কবি সজনীকান্ত দাস-এর কবিতা
"কত কিছু পড়িলাম --"
কবি সজনীকান্ত দাস

স্তব্ধ নিশীথিনী রাত্রি, দ্বিপ্রহর বেলা ---
নিস্তরঙ্গ মরুমাঝে ভাসাইনু ভেলা |
শূণ্য মাঠ জনাকীর্ণ, গোষ্ঠে ফেরে গাই,
বিশুরে মারিল ঢেলা জগাই মাধাই |
দর দর রক্তধারা বহে ক্ষুরধার---
দ্রৌপদী আনিল ত্বরা  হোম-রৌপ্যধার ;
ফিরিয়া চাহির দান্তে ছল ছল চোখে,
গেল চলি মহাশ্বেতা দগ্ধ হিম-লোকে!
রৌদ্রকর-ম্লান তার কচি মুখখানি
ঝলকিল অর্ধরাত্রে, করে কানাকানি
আয়েসা ও ওফেলিয়া, বলে --- শোন ভাই
কিষ্কিন্ধা করিল জয় কানাই বলাই |
কুঞ্জবনে পুঞ্জ পুঞ্জ ফুটেছে কণ্টক,
মুছিল বিশীর্ণ সন্ধ্যা রক্ত অলক্তক,
বায়স ডাকিছে দূরে সারস ঘুমায়,
কাঁচা ঘুম ভেঙে খোকা মিটি মিঠি চায় |
বঙ্কিমে চাপিয়া ধরে রোহিণী সুন্দরী---
হীরারে করিলে সাধ্বী কোন যুক্তি ধরি ?
বোঠানে সতীশ বলে একী সর্বনাশ ---
পার্বতী হইল সতী, মরে দেবদাস!
রাধিকা পদ্মের নালে লিখিল লিখন ---
কার শাপে পাসরিল দুষ্মন্ত রাজন!
ভৈমীরে ফেলিয়া বনে শ্রীবত্স হেথায়,
বেহুলা ভেলায় ভাসে মাঝ দরিয়ায় ;
মুসোলিনী জাগে আর ঘুমায় লিঙ্কন্,
কুরুক্ষেত্রে কে ভাঙিল "হেগ্" সন্দিপন |
বটিচেলী কাঁদে কেন উজ্জয়িনীপুরে ;
তানসেন সঙ্গীহীন বালিগঞ্জে ঘুরে ;
নিউটন কাউন্সিলে বাধাইল গোল
স্বর্গেতে স্বরাজ্য হল বল হরিবোল |  


.              **********************     
.                                                                              
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
গৃহীর প্রভাত-চিন্তা
কবি সজনীকান্ত দাস

হব সন্ন্যাসী, হব সন্ন্যাসী ---
ইন্দ্রিয়জয়ী ব্রহ্মচারী, সর্বত্যাগী বৈরাগী,
ক্রেধের কারণ যত হোক, আমি কই রাগী!
প্রভাতে ভাবিয়ে বসি        পড়িব পড়িব খসি
.        এই সংসারবৃক্ষ হইতে শুষ্কপত্র-মত ;
মানিব না বাধা মায়ার কান্না, লব সন্ন্যাস-ব্রত |
.        আমি আপিল করিব না ;
.        বাহানা-মাফিক গৃহিণীর গহনা
সাধের নিদ্রা রাত্রে বাঁচাতে তাহাও গড়িব না |
সকালে উঠিয়া ঝাঁকা হাতে লয়ে ছুটিব না বাজারে,
আমি ট্যাক্স দিব না কর্পোরেশনে, বিজাতীয় রাজারে |
প্রতি রবিবারে ধোপার পিছনে হইবে না ছুটিতে,
হবে নাকো যেতে শশুরগৃহেতে প্রতেক ছুটিতে |
পরের শ্রাদ্ধে, দেশের কারণে আর নাহি দিব চাঁদা ;
দুঃখ হবে না কোলে নিতে ছেলে কালো-রোগা-নাকখাঁদা |
সর্দি মুছায়ে বিলাস-বস্ত্র নোংরা হবে না আর,
মাসের শেষেতে যার তার কাছে লইতে হবে না ধার |
দাড়ি-গোঁফে দিব অবাধে বাড়িতে,
ডাকিব না প্রাতে নাপিত বাড়িতে,
দুধে জল হেতু গোয়ালার সাথে হবে না ঝগড়া-ঝাঁটি ;
"পড়্ পড়্" বলে ছেলের মাথায় মারিতে হবে না চাঁটি |
কিবা ভয় আর বাড়ন্ত যদি গিন্নীর ভাণ্ডার ;
তীর্থে তার্থে হব না ত্যক্ত হস্তেতে পাণ্ডার |
অশৌচ নাহিকো, অসুখের কালে ডাক্তারে ফিস্ গোনা,
ছেলের পিলেটা সারাবার তরে খুঁজিতে হবে না চোনা |
দুর্জয় শীতে ঘামিতে হবে না চোর ডাকাতের ভয়ে,
অপমান আর কিছু নাহি হবে মামলায় পরাজয়ে ;
মোয়ে-বিয়ে নিয়ে ছেলের বাপের পায়ে পায়ে তেল দিয়ে
ফিরিব না আর --- না হবে ভাবিতে পূজার তত্ত্ব নিয়ে ;
বাসন মাজার ফ্যাসাদ নাহিকো চাকর পালিয়ে গেলে,
পাড়াপড়শীর নালিশ নাহিকো পাজী যদি হয় ছেলে |
সাহেবের লাথি বাপান্তি গাল হবে না শুনিতে আর,
ছেলে মেয়ে আর স্ত্রীর ফরমাসে ছেড়ে যাব সংসার |
অসহ্য সব --- নিশ্চয়ই আমি হয়ে যাব সন্ন্যাসী,
ভাবিতেছি বসে ; পত্নী নিকটে আসিয়া যে কন হাসি ---
"তুমি হেথা বসে, এদিকে যে চা-টা জুড়িয়ে ঠাণ্ডা হ'ল!
বুদ্ধি হ'ল না বয়স যদিও এক কুড়ি আর ষোলো |"
চা'র ক্ষুধা আর গৃগিণীর তাড়া জুড়াইয়া দিল মোরে ;
আজি শুনি কথা, ভাবা যাবে ফের আগামী কল্য ভোরে ||
.                                                        ---অঙ্গুষ্ঠ


.              **********************     
.                                                                              
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
নবায়ন
কবি সজনীকান্ত দাস

অন্ধকার আবরণ বিদুরি বিজ্ঞন-শলাকায়
সুনিপূণ হস্ত যাঁর প্রকাশিল নব সূর্ষালোক---
লভি নয়নের জ্যোতি তাঁর প্রতি নতি মোর ধায়,
অবারিত দৃষ্টি মোর দিনে দিনে দূরগামী হোক |
তমসা আচ্ছন্ন আঁখি যা দেখেছে কটু ও কষায়
চারিদিকে যা দেখিয়া ভেবেছিনু অন্ধ হোক চোখ,
নবীন দর্শন লভি চিত্ত মোর প্রর্থনা জানায়---
সুন্দর হোক ধরা মানুষেরা হোক বীতশোক |
বহুদিন ভুলেছিনু পৃথিবীতে এত আছে আলো,
যত আলো এ আকাশে এ মাটিতে তত ভালবাসা---
জড়ত্বে আবরণ মানুষেরে দেবত্ব ভুলালো,
জ্ঞানাঞ্জন শলাকায় ঘুচুক এ তম সর্বনাশা |
দরদী বিজ্ঞনী এসো, এ আঁধারে দৃষ্টি-দীপ জ্বালো,
আনন্দে হোক পৃখ্বী, দূর হোক নিষ্ফল হতাশা ||

.              **********************     
.                                                                              
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
ওগো সুন্দর, মনের গহনে তোমার মূরতিখানি
রচনা --- সজনীকান্ত দাস
সুর   ---- রাইচাঁদ বড়াল
শিল্পী  ---  কানন দেবী
ছবি -----   মুক্তি, ১৯৩৮

ওগো সুন্দর, মনের গহনে তোমার মূরতিখানি
.         ভেঙে ভেঙে যায়, মুছে যায় বারে বারে,
.         বাহির-বিশ্বে তাইতো তোমারে টানি ||
.                    ঐ যে হোথায় আকাশের নীলে
.                    বনের সবুজ এক হয়ে মিলে,
ঐ যে হোথায় সাগর-বেলায় ঢেউ করে কানাকানি ||
.          তোমার আসন পাতিব’ পথের ধারে,
.          তোমার আসন পাতিব’ হাটের মাঝে,
.          আঁধারে আলোকে যুগ যুগ ধরি’ প্রিয়,
.          বিরহে মিলনে চিরদিন জানাজানি ||

.              **********************     
.                                                                              
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
বন্ধন-ভয় তুচ্ছ করেছি উচ্চে তুলেছি মাথা
রচনা --- সজনীকান্ত দাস
সুর   ---- সুকৃতি সেন
শিল্পী  ---  সত্য চৌধুরী, সুকৃতি সেন ও সম্প্রদায়,১৯৪৬

.        বন্ধন-ভয় তুচ্ছ করেছি উচ্চে তুলেছি মাথা
আর কেহ নয়, জেনেছি মোরাই মোদের পরিত্রাতা ||
করিব অথবা মরিব এ পণ, ভরিয়া তুলেছে ভারত ভুবন,
স্বপ্নের মাঝে শুনিতেছি যেন স্বাধীন ভারত-গাথা |
জয় জয় জয় ভারতের জয়, জয়তু ভারত-মাতা ||
শুনিতেছি নাকি শৃঙ্খল ওই ভাঙিতেছে খান খান,
মুক্তি-কেতন উড়িছে আকাশে তারি বন্দনা গান,
করিব অথবা মরিব এ পণ, ভরিয়া তুলেছে ভারত ভুবন,
লক্ষ প্রাণের বলি-বেদীমূলে নূতন আসন পাতা |
জয় জয় জয় ভারতের জয়, জয়তু ভারত-মাতা ||

.              **********************     
.                                                                              
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
শোনিত অর্ঘ্যে ভারতের মাটি করিয়া
রচনা --- সজনীকান্ত দাস
সুর   ---- সুকৃতি সেন
শিল্পী  ---  সুকৃতি সেন ও গৌরী সেন, ১৯৪৭

শোনিত অর্ঘ্যে ভারতের মাটি করিয়া
.                           লাল |
মরণের পারে যাহারা গিয়াছে মা’র
.                           দুলাল ||
.                 তাঁহারা মোদের প্রণাম নাও,
.                 তাঁহারা মোদের আশিস দাও,
বক্ষে বক্ষে সাড়া দাও তুলে ‘জাগো
.                           হল সকাল’ ||
বিদেশী শাসন, মোহ বন্ধন----হল
.                            শিথিল,
শুরু হইয়াছে পথে পথে হের ভুখা
.                            মিছিল |
.         তোমরা দাঁড়াও সমুখে আসি’
.         যুগান্তরের জড়তা নাশি
মানুষ করিয়া তোলো তাহাদের
.         ভয়ে যারা হ’ল ভীরুর পাল |

.              **********************     
.                                                                              
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
চক্রশোভিত উড়ে নিশান
রচনা --- সজনীকান্ত দাস
সুর  ও শিল্পী  --- সুকৃতি সেন ,১৯৪৮

চক্রশোভিত উড়ে নিশান
নব ভারতের বাজে বিষাণ
কে আছ কোথায় ছুটে এসো সবে
.           জ্ঞানি ও কর্মী ধনী কিষাণ |
পনেরো আগস্ট পুণ্য দিন
প্রাচীন ভারতে জাগে নবীন
হেরো তিনরঙা পতাকার তলে
.           মিলিত হিন্দু মুসলমান ||
নতুন যাত্রা শুরু এবার
মিলেছে সুযোগ জনসেবার
মৃত্যুসাধনা সফল হয়েছে
.            গাই সবে মিলি জীবনগান ||

.              **********************     
.                                                                              
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
বিভেদ রক্ত-সায়র মাঝারে
রচনা --- সজনীকান্ত দাস
সুর   ---- সুকৃতি সেন
শিল্পী  ---  জগন্ময় মিত্র, ১৯৪৭

বিভেদ রক্ত-সায়র মাঝারে
.         মিলনের শ্বেত এ শতদল
ফুটিয়া উঠল পুণ্যে যাঁহার
.         তাঁর নাম কভু নয় বিফল |
মহাত্মাজীকে করি প্রণাম
মুখে মুখে লই গান্ধীনাম
ভারতমাতার সন্তান মোরা এক আজ
.                      নাই দুইটি দল ||
হানাহানি ভুলে কোলাকুলি করি
.         মনে মনে ভাবি চমত্কার
তাঁহারে স্বতই নতি করে মন
.         অহিংসা প্রেম মন্ত্র যাঁর ;
.          জয় জয় জয় গান্ধিনাম
.         মহাত্মাজীরে করি প্রণাম
পথে পথে তাঁর শোনো জয়গান
.         বিদীর্ণ করে গগনতল ||

.          **********************     
.                                                                              
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
নেতাজী সুভাষচন্দ্র সে তুমি
রচনা --- সজনীকান্ত দাস
সুর ও শিল্পী ---সুকৃতি সেন , ১৯৪৮

নেতাজী সুভাষচন্দ্র সে তুমি
.          দুলাল বাংলা মার
তোমারি আঘাতে কারার দুয়ার
.          টুটিল অকস্মাৎ
স্বাধীন ভারত বক্ষে তোমার
.          নির্ভীক পদাঘাত
নিজেরে করিয়া অকাতরে দান
তুমি গেয়ে গেলে জয় হিন্দ্ গান
দিয়ে দিল্লীর পথ সন্ধান
.          লাগালে চমত্কার
জয়তু নেতাজী সুভাষচন্দ্র
.          দুলাল বাংলা মা’র ||

.          **********************     
.                                                                              
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*
মঠমন্দির মসজিদ চূড়া
রচনা --- সজনীকান্ত দাস
সুর ও শিল্পী  --- সুকৃতি সেন  ১৯৪৯

মঠমন্দির মসজিদ চূড়া
.            ঢেকেছে এ সারা ভারতটাই |
মানুষ, দেশের দুঃখী মানুষ
.            বলত মোদের কোথায় ঠাঁই ?
আমাদের মাঝে রক্তের নদী বহে প্রখর
সাম্প্রদায়িক ধর্ম ভীষণ ভয়ঙ্কর
এপারে ওপারে করে আছে ভীড়
মানুষ কোথায় বাঁধে বল নীড়
উর্ধে শূন্যে মাটি আর জলে
.             আশ্রয় তার কোথাও নাই |
মানুষ এখানে অশুচি হয়েছে
.             পবিত্র হেথা মাটি পাথর
জন্মের গুণে কেউ উঁচু শির
.             সেই দোষে কেউ ভয়কাতর
আচার ধর্ম রুদ্ধ করেছে চলার পথ
মানুষে মানুষে প্রেম ভালোবাসা
.              তার চেয়ে বড় শাস্ত্রের ভাষা
অন্ধ গোঁড়ামি-মাহাত্ম্য, বুকে
.              কঠিন আঘাত হানিছে তাই |

.            **********************     
.                                                                              
সূচিতে . . .    


মিলনসাগর
*