শচীন্দ্রনাথ সেনের কবিতা |
খুড়োর কথা (প্রথম পর্ব) খুলনা জেলার মূলঘরেতে শীতল খুড়োর বাড়ী | বেঁটে কাল মোটা মানুষ ছিল না গোঁফ দাড়ি | মানুষ ছিলেন সরল সোজা বুদ্ধি কিছু খাটো | নূতন কথা পেতে কিছু যতই তারে ঘাটো | ঠাকুর দাদার পুতে নাতি সবার তিনি খুড়ো | খুড়ো বলেই ডাকতো তারে গ্রামের ছেলে বুড়ো | বুদ্ধির মতই ছিল তাহার মোটা একটু ভুরি | ইচ্ছে করলে খেতে পারতেন এক ধামা গুড় মুড়ি | অবলীলা ক্রমে তিনি গাছির বাড়ী গিয়ে | ঝোলা গুড়ের একখানি ভার খেতেন চুমুক দিয়ে | মুনকে রঘুর নাম শুনেছি চক্ষে দেখি নাই | খুড়োর খাওয়া দেখলে প'রে আসতো মনে তাই | একটি পন পাকা গাব বিচি শুদ্ধ গিলে | পরদিন তার কোষ্ঠ সাফ হতো প্রাতঃকালে | আমরা কিন্তু বলি না তা দুষ্টু লোকই বলে | দেখা হলেই খুড়ো তাদের দিতেন কানটি মলে | গাবের গাছে খুড়োর এত ভক্তি কেন জান ? কোষ্ঠ সাফের গাবের আঁটি গজিয়েছিল হেন | খুড়োর বাগানে এত গাবগাছ কেন হলো তুমি জান ? সারা বাগানেতে গাবের সে আটি পড়েছিল আজ শোন | বল তো খুড়োর কম ছিল না বলি একটু খুলে দু'মন চালের বস্তা সোজা দাঁতে নিতেন তুলে | একদিন খুড়ো মাঠে তখন ঝড় বৃষ্টি এল ছাতি তো নেই তেলের ডোঙ্গা @@@@@@@ গেল | দুহাত দিয়ে সেইটে তখন মাথার উপর দিয়ে আধ মাইল পথ হেঁটে সোজা বাড়ী উঠল গিয়ে | কবিরাজী করতেন খুড়ো ফলতিতে কলকলে শুধু হাতে ফিরে বলতেন ভিজিট দেয় নি ভুলে | কলা, মুলো আর সিকি, দুয়ানি মাঝে মাঝে যেত জুটে সেদিন তাহার শ্রীমুখেতে হাসি উঠিত বেজায় ফুটে | একদিন খুড়ো কল@@@@গে কোন এক রোগীর বাড়ী সেথা গিয়ে দেখে রোগীটির তার ছাড়িয়া @@@@ নাড়ী | কি করিবে খুড়ো ভেবে নাহি পেয়ে গম্ভীর হয়ে@@@@ | কেমন দেখ@@@@@@@@ রোগীর মতি@@@@@| কোন ক্ষেত্রের জ্বর হল বাবু বলিল একটি বুড়ো বলব কি ছাই কুরুক্ষেত্র চটিয়া বলিল খুড়ো | রোগীটি তাহার অক্কা পাইল রাম বান বটি খেয়ে খুড়োও তখন চম্পট দিল ভিজিট কিছু না নিয়ে | আর একদিন বেনে খালি গ্রামে খুড়োর পড়িল কল হাটবারে কিছু দক্ষিণা মিলিবে বাড়িল তাহার বল | রোগী বাড়ী গিয়ে দেখিল রোগীর শ্বাসের হয়েছে টান কি করিবে খুড়ো ভেবে নাহি পেয়ে দিল তারে রাম বান | রোগীর পিতারে বলে খুড়ো এতে ঠিক হয়ে যাবে নাড়ী হাটে যেতে হবে ভিজিটটা দাও তাড়াতাড়ি যাই বাড়ী | পথে এসে খুড়ো শুনিতে পাইল কান্নাকাটির রোল আর একটু পরেই দৌড়িতে লাগিল শুনে হরি হরি বোল | এইভাবে খুড়ো কবিরাজী করে গ্রাম হতে গ্রামে যেত কাছিমের হাতা কই ও মাগুর মাঝে মাঝে কিছু পেত | খুড়োর আবার দুষ্টু বুদ্ধি মাঝে মাঝে হত মনে জমার খালেতে মাছ মেরে যেত চুপি চুপি জাল টেনে | একদিন খুড়ো মাছ মারিবারে এইরূপ এক খালে চুপি চুপি গিয়ে মালই ভরিল দু'বার জালটি ফেলে | খালের মালিক টের পেয়ে তাহা লাঠি লয়ে এল রুখে খুড়া তাহা দেখি প্রমাদ গণিয়া কহিল শুষ্ক মুখে | কটা মাছ আর আমি মারিয়াছি দেখ গিয়ে আগা খালে খাল ভেঙ্গে তারা সব মাছ নিল দশখানা জাল ফেলে | মালিক ছুটিল খুড়াকে ছাড়িয়া সোজা খাল পাড় দিয়ে ভর্ত্তি মালই খুড়া ছোটে বাড়ী জালগাছ পিঠে নিয়ে | এরূপ খুড়ার কাহিনী অনেক বলিতও আমি পারি কিন্তু তাহাতে পুথি বেড়ে যাবে কাগজের দামও ভারি | দুষ্টুমি খুড়োর আর একদিনের পড়িতেছে আজ মনে মকর্দ্দমার কারণেতে খুড়ো যাবে মহকূমা পানে | কালীবাড়ী ঘাটে গয়নার তরে দাঁড়াইয়া আছে খুড়ো গয়না আসিলে দেখা গেল তার স্থান নাই আর কারও | যাহা হোক খুড়ো গলুইয়ের কাছে উঠিলেন কোন রূপে কাঁকড়ার টিন রয়েছে দেখিয়া ছাতি ঢুকালেন চুপে | ছাতির কাপড় পাইয়া কাঁকড়া ঠ্যাং দিয়ে ধরে তায় খুড়ো চুপিসারে ছাতিটি উঠায়ে ছৈ'যের ভেতর যায় | রেখে বলে বাপু অসুখ আমার একটু বসিতে দাও কোনরুপে আমি শুধু বসে যাব তোমরা তামাক খাও | এই অবসরে ছাতি হতে ধীরে কাঁকড়া সরিয়া যায় খুড়ো সেই ফাঁকে কাকড়া সরাতে জায়গা করিয়া লয় | একটি মিয়ার উরুতলে গিয়ে ভীষণ কামড় দেয় মিয়ার চিত্কারে সচকিত হয়ে সবাই সরিয়া যায় | মাঝিটারে বলে ভীষণ চটিয়া কি কাজ করিলে দেখ মানুষ মারিতে নৌকার মাঝে কাঁকড়া আনিয়া রাখো | মাঝি ভয়ে বলে দোহাই কর্তা দোষটা আমার নয় ঢাকা ছিল টিন খুলে কে দিয়েছে নতুবা এমন হয় ? খুড়োর পসার তখন সেথায় হল যা বুঝিতে পার মেয়াভাই সব স্থান দিয়ে বলে কর্তা তামাক ধর | এমন যে খুড়ো কলিকাতা আর কশীতে যখন গেল যা দেখিল আর যা বলিতে গিয়া যেরূপ বেকুব হলো | সে কথা গ্রামের সকলেই জানে বেশী বলিবনা হেথা বিশেষত সেই পয়োগ্রামের কচু জব্দের কথা | আরও কত কথা পড়িতেছে মনে লিখিলে হয় না শেষ খুড়োর গল্প "কাহিনী" হইয়া জুড়িয়া রয়েছে দেশ | দুদিনের জ্বরে এহেন খুড়োটি তোরশ পঞ্চাশ সালে হারিয়েছি মোরা তিরিশে কার্ত্তিক বেলা ১২টার কালে | কি বলে তাহার পরিবারদের সান্ত্বনা দিব মোরা গুণমুগ্ধ তার ভাইপোর দল কাঁদিয়া হতেছি সারা | স্বর্গ দুয়ার খুলিয়া রেখেছে দেবরাজ তব তরে ঊর্ব্বশী মেনকা দাঁড়ায়েছে দ্বারে পারিজাত মালা করে | যাও তবে খুড়ো সে অমরধামে তোমার পূণ্যবলে পাপী ভাইপোরা পায় যেন স্থান তোমার চরণ তলে | . **************** সূচির পাতায় মিলনসাগর |
খুড়োর কথা (২য় পর্ব), মুলঘর, ১৩৪০ সাল খুড়োর কাহিনী প্রথম পর্ব শুনেছ তোমরা সবে আজি পুনরায় খুড়োর কাহিনী দ্বিতীয় পর্ব হবে | খুড়ো চলে গেছে কাহিনী তাহার অমর হইয়া রবে দেশের আবাল বনিতা বৃদ্ধ মুখে মুখে তাহা কবে | কবিরাজী করে খুড়ো বহু দিন রুদ্দুরগাতী গ্রামে ডাকিতে আসিল তারে একজন নিমাই মণ্ডল নামে | ছাতি ও চাদর সঙ্গে লইয়া তখনই চলিল খুড়ো গিয়ে দেখে সেথা ছেলে হইলেও রোগীরে দেখায় বুড়ো | ফিটের অসুখ মাঝে মাঝে তাই জ্ঞান হারা হয়ে পড়ে চক্ষু কপালে উঠে যায় তার প্রাণ যেন নাই ধরে | নিমাই কাঁদিয়া বলে কবিরাজ বাঁচাও ছেলেরে তুমি ছেলের অসুখ সারিলে তোমায় খুশী করে দেব আমি | দেখে শুনে সব খুড়োর তখন কাল ঘাম ছোটে গায় বলে মনে মনে ঠাকুর আজিকে একি ঠেকাইলে দায় | গম্ভীর হয়ে নাড়ী দেখে খুড়ো ইষ্টনাম যঁপে মনে হটাৎ খড়ম চালারে বাতায় গোজা দেখে সেইখানে | আঙ্গুলের ছাপ খড়মের গায় পষ্ট দেখিতে পায় কি ভাবিয়া খুড়ো মণ্ডলের কাছে দুই গাছি দড়ি চায় | দড়ি নিয়ে খুড়ো রোগীর পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুলে বেঁধে বলে জোরে টান তোরা চক্ষু তাহলে জায়গায় আসিবে চলে | বিধির দয়ায় টান লেগে পায়ে রোগীর চক্ষু নামে পুলকে খুড়োর রোমাঞ্চ হইল সারা গা ভিজিল ঘামে | রোগীর মাথায় জল দিয়ে খুড়ো সুস্থ করিল তায় খুড়োর কাণ্ড দেখিয়া নিমাই অবাক হইয়া যায় | রাম@@ আর সাদা চটি পায়ে ভিজিট লইয়া খুড়ো গ্রামেতে ঢুকিলে পেছনে লাগিল পাড়ার ছেলে ও বুড়ো | কোথা গিযেছিলে টাকা পেলে কত কি রোগী দেখিলে বল খুড়ো হেসে বলে ছ টাকা ভিজিট বেঁধেছি দা@@ | @@@@@ @@@@ খুড়ো খুলে বলে তখন হইতে খুড়োর পসার বেড়ে গেল সে অঞ্চলে | রস চুরি করে খেতো খুড়ো খুব পাড়ায় পাড়ায় ঘুড়ে | গেল তারি আশে রাতে মাঘ মাসে গাঙ্গুলী পুকুর পাড়ে | সঙ্গে তাহার ফণি ও পাদুষ চিকো হাতে নিয়ে ফেরে | কারা রস পাড়ে বসন্ত গাঙ্গুলী হুইল হাতে এল তেড়ে | গাছি ভেবে খুড়ো ভয় পেয়ে ঢোকে কুটোর পালার তলে | ভুরিটা বিশাল ঢোকে না তলায় পাদু পেছলে ঠেলে | এমন সময় বসন্ত গাঙ্গুলী নিকটে আসিয়া পড়ে | ফণি ও পাদুষ খুড়োরে ছাড়িয়া পালায় তখন দূরে | বসন্ত তখন খুড়ো রে টানিয়া বাহির @@@ বলে আরে এ কি খুড়ো তুমি কেন হেথা @@@@@@@@ | বাহির হইয়া খুড়ো কেঁদে বলে মেরো নাকো গাছি ভাই | রস খেতে ডেকে আনিল পাদুষ আমি নিজে আসি নাই | বসন্ত কহিল আরে খুড়ো আমি কেন এত ভয় পেলে ? ভয় দূরে গেল ঠাণ্ডা হল খুড়ো এক ঠিলে রস গিলে | পুলিশের নামে খুড়োর বেজায় ভয় বরাবর ছিল প্রমাণ তাহার একদা সেবার হঠাৎ ফলিয়া গেল | মুকুন্দ দাসের স্বদেশী যাত্রা শিষ্যেরা তার গায় গাহিতে গাহিতে একদল এসে ঢুকিল মোদের গাঁয় | খুড়ো সারা দিন সাথে সাথে ফেরে একটি পাঠের আশে মিলে গেল পাঠ খুড়ো দেখা দিল বুড়ো ব্রাহ্মণ বেশে | লম্বা টিকি আর নামাবলি গায় পৈতেও ঝোলে গলে তারে দেখে সবে হাততালি দেয় খুড়ো এল তাই চলে | স্বদেশী যাত্রায় ঢুকিয়াছে খুড়ো পুলিশ লাগিবে পাছে এই কথা শুনে ভয় পেয়ে খুড়ো রাতদিন থাকে গাছে | বিন্দু রায় নিকুঞ্জ সেন ও বিধুভূষণ মিলে পরামর্শ এক গোপন বৈঠক সেরে ঠিক করে ফেলে | পরদিন খুড়ো নিজের ঘরেতে বসে আছে চুপ করে বাহির হইতে কড়া সুরে কারা ডাকে তার নাম ধরে | উকি দিয়ে খুড়ো দেখিতে যা পেল চক্ষু স্থির হল তাতে সভয়েতে খুড়ো ঢোকে তাল বনে বসিল মা@@ @@@ | এদিকে বাহিরে দারোগার সনে সিপাহী দু'জন নিয়ে ছীতল বাবু কি কোঠি পর হ্যায় হাঁকে গম্ভীর হয়ে | প্রতাপ আসিয়া হাসিয়া ফেলিল খুড়োর রকম দেখে বলে খুড়ো তুমি পাঁচ টাকা দাও মুক্তি আনিব লিখে | খুড়ো কেঁপে ভয়ে বলে ও প্রতাপ রক্ষা করো মোরে ভাই পাঁচটি টাকাই আলমারিতে আছে তার বেশী আর নাই | শিশির তলায় খুঁজিলেই পাবে তাই দিয়ে পাপ বিদেয় কর নতুবা হেথায় মারা যাব আমি "গো বধ" তোমার হইবে বড় | প্রতাপ গাঙ্গুলী হাসিয়া ছুটিল ঘুরে ভেষজাগারে শিশির তলায় টাকা পাঁচটিও ফেলিল পকেটে পুরে | দারোগা পুলিশ সব চলে গেল প্রতাপ হাসিয়া কয় শিঘ্র এস খুড়ো গেছে গেছে তারা আর কিছু নাহি ভয় | তাল বন হতে খুড়ো এল ঘরে কেটে গেছে সারা দেহ সে দিকে খুড়োর দৃষ্টি পরে না (বলে) আর তো নাহিক কেহ | প্রতাপ তখন খুড়োর পিঠেতে দুইটি চাপর মেরে হেসে বলে আরে এত ভয় কেন ওরে ও ভেড়ের ভেড়ে | তারপর হলো একদিন রাতে বন ভোজনের পালা বুঁড়ে কাছিমের মাংস সহ পাতে খিচুড়ী হইল ঢালা | এহেন খুড়ো কে হারিয়েছি মোরা চোখে আসে জল ভরে খুড়ো শুণ্য তার ভাইপোরা হায় আর তো পাবে না তারে | . **************** সূচির পাতায় মিলনসাগর |