কবি সাহানা দেবীর গান ও কবিতা
|
দিকে দিকে কভু রাঙা পথে কভু শ্যামলের গায়ে গায়ে।
. ---কবে কোন্ পর্বতে,
রাজার দুলাল চলেছিল কোন্ মেঘের শুভ্র রথে,
আনিতে জিনিয়া পাষাণ পুরীর পর্বত দুহিতারে
. নাশিয়া দৈত্য--- ছিল যে জাগিয়া দ্বারে।---
. ---কোথায় মেঘের গায়,
মরালীর ওই সুন্দর পাখা মেলিয়া গগনে কোন্ পথে ভেসে যায়
. কোন্ শৃঙ্গের ধবল তুষার’ পরে,
. কে নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ করে।
. গিরিগুহা গহ্বরে,
. কোন্ মুনি ধ্যান করে।
. ---কোথা নীল সরোবরে,
করেছিল কারা জলকেলি কবে কমল তুলিয়া করে।
. কবে কোথা অপ্সরা সে রূপসী
গেয়েছিল কার প্রাণের রাগিনী কোন্ প্রাঙ্গনে বসি’।---
. রাজার কন্যা, যৌবন ডাক শুনি একদিন কবে,
ছাড়ি’ আপনার বারের সজ্জা চেয়েছিল কোন্ বীরশ্রেষ্ঠরে
. ছিল বনবাসে যবে।---
কত কথা, ছবি, কত কাহিনীর সুমধুর ঝঙ্কার
তুলিয়া চলে যে ছন্দ তোমার স্রোতসঙ্গীতে তার।
. ওগো মহিয়ান, ওগো মহা রূপকার,
. হে সৌরভের গৌরব মণিহার,
. নিখিলের অন্তর
পূর্ণ করিয়া দিয়েছ ভরিয়া, ওগো ধ্যানী সুন্দর।
. তব গৌরবে গৌরবী আজ সবে,
. জগত্জীবন তোমার কাহিনী ক’বে,
. মর্মে মর্মে মূরতি তোমার র’বে
. চিরকাল চিরদিন।
শিল্পীর ধ্যান-অন্তরে র’বে তোমার প্রেরণা চির অন্তর্লীন।
. এই ধরণীরে বেসেছিলে কত ভালো।
. নয়নে তাহার জ্বেলে দিয়ে গেছ আলো।
. দিতে ভাষা, দিতে গান,
. দিতে রূপ, রস, বৈচিত্র্য মহান্,
. এসেছিলে তুমি কবি,
. কেখে যেতে তারি ছবি।
. শারদ পূর্ণিমায়,
সুরের জ্যোত্স্না দিয়েছ বিছায়ে বিশ্বের আঙিনায়।
. ভরা শ্রাবণের ঘণ বরিষণ সাথে
কণ্ঠ ছাড়িয়া গেয়েছ গান সে বরষা-মুখর রাতে।
. বসন্ত-উত্সবে,
ডাক দিয়ে গেলে চিরসুন্দরে সুন্দর সব যবে।
. জীবনের সাজি ভরে
দিয়েছ সাজায়ে পূজার কুসুম কাহার পূজার তরে।
আমার কুসুম আনি’,
এসেছি চরণে নিবেদিতে আজ প্রাণের প্রণাম খানি।
. আজ নাই, তুমি নাই,
আমার কণ্ঠ আজো খোঁজে, তব সে-পরশ মাঝে ঠাঁই।
. শৈশব হতে তব গীত-সুধা পানে,
. শুনেছি গানের মর্মের কথা কানে,
. শিখেছি তাহার গভীর প্রাণের ভাষা,
চিনেছি সুরের সুষমার মাঝে কী তার নিভৃত আশা।
তোমার কাব্যে নিখিলের সনে হোল পরিচয়, হোল মন জানাজানি,
তোমার কাব্যে ভারতগাথায় শুনি কত ভাবে ভারতে মহাবাণী।
. আজ আমি রেখে যাই---
আমার কাব্যে তোমারি লিখন--- “ভুলি নাই, ভুলি নাই।”---
কীর্তিরে দিল মহিমার এই উচ্চশিখর যেই শিল্পীর তুলি,
মরণের মাঝে অমরণ নিল তাহারে দুয়ার খুলি’।
. *************************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
রবি-স্মৃতি
কবি সাহানা দেবী
স্বর্ণকমল হাতে
আসিলে যখন রাতের গগনে শুকতারা ছিল সাথে
আলোর সাথে ছায়ার সাথে
কবি সাহানা দেবী
কবিতাটি সম্ভবত সাহানা দেবিরই লেখা। আমরা পেয়েছি তাঁর আত্মজীবনী “স্মৃতির
খেয়া” বইটিতে। যদি অন্য কারোর হয় তাহলে আমাদের জানাবেন প্রমাণ সমেত। আমরা
শুধরে নেবো।
আলোর সাথে ছায়ার সাথে
পূর্ণিমাতে, শুক্লা রাতে,
প্রভাতরবির কিরণ মাথায়
অন্তরবির রক্তিমাভায়,
ঝড়ের মত্ত হাওয়ার বেগে,
মেঘ বিজলীর চমক লেগে
ঝলকে ওঠা আলোর ফাঁকে
দেখেছি যে কতই তাকে
কত ভাবে দেখেছি তার
সবুজ রঙের কত বাহার
কত শোভা মনোলোভা---
. ************************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
শৈশব হতে. . .
কবি সাহানা দেবী
রবীন্দ্রসঙ্গীত সম্বন্ধে এটাই ছিল সাহানা দেবীর শেষ কথা। (স্মৃতির খেয়া, পৃষ্ঠা ১৪৭)
শৈশব হতে গীতসুধাপানে
শুনেছি গানের মর্মের কথা কানে।
শিখেছি তাহার গভীর প্রাণের ভাষা।
চিনেছি সুরের সুষমার মাঝে কি তার নিভৃত আশা
. ************************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
বিশ্ব-লীলা কবি সাহানা দেবী উপেন্দ্রনাথ গঙ্গোপাধ্যায় সম্পাদিত বিচিত্রা পত্রিকার শ্রাবণ ১৩৪৬ (অগাস্ট ১৯৩৯) সংখ্যা থেকে নেওয়া।
চারিদিকে শুধু ধূসর অনন্ত ধূ ধূ আত্মলীন কায়াহীন কায়া, ছায়া, ছায়া, শুধু ছায়া! নাহি সীমা নাহি শেষ, নাহি স্পন্দনের লেশ, নাহি গতি, শুধু স্থিতি, শুধু অবারিত এক অপার বিস্তৃতি শূন্যতার সমাবেশ বিরাট-নির্দেশ!
ব্রহ্মাণ্ডের অগ্নি-কুণ্ড তীরে
|
অগ্নিমন্ত্র কবি সাহানা দেবী সুর ও স্বরলিপি - দিলীপকুমার রায় ফণীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ভারতবর্ষ পত্রিকার ভাদ্র ১৩৪৭ (সেপ্টেম্বর ১৯৪০) সংখ্যা থেকে নেওয়া। গানটি স্বরলিপি সমেত প্রকাশিত হয়েছিল।
অগ্নিময়ী! অগ্নি জ্বালো কায়ায় তুলি’ সাড়া। রক্তে আমার বহাও তব বহ্নিরসধারা। . তারার ম’ত ঊর্দ্ধ শিখা . ধরি’কা উঠুক সব ধূলিকা মুক্ত কর ভাঙি’আমার মৃত্তিকার এই কারা। ( নাশি কালো আজি ঢালো তব আলোধারা ) . আঁখি তোমার যেমন জাগে . জাগাও তেমন অনুরাগে শরণবেদীর তলে জ্বলুক জীবন আত্মহারা। . বোসে কমলমর্মসাথী . কমলে মোর আসন পাতি’ আপন মাঝে লুপ্ত করো আপন মম যারা। ( নাশি কালো আজি ঢালো তব আলোধারা )
. ************************ . সূচিতে . . .
মিলনসাগর
|
ওই যায়
কবি সাহানা দেবী
ফণীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ভারতবর্ষ পত্রিকার ফাল্গুন ১৩৪৭ (মার্চ ১৯৪১) সংখ্যা
থেকে নেওয়া।
আজি সোনার স্বপনে রঙিন গগন এ কী ও আলোকে চাষ
আজি ধরণীর পারে সুনীল সরণী উজলি’ কে যায়।
আজি কে যায় নবীন লগন মেলে,
. কে যায় অপার আঁধার ঠেলে,
. কে যায় মরণ-শিয়রে জ্বেলে
. আপন অমরতায়!
আজি ধূলার জীবন রাঙিয়া কে ওই আপনা বিকায়ে যায়।
আজি রাতের আকাশে কত চাঁদ হাসে কত যে তারকা গায়,
নয়তো আঁধার নয় তো রাতি---দেখ না চেয়ে দেখ না রে আয়
কবি সাহানা দেবী
ফণীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ভারতবর্ষ পত্রিকার মাঘ ১৩৪৭ (ফেব্রুয়ারী ১৯৪১)
সংখ্যা থেকে নেওয়া।
. গান
নয়তো আঁধার নয় তো রাতি---দেখ না চেয়ে দেখ না রে আয়,
আলোর পালেই বয় যে তরী তবু কেন উদাসী হায়!
. অপার ওঐ অনন্ত কোলে
. আনন্দ সাগর উথলে,
দে না ঢেলে হৃদয় মেলে দেখবি পরাণ ভাসে সেথায়।
আমরা আলোর শিশু চলি চির আপন হাটি ধ’রে
সমুখ দিয়ে কতই রঙে আলোর স্বপন খেলা করে।
. আজ আমাদের ভাসে ভালো
. চিরকালোর আলোর আলো!
আজ সে তার ওই আলোর গোঠে মোদের জীবন-ধেনু চরায়।
আজ আমরা তারি সুরে বসব কথা তারি ভাষায়,
ফুটবে দূরের আচিন তারা আমাদের এই আঁখি তারায়।
. আজ যে নবীন লগ্ন ধ’রে
. বিছাবো প্রাণ পথের পরে ;
আজ আমরা চলব শুধু, চলার এ পথ মেশে যেথায়।
এলো যে আজ ধূলার জীবন ধূলা ঝেড়ে দিতে ভুলে!
এসেছি আজ সকল দিয়ে বিকাতে ওই চরণমূলে।
. এলাম কত জনম পরে
. আজ আমাদের আপন ঘরে ;
আজ আমাদের জীবন দিয়ে জ্বালব জীবন অমর শিখায়।
. ************************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
আপনারে তুই ছাড়িয়ে যা রে
কথা, সুর ও স্বরলিপি - সাহানা দেবী
ফণীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ভারতবর্ষ পত্রিকা ফাল্গুন ১৩৪৬ (মার্চ ১৯৪০) সংখ্যা
থেকে নেওয়া। গানটি স্বরলিপি সমেত প্রকাশিত হয়েছিল।
আপনাকে তুই ছাড়িয়ে যা রে
চল্ ওরে তুই সেই শিখরে যেথা হ’তে নামবি না রে।
শিয়রে তোর জাগবে তপন
থাকবে নীচে মাটির জীবন,
উঠবে ফুটে তোরি স্বপন
. মুক্ত-ভূমের সেই পাথারে।
সেথায় আকাশ তোরি সাথী,
চন্দ্র তারা জ্বলবে বাতি,
পার হ’য়ে তোর আঁধার রাতি
. আলোর সাথে দিন কাটারে।
দূর অদূরের সকল ব্যথা
পার অপারের সকল কথা
শেষ ক’রে সব ব্যকুলতা
. আয় পেরিয়ে সব খোঁজা রে।
. ************************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
তর্পণ
কবি সাহানা দেবী
বিজয়চন্দ্র মজুমদার ও দীনেশচন্দ্র সেন সম্পাদিত বঙ্গবাণী পত্রিকার শ্রাবণ ১৩৩২ (জুলাই
১৯২৫) সংখ্যা থেকে নেওয়া। দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের পরলোক গমনের পরে লেখা।
কি দিয়ে পূজিব কোন মূরতি
. আজ শুধু মোদের নহ
শত রূপে আজ বিরাজিত তুমি
. আজ তুমি একটি নহ।
বংশের গরব নহতো শুধু
. শুধু আত্মীয়ের স্মৃতির ধ্যান!
দশের তুমি দেশের তুমি,
. ভারতের তুমি, ওগো মহান্!
সেই রূপ
কবি সাহানা দেবী
ফণীন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ভারতবর্ষ পত্রিকার আশ্বিন ১৩৪৭ (অক্টোবর ১৯৪০)
সংখ্যা থেকে নেওয়া।
দুয়ারে তোমার রেখে গেছে এঁকে অনন্ত রূপটিকা,
তাই সুদূরের পার হ’তে ভাসে তোমারি অগ্নিলিখা ;
. তোমার প্রাণের স্বরুপ খুলিয়া
. অরূপের শশী ওঠে য়ে দুলিয়া
. রূপজালে তার নিশি আকুলিয়া
. সুন্দর হৃদি মেলে।
লগনে লগনে রূপালি ছায়ায় গগনের মায়া খেলে।
দূর হ’তে দূরে নিয়ে যায় সেই লগ্নের আহ্বান,
পার হ’তে পারে ভেসে ভেসে চলে পার-অন্তের গান।
. সে যে গো তোমার অতল তিমিরে
. গোপনে ঝলসি তোলে স্বপনীরে,
. স্বপ্ন মাখানো সে নয়নতীরে
. পরাণ পলক হারা!
আপনার পারে ঝলি’ আপনারে জ্বলে সে নয়নতারা।
একে একে যায়, ঝ’রে ঝ’রে যায় কামনার সুরগুলি,
দুলে দুলে আসে অমৃত উছাসে নীলিমা লহর তুলি।
. নাই নাই আর রাতের কুয়াসা
. হিয়ায় ফোটে যে তারকার ভাষা,
. অম্বরলীন আবারিত আশা
. অন্ক পারে খোলে,
নিষ্কণ্টক বৃন্তে আজি যে রক্তগোলাপ দোলে!
খুলে যায় ওগো খুলে যায় ওই আকাশের গুণ্ঠন,
এক হ’য়ে যায় এপার ওপার ভুলি সেই আবরণ ;
. এক হ’য়ে যায় স্বরূপ অরূপ,
. এক হ’য়ে ওই ভাসে সে-অনুপ!
. আপনার মাঝে এ কি অপরূপ
. সত্তার বিকশন!
কূলহারা মোর হৃদয় অপার তারি রসে নিমগন!
ওই ওঠে সব রূপতরঙ্গ সে মহাকেন্দ্র হ’তে!
ওই আসে যায় জীবনের দোলা মরণশূন্য পথে!
. ঐ কত আসে, কত যায় ফিরে---
. মিশে যায় পুন সেই মহা নীরে,
. বহু রূপরেখা এক হয় ধীরে
. পূর্ণ পরম মূলে!
থেমে যায় সব গতি-উত্সব সে নীরব উপকূলে।