*
শচীন্দ্রনাথ সেনের কবিতা
শেফালী

সেনের বাড়ীর মেয়ে আমি
.                নামটা আমার শেফালী
রাগ হয় খুব মিছে মিছি
.                আমায় কেহ খেপালী |
চৌধুরীদের বামনদাদা
.                রোজই আসেন সকালে
তারও উপর রাগ হয় মোর
.                যখন তখন বকালে |
ছেপ্ বলিয়া জ্যাঠামণি
.                ডাকেন কখনো কখনো
ক্ষেপাবে কী বামনদাদা
.                তাইতে যখন তখনো ?
আমি যে খুব চটি তাতে
.                বোঝেন নাকি তিনি তা
রাগের চোটে সে ডাক আমি
.                তাই কখনো শুনি না |
সেদিন আবার এসে আমায়
.                ডেকে ফেল্লেন শেয়ালী
জানে না তো তিনি আমার
.                মনটা কেমন খেয়ালী |
এর পরেতে তাহার সাথে
.                কথা মোটেই কইব না,
নয়তো দেব উচিত জবাব
.                কথাটি তার সইব না |
রাম চরণ আর চন্দ্রকুমার
.                যাই কেন মোর হোকনা নাম
কেন লাগেন আমার পিছু
.                সে সব কথায় তার কি কাম |
আমার পাছে লাগেন বলি
.                ভাল কিন্তু হবে না তার
আজকে তবে হোলাম বিদায়
.                দিয়ে আমার নমস্কার |



.       ****************                                                    
সূচির পাতায়


মিলনসাগর
*
খুড়োর কথা
(প্রথম পর্ব)

খুলনা জেলার মূলঘরেতে
শীতল খুড়োর বাড়ী |
বেঁটে কাল মোটা মানুষ
ছিল না গোঁফ দাড়ি |
মানুষ ছিলেন সরল সোজা
বুদ্ধি কিছু খাটো |
নূতন কথা পেতে কিছু
যতই তারে ঘাটো |
ঠাকুর দাদার পুতে নাতি
সবার তিনি খুড়ো |
খুড়ো বলেই ডাকতো তারে
গ্রামের ছেলে বুড়ো |
বুদ্ধির মতই ছিল তাহার
মোটা একটু ভুরি |
ইচ্ছে করলে খেতে পারতেন
এক ধামা গুড় মুড়ি |
অবলীলা ক্রমে তিনি
গাছির বাড়ী গিয়ে |
ঝোলা গুড়ের একখানি ভার
খেতেন চুমুক দিয়ে |
মুনকে রঘুর নাম শুনেছি
চক্ষে দেখি নাই |
খুড়োর খাওয়া দেখলে প'রে
আসতো মনে তাই |
একটি পন পাকা গাব
বিচি শুদ্ধ গিলে |
পরদিন তার কোষ্ঠ সাফ
হতো প্রাতঃকালে |
আমরা কিন্তু বলি না তা
দুষ্টু লোকই বলে |
দেখা হলেই খুড়ো তাদের
দিতেন কানটি মলে |
গাবের গাছে খুড়োর এত
ভক্তি কেন জান ?
কোষ্ঠ সাফের গাবের আঁটি
গজিয়েছিল হেন |
খুড়োর বাগানে এত গাবগাছ
কেন হলো তুমি জান ?
সারা বাগানেতে গাবের সে আটি
পড়েছিল আজ শোন |
বল তো খুড়োর কম ছিল না
বলি একটু খুলে
দু'মন চালের বস্তা সোজা
দাঁতে নিতেন তুলে |
একদিন খুড়ো মাঠে তখন
ঝড় বৃষ্টি এল
ছাতি তো নেই তেলের ডোঙ্গা
@@@@@@@ গেল |
দুহাত দিয়ে সেইটে তখন
মাথার উপর দিয়ে
আধ মাইল পথ হেঁটে সোজা
বাড়ী উঠল গিয়ে |
কবিরাজী করতেন খুড়ো
ফলতিতে কলকলে
শুধু হাতে ফিরে বলতেন
ভিজিট দেয় নি ভুলে |
কলা, মুলো আর সিকি, দুয়ানি
মাঝে মাঝে যেত জুটে
সেদিন তাহার শ্রীমুখেতে হাসি
উঠিত বেজায় ফুটে |
একদিন খুড়ো কল@@@@গে
কোন এক রোগীর বাড়ী
সেথা গিয়ে দেখে রোগীটির তার
ছাড়িয়া @@@@ নাড়ী |
কি করিবে খুড়ো ভেবে নাহি পেয়ে
গম্ভীর হয়ে@@@@ |
কেমন দেখ@@@@@@@@
রোগীর মতি@@@@@|
কোন ক্ষেত্রের জ্বর হল বাবু
বলিল একটি বুড়ো
বলব কি ছাই কুরুক্ষেত্র
চটিয়া বলিল খুড়ো |
রোগীটি তাহার অক্কা পাইল
রাম বান বটি খেয়ে
খুড়োও তখন চম্পট দিল
ভিজিট কিছু না নিয়ে |
আর একদিন বেনে খালি গ্রামে
খুড়োর পড়িল কল
হাটবারে কিছু দক্ষিণা মিলিবে
বাড়িল তাহার বল |
রোগী বাড়ী গিয়ে দেখিল রোগীর
শ্বাসের হয়েছে টান
কি করিবে খুড়ো ভেবে নাহি পেয়ে
দিল তারে রাম বান |
রোগীর পিতারে বলে খুড়ো এতে
ঠিক হয়ে যাবে নাড়ী
হাটে যেতে হবে ভিজিটটা দাও
তাড়াতাড়ি যাই বাড়ী |
পথে এসে খুড়ো শুনিতে পাইল
কান্নাকাটির রোল
আর একটু পরেই দৌড়িতে লাগিল
শুনে হরি হরি বোল |
এইভাবে খুড়ো কবিরাজী করে
গ্রাম হতে গ্রামে যেত
কাছিমের হাতা কই ও মাগুর
মাঝে মাঝে কিছু পেত |
খুড়োর আবার দুষ্টু বুদ্ধি
মাঝে মাঝে হত মনে
জমার খালেতে মাছ মেরে যেত
চুপি চুপি জাল টেনে |
একদিন খুড়ো মাছ মারিবারে
এইরূপ এক খালে
চুপি চুপি গিয়ে মালই ভরিল
দু'বার জালটি ফেলে |
খালের মালিক টের পেয়ে তাহা
লাঠি লয়ে এল রুখে
খুড়া তাহা দেখি প্রমাদ গণিয়া
কহিল শুষ্ক মুখে |
কটা মাছ আর আমি মারিয়াছি
দেখ গিয়ে আগা খালে
খাল ভেঙ্গে তারা সব মাছ নিল
দশখানা জাল ফেলে |
মালিক ছুটিল খুড়াকে ছাড়িয়া
সোজা খাল পাড় দিয়ে
ভর্ত্তি মালই খুড়া ছোটে বাড়ী
জালগাছ পিঠে নিয়ে |
এরূপ খুড়ার কাহিনী অনেক
বলিতও আমি পারি
কিন্তু তাহাতে পুথি বেড়ে যাবে
কাগজের দামও ভারি |
দুষ্টুমি খুড়োর আর একদিনের
পড়িতেছে আজ মনে
মকর্দ্দমার কারণেতে খুড়ো
যাবে মহকূমা পানে |
কালীবাড়ী ঘাটে গয়নার তরে
দাঁড়াইয়া আছে খুড়ো
গয়না আসিলে দেখা গেল তার
স্থান নাই আর কারও |
যাহা হোক খুড়ো গলুইয়ের কাছে
উঠিলেন কোন রূপে
কাঁকড়ার টিন রয়েছে দেখিয়া
ছাতি ঢুকালেন চুপে |
ছাতির কাপড় পাইয়া কাঁকড়া
ঠ্যাং দিয়ে ধরে তায়
খুড়ো চুপিসারে ছাতিটি উঠায়ে
ছৈ'যের ভেতর যায় |
রেখে বলে বাপু অসুখ আমার
একটু বসিতে দাও
কোনরুপে আমি শুধু বসে যাব
তোমরা তামাক খাও |
এই অবসরে ছাতি হতে ধীরে
কাঁকড়া সরিয়া যায়
খুড়ো সেই ফাঁকে কাকড়া সরাতে
জায়গা করিয়া লয় |
একটি মিয়ার উরুতলে গিয়ে
ভীষণ কামড় দেয়
মিয়ার চিত্কারে সচকিত হয়ে
সবাই সরিয়া যায় |
মাঝিটারে বলে ভীষণ চটিয়া
কি কাজ করিলে দেখ
মানুষ মারিতে নৌকার মাঝে
কাঁকড়া আনিয়া রাখো |
মাঝি ভয়ে বলে দোহাই কর্তা
দোষটা আমার নয়
ঢাকা ছিল টিন খুলে কে দিয়েছে
নতুবা এমন হয় ?
খুড়োর পসার তখন সেথায়
হল যা বুঝিতে পার
মেয়াভাই সব স্থান দিয়ে বলে
কর্তা তামাক ধর |
এমন যে খুড়ো কলিকাতা আর
কশীতে যখন গেল
যা দেখিল আর যা বলিতে গিয়া
যেরূপ বেকুব হলো |
সে কথা গ্রামের সকলেই জানে
বেশী বলিবনা হেথা
বিশেষত সেই পয়োগ্রামের
কচু জব্দের কথা |
আরও কত কথা পড়িতেছে মনে
লিখিলে হয় না শেষ
খুড়োর গল্প "কাহিনী" হইয়া
জুড়িয়া রয়েছে দেশ |
দুদিনের জ্বরে এহেন খুড়োটি
তোরশ পঞ্চাশ সালে
হারিয়েছি মোরা তিরিশে কার্ত্তিক
বেলা ১২টার কালে |
কি বলে তাহার পরিবারদের
সান্ত্বনা দিব মোরা
গুণমুগ্ধ তার ভাইপোর দল
কাঁদিয়া হতেছি সারা |
স্বর্গ দুয়ার খুলিয়া রেখেছে
দেবরাজ তব তরে
ঊর্ব্বশী মেনকা দাঁড়ায়েছে দ্বারে
পারিজাত মালা করে |
যাও তবে খুড়ো সে অমরধামে
তোমার পূণ্যবলে
পাপী ভাইপোরা পায় যেন স্থান
তোমার চরণ তলে |


.                                       ****************                                 
সূচির পাতায়

মিলনসাগর
*
খুড়োর কথা
(২য় পর্ব),
মুলঘর, ১৩৪০ সাল


খুড়োর কাহিনী               প্রথম পর্ব
শুনেছ তোমরা সবে
আজি পুনরায়          খুড়োর কাহিনী
দ্বিতীয় পর্ব হবে |
খুড়ো চলে গেছে        কাহিনী তাহার
অমর হইয়া রবে
দেশের আবাল            বনিতা বৃদ্ধ
মুখে মুখে তাহা কবে |


কবিরাজী করে         খুড়ো বহু দিন
রুদ্দুরগাতী গ্রামে
ডাকিতে আসিল        তারে একজন
নিমাই মণ্ডল নামে |
ছাতি ও চাদর             সঙ্গে লইয়া
তখনই চলিল খুড়ো
গিয়ে দেখে সেথা         ছেলে হইলেও
রোগীরে দেখায় বুড়ো |
ফিটের অসুখ        মাঝে মাঝে তাই
জ্ঞান হারা হয়ে পড়ে
চক্ষু কপালে            উঠে যায় তার
প্রাণ যেন নাই ধরে |
নিমাই কাঁদিয়া         বলে কবিরাজ
বাঁচাও ছেলেরে তুমি
ছেলের অসুখ         সারিলে তোমায়
খুশী করে দেব আমি |
দেখে শুনে সব           খুড়োর তখন
কাল ঘাম ছোটে গায়
বলে মনে মনে         ঠাকুর আজিকে
একি ঠেকাইলে দায় |
গম্ভীর হয়ে           নাড়ী দেখে খুড়ো
ইষ্টনাম যঁপে মনে
হটাৎ খড়ম             চালারে বাতায়
গোজা দেখে সেইখানে |
আঙ্গুলের ছাপ            খড়মের গায়
পষ্ট দেখিতে পায়
কি ভাবিয়া খুড়ো        মণ্ডলের কাছে
দুই গাছি দড়ি চায় |
দড়ি নিয়ে খুড়ো         রোগীর পায়ের
বৃদ্ধাঙ্গুলে বেঁধে বলে
জোরে টান তোরা        চক্ষু তাহলে
জায়গায় আসিবে চলে |
বিধির দয়ায়          টান লেগে পায়ে
রোগীর চক্ষু নামে
পুলকে খুড়োর            রোমাঞ্চ হইল
সারা গা ভিজিল ঘামে |
রোগীর মাথায়         জল দিয়ে খুড়ো
সুস্থ করিল তায়
খুড়োর কাণ্ড            দেখিয়া নিমাই
অবাক হইয়া যায় |
রাম@@ আর          সাদা চটি পায়ে
ভিজিট লইয়া খুড়ো
গ্রামেতে ঢুকিলে           পেছনে লাগিল
পাড়ার ছেলে ও বুড়ো |
কোথা গিযেছিলে        টাকা পেলে কত
কি রোগী দেখিলে বল
খুড়ো হেসে বলে        ছ টাকা ভিজিট
বেঁধেছি দা@@ |
@@@@@         @@@@
খুড়ো খুলে বলে
তখন হইতে            খুড়োর পসার
বেড়ে গেল সে অঞ্চলে |


রস চুরি করে        খেতো খুড়ো খুব
পাড়ায় পাড়ায় ঘুড়ে |
গেল তারি আশে      রাতে মাঘ মাসে
গাঙ্গুলী পুকুর পাড়ে |
সঙ্গে তাহার             ফণি ও পাদুষ
চিকো হাতে নিয়ে ফেরে |
কারা রস পাড়ে            বসন্ত গাঙ্গুলী
হুইল হাতে এল তেড়ে |
গাছি ভেবে খুড়ো      ভয় পেয়ে ঢোকে
কুটোর পালার তলে |
ভুরিটা বিশাল        ঢোকে না তলায়
পাদু পেছলে ঠেলে |
এমন সময়                বসন্ত গাঙ্গুলী
নিকটে আসিয়া পড়ে |
ফণি ও পাদুষ        খুড়োরে ছাড়িয়া
পালায় তখন দূরে |
বসন্ত তখন           খুড়ো রে টানিয়া
বাহির @@@ বলে
আরে এ কি খুড়ো     তুমি কেন হেথা
@@@@@@@@ |
বাহির হইয়া        খুড়ো কেঁদে বলে
মেরো নাকো গাছি ভাই |
রস খেতে ডেকে         আনিল পাদুষ
আমি নিজে আসি নাই |
বসন্ত কহিল         আরে খুড়ো আমি
কেন এত ভয় পেলে ?
ভয় দূরে গেল        ঠাণ্ডা হল খুড়ো
এক ঠিলে রস গিলে |


পুলিশের নামে           খুড়োর বেজায়
ভয় বরাবর ছিল
প্রমাণ তাহার            একদা সেবার
হঠাৎ ফলিয়া গেল |
মুকুন্দ দাসের             স্বদেশী যাত্রা
শিষ্যেরা তার গায়
গাহিতে গাহিতে             একদল এসে
ঢুকিল মোদের গাঁয় |
খুড়ো সারা দিন       সাথে সাথে ফেরে
একটি পাঠের আশে
মিলে গেল পাঠ        খুড়ো দেখা দিল
বুড়ো ব্রাহ্মণ বেশে |
লম্বা টিকি আর           নামাবলি গায়
পৈতেও ঝোলে গলে
তারে দেখে সবে         হাততালি দেয়
খুড়ো এল তাই চলে |
স্বদেশী যাত্রায়           ঢুকিয়াছে খুড়ো
পুলিশ লাগিবে পাছে
এই কথা শুনে           ভয় পেয়ে খুড়ো
রাতদিন থাকে গাছে |
বিন্দু রায়                    নিকুঞ্জ সেন
ও বিধুভূষণ মিলে
পরামর্শ এক               গোপন বৈঠক
সেরে ঠিক করে ফেলে |
পরদিন খুড়ো             নিজের ঘরেতে
বসে আছে চুপ করে
বাহির হইতে             কড়া সুরে কারা
ডাকে তার নাম ধরে |
উকি দিয়ে খুড়ো         দেখিতে যা পেল
চক্ষু স্থির হল তাতে
সভয়েতে খুড়ো           ঢোকে তাল বনে
বসিল মা@@ @@@ |
এদিকে বাহিরে           দারোগার সনে
সিপাহী দু'জন নিয়ে
ছীতল বাবু কি          কোঠি পর হ্যায়
হাঁকে গম্ভীর হয়ে |
প্রতাপ আসিয়া        হাসিয়া ফেলিল
খুড়োর রকম দেখে
বলে খুড়ো তুমি        পাঁচ টাকা দাও
মুক্তি আনিব লিখে |
খুড়ো কেঁপে ভয়ে         বলে ও প্রতাপ
রক্ষা করো মোরে ভাই
পাঁচটি টাকাই         আলমারিতে আছে
তার বেশী আর নাই |
শিশির তলায়         খুঁজিলেই পাবে
তাই দিয়ে পাপ বিদেয় কর
নতুবা হেথায়         মারা যাব আমি
"গো বধ" তোমার হইবে বড় |
প্রতাপ গাঙ্গুলী         হাসিয়া ছুটিল
ঘুরে ভেষজাগারে
শিশির তলায়        টাকা পাঁচটিও
ফেলিল পকেটে পুরে |
দারোগা পুলিশ        সব চলে গেল
প্রতাপ হাসিয়া কয়
শিঘ্র এস খুড়ো        গেছে গেছে তারা
আর কিছু নাহি ভয় |
তাল বন হতে        খুড়ো এল ঘরে
কেটে গেছে সারা দেহ
সে দিকে খুড়োর         দৃষ্টি পরে না
(বলে) আর তো নাহিক কেহ |
প্রতাপ তখন         খুড়োর পিঠেতে
দুইটি চাপর মেরে
হেসে বলে আরে        এত ভয় কেন
ওরে ও ভেড়ের ভেড়ে |

তারপর হলো         একদিন রাতে
বন ভোজনের পালা
বুঁড়ে কাছিমের         মাংস সহ পাতে
খিচুড়ী হইল ঢালা |

এহেন খুড়ো কে         হারিয়েছি মোরা
চোখে আসে জল ভরে
খুড়ো শুণ্য তার        ভাইপোরা হায়
আর তো পাবে না তারে |

.                                        ****************                                 
সূচির পাতায়


মিলনসাগর
*
খুড়োর কাহিনী
(৩য় পর্ব)


খুড়োর কাহিনী প্রথম দ্বিতীয়
.                পর্ব হয়েছে লেখা
কাহিনী তাঁহার তৃতীয় পর্ব
.                রূপেতে গিয়েছে দেখা |
সেনের বাড়ীর পাঠশালে খুড়ো
.                পাততাড়ি নিয়ে সাথে
লিখিবার আশে দেখা দিল এসে
.                দোয়াত কলম হাতে |
লিখিবে কি খুড়ো ঘাটে গিয়ে দেখে
.                পাড়েরে কলার গাছে
চাঁপাকলা পেকে খ'সে প'ড়ে তাহা
.                তলাতে ছড়িয়ে আছে |
দ'তে জল দেওয়া ঘুচিল খুড়োর
.                কোচোরে পুরিল কলা,
বাগানে ঢুকিয়া খেল যত পারে
.                রসেতে ভিজায় গলা |
গুরু মহাশয় এদিকে খুড়োর
.                দেরী হইতেছে দেখে,
দুইটি বালক পাঠাইয়া দিল
.                ধরিয়া আনিতে তাকে |
খুড়ো তাই দেখে সেই যে পালালো
.                ছ'দিন এল না স্কুলে,
যেদিন আসিল মারের চোটে
.                সকলি বলিল খুলে |


আর এক দিন ভাদ্র মাসের
.                ঠিক সন্ধ্যার কালে
খুড়ো আসিলেন সেনের বাড়ীর
.                তালের গাছের তলে |
তিন তাল পেয়ে পুরিল না আশা
.                আরও পাইবার আশে
খুঁজিতে লাগিল উপুর হইয়া
.                গাছটার চারিপাশে |
এমন সময় গাছ হ'তে খ'সে
.                খুড়োর পিঠের পরে
বড় এক তাল আসিয়া পড়িল
.                হঠাৎ ভীষণ জোরে |
ঘ্যাঁক্ করে এক শব্দ পাইয়া
.                দেব বাবু গিয়ে বলে
ও রাসবিহারী আলো নিয়ে হেথা
.                শীগগির এসো চলে |
পিঠের ব্যথাটা ভুলে গিয়ে খুড়ো
.                মার খাইবার ভয়ে
ভান্ করে সেথা পড়ে থাকে যেন
.                গেছে জ্ঞানহারা হ'য়ে |
আলো এলো দেখে দেব বাবু বলে
.                শীতলটা বুঝি মলো
ও রাসবিহারী দাঁড়ায়ে দেখ কি
.                শীগগির ধরে তোলো |
তুলিলে তাহাকে ভয় পেয়ে খুড়ো
.                কাপড়ে ফেলিল মুতে
আলো লয়ে শেষে তালগুলি সহ
.                বাড়ী গেল তাকে থুতে |
বাড়ীতে লইয়া দাদাকে তাহার
.                বলিল সকল কথা
হাত বুলাইয়া পিঠেতে খুড়োর
.                তারক ভুলান ব্যাথা |

আর একদিন দয়ার আড়তে
.                বঁড়শি লইয়া হাতে
মাছ ধরিবার আশায় গেলেন
.                চাড়া কিছু লয়ে সাথে |
ফুট্ কেটে খুড়ো বসিলেন সেথা
.                বঁড়শী ফেলিয়া জলে,
একটু পরেই খুড়ো দেখিলেন
.                ফাতনা ডুবিল তলে |
জোর টান দিয়ে বঁড়শী উঠায়ে
.                খুড়ো যে দেখিতে পেল,
মাগুর একটা আর্দ্ধেক উঠিয়া
.                জলেতে পড়িয়া গেল |
দুইচার জনে আরো হেথা সেথা
.                বসে ছিপ নিয়ে
তাদের ডাকিয়া বলিলেন খুড়ো
.                দেখলেত সব চেয়ে |
শালার মাগুর কতদূরে যাবে
.                কদিন রহিবে জলে,
শীতকালে তারে ধরিয়া আনিব
.                খালেতে জালটি ফেলে |
এই ত আষাঢ় পাঁচ ছয় মাসে
.                বড় তো খানিক হবে,
তেল হবে গায় পকা মাছটিরে
.                আরামেও খাওয়া যাবে |
সকলে শুনিয়া খুড়োর বুদ্ধির
.                তারিফ করিল যাহা,
না লিখিলে হেথা তোমরা সকলে
.                বুঝিতে পারিছ তাহা |


এ দুটো কাহিনী শীতল খুড়োর
.                বাল্য কালের কথা
বুড়ো হয়ে খুড়ো কীর্তি যা রেখেছে
.                এখন বলিব হেথা |

বরযাত্রী সহ চলিয়াছে খুড়ো
.                সেবার পয়োগ্রামে
যামিনী সেনের পুত্রের বিয়ে
.                অনাদি সেনের ধামে |
বাসা দেছে তারা বরযাত্রীদের
.                বিজয় রত্নের বাড়ী
খুড়োকে লইয়া সকলে আমরা
.                দিলাম তথায় পারি |
সকাল বেলায় জলযোগ সহ
.                চায়ের আসিল পালা,
মিষ্টান্ন সাজায়ে চা তৈরী করে
.                পেয়ালায় হইল চালা |
খুড়ো চা খায়না নেশা হয় তাতে
.                তাহা সে আগেই জানে,
মিষ্টান্নের থালা টেনে নিয়ে তাই
.                বসিল একটি কোণে |
নিশিকান্ত সেন সবারে ডাকিয়ে
.                বলিল হবে না তা,
খাওয়াতেই হবে যে ভাবেই হোক
.                আজকে খুড়ো কে চা |
একে হনুমান তায় আজ্ঞা পেয়ে
.                ছুটিনু আমরা সবে
খুড়ো ধরিয়া চা-র কাপ নিয়ে
.                ঢালিয়া দিলাম মুখে |
হাঁ হাঁ করে খুড়ো খাবার ফেলিয়া
.                বাহিরে ছুটিয়া যায়,
আমরাও সবে বাহিরে আসিয়া
.                ঘিরিয়া ফেলিনু তায় |
রাগ করে খুড়ো ঘরে ছুটে গিয়ে
.                ছাতা ও চাদর নিয়ে,
স্টেশনের পথে সোজা হাঁটা দিল
.                জুতো জোড়া পায় দিয়ে |
বিবরণ শুনে চন্দ্রকান্ত সেন
.                খুড়োকে ফিরায়ে নিয়ে,
ঠাণ্ডা করেন রাগটা তাহার
.                প্রচুর মিষ্টান্ন গিয়ে |
দুপুর বেলায় খেতে বসে গেছি
.                সে চক্ মিলান রকে,
খুড়োও আসিয়া বসিয়া গেছেন
.                আমার বাঁয়ের দিকে |
অর্দ্ধেক খাওয়া হয়ে গেছে প্রায়
.                খাইতেছি মাছ দিয়ে
পড়িতে পড়েতে বাঁচিয়া গেলাম
.                খুড়োর ধাক্কা খেয়ে |
বান্ চোত কচু জব্দ হয়েছে
.                দেখনা ওদিকে চেয়ে |
দেখিলাম কোণে কচুগাছ এক
.                নধর পুষ্ট হয়ে
দাঁড়ায়ে রয়েছে মন্বন্তর যেন
.                লাগেনি তাহার গায়ে |
বলিনু খুড়োকে কচু জব্দ কিসে
.                হইল বুঝিতে নারি,
খুড়ো চটে বলে বুঝিলেনা ইহা
.                বুদ্ধি তোমার ভারি |
জব্দ হলোনা কচুটা, তাহাকে
.                সজারু পেল না খেতে,
পাঁচিল ঘিরিয়া রেখেছে
.                সজারু পারে কি সেথায় যেতে ?
হা হা রবে সবে উঠিল হাসিয়া
.                খুড়োর বচন শুনে,
খুড়ো ততক্ষণে রসগোল্লা পেয়ে
.                গিলিতেছে গুনে গুনে |


আর একদিন খুড়োকে লইয়া
.                গিয়াছি ভবানীপুরে
কুট্টিকাকার মেয়ের বিবাহ
.                দেখিয়া যাবেন ঘুরে |
প্রকাণ্ড বাড়ীটা নেওয়া হইয়াছে
.                মেয়ের বিয়ের তরে,
গেটে বসে আছে দুই দারোয়ান
.                বন্দুক লইয়া করে |
সাজান গোছান বিবাহ বাড়ীটা
.                ইন্দ্রপুরী সম রাজে,
নহবৎখানায় বাজিছে শানাই
.                বাজাদার নানা সাজে |
খুড়োকে লইয়া সকাল বেলায়
.                গেলাম বাড়ীর গেটে,
ঢুকিবে কি খুড়ো দারোয়ান দেখে
.                ভয়েতে পিছনে হঠে |
যা হোক তখন খুড়ো কে লইয়া
.                ভিতরে আসিলে পরে
আরে এযে খুড়ো! ব'লে কুট্টিকাকা
.                তাহাকে জড়াইয়া ধরে |
এই ভাবে যবে আনন্দের বেগ
.                খানিক কাটিয়া গেল,
বাড়ীটার পানে চাহিয়া খুড়া তো
.                অবাক হইয়া গেল |
এতগুলি ঘর সাজান গোছান
.                জীবনে দেখেনি খুড়ো,
বয়স তখন কম নয় তার
.                ৭০ বছরের বুড়ো |
দেখায়ে শুনায়ে খুড়ো কে যখন
.                ফিরায়ে আনিনু ঘরে,
বারটা বেলায় বেল বেজে গেল
.                তখন স্নানের তরে |
আমরা সবাই স্নানাগারে সবে
.                আসিনু স্নানের সাজে
খুড়ো কে কিন্তু খুঁজে না পাইল
.                কেহই তাহার মাঝে |
স্নান শেষে সবে ফিরিলাম ঘরে
.                শুনিনু ভিষণ রব,
খুড়ো নাকি কোথা নষ্ট করেছে
.                খাবার জলের টব |
খাবার জলের charge এ ছিলেন
.                মোদের ভগ্নিপতি
শুনিলাম তিনি কুট্টিকাকাকে
.                বলেন চটিয়া অতি |
আপনার খুড়ো স্নানের তরেতে
.                ঢুকিয়া জলের হলে
স্নান করে তথা নিজের কাপড়
.                ডুবাল টবের জলে |
এতবড় টব জল ফেলে পুনঃ
.                কেমনে ভরিব জল,
ভাড়ী সব গেছে বেলা বাজে এক
.                বন্ধ হয়েছে কল |
চেয়ে দেখি খুড়ো দাঁড়ায়ে রয়েছে
.                মুখটি করিয়া নীচু
অপরাধী সম দাঁড়ায়েছে এসে
.                কুট্টিকাকার পিছু |
সবাই বলিল ব্যাপার কি খুড়ো
.                না গিয়ে স্নানের ঘরে
খাবার জলের টবটি কি হেতু
.                ফেলিলে নষ্ট করে |
খুড়ো বলিলেন আমি তো ভেবেছি
.                স্নানের জলই হোথা
স্নান করে সেথা কাপড় ধুইতে
.                যাইব আবার কোথা |
খুড়োর বচন শুনিয়া সেথায়
.                উঠিল অট্টহাসি
নিজ বাহাদুরি ভাবিয়া খুড়োও
.                হলেন বেজায় খুশী |

চলে গেছে খুড়ো আজিও তাহার
.                কথাগুলি পড়ে মনে,
পাবনাক আর খুড়োকে ভাবিয়া
.                জল আসে আঁখি কোণে |


সেদিনের এক কাহিনী খুড়োর
.                এখন পড়িছে মনে
রোগী এসে এক দেখা দিল সাঁঝে
.                একটি কাছিম সনে |
রাত হলো দেখে কাছিমের হাতে
.                দড়ি বেঁধে দিল রেখে,
পর দিন ভোরে কেটে কুটে তারে
.                খাওয়া যাবে মহাসুখে |
এদিকে কাছিম রাতের বেলায়
.                বাঁধন কাটিয়া দাঁতে,
লম্বা দড়ি সহ বেড়া ফুটো করে
.                নামিয়া পড়িল পথে |
বাড়ী পার হয়ে পূব দিকে গিয়ে
.                একটি খানার জলে,
কাছিম প্রবর মহাসুখে নেমে
.                ঢুকিল ঝোপের তলে |
মানিক ধীরেন দুই ভাই তারা
.                ছিপ হাতে ঘোরে পথে,
এমন সময় খানার ভিতরে
.                দেখা কাছিমের সাথে |
বহু যত্ন করে চার গেঁথে ছিপে
.                কাছিম ধরিবে বলে,
দুই ভাই তারা ঝোপঝাড় ঠেলে
.                বড়শী ফেলিল জলে |
আর কোথা যায় খাটেতে বসিয়া
.                খুড়ো তা দেখিতে পেয়ে,
আমার কাছিম মেরোনা বলিয়া
.                ছুটিয়া আসিল ধেয়ে |
কাছে এসে খুড়ো ঐ দেখ বলে
.                লাফায়ে পড়িল জলে,
পাঁক ও ঝোপেতে আটকিয়া খুড়ো
.                কাতর হইয়া বলে |
ও ধীরে, মানিক ডুবিয়া গেলাম
.                আমারে টানিয়া তোল,
বঁধুরা ছুটিয়া আসিল তথায়
.                শুনিয়া গণ্ডগোল |
যাহোক খুড়োকে অনেক কষ্টে
.                টানিয়া তুলিতে হলো,
সারা অঙ্গে তার জোঁক লেগে আছে
.                সবাই দেখিতে পেল |
কচ্ছপ খাওয়া ঘুচিল খুড়োর
.                দাপায় ভয়ের চোটে,
সবাই তখন একটি করিয়া
.                জোঁকগুলি তার খোটে |

কাছিমের নামে খুড়োর জিভেতে
.                আসিয়া পড়িত জল,
হারানো কাছিম পুনঃ পাওয়া যাবে
.                ভেবে বেড়েছিল বল |
খুড়ো কাছিম কত প্রিয় ছিল
.                ইহাতে বুঝিয়া গেলে,
সব ভুলে যেত খুড়ো সেইদিন
.                কাছিম একটি পেলে |

.                    ****************                          
সূচির পাতায়

মিলনসাগর
*
উত্কট স্বাধীনতা

স্বাধীনতার নামে বাংলা ভাগ হোল আগে
পূর্ববাংলা পড়ল গিয়ে পাকিস্তানের ভাগে
খুলনা যশোর পাকিস্তানে গেল তারি টানে
কেন গেল ? এ কথাটার বুঝলো না কেউ মানে
এরই পরে শুরু হলো হিন্দুর ভিটে ছাড়া
সব কিছু ফেলে সেথায় পালিয়ে এল তারা
পশ্চিমবাংলা বাধ্য হয়ে দিল তাদের ঠাঁই
কারণ, তারা নিঃস্ব আজি, কিচ্ছু তাদের নাই
সরকার তাই নানাস্থানে উদ্বাস্তু ক্যাম্প খুলে
এই সব বাস্তুহারার স্থান করে দিল  
আসতে যেতে কতক মলো কতক অনাহারে
এত ক্লেশেও বাঁচলো যারা রইল ক্যাম্পের ঘরে


.                ****************                               
সূচির পাতায়


মিলনসাগর
*
বঙ্গদেশ ছেড়ে যদি বাঙ্গালীর যেতে হয়
স্বরাজ অমৃতে শেষে অরুচি আসিবে হায় |
শূকর আছিল ভাল কৈ মাছ খেয়ে
ভিটাছাড়া দেশছাড়া স্বাধীনতা পেয়ে |

.               ****************                                 
সূচির পাতায়


মিলনসাগর