কবি সমর সেনের কবিতা
*
ঘরে বাইরে
কবি সমর সেন

তোমার ক্লান্ত ঊরুতে একদিন এসেছিল
কামনার বিশাল ইশারা !
ট্যাঁকেতে টাকা নেই,
রঙিন গণিকার দিন হল শেষ,
আজ জীবনের কুঁজ দেখি তোমার গর্ভে,
সেইদিন লুপ্ত হোক, যেদিন পুরুষ পৃথিবীতে আসে !
সময়ের চূর্ণ পাহাড়ে পিঙ্গল মানুষেরা মরে,
কর্কশ কাকের কন্ঠে শুনি ধ্বংসের গান,
আর গর্ভের ঘুমন্ত তপোবনে কৃষ্ণবর্ণ পুরুষ
তোমাকে নিরন্তর কাপুরুষ প্রহার করে ;
সেইদিন লুপ্ত হোক যেদিন মানুষ পৃথিবীতে আসে !

কোনো নগরে একদিন যেন ছিল
চারদিকে মেখলার মতো শালবনের অন্ধকার,
পাহাড়ের মতো মেঘবর্ণ প্রাসাদ, স্বয়ম্বরা প্রেম ;
আর আজো তো আছে
কাঁচা ডিম খেয়ে প্রতিদিন দুপুরে ঘুম,
স্ফীতোদর দাম্ভিক স্বামীর পিছনে গর্ভবতী সতী সাবিত্রী,
আর বন্যার মতো পুত্রকন্যা, অরণ্যে রোদন ;
হে ঈশ্বর  এ কী অপরূপ !

অনুর্বর বালুর উপরে
কর্কশ কাকেরা করে ধ্বংসের গান |

কাঁচা ডিম খেয়ে প্রতিদিন দুপুরে ঘুম,
নারীধর্ষণের ইতিহাস
পেস্তাচেরা চোখ মেলে প্রতিদিন পড়া
দৈনিক পত্রিকায় |

আর মধ্যএশিয়ার মরুভূমি, নীল-কার্জন সমুদ্র,
বিপুল পৃথিবী আর নিরবধি কাল !

তবু কিছুদূরে প্রখর রৌদ্রে ঘোরে
মহাযুদ্ধের ভগ্নদূত,
আর নীলরক্তবান নীলকর কবন্ধ মৃত্যু আনে |
জানি রক্তহীন অন্তরে প্রতিদিন বারে বারে আসে
ফুটবল মাঠের চঞ্চলতা,
অষ্টপ্রহর কাঁপে
ভদ্রমহিলা দেখার তীব্র ব্যাকুলতা
আর মাঝে মাঝে উদ্যত যমদূত ক্লান্ত হতাশা আঁকে
দিন রাত্রির নরকের সিংহদ্বারে |

তবু জানি, কালের গলিত গর্ভ থেকে বিপ্লবের ধাত্রী
যুগে যুগে নতুন জন্ম আনে,
তবু জানি,
জটিল অন্ধকার একদিন জীর্ণ হবে চূর্ণ হবে ভস্ম হবে

আকাশগঙ্গা আবার পৃথিবীতে নামবে
ততদিন
ততদিন নারীধর্ষণের ইতিহাস
পেস্তাচেরা চোখ মেলে শেষহীন পড়া
অন্ধকূপে স্তব্ধ ইঁদুরের মতো,
ততদিন গর্ভের ঘুমন্ত তপোবনে
বণিকের মাণদন্ডের  পিঙ্গল প্রহার |

.           ******************     
.                                                                              
সূচিতে . . .     


মিলনসাগর
*
সন্ধ্যা ও প্রভাত
কবি সমর সেন

শুধু জনহীন চৌরঙ্গীতে পাথরের মূর্তি,
খনির আগুনে সূর্যাস্ত আসে |

পরদিন
লাল জীবনের জাল সঙ্কীর্ণ আকাশে ;
শহরের প্রখর সকালে
দূরে শবযাত্রার প্রতিধ্বনি
হৃৎপিন্ডে মুহূর্তের মৌনতা আনে ;
জীবিকার স্রোতে ভেসে যায় জীবন যৌবন,
আশেপাশে ব্যর্থতায় চিরকাল মৃত্যু আসে আর যায় |

আজ বহুদিন তুষার স্তব্ধতার পর
পর্বত চাহিল হতে বৈশাখের নিরুদ্দেশ মেঘ |
তাই বসন্তের কার্জন পার্কে
বর্ষার সিক্ত পশুর মতো স্তব্ধ ব’সে
বক্রদেহ নায়কের দল
বিগলিত বিষণ্ণতায় ক্ষুরধার স্বপ্ন দেখে ;
ময়দানে নষ্টনীড় মানুষের দল |
ফরাসী ছবির আমন্ত্রণে, ফিটনের ইঙ্গিতে আহ্বানে
খনির আগুনে রক্তমেঘে সূর্যাস্ত এল |

.           ******************     
.                                                                              
সূচিতে . . .     


মিলনসাগর
*
নিঃশব্দতার ছন্দ
কবি সমর সেন

স্তব্ধরাত্রে কেন তুমি বাইরে যাও ?
আকাশে চাঁদ নেই, আকাশ অন্ধকার,
বিশাল অন্ধকারে শুধু একটি তারা কাঁপে,
হাওয়ায় কাঁপে শুধু একটি তারা |

কেন তুমি বাইরে যাও স্তব্ধরাত্রে
আমাকে একলা ফেলে ?
কেন তুমি চেয়ে থাক ভাষাহীন,  নিঃশব্দ পাথরের মতো ?
বাতাসে গাছের পাতা নড়ে,
আর দেবদারুগাছের পিছনে তারাটি কাঁপে আর কাঁপে ;
আমাকে কেন ছেড়ে যাও
মিলনের মুহূর্ত হতে বিরহের স্তব্ধতায় ?

মাঝে মাঝে চকিতে যেন অনুভব করি
তোমার নিঃশব্দতার ছন্দ :
সহসা বুঝিতে পারি ----
দিনের পর কেন রাত আসে
আর তারারা কাঁপে আপন মনে,
কেন অন্ধকারে
মাটির পৃথিবীতে আসে  সবুজ প্রাণ;
চপল, তীব্র, নিঃশব্দ প্রাণ---
বুঝতে পারি কেন
স্তব্ধ অর্ধরাত্রে আমাকে তুমি ছেড়ে যাও
মিলনের মুহূর্ত থেকে বিরহের স্তব্ধতায় |

.           ******************     
.                                                                              
সূচিতে . . .     


মিলনসাগর
*
নষ্টনীড়
কবি সমর সেন

বুদোয়ার ঝোড়ো হাওয়া দিনরাত্রি উচ্ছল,
গ্রীষ্মে পিচ গলে ; অকস্মাৎ বর্ষা নামে |
তারপর শরৎ, মহৎ নীল আকাশ অখন্ড প্রতীক্ষায় স্তব্ধ |
ধানক্ষেতে হেমন্তের ঈষৎ-বিষণ্ণ হাত, দূর গ্রামে কুয়াশা |
বাঙলার ঘরে ঘরে গুপ্তচর এ জিজ্ঞাসা ;
এত সবুজ বাসা ! ভিটে ভাঙার পালা কি এল এবার ?

তোমার পাখি এসে ডাকে
আমার বাগানে,
সূর্য ওঠে, হলুদ আলো সবুজ ধানে----
কিন্তু দুর্দিন এল,  কী দুর্দিন এল |
মেঘে মেঘে অন্ধকার, ঝড়বৃষ্টি, বিদ্যুৎহুঙ্কার.
এ কী আকাশ,
ভয়াল ভবিতব্যতায় ঘোর আকাশের
শাক্ত গোধূলিতে
ভয়ঙ্কর মন্দিরে দিগম্বরী কালী,
শবাসনে তান্ত্রিকেরা স্তব্ধ,
দিনের ভাগাড়ে নামে রাত্রের শকুন |

নষ্টনীড় পাখি কাঁদে আমাদের গ্রামে
রক্তমাখা হাড় দেখি সাজানো বাগানে |

.           ******************     
.                                                                              
সূচিতে . . .     


মিলনসাগর
*
জয়হিন্দ
কবি সমর সেন
                
দক্ষিণপূর্ব এশিয়ার মালিকেরা ফের বেঁধেছে ঘাঁটি;
বৈষ্ণবী বিনয়ে ইংরেজ বসেছে বর্মায়,
ফরাসীরা প্রত্যাগত ইন্দোচীনে,
গোলন্দাজহীন ওলন্দাজ ঘোরে যবদ্বীপে |
ভারতের স্বাধীনতা আসন্নপ্রায় |

বম্বেতে দিন রেখে গেল বারুদের গন্ধ .
রাস্তায় রক্তের ছিটে |
বন্দুকের খর শব্দ থামলে শহরে
বিপ্লবী নেতারা জমে বক্তৃতার মাঠে,
সর্দারের ধমকে পার্কের পার্কের রেলিং কাঁপে ,
হয়তো কৃত পাপের লজ্জা জাগে
মর্গে জমা দুশো সত্তরটা লাসে |
ধোঁকায় জব্দ জাহাজেরা বন্দরে স্তব্ধ,
মাঝে মাঝে উদ্যত সঙিন, সাম্রাজ্যের উদ্ধত প্রতীক |

আমাদের স্বাধীনতা আসন্নপ্রায়,
মন্ত্রীসভার বিলিতী দুতেরা আগতপ্রায়,
জয় হিন্দ |

.           ******************     
.                                                                              
সূচিতে . . .     


মিলনসাগর
*
বকধার্মিক
কবি সমর সেন

নবাবী আমল শুধু সূর্যাস্তের সোনা |
ব্যবসায়ী সংসার
বারে বারে পাকা ধানে মই দিল,
চোখ বেঁধে আজ ভবের খেলায় ভাসা !
তবু তো চারিধারে অদৃশ্য ধ্বংসের গ্লেসিয়ার |

নকল দুঃস্বপ্নে আর কতকাল কাটাই,
সামুদ্রিক মাছের তেলে শরীর বৃদ্ধি ;
শীতের কুয়াশায়, নদীর নরম হাওয়ায়
নিজেরই গোলকধাঁধার মন অবিরত ঘোরে;
মনে পড়ে
কিছু দূর দেশে দিগন্তে লোহিত সূর্য
কুয়াশায় ঝাপটা পাহাড়
লাল পথে কালো সাঁওতাল মেয়ে |
আবার আড়চোখে চেয়ে দেখি আমার মানস পৃথিবীতে
বিরোধের বীজ পুঁজি, কত স্বর্ণবণিক ঢোকে,
কি অপরূপ প্রশান্তি মুখে !
এরোপ্লেনের চঞ্চল বেগ হাওয়ায় ওড়ায় |
বকমুখ মন্ত্রীর নাম |
গাত্রদাহ শুধু নিষ্ফল আক্রোশ |
সখি, শেষে কি গেরুয়া বসন অঙ্গেতে ধ’রে
ব্রহ্মচারী বেশে পন্ডিচেরী যাব!----
সকালে হাওয়া খেতে নদী সৈকতে আসি,
যদি দেখি
ফেরি স্টিমার ওপারে, হাওড়ার পোল তোলা,
বসে থাকি বিষণ্ণ মুখে !

সন্ধ্যায় ভিড়াক্রান্ত মন্দিরে কাঁসর ঘন্টা
দেবতারও চোখে অনিদ্রা আনে,
পূজার পচা ফলে ফুলে পিচ্ছিল পথে
রক্তচক্ষু পুরোহিত হাঁকে,
হাঁকে জগদ্দল বৃষভ |
কালসন্ধ্যার এই কুটির লগ্নে
রাস্তায় হাসির গর্ রায় ঘোরে তুখোড় ইয়ারের দল,
রেস্তহীন গুলিখোর, গেঁজেল, মাতাল ;
অবশেষে শূন্যের সরাইখানায়
ভ্রাম্যমাণ বিলোল দিন অদৃশ্য হয়,
পিছনে রেখে যায় শুধু কারণের গন্ধ,
কয়েক প্রহরের নিশাচর শান্তি |
আবার ব্রাহ্মমুহূর্তে
চিত্পুরের বারান্দায় কোকিল ডাকে,
অলস হাই তোলে বেকার কুকুর |
দেবনখরে লোলচর্ম , পীত চোখ
ক্রমে ক্রমে গঙ্গাতীরে নিরানন্দ নারীদল জমে |

.           ******************     
.                                                                              
সূচিতে . . .     


মিলনসাগর
*
মদনভস্মের প্রার্থনা
কবি সমর সেন

মাস্তুলের দীর্ঘ রেখা দিগন্তে
জাহাজের অদ্ভুত শব্দ,
দূর সমুদ্র থেকে ভেসে ভেসে আসে
বিষণ্ণ নাবিকের গান |
সমস্ত দিন কাটে দুঃস্বপ্নের মতো ;
রাত্রে নিবিড় প্রেম : কুসুমের কারাগার |
কত দিন, কত মন্থর, দীর্ঘ দিন,
কত গোধূলি-মদির অন্ধকার,
কত মধুরাতি রভসে গোঙায়নু,
আজ মৃত্যুলোকে দাও প্রাণ
দূর সমুদ্র থেকে ভেসে আসে
বিষণ্ণ নাবিকের গান |

.           ******************     
.                                                                              
সূচিতে . . .     


মিলনসাগর
*
একমাত্র তোমাকে সত্য বলে মানি
কবি সমর সেন

এক মাত্র তোমাকে সত্য বলে মানি |
দারুণ গ্রীষ্মে অভীপ্সা-ব্যাকুল মন
তোমার আদেশে শহরের দিগ্বিজয়ে ঘোরে
তোমার আদেশে সন্ন্যাসীর সাধনা-সঙিন দিনগুলি
যুবতী-সঙ্কুল আসরে
সান্ধ্য-সঙ্গীতে সংহত |
প্রভু, পৃথিবীতে তোমার লীলা অবিরাম,
এ্যাসেম্ ব্লি-হলে বিরহছলে মিলনে আনো,
প্রবীণ কবির মুখে আবার আনো
স্বদেশী গান |

রাত্রির দূষিত রক্তে বিকলাঙ্গ দিনের প্রসবে
আমাদের তন্দ্রা ভাঙে ;
তারপর আকাশ ভারি হয়ে ওঠে,
বিরস কাজের সুরে
কতদিনের ক্লান্তিতে কলের বাঁশি বাজে ;
পিছনে সমস্তক্ষণ ক্ষিপ্রগতি বাসের শব্দ |

পৃথিবীর কবিতার শেষ নেই :
দিনের ভাটার শেষে
গলিত অন্ধকারে মরা মাঠ ধূ ধূ করে,
চরাচরে মরা দিনের ছায়া পড়ে |
উদ্দাম নদীতে শেষ খেয়া নেই,
শিকারী কীট সোনার ধানে |
তাই বঙ্কিম ব্রহ্ম যীশু পরমহংস
সময় যখন আসে তখন সকলি মানি,
দুর্গম দিন,
নামহীন অশান্তিতে বিচলিত বুদ্ধি,
তবু সরল চরম কথাটি এই বলে মানি
ভারি ট্যাঁক ছাড়া কিছুই টেকে না,
সবার উপরে আমিই সত্য
তার উপরে নেই |

.      ******************     
.                                                                              
সূচিতে . . .     


মিলনসাগর