কবি সাগর চক্রবর্তী-র কবিতা
যে কোন কবিতার উপর ক্লিক করলেই সেই কবিতাটি আপনার সামনে চলে আসবে।
*
রিফিউজী ও অন্যান্য কবিতা কাব্যগ্রন্থ থেকে. . .

রিফিউজী   
সাগর চক্রবর্তী


১.
উদ্দালক সত্যকাম কিম্বা নচিকেতা
ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির অথবা অর্জুন ----


গ্রহণের ফাঁদে পড়া সূর্য, তার আলো
সন্ধ্যার নদীর মতো ;  এ বলয়গ্রাসে
দ্রুত নিভে যাচ্ছে সব ভারতবর্ষের------

২.
অথচ সবারইতো মাটি চাই |  দরকার |
বায়ুচারী পাখিকেও বৃক্ষের আশ্রয়ে
মাটিরই আশ্রয়ে ফিরে আসতে হয় |
মাটিই মায়ের মতো মানুষের প্রথম আশ্রয় |

৩.
বাবা আমাকে চিনিয়েছিলেন ফুল
মা চিনিয়েছিলেন ফল
মাটি চিনতে গিয়ে আমি-----
থাক সে কথা আমার নিজের গোপনতায়-----

৪.
মাথা ফাটাফাটি হতে পারে তেমন জমিজমা আমাদের
.                                        কিছুই ছিলোনা ;
নিজেদের হাতে লাঙ্গল ঠেলতে হয়নি আমাদের কোনোদিনই |
মা অবশ্য পাড়ার বউ ঝিউরীদের নিয়ে ঢেঁকিতে
.                                ধান ভানতেন-------চিঁড়ে কুটতেন ;
সোনাকাকী গান গাইতো
.            : নারদ মুনির বাহন রে /  ধান ভানিস তিনকাহণ রে-----
মেয়েরা সব ধুয়ো ধরতো  : দে আলায়------- আলায় দে-------



আমাদের সুজন পড়সী ছিলো, ঘরের কাছেই
আরশীনগরে তারা বসত করতো-----


আমি ঝোপে ঝাড়ে ঘুরে পাখি চিনতাম
গাছগাছালির পাতা লতা ছুঁয়ে ছেনে চেখে দেখতাম
মাঠে মাঠে তাইরে নাইরে মুক্তি ছিলো আমার

মেঠো ইঁদুরের সাথে খুব জানাশোনা ছিলো
ধানের ক্ষেতের কয়াপোকা----গঙ্গাফড়িং---প্রজাপতি ধরতাম
আমার ছোটোবেলা ছিলো রূপকথার মতো
.                     অলৌকিক ঐশ্বর্যে রা
এক পাগলা ঘোড়ার পিঠে সওয়ার ছিলাম আমি তখন
সে আমারে কইথ্বনে কই লইয়া যাইতো-----


বিন্নুধানের খইয়ের মতো আকাশে তারা ফুটলে
জোছনার ফিনিক দেওয়া উঠোনে পাটি পেতে
রাঙ্গাদিদি সুর করে প্রস্তাব বলতেন
.                 : আমি স্বপ্নে দেখি মধুমালার মুখরে
.                             মদন কান্দিয়া কয়
.                  আমার স্বপ্ন যদি মিথ্যারে হইতো-----

খুব গরম পড়লে যখন গাছের পাতাটিও নড়তো না
পিঁপড়েরা সাদাসাদা ডিম মুখে সারি সারি
.                ঘরের দেয়াল বেয়ে উপরের দিকে উঠতো
আকাশের অনেক উঁচু থেকে ভেসে আসতো ফটিকজলের কান্না
রাঙ্গাদাদু বলতেন
.                :  বিষ্টি অইবো |   খুব শিগ্ গিরই
বিষ্টি অইবো, বুঝলি সোনা ভাই  !
---- বাতাসে তিনি বৃষ্টির গন্ধ পেতেন |
আমার ছোটোবেলার দশদিক ঝাপ্ সা করে
বজ্রমাণিকগাঁথা  বৃষ্টি আসা
.                        এক আশ্চর্য ঘটনা
সারাগ্রাম জেগে উঠতো শাঁখের শব্দে আর জয়জোকারে
:   বিষ্টি----- বিষ্টি------- বিষ্টি আইছে গে-------


কাকের ডিমের বরণ নীলমেঘ
.                      মেঘের বুকের কাছ দিয়ে
বিদ্যুতের ঝিকিমিকি গজমোতি হারের তলা দিয়ে
.                       শংখের মালার মতো
.                             বকের সারি-----
আমি স্বপ্নে দেখি মধুমালার মুখরে
আমি স্বপ্নে দেখি মধুমালা-----



তারপর রাজপুত্র
এক ডুবে তুইল্যা আনলো হীরার কৌটায় বন্দী ভোমরা- ভোমরী
নিয়া আইলো হীরামন পাখি আর গান গাওয়া জল
.                                   আর আনলো নাচইন্যা ময়ূরী---


রাঙ্গাদাদু বলতেন :  রাইক্ষস খোক্কস সব শে, হইলো
দুয়োরাণী বনবাস ছাইড়া ফিব়্যা সংসারে আইলেন
পাটরাণী হইলেন তিনি ----- রাইজ্যে জয় জয় |

এক একদিন ঝড় আসতো ঝড় মানে তুফান |
গাছপালা আকাশ বাতাস টালমাটাল
মা’র আঁচল ধরে অবাক দেখতাম
উঠানে কাঁঠাল পিঁড়ি পেতে দিয়ে বোনেরা গলা ছেড়ে শোলোক
.                                                        কাটতো


: পবন ঠাকুর বইসো বইসো বইসো
পবন ঠাকুর বইসো বইসো বইসো
রাঙ্গাদাদু বলতেন : কাইল দেখবি কী সোন্দর রৈদ উঠবো
সোনাভাই, হাইস্যা উঠবো গাছপালা মাঠ
.                        য্যান্ কার্তিকপালের আঁকা পটখান |
বাবা বলতেন :  তুই ক্যান ভয় পাস, বোকা ?


অনেক রাতে লেবুর ঝোপের ভিজে পাতায় থোকায় থোকায়
.               জোনাক জ্বলতো, জ্বলতো নিভতো, আবার জ্বলতো
লেবু পাতার   ভিজে মাটির   গন্ধ আসতো,   আমার শরীর
.                        কদম হয়ে ফুটে উঠতো  |
মা’র বুকে মুখ ডুবিয়ে তখন কী দারুণ এক গন্ধ পেতাম |
থাক্ সে গন্ধ আমার মনের মণিকোঠায় অন্ধভ্রমর বন্দী হয়ে |



৫.
আল্লা  হো আকবর ------ নারায়ে তগদীর
.                      আর বন্দেমাতরম্
নোখ আর দাঁতের ধারালো নদী হয়ে
পাহাড়ের শক্ত প্রাচীর হয়ে
.                  দু’ভাগে ভাগ করে দিলো তাবৎ মানুষকে |


আগুনজ্বালা আর্তনাদ আর অত্যাচারের মহোল্লাসের
.                                রাত পেরিয়ে
.                কীর্তিনাশা পদ্মা বিশাল গাঙ পেরিয়ে
গোয়ালন্দ |
সূর্য তখন পাটে বসেছেন   রাত ছড়িয়ে


সাঁঝ আঁধারে সুবল-মামী ডুক্ রে উঠলো :  যমুনা কই ?
দলে  হই হই----কান্নাকাটি--- সুবল--মামুর মেয়েটা নেই |
.                        নেই মানে নেই |
রাঙ্গাদাদু ধমক দিলেন চাপা গলায় : চুপ করোনা  !
ধইব়্যা নেওনা যমুনারে কুমইরে নিছে !



কু ঝিক্ ঝিক্ রেলের গাড়ি ধরতো দেখি ধরতো দেখি
আলোছায়ায় দুলছে সবই--- দুলতে দুলতে যাচ্ছে সরে
.                        চোখের জলের দীর্ঘশ্বাসে
কাঁচা তেঁতুল পাকা তেঁতুল --- কাঁচা তেঁতুল পাকা তেঁতুল--
সরে যাচ্ছে এতোকালের চেনা মাটি
নতুন দেশটা আসছে কাছে !
রাত্রিজাগা দুর্ভাগা সব ভাঙ্গাচোরা মানুষগুলো
তৈরী হচ্ছে নামবে নতুন ইস্টিশনে
.                    পায়ের তলায় আপদবিহীন জমিন পাবে |
হঠাৎ যেন পাগলা হয়ে টলতে টলতে
শূন্যপানে হাতটা ছুঁড়ে
মাথায় ব্যান্ডেজ পট্টি বাধা মদন দাদা   চেঁচিয়ে উঠলো
ভাঙ্গা গলায় কেমনতরো কান্না যেন
: পালানোডা ঠিক হইলো না  !
কে যেন জোর ধমক দিলো বিরক্তিতে
:  চুপ্ যা দেহি !
রাত্রি তখন ভোর হচ্ছে কি     আমি সেটা ঠিক দেখিনি ||



৬.
স্বাধীনতা নয়া স্টেশনে এলাম আমরা
আকাশে তখন কড়া রোদ সেঁকে চামড়া
বাতাসে কেমন নেই নেই এক শব্দ


আকাশ দেখিনা ;  মাটিও দেখিনা শহরে
শানবান্ধা সব |  চুপ হয়ে থাকি জব্দ
জুবুথুবু ; ভয় জাগছে লহরে লহরে----
স্বদেশের সেই ইস্টিশনে দিনের বেলায়
চিড়িক্ মিড়িক্ ছবি তোলেন কতো মশাই
.                বাস্তুহারা  !  রিফিউজী  !!!


রাতের বেলায় ইস্টিশনে
সুন্দর বনের বাঘের বিষম আনাগোণা
ইস্টিশনের মিষ্টি কূলের লোভেই বুঝি !
বাঘের পেটেই গেলো ফুলি চম্পা বীণা সোনাকাকী
.                                        পেটের দায়ে !
গাড়ি ঘোড়া অট্টালিকা নিওন বাতির
শহর তখন আমার কাছে ম্যাজিক ম্যাজিক !


বাবা বললেন
: এটাই তোমার স্বদেশ এবার থেকে |
মা আকাশে সপ্তঋষির পায়ের তলায়
.                অরুন্ধতিকে খুঁজে পেতে চাইলেন |
রাঙ্গাদাদু আমার রাঙ্গাদাদু কথা বললেন না
শুধু একবার খুব জোরে মুঠো করে ধরলেন আমার মাথার চুল
: ঈশ্বর !!


এসব পরণ কথার বিষয়
বিষম পাথর |     নড়েনা চড়েনা |
থাক আমার বুকে, পাশাবতী আমার
নিজস্ব হয়ে ||


৭.
মা’র হাতে কাদামাটি গোবর মাখা, নতুন দেশের
নতুন বাড়ির পিড়া ওটা উঠান লেপতে লেপতে
আঁচল দিয়ে চোক মুছতেন মা  |  দেখছি  |
আমি তখন কয়লার ধোঁয়া উড়িয়ে ছুটে চলা রেলগাড়ির
.                                                বাঁশীর মতো


.                        লম্বা হচ্ছি----- লম্বা --------


নতুন দেশের নতুন মাটিতে বাবা নানা গাছ লাগাতেন
আমি জল ঢালতাম |        বাবার সাথে বেড়া বাঁধতাম |
ফুল ফুটলে মা প্রথমে ঠাকুরকে দিতেন | বোনেরা সব মাথায়
.                                                        পরতো |
ফল হলে মা ঢালাও হাতে বলোতেন একে তাকে |


কাঁঠাল কাঠের কৌটোয় ভরে একখাবলা শুকনো ঝুরো মাটি
পদ্মা পাড়ের
আগের দেশের
লুকিয়ে এনেছিলেন মা |   সেই মাটি আমার মা
এই মাটিতে ছড়িয়ে দিয়ে
.                তুলসীতলায় গলায় আঁচল গড় করতেন |
এসব কথা আমার মনে আছে |
এসব আমি কিছুই ভুলিনি |


আমি তখন মধুমালার স্বপ্ন দেখি
আমি তখন নতুন দেশে খুঁজতেছিলাম এমন পাখি-----
থাক সে কথা আমার নিজের বিষন্নতায়


৮.

কাজেই আমি প্রেমে পড়লাম |
এমন কিছু বলার মতো ঘটনা নয় |
মেয়ে না হলে এদেশের মেয়েদের সাথে প্রাণখুলে মেলামেশা
করা যায় না |  প্রেমিকার প্ররোচনায় আমি তাই মেয়ে হলাম |
স্নো পাউডার মাখতাম নিয়মিত |      আঙুলের নোখে নেইল
পালিশও লাগাতাম |    তখন আমার প্রেমিকা ছাড়া দুনিয়াতে
আর সবাই আমার চারপাশে পুরুষ |   আমরা বেশ কিছুদিন
এগোলে হঠাৎই আমার প্রেমিকা বলে বসলো :      যদি তুমি
মেয়েই হলে, দু’জনে ঘরসংসার করবো কি করে | তাই আমি
আবার ছেলে হলাম | ব্যাটা ছেলে | ব্যাপারটা খুব মজার------
ক্রমে আমি নষ্ট হলাম কারণ আমি চালাক হলাম |  এছাড়া
আর  কি হতে পারতাম  !     যাদুকরী শহর আমাকে গিলে
ফেললো |    আর আমার সবকিছুই বিক্রি হয়ে গেলো খোলা
বাজারে |আমার জাত গেলো পেট ভরলো না এই পোড়া শহরে |
প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে টের পেতাম আমার নিজস্ব বিষয়গুলো
একে একে আমাকে ছেড়ে চলে যাচ্ছে |  কেননা আমি তাদের
বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছি |  কাল কি বিক্রি করবো, এক অসম্ভব
ভয় আমাকে পেয়ে বসেছিলো তখন | ফলে, হিংস্র হতে আমার
বাঁধেনি |

৯.
এই সময়
রাস্তা ঘাটে মাঠে     ব্যরিকেড
আইন- শৃঙ্খলার নির্দিষ্ট আগুন
মস্কোগ্রাদ আর ওয়াশিংটনের বাতাস পেয়ে
ঝলসে উঠতে লাগলো
রাজ্যজোড়া বিশৃঙ্খলার মধ্যে
চাবুকের মতো ;  আমাদের
হারাবার মতো কিছুই ছিলো না
ফায়ার !   ফায়ার  !!   ফায়ার !!!


রাঙ্গাদাদুর কথা খুব মনে হতো |    হঠাৎ হঠাৎ
দু’হাতে মুখ ঢেকে কেঁদে নাকি কঁকিয়ে উঠতাম
নেতাদের মুখে তখন ভিন্ দেশী ললিপপ তাঁরা তাই চুষছেন
রাতারাতি ঝান্ডা বদল হয়ে গেলো
.                        অনেক এজেন্সীর
রাতারাতি দোতলা তিনতালা পাঁচতালা হলো
.                        অনেক পুলিশ অফিসারের
অনেকের লাস রক্তে মাখা পড়ে রইলো রাজপথে
.                        ড্রেনে, অনেকে হাফিজ
অশোক চক্রের সিংহ জিভ বের করে চেটে নিলো থাবা
.                            তারপর যথারীতি ধ্যানে মগ্ন



১০.
এ দেশ আমার স্বদেশ এবং এই মাটিতেই
বেড়ে বেড়ে বুড়িয়ে গেলাম তীক্ষ্ণ, ভোঁতা ঠোকর খেয়ে
দিনের সাথে পাঞ্জা কষে রাতের সাথে কুস্তি লড়ে
.                লড়তে লড়তে সব কিছু পুরোনো শোলোক
.                ঝেড়ে ঝুড়ে ফুরিয়ে গেলাম


তিন দশকে তিরিশ বছর পার হয়ে আজ
বুকে গভীর তীর লেগেছে
.                নতুন করে ভয় ধরেছে
.                              এ মাটিও ছাড়তে হবে |
কিম্বা থাকলে থাকতে পারি পরদেশী ভিন্ দেশীর মতো
.                            চুক্তিমাফিক শর্ত মেনে  |
যে কোনোদিন নোটিশ পেলেই উঠতে হবে |
উঠতে হবে নিজের রক্ত ঘামের বসত ভিটে ছেড়ে
নাঙ্গাভুখা গ্রামের মানুষ পা বাড়াচ্ছে যেমনতরো শহরমুখো ;
টিঁকে থাকার বস্তী ভেঙ্গে জাগছে শহর আকাশটাকে দাঁত খিঁচিয়ে
.                        ম্যাজিক ম্যাজিক ম্যাজিক শহর |
পায়ের তলায় মাটি ক্রমে কাটতে কাটতে শহর যাবে সমুদ্দুরে ?
যেখানে মাটির ঢিবি উঁচু হচ্ছে ময়দানে,  মানুষ
কোদালে শাবলে খুঁড়ে তুলছে এ মাটির পাহাড়
সেইখানে চম্পা, পদ্মা, নুরজাহান মেলে দেয় মাংসহীন হাড়
ট্র্যানজিস্টার বেজে ওঠে চড়া বাজনা বিসর্জনের
যে কয়টা টাকা আসে তাই দিয়ে ভাত ফুটবে ;  ফুটপাতের সংসার
আশ্চর্য ভাতের গন্ধে জেগে উঠে    মধ্যরাতে শহর জাগায়  !

আমরা কোথায় যাচ্ছি     আমরা কোথায় যাবো তবে


মাটি নেই     আকাশ রয়েছে


আমাদের
নিজস্ব সব গাছের শিকড় উপড়ে হাওয়ায় ভাসতে হবে

ভারতবর্ষ কাদের তবে  |

কবিগুরু !  আপনি কাকে ভুবনমোহিনী বলেছেন !!


১১.
আমি তো আগের মতো শিশু নেই আর
আমার দু’চোখে আর রূপকথার রঙ নেই
এখন তেমন কোনো ঋতু নেই বর্ষা বা ফাল্ গুণ
ভিতরে বাইরে বেজে উঠতে পারে ঝনন্ ঝনন্  !


আমার হাতের নোখে ময়লা জমে, নোখ
ক্রমে দীর্ঘ বাঁকা হয় আর
মধ্যরাতে সেই নোখ বসে যায় আমারই গলায় |
একদিন এই হাত কুসুমের বীজ ছড়িয়েছে ?
একদিন এই হাত ছুঁয়েছিলো আলতারাঙ্গা পা ?


আমার বাবার মুখখানা আর
আমার মায়ের চোখ দুটি আর
.                        কিছুতেই ধরতে পারি না !
১২.
কে আমাকে বলেছিলো সত্যিকার মানুষের দেশ
.                   ভুবনে কোথাও নেই
আছে সব দেশে মানুষের ঘর
.         সব দেশই মানুষের ঘর
যে মানুষ মার খায় বার বার রক্ত ঢালে, আনে টালমাটাল ঝড়
দেশ তার কাছে কিছু নয় |
সব দেশই দেশ তার    সব দেশেই তার সূর্যোদয় !


এখন আমি তাঁকে খুঁজছি |

১৩.
আমার পায়ের তলে মাটি নেই |
রিফিউজী !
আমার নিজস্ব সব গান ছিলো-----এখন নেই |
রিফিউজী  !
আমার হাতের কিছু কাজ ছিলো মাটিতে |  এখন নেই  |
রিফিউজী !
আমার আশার, স্বপ্নের, ভবিষ্যতের কোনো স্থির
.                                দাঁড়াবার মতো জায়গা নেই |
রিফিউজী  |
ষাট্ কোটি মাঝি মাল্লা ট্রাকড্রাইভার
মজুর কিষাণ মধ্যবিত্ত কুলি কামিন
আদিবাসী হরিজন গিরিজন মানুষের মতো
আমার পায়ের নিচে  মাটি নেই !


কোথায়  তবে  আমার  মাটি ?


সে মাটি কি কীর্তিনাশা পদ্মার কুমীরে নিয়েছে ?
সে মাটি কি বাঘের থাবায় চলে গেছে ?
সে মাটি কি ঈগলের ধারালো ঠোঁটের বস্তু ?
.                        শ্বেত কোনো ভালুকের লীলাক্ষেত্র ?


কোন্ মাটিতে ঘর বসতের স্বাধীনতার নিরাপত্তা
কোন্ মাটিতে ফুলের বাগান ফলের স্বপ্ন বপন করবো
এ দেশ যদি আমার না হয়  কী দেশ তবে   কত দূরে ?


আমরা কতোকাল ঘুমুবো যার যার শরীরে রক্তে করবো স্নান
আমরা কতোকাল টিনের তলোয়ার ঘুরিয়ে যাত্রার সাজবো ভীম
আমরা কতোকাল এভাবে বারবার স্বভূমি থেকে হয়ে উৎখাত
স্রোতের শ্যাওলার মতন ভেসে যাবো-----ভাসানে   ভাসবো  হে
.                                                        লখিন্দর !
আমরা কতোকাল ছিন্নমস্তার পূঁজির দেবীকার বলি হবো !


১৪.
এই প্রশ্ন
ক্রমশ অমোঘ আর অনিবার্য হয়ে ওঠে
ক্রমশ ঈশাণী কোণে মেঘ
.                বাতাস থমথমে
.                বাতাসে আগুন জমে বিস্ফোরক ক্রোধে ও ঘৃণায়
ক্ষমা, কাকে ক্ষমা ?



পৃথিবীর মূলকেন্দ্রে পোড়া শূণ্যতা  পাক খায়
টেনে নেয় উপরিসৌধের সৌন্দর্যের স্থিরপ্রজ্ঞা ;
শূণ্যতা ----শূণ্যতা  বড়ো চতুর্দিকে-----
.                        শূণ্যতা ভরাতে
.                        ছুটে আসে হাওয়া---নষ্ট হাওয়া !
অগ্নিময় সেতুর ওপরে দাঁড়িয়ে আমরা বিপন্ন মানুষ
.                জল জল বলে ভয়ংকর দুলতে থাকি
ত্রাণ না উদ্ধার এই প্রশ্নে
ভেসে আসে নষ্ট কিশোর পুত্রের মুখ
ভেসে আসে নষ্ট কিশোরী পুত্রের মুখ
ক্ষমা ?  কাকে ?
আমাদের প্রজন্মের যাবতীয় ঐশ্বর্যও অন্ধকারে
পরস্পর পরস্পরকে আঁকড়ে ধরি প্রক্ষোভেই
পরস্পর পরস্পরকে ব্যবহার করি অভ্যাসেই
.                        হাতের আঙ্গুল ঘাতক হয়ে ওঠে |

ক্ষমা,    কাকে ক্ষমা ?

১৫.
যুধিষ্ঠির !  যুদ্ধ করলেন পৃথিবীকে ক্ষত্রিয়হীন করলেন
কারণ, দেবতারা চেয়েছিলেন |
অর্জ্জুন !  দেববরে দেবঅস্ত্রে দেবতাদের ইচ্ছেকেই
.                রক্তে স্নান করিয়ে  জয়ী করলেন |
আমরা ঢের যুধিষ্ঠির ঢের ঢের অর্জ্জুনও দেখলাম |
আমরা আর কুরুক্ষেত্র চাই না |    না |

১৬.
ফিরে যাও উদ্দালক  সত্যকাম
কার মাটি ?  কেন দেবো  বাঁধ ?
দেখছোনা চোখের জলে, খুনে
.               বিষাদের সমুদ্র অগাধ |


ফিরে যাও নচিকেতা |  যাও  |
কার ঘরে জ্বালতে চাও আলো ?
কেন চাও !  থাক অন্ধকার !
দেখছো না, বিভীষিকা শ্মশানের হাড়ের পাহাড় !
----পাশাবতি, হৃদয় জুড়ালো !!

১৭.
বংশ বংশ ধরে আমরা এ মাটিতে ছড়িয়েছি আকাঙ্ক্ষার কুসুমের বীজ
চোখের আঁধার মুছে আকাশে খুঁজেছি ধ্রুবতারা
.                    সুতরাং এ মাটি আমার
.                    সুতরাং এ দেশ আমার
এ মাটিকে ভাঙ্গনের ক্ষয় থেকে রক্ষা করা কর্তব্য আমার |
বঞ্চণায় অপমানে ফিরিয়ে নিয়েছি কালো মুখ
অভিমানে অভিশাপ উচ্চারণ করেছি বার বার
এইবার হাতে হাত রাখি
এইবার এসো হাত ধরি
.             গান গাই ভালোবাসার
.             গান গাই দুঃখ জয়ের
এসো বাঁচবার গান গাই |

১৮.
শেখানো বুলির তোতা ময়না বুলবুলিরা দেখুক
দুঃখ আর পীড়নের দিঘিতে ডুব দিয়ে আমরা
.         তুলে এনেছি সেই হীরের কৌটোর রহস্যময়
.         ভ্রমরা ভ্রমরী :  আমাদের হাতের মুঠোয়
রাক্ষস আর রাক্ষসীদের প্রাণ !


গল্পের শেষটাতো সবারই জানা |


সিংহাসনে বসবে আবার
.                ঘুঁটে কুড়োনী দুয়োরাণী মা
.                আমাদের জনম দুঃখিনী মা
আমাদের সর্বংসহা সর্বহারা মা
পাটরাণী হবে আবার |


.                   ****************                                                      
সূচিতে    


মিলনসাগর
*
রিফিউজী ও অন্যান্য কবিতা কাব্যগ্রন্থ থেকে. . .

এই তো সময়  
সাগর চক্রবর্তী


১.
কান পাতলে আর্তনাদ বাতাসে    ভীষণ দুঃক লজ্জা    অপমান
এই কি আমার দেশ ?
এখন নিয়ম আইন সংবিধান আগ্রাসী জহ্ লাদ
এই কি আমার দেশ ?
বৃদ্ধাবেশ্যা তীর্থে যায় ;  উত্তরাধিকার রেখে যায় মা বোনের
ইজ্জত বিক্রেতা দালালের হাতে |
কতিপয় বুড়ো হিজড়ে পাতচাটা কুত্তার সন্তান
আমাদের অহিংস হতে বলে |


২.
জাতীয় ধনিক চক্র
সাম্রাজ্যবাদের কূটকৌশল
সামন্ততন্ত্রের অবশেষ আর ক্ষমতার হঠকারী লোভ
.                                দল-- উপদল--মন্ত্রী
সিংহভাগদার মুত্সুদ্দিরা
শ্রমিকের কৃষকের ক্ষুধার নিংড়ানো গ্রাসে-রক্তে-ঘামে
পার্লামেন্টকে পুষ্টতা দিয়েছে --- শ্রীমতী গান্ধীর
হাত যথেষ্ট শক্ত !

৩.
‘বিপ্লব আমদানি করো এ মাটিতে’
কোন্ পথে ?  কোন দেশ থেকে ?  সপ্তডিঙ্গা রণপোত
কেন ঘুরে যায়--- ?   আমাদের সমুদ্র
এমনকি স্বাধীন আকাশে
ঈগল ও শ্বেত ভল্লুকের
.                   সতর্ক সজাগ ক্রিয়াশীল দৃষ্টি !
এই কি আমার দেশ ?



৪.
ক্রোধ সংগঠন খুঁজে অবৈধ দাউ দাউ জ্বলে যায়
পোড়ে বিশ্ববিদ্যালয় রেল গুমটি ষ্টেশন ট্রাম বাস
মানুষ ;  আমরা তো মানুষ
ক্রোধ সংগঠন খুঁজে আত্মঘাতী শব্দে ফেটে পড়ে
আমার মনুষ্যত্ব আমাদের বিবেক আমার আমাদের ভালোবাসা
প্রতিরোধের মুখে লাথি মেরে প্রত্যাঘাতে যৌবনের যন্ত্রণা
.                                                      যাচায় |


৫.
শ্রমিক কৃষক মধ্যবিত্ত সর্বহারার দল,
তোমাদের পরার শেষ কাপড়টা দিয়ে দাও
.                               গরিবী হটছে---------
বৌয়ের সামান্য সোনা বাঁধানো এয়োতি চিহ্ন নোয়াটা দাও
.                               বেকারী হটছে--------
তারপর ?   জিজ্ঞেস করোনা--------- মার খাও !
ট্যাকসো দাও ----------- মাসুল দাও মাসুল !
তারপর ?   যেখানে খুশী যাও
জাহান্নামের দরোজা খোলাই আছে !  যাও  !


৬.
বেশ |   তবে চলো  |    আবহাওয়া
বরানগর কাশীপুর বেলেঘাটা হাওড়া ঘুরে এসে জানান দিচ্ছে
: চলো ---------- বাধ্য হয়ে !


জেলখানায়  |
জেলখানাগুলিতে আর জায়গা হচ্ছে না  ;  রোজ
জায়গা পরিস্কার করে দিচ্ছে সরকারী জহ্লাদ
জেলখানা তো কসাইখানা  !

৭.
পুঁজির স্বৈর  শাসন ভীষণ নষ্ট জাতীয়তা
সাম্প্রদায়িক ভন্ডামী আর পূরুত মৌলা পাদরী গোঁসাই
উঠতে বসতে মার মেরেছে চাবুক লাথি বুলেট হাজত
মার মেরেছে হাড়েমাংসে বিবেকটাকে লুঠ করেছে  |
হক্ কেড়েছে বাঁচার ;  শ্রমিক রুজির ক্রীতদাস হয়েছে !
জলছাড়া মাছ বাঁচতে পারে ?
জমিন ছাড়া কৃষক বাঁচে ?
৮.
ওরা গুলি করে মেরেছে হাজার তরুণ কে
লাঠিপেটা করে মারলো বন্দী জেলখানায়
বহরমপুর দমদম আলিপুর এবং
হাজারীবাগের জেলের ভিতর বিচারহীন-----
জ্যান্ত কবরে গিয়েছে ক’লাখ !  কে বলবে |


গণতান্ত্রিক হিটলারশাহী অত্যাচার
কেড়ে নেয় সব !  বাঁচার রাস্তা ট্যাকসো চায়----
কেবল রক্ত !  কেবল আব্রু, বোন মায়ের !


পোড়া ঘর ফাঁকা ভিটে বন্দর অন্ধকার
পশুর থাবায় সব চলে যায় |
.                              সত্য আজ
মার খায় বোবা ;  মিথ্যে প্রচার হয় জোরে  |
কিন্তু, পৃথিবী অবাক করা এ খুনীরা, কই
এখনো পারেনি হত্যা করতে গোর দিতে
মার খেয়ে লাল আমাদের লাল স্বপ্নকে !


যতোই চালাও  অত্যাচারের  ষ্টীম রোলার
বুকের ভিতরে কখনো তোমার লোমশ হাত
ছুঁতে পারবেনা,  জেনে গেছি,  লাল হৃদয় কে !

৯.
আমরা এতোকাল টিনের তলোয়ার
ঘুরিয়ে নেচে গেছি যাত্রা আসরের
কুশলী যোদ্ধার মেক--আপে ঝলমল |

এখনো সেই ভাবে নাচাই শ্রেয় নাকি  ?
বুকের পঞ্জরে হাজার শহীদের
রক্তেগম্ভীর মৌল প্রশ্নকে
আগুন ছুঁয়ে দৃঢ় বুঝবো ইস্পাতে
চিনবো তাই আর নীরব নিস্কৃয়
থাকবোনা পুরনো টিনের তলোয়ারে !

১০.
সময় কে আমরা ধারালো অস্ত্র করতে পারিনি
তাই আমাদের সময় এসেছে মাটির গভীরে চলে যাবার
আমরা ক্ষমতার হঠকারী লোভে ভাইয়ের রক্তে হাত রাঙ্গিয়েছি
তাই আমাদের জলের গভীরে চলে যেতে হবে |
উপড়ে ফেলতে চাইনি প্রাচীন  বিষবৃক্ষকে শিকড়বাকড় সমেত
তাই আমাদের বৃক্ষের অরণ্যে চলে যেতে হবে !


১১.
চলে যাবো |   ফিরে আসবো ভয়ঙ্কর দাবানল হয়ে |
ফিরে আসবো পূর্ণবার
সাবালক সময়ের টানে------পূর্বাঞ্চল লেলিহান
আগুনের নয়া ইতিহাস
পূনশ্চ দখল করবো দৃঢ় পদক্ষেপে
.                           শস্যের সমস্ত ঘাঁটি
.                           শিল্পের সমস্ত উত্স
.                            কলকারখানা----ফুলফল
মাটি জল দেশের সীমানা আমাদের
আকাশ বাতাস আলো আমাদের
বর্তমান, ভবিষ্যত আমাদের
সমস্ত শিশু বৃদ্ধ তরুণ তরুণী-----মানুষ, আমাদের |

১২.
আমরা জানি, জেনে গেছি
আমাদের দাবীগুলি দাবীর লড়াইগুলি

একে একে রক্তমেখে ফিরে আসতে বাধ্য |
এসব লড়াই-ই নয় !   লড়ায়ের ভূমিকা কেবল !

১৩.
সব নদী লাল হতে হবে
সব হাওয়া অগ্নিভ বারুদ
সব ব্যথা ঘন হয়ে প্রচন্ড আগ্নেয়গিরি হবে
সব হাতে পরোয়ানা : এইদেশ       এইমাটি
.                        এ ধান ----আমার  !
দক্ষিণে সমুদ্র বন উত্তরে তরাই
ধ্বনি দিলে প্রতিধ্বনি বজ্র হয়ে বাজে
.                        :  তৈয়ার----তৈয়ার----


১৪.
মৃত্যুর গভীর থেকে আমোঘ জীবন উঠে আসে
মৃত্যুঞ্জয় পথ দাবী করে
বিকল্প প্রস্তাব মালা পড়ে থাকে অবহেলায় ঘৃণায় |
আখের ক্ষেতের ঝড় চিনি হয় ক্রমে দানা বাঁধে |
লবঙ্গ দারুচিনি রবার বাগানে ঝোড়ো হাওয়া
এখন নিয়ন্ত্রিত ছন্দে বাজে সৃষ্টির উল্লাসে-----


হোয়াংহো মেকংয়ের লাল স্রোত ডাক দেয়
:  এসো  !
তৈরী হবার দিন তৈরী করার দিন এসে গেছে সূর্যের সংসারে |

.                   ****************                                                      
সূচিতে    


মিলনসাগর
*
আমাদের কবিতা কাব্যগ্রন্থ থেকে. . .

মধুসূদন স্মরণে  ২০০০  
সাগর চক্রবর্তী


আত্মরতির অন্ন খুঁটে   টিকিয়ে রাখা প্রাণ
 তবুও নদী সমুদ্দুরের কথাই যায় বলে ;
সপ্ত সিন্ধু দশ দিগন্তের হাওয়ীয় টালমাটাল
ভাষার নিশান আশার আলোয় শুভঙ্কর জ্বলে |


   দুয়োরানির লক্ষ  হাজার সমর্থ সন্তান
এপাড় গঙ্গা   ওপাড় পদ্মা  আদিম-অস্ত্রাল
ত্রাণ খোঁজে না মধুসূদন, বাজী ধরেছে জান---
     জন্মভূমি এবং ভাষার গড়েছে সংগঠন !
 এপাড় গঙ্গা  ওপাড় পদ্মা  স্পর্ধিত উথ্বান
ক্রোধ ভেঙ্গেছে আর্যরীতির শ্রেণীজ বন্ধন |


পতন ভেঙ্গে নিশান হাতে চলছে নওজোয়ান
        সমর্পিত শরীর এবং সমর্পিত মন
কালের বক্ষে গভীর চিহ্ন আঁকছে মহাকাল
          এবঙ্গ ভান্ডারে আজো অমূল্য রতন ||

.                                             ১৯.০১.২০০০

.                   ****************                                                      
সূচিতে    






মিলনসাগর
*
আমাদের কবিতা কাব্যগ্রন্থ থেকে. . .

কবিতা বিষয়ক
সাগর চক্রবর্তী


কবিতাকে, ধ’রে নিচ্ছি,  সমস্ত শিল্পের প্রতিনিধি
কবিতাকে,  ধ’রে নিচ্ছি,  শুদ্ধতম মানব সন্তান
                কবিতাকে, ধ’রে নিচ্ছি, মহাশূন্যের মধ্যে নিজস্ব কেন্দ্রের
                                              স্থিরতায়,
                        খানিকটা টাল খেয়ে ঝোঁকা
                            গতিময় চৌম্বক অবস্থান


শ্রেণিসংগ্রামের কথা শুনতে শুনতে বুড়ো হলো খোকা
                 আসমুদ্র হিমাচল এখনো দেয়নি ধুয়ে
                              ভালোবাসা নামে এই কবিতার নদী |
                                                     সুতরাং
         কবিতা বাজারে যাবে, ব্যবসায়ের কথা বলবে,
                                                          আর
     নিপুণ হিসেব করবে পড়তা লাভ মুনাফা লোকসান
                              পার্লামেন্টে যাবে, সরব নীরব থাকবে |
                           নীলামের দর হাঁকবে, গ’ড়ে নেবে বাণিজ্যিক শিল্প প্রতিষ্ঠান |


                            সন্তান যেহেতু হলো সম্যক বিস্তার,
                                                    বলে অভিধান
                              সন্তান যেহেতু হলো নন্দন নন্দনী
                                              ছড়িয়ে পড়বে তারা,
                           গৃহকোণে থাকবে না বন্দী বা বন্দিনী
                                         বিবাহিতা পরিণীতা হবে
                                                       আনবে ত্রাণ
                                                 নন্দন আনন্দ দেয়,
                                                       নন্দিনীও দেয়,
                                                       করে নরক-উদ্ধার |



                                           স্বর্গ আর বিপরীতে নরক |
               নরক বানায় কারা ? কী ভাবে বানায় ?
            এতোদিন পৃথিবীতে বাস ক’রে ঘুণ
    মানুষ সে সব তত্ত্ব জেনে বুঝে শিখে গ্যাছে মানা না মানায়
          সুন্দর উপার্জন মানে স্বর্গ এক কথায় তাই তো দাঁড়ায় |
    সহজ সরল রাস্তা জটিলকুটিল হয়ে ঘোরায় যে দমছুট চড়ক
   তা-ই তো স্পষ্ট দেখছি জাহান্নামে যাবার সড়ক |


    সন্তান নরকযাত্রী হবে
সন্তান ব্যবসা করবে সুন্দর উপার্জন চেয়ে
      উথ্বানে উঠে যাবে ধাপগুলো বেয়ে
প্রতিযোগিতার মঞ্চে, রণক্ষেত্রে লড়তে হবে রোজ |
                              কবি কি এসব রাখে খোঁজ ?
              বিভেদের লড়াই তো বিচ্ছিন্নতা আনে
                            লড়াই যে আনে ক্লান্তি, শোক
             সে শোক গভীর হলে, গভীর গভীরতর হলে দানাবাঁধে মিলনের গানে
                দ্বীপগুলো নোনাজলে সাঁতরে এসে মিলতে থাকে-----
                                                          এক মহাদেশ |
   সুন্দর উপার্জনই নরকের শেষ

                                                                                                 
২৬.০১.৯৮

.                   ****************


  .
           
সূচিতে    



মিলনসাগর
*
আমাদের কবিতা কাব্যগ্রন্থ থেকে. . .

কবি ও কবিতা বিষয়ক
সাগর চক্রবর্তী


( এক )
অহঙ্কার থেকেই তিনি কবিতা লেখেন |
                               অনেক অনেক কবিতা তিনি লিখেও ফেলেছেন |
                     তাঁর সেইসব কবিতারা দারুণ অহঙ্কারী দেমাগী
                       পোষাক আশাক
            চালচলন  ভঙ্গি  উচ্চারণ
                এমনকি রুচি চেতনাও
   এতো অহঙ্কার নিয়ে তাঁর কবিতা
সবার ঘরে যেতে পারে না, যায়ও না |

        মানুষ তো সমাজকে শ্রেণীকে গোটাগুটি অস্বীকার ক’রতে
                                         পারেনা |
         দেওয়া নেওয়া  যাওয়া আসা লোকলৌকিকতা রা’খতেই হয় |
           তিনি তাঁর কবিতাকে নিয়ে
অহঙ্কারী সমৃদ্ধ মানুষের কাছেই যান |
                 তাঁদের নেমন্তন্ন করেন | যোগাযোগ রাখেন | তাঁরাও
                            তাঁকে তাঁর কবিতাকে  সুসজ্জিত কক্ষে এনে বসায়
                                          অথবা মঞ্চে |


                  যাদের অহঙ্কার করার মতো অলঙ্কার সাজপোষাক
                                  ঘরদোর
                             চাকরীবাকরি
                             শিক্ষা দীক্ষা
                কাজকর্ম ব্যবসাপত্র নেই
                      তারা দ্যাখে | অবাক হয় |
       ------ বাব্ বা রে বাব্ বা ! কী কান্ড |
           কেউ কেউ ভাবেও বটে --- ঐ’রকম হওয়াটাই আসল হওয়া |
                কিন্তু সে ভাবনা ফুল হবে তারপরতো ফল ধ’রবে----
   এতো সময় ধৈর্য ধ’রে কে ? তা ছাড়া
                        জমিও তো তৈরী নেই |
আবহাওয়ার কথা না হয় ছেড়েই দিলাম |


(  দুই  )
                          কারো কারো কবিতা
        দামি শাড়ি গয়না পরে, ওষ্ঠঅধরে রঙের উজ্জ্বল হাসি ফুটিয়ে
                      বাইরে আসে, রাস্তায়, হয়তো বা বেড়াতে যায়-----
আমার দারুণ লাগে !


কারো কারো কবিতা
বিয়ের রাতের কনে বউটির মতো সেজে গুঁজে ঘরে ব’সে থাকে পোজ
                                      দিয়ে |
                           সে কারো কাছে যায় না, অতিথিরা আমন্ত্রিতরাই আসে |
 সাধ্য মতো
    উপহার দিয়ে প্রশংসা করে |
আমি দেখেছি, এই ব্যাপারটার মধ্যে আন্তরিক প্রীতির স্নিগ্ধতার চেয়ে
      ভিন্নতর কিছু থাকে |


   কারো কারো কবিতা
         বিরহিনী সীতার মতো অ- শোক কাননে
     বন্দী, গালে হাত দিয়ে ব’সে থাকে, দীর্ঘশ্বাস
             আর চোখের জল |



কারো কারো কবিতা
          এমন পোষাক প’রে সাজে যাতে
তপব্রতধারী মুনিরও ধ্যানভঙ্গ হয় |
     কারো কারো কবিতা
                     ফুল লতা চাঁদের আলো পাখি প্রজাপতি ঝরণার সংসার
  সেখানে কখনো খরা ঝড় বন্যা দুর্ভিক্ষ শ্রেণিসংগ্রাম
      ঢুকতেই পারে না |
কারো কারো কবিতা
                        বটানিক্যাল গার্ডেনের সেই বটগাছ, মূলকান্ড কোথায়
   খুঁজেই পাইনা, কিম্বা গতিশীল সাইকেলের চাকা
আমি গতি ভালোবাসি তবু
       সাইকেল চাপতে শিখিনি |
         চেষ্টা করলে পতনের
               যন্ত্রণা ও ব্যথাই পাই |

              কারো কারো কবিতায়
যশোদা মায়ের সেই নন্দদুলাল
                                   যেন
       হামা টানে, কী দারুণ হাসে,
               কখনো বা চোখে জল |
   বৈষ্ণব না হয়েও আমি দু’হাত বাড়াই, ওকে একটু
                        ছুঁতে চাই, বুকে তুলে নিতে চাই, জানি
                           সকলেই চায় |


               কারো কারো কবিতা
     ছেড়ে যাওয়া জাহাজের বাঁশি
                কারো কারো কবিতা
            হাতজোড় ক’রে থাকা সেবাদাস সেবাদাসী
               কারো কারো কবিতা
                  যোজন যোজন অন্ধকার
                                     শীতলতা, শুধু
             পাতা ঝ’রে যাওয়া, যেন এক এলোকেশী রাত
                         নিজেকে দ্যাখায় শুধু
এই রকম কবিতায় গ্রস্থ হবার ভয়ে আমি দূরে থাকি |



            কোনো কোনো কবিতায়
             নদী মাঠ মাটি ফসলের
                খুদকুঁড়োর গন্ধমাখা
                        হাটুরে মানুষ,
             শুধু গ্রাম সামন্ত সম্ভার |
          কোনো কোনো কবিতাতো
           ভারতীয় অর্থনীতি আর রাজনীতির মতোই
                       নষ্টভ্রষ্ট জন্মপঙ্গু
              নাবালক দুষ্টবৃত্তি ভরা |


               কোনো কোনো কবিতায়
ছেড়ে চলে যাওয়া সন্তানের পথ চেয়ে
     দু’চোখে প্রদীপ জ্বেলে বসে থাকা
                  ঐশ্বর্যময়ী গরবিনী মা |


          কবিতার রাজ্যপাট ও রাজনীতিতে ঘুরে এসে
                                      আমি
              সেই রাজ্যেশ্বরী জননীকে
                    পা ছুঁয়ে প্রণাম করি
                              হাত পাতি :
                                অন্ন দাও !

                                     ০৫.০১.১৯৯৮

.                   ****************



.
        
সূচিতে    



মিলনসাগর