ভুল করে বসিওনা তাঁরে কন্যা মানি
কন্যার জননী সে ব্যাসের গৃহিনী |
অভিমানে ধুতি তাই নাভি নিম্ন দেশে
স্নান করি লইয়াছে কোনমতে শেষে |
মহাদেব, রাণী আর ভবানী কল্যাণী
এক পুত্র তিন কন্যা আছে তাঁর জানি |
ডাকিয়া বলিবে তারে জলদূত আমি
পেয়েছে ছুনন বার্তা পাঠালে যা তুমি |
উত্তর দানিতে আমি আসিয়াছি তার
সব কথা বলে আমি যাইব আবার |

.          "ছুননের উক্তি"
হেথা আমি জমিদার কর্মব্যস্ত সদা
অকর্মার স্থান নাই এখানেতে দাদা |
তবু যবে বিশ্রামেতে বসি নিরালায়
আপনার কথা মনে হয় যে উদয় |
শচীন, নরেন আদি সব বন্ধুগণে
ফাঁকে, ফাঁকে, মাঝে মাঝে পড়ে যায় মনে |
তখন মনটা মোর হয় যে উদাসী
জমিদারী হিসাবেতে ভুল করে বসি |                      
সূচিতে ফেরত
যবে বসে থাকি আমি কাছারির মাঝে
মোড়ল প্রজারা সব চারিদিকে রাজে |
কেউ বলে খাজনাটা দিতে পারিবনা
বেয়াদপী তরে কারো করি জরিমানা |
কেউ এসে মাফ চায় দুইটি বছর
কেউ কিছু কম দিতে করিছে ওজর |
নায়েব, গোমস্তা আদি ব্যস্ত সবে কাজে
হেথায় ঢুকিতে ভয় আপনার হবে |
এই রূপে মাঝে মাঝে করি জমিদারী
আবার কখনো একা গনি বসে কড়ি |
দুদিনের মাঝে কারো পাইনাকো দেখা
তখন মনটা মোর হয়ে যায় ফাঁকা |
ভাগ্যে সাথে দাশুরার পাঁচালী আছে
সময় কাটাই তাই বসে তার কাছে |
ধু ধু করে ধান ক্ষেত আর শুধু জল
আন্দামানে বসে চিত্ত হয় যে বিকল |
যখন এখানে আমি মাধবীর মাতা
গেছেন বাপের বাড়ী, জানি সেই কথা |
কি প্রকারে জানিলেন তাহার কুশল
সে কথা জানিতে মনে হয় কুতুহল |
আপনি কি গেছিলেন সে বাড়ীর পথে?
দেখা কি হয়েছে সেথা তাহাদেরই সাথে?
দেখা যদি হয়ে থাকে বলিবেন তারে
বাড়ী আমি যাইতেছি দিন দুই পরে |
দেখা হলে আর সব সাক্ষাতে বলিব
গ্রামের খবর সব যাইয়া শুনিব |

নব জলদূত আমি প্রথম এবারে
দূতরূপে আসিলাম চারুর খাতিরে |
এই কথা বলে তুমি লইও বিদায়
ব্যস্ত তুমি দাঁড়াবার সময় কোথায় |
নব জলদূত এই অমৃত সমান
শচীনের বাণী এই শুনে পূণ্যবান |
যে রাখে যে শোনে আর যেবা ইহা পড়ে
জলদূত বরে তার মন বাঞ্ছা পুরে |

ইতি নব জলদূত গীতি সমাপ্ত

.                সচীন সেন

.           *************************                            
সূচিতে ফেরত
[ একটি অনুরোধ - এই সাইট থেকে আপনার ব্ লগ্ বা সাইটে, আমাদের কোন লেখা, কবিতা
বা তার অংশবিশেষ নিলে, আমাদের মূল পাতা
https://www.milansagar.com/index.html এ দয়া
করে একটি ফিরতি লিঙ্ক দেবেন আপনার ব্লগ্  বা সাইট থেকে, ধন্যবাদ ! ]
*
প্রীতি উপহার            

কাঙ্গালের দেওয়া তুচ্ছ উপহারে
.                করিও না হেলা ভাই
ভালবাসা, প্রীতি, স্নেহাশিস ছাড়া
.                দিবার কিছুই যে নাই,
ধর করপুটে তুচ্ছ উপহার
.                স্নেহ ও প্রীতির সনে
যতদিন ইহা রবে তব কাছে
.                আমারে পড়িবে মনে |

.            *******************                                         
সূচি
*
টাটায় কেন চোখ            
(২২শে আশ্বিন ১৩৫০ সাল)

আমরা কটি ভাই আর বোন
.                   ছিলাম সেনের বাড়ী
বাড়ী মোদের মূলঘরেতে
.                   নাইকো মোদের জুড়ি |
বদ্য বংশে জন্ম মোদের
.                   নয়কো বড়লোক
তবু মোদের দেখে কেন
.                   টাটায় কেন চোখ |
সেদিন মোরা পূজার সময়
.                   সব কটি ভাই বোনে
কালিবাড়ীর মেলা দেখে
.                    ফিরছি বাড়ীর পানে |
পথে মোদের দেখে কারা
.                    আৎকে উঠেছিলো
এতো মেয়ে কাদের বাড়ীর
.                    সোজা বলে দিল |
ভাই চারটি যে সঙ্গে ছিলো
.                    পড়লো না তায় চোখ
এত মেয়ে দেখে তাদের
.                     উঠলো জেগে শোক |
শুনে মোদের রাগ যে হলো
.                     বুঝতে পার ভাই
ইচ্ছে হল মুখের মতা
.                     জবাব দিয়ে যাই |
কিন্তু কিছু না বলে সব
.                     বাড়ী এলাম চলে
রাগ ঠাণ্ডা হলো শেষে
.                     মিষ্টি কিছু দিলে |
কাজেই মোরা কত ভাল
.                     ভেবে দেখ সবে
বেশী কিছু বলব না আর
.                     আসি এখন তবে |

.            *******************                                         
সূচি
*
বন্যার খবর          
(১৩৪৫ সালের ভাদ্রমাসের বন্যা)  

কি বিপদ হয়ে গেছে এবারের বন্যায়
খবর কি রাখ কিছু না রাখা তো অন্যায় |
দেওয়ালের ঘরগুলি নাই তার পাত্তা,
দু'একটি আছে যাহা হয়ে গেছে কাত্ তা |
গত রাতে পড়ে গেছে সেনেদের মণ্ডপ
দেওয়ালের ঘরটিও কিছু আর নেই
Hope  |
নরেনবাবুর বাড়ী আজও আছে ডুবিয়ে
উঠানেতে নৌকা চলে স্বাভাবিক খুবই এ |
ফলতিতে কলকলে নেই তার চিহ্ন
কিছু নাহি দেখা যায় শুধু জল ভিন্ন |
সোনাখালি গ্রামটারে বিল বলে ভুল হয়
লোকগুলো কেউ গাছে কেউ আছে মটকায় |
খাল হয়ে গেছে সব বড় বড় রাস্তা
নৌকা চলেছে নিয়ে ভারি ভারি বস্তা |
ব্যাঙ্ক হতে নৌকায় জ্যোতিষ বাড়ীতে যায়
গিয়া দেখে জলভরা রান্নার চৌকায় |
মেয়েরা খিচুরি রাঁধে তোলা চুলো পাতিয়া
ছেলেরা উঠানে মাছ ধরিতেছে মাতিয়া |
ডাক্তারখানায় আসে ডোঙ্গা চড়ে ডাক্তার
রোগী কি দেখিবে জল দেখে লাগে তাক্ তার |
সবাই ডোঙ্গায় ফেরে নিয়ে ছিপ বড়শি
বিষ্ণু ও বামন রায় আরও পাড়া পড়শী |
ছেলেরা ছেড়েছে স্কুল জলে যেতে না পেরে
মেয়েরা ভাঙ্গিছে জল সদা ভিজে কাপড়ে |
কারো জোটে এক বেলা কারো বা জুটে না
কিরূপ কাটিবে দিন বুড়োরা ভাবিছে তা |
রাত্তিরে ঘরে শুয়ে রব শুনি ঝুপঝাপ্
ভয়েতে আসে না ঘুম ভয়ে যেন ধরে হাপ্ |
জীবনে তো দেখি নাই এরকম বন্যা
একি তোর রূপ মাগো কেন এত কান্না |

.                             ভাদ্রমাস ১৩৪৫ সাল

.            *******************                                         
সূচি