কবি সামসুল হক-এর কবিতা
*
স্নানার্থী
কবি সামসুল হক

রাত হলেই আমার কবিতাগুলো একে-অপরকে ধ্বংস করতে চায়
আমার কিছু করার থাকে না
খাদ্যহীন প্রাণীর মতো তারা ছন্দ ও অলঙ্কার ভুলে যায়

অথচ দিনের বেলা নিষাদ ও বাল্মীকিকে প্রতিষ্ঠাহীন করতে চেয়েছিল


আর-একটু বেশি রাতে
কবিতার ধ্বংসস্তূপের উপর স্বাতিনক্ষত্রের একফোঁটা অশ্রু ঝরে পড়ে
আমার কিছুই করার থাকে না
শুধু এক গর্ভবতী উলঙ্গ পাগলি-ভিখারিনির কথা মনে আসে


কাল ভোরবেলা তমসানদীতে আবার স্নান করতে যাব

.                   *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
একই তরবারি
কবি সামসুল হক

কেন ওই একই তরবারি দিয়ে সুন্দরকে জাগাতে হয় প্রতিদিন
কেন প্রতিদিন ওই একই জ্যোত্স্নার পাথর গলায় বেঁধে দিয়ে
অন্ধ ভিখারিনিকে
লালদিঘির জলে নামতে হয়

রামমোহনের স্ত্রীকে কেন
প্রতিদিন সহমরণে যেতে হয়
“ঈশা বাস্যমিদং সর্বম্”-এর চিতায়

আজ সারাদিন জেলখানার গেটের সামনেএকটা আর্ষ শেকড় পড়ে আছে
ন্যাশনাল লাইবেরোরি থেকে ফেরার সময় তুমি কি দেখতে পেয়েছ
তুমি দেখে এসো অপর্ণা

আর ওই দেখ
ক্লিওপেট্রার হাত ধরে সুরদাস অমরনাথের পথে চলেছেন
আর বাঁকুড়ার ঘোড়া দেখে
লক্ষ্মণ সেন ক্রোচেকে সঙ্গে নিয়ে পালাচ্ছেন
এই আষাঢ়েও বাঁকুড়া-পুরুলিয়ায় বৃষ্টি নেই

কেন ওই একই তরবারি হাতে নিয়ে ওদেরও
শ্মশান ও ক্যাথিড্রালের প্রহরায় থাকতে হয় প্রতিদিন

.                   *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
এইবেলা
কবি সামসুল হক

নিজের অনুগত প্রজাকে কেন ওরা মাথায় রোদ্দুর বৃষ্টি
শহর নিঙড়িয়ে বলে না কেন                এই বন্দী আমাদের প্রাণেশ্বর
প্রাণেশ্বর মহাশিশ্ন ছিঁড়ে বলে                তোমার মন নাই কুসুম
ওদিকে স্টেডিয়ামে ঢুকছে পুলিশেরা বিমুঢ় সরোদিয়া আমজাদ
প্রতিমা ধসে পড়ে ভূগোল খসে পড়ে স্টিমার ঠেকে গেছে ব্রীজে
দয়াল এইবেলা চোদ্দ ইন্দ্রিয় চূর্ণ করে দিয়ে যা

.                   *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
অর্বাচীন উপনিষদ্
কবি সামসুল হক

আগুন পুড়িয়ে দেয় সবকিছু        শুধু
আগুনকে পোড়াতে পারে না
আগুন হয়ে যা তুই তবে

ব্রহ্মবীদ্ লজ্জা ঢাকে ব্রহ্মের পল্লবে

বাতাস উড়িয়ে দেয় সবকিছু        শুধু
বাতাসকে ওড়াতে পারে না
বাতাস হয়ে যা তবে তুই

ব্রহ্মের বাতাসে ঘর বেঁধেছে বাবুই

ব্রহ্মবীদ্ লজ্জা ঢাকে ব্রহ্মের পল্লবে
সে সময় মানুষের আত্মা এসে ঢুকে যায়
.                        কবিতার শবে

ব্রহ্মের বাতাসে ঘর বেঁধেছে বাবুই
সে সময় কবিতার পঙ্ক্তি থেকে উড়ে যায়
.                        সোনার ত্রিশূলে গড়া উই

.            *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
টায়ার অব সাইলেন্স
কবি সামসুল হক

রাম কি ? বোধহয় শ্যাম,
যদুর মতোই শুয়ে আছে।
ফুল
এক ঠোক্কোরে একটা চোখ তুলে নেয়,
চাঁদ
এক খাবলায় আরেকটা ;
শ্যামা আর ঝাউবীথি
নাক
প্রথম-বৃষ্টির নোখে লটকে থাকে ;
হাত-দুটো
টানাটানি করে কবিতা,
আর পা-দুটো
মাটি।

.       *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
খোকা ভাত খাবি আয়
কবি সামসুল হক

অর্ধেক আকাশ গ্রামকে দান করে বাকি অর্ধেক নদীকে দেবে ব’লে নিজের
.                                        অধিকারে রেখেছে পূর্ণিমা
বুনো কচুপাতায় চারফোঁটা শব্দ টলটল করতে-করতে ঘাসের ঠোঁটে
.                                                ভেঙে পড়লো
বাতাস মেলায় তার সর্বস্ব দান ক’রে একবস্ত্রে ফিরে যাচ্ছে ওই
শুধু সরস্বতী নদী থেকে উড়ে-আসা একটা ছায়া কান পেতে ঠায় দাঁড়িয়ে আছে
কে কখন কাকে বলবে খোকা ভাত খাবি আয়

পূর্ণিমা শব্দ বাতাস ছায়া ওসব কিছুই নয় বর্ণমালার মতেন খুব ভুল
গ্রাম নদীর ভিতর সারাদিন খেলা করে শব্দ সারারাত ঘাসের উপর ঘোড়া চড়ায়
বাতাস মেলায় গিয়েছিল শুধু নাগা-সন্ন্যাসীর পায়ের তলায় ঘুমিয়ে
.                                                পড়বে ব’লে
মায়ের মুখাগ্নি করার সময় একটি শিশুর ঠোঁটে শুধু সরস্বতী ফুটে উঠেছিলো
কেউ কাউকে কখনও বলে নি খোকা ভাত খাবি আয়

এসব জেনেও ভিখিরি-বালকের বালকের গলা থেকে ঝ’রে পড়ার লোভে এর নিষাদ
ক্রৌঞ্চ-ক্রৌঞ্চীর দিকে নিজের গার্হস্থ্য ছুঁড়েছিলো
একটা পাখি উড়ে যায় ভিখিরি-বালকে গলা খুলে দিতে একটাকেই নিতে
.                                                হয় সম্পূর্ণ আকাশ
আর ওই নিষাদ বহুক্ষণ নিজের স্বরলিপির দিকে তাকিয়ে থেকে পিছন
.                                                ফিরে হাঁটতে থাকে
সেও কি গ্রামের মতো খেলেছিলো পূর্ণিমার নদীর তলায় একা-একা
গৃহহীন পুত্রের মুখাগ্নি করার সময় তার ঠোঁটেও কি সরস্বতী ফুটে উঠেছিল
কেউ জানে না ওই ক্ষত্রিয় পুরুষ যাজ্ঞক কৃষকরমণী
ওদের কাছেও তো ভিখিরি-বালককে পাঠাবার কথা ছিলো তার

ওই নিষাদ তার ঘাতক বীণায় টঙ্কার তুলে নিজের পাথুরে বুকের ঘোর
.                                কাছাকাছি মুখ নিয়ে চেঁচিয়ে ওঠে
.                খোকা ভাত খাবি আয়
আর সে এই প্রথম স্পষ্ট শুনতে পায়কে যেন তাকেই চারফোঁটা টলটল
.                                শব্দে গোপন দূর থেকে বলছে

.                খোকা ভাত খাবি আয়
আর হঠাৎ ক্ষত্রিয়পুরুষ যাজ্ঞিক কৃষক রমণীর সামনে ভিখিরি-বালক এসে পড়ে

.                           *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
শীতের ছড়া
কবি সামসুল হক

ইঁদুর বললো, কাঁপছি শীতে
নেই তো আমার কাছে ভিতে
লেপ-কাঁথা তোশোক।
বেড়াল বললো ভাবনা কী তোর ?
আমার গরম পেটের ভিতর
সুড়ুৎ করে ঢোক।

পেঁচা বললো, হুতুম হুতুম
আমি থাকতে কে তোর কুটুম
আমি যে তোর কাকা,
ঈঁদুরমণি শীত তাড়াতে
চলে এসো ঘরের ছাতে
পেটটা আমার ফাঁকা।

.    *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
তবু খুশি
কবি সামসুল হক
(কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত কাব্য সংকলন “ব্রাত্য পদাবলী” থেকে)

হাট্টি মাটিমটিম
ডিম পাড়ে না মাঠে
পেয়েছে কুট্টিম
হাভাতে সম্রাটের

হাট্টিমাট্মহাট্টি
শিং নেই তার খাড়া
ঘাস জোটে না চাট্টি
উল্টে ষাঁড়ের তাড়া

তবু খুশি হাট্টিমা
জন্মেছে এই দেশে
শুধু শ্মশান ঘাটটি মা
থাকুক রাজার বেশে

.    *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
গণতন্ত্র
কবি সামসুল হক
(কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত কাব্য সংকলন “ব্রাত্য পদাবলী” থেকে)

রামান আছে মশা নেই
ঘামান মাথা মন্ত্রী
পালিয়ে গেছে শ্মশানেই
সব অগণতন্ত্রী

মশা আছে কামান নেই
মাথা ঘামান মন্ত্রী
কামানরা কাৎ সামান্যেই
ধিক্ অগণতন্ত্রী

মশা আছে কামান আছে
মন্ত্রী ভোলেন মন্ত্র
কোনটা দিয়ে কোনটা মারি
রাবিশ গণতন্ত্র

.    *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
মাছি
কবি সামসুল হক
(কবি বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত কাব্য সংকলন “ব্রাত্য পদাবলী” থেকে)

ঘর করেছি ত্যাগ
মাথার উপর ম্যাঘ
ম্যাঘের বউ রাঁড়ী
যায় পুলিশের ফাঁড়ি
ফাঁড়ির লঙ্কা ধানি
ক্ষেতে নামলো পানি
পানির ব্যাটা হাঁটে
ধান বুনলো মাঠে
ধান দিয়েছে ভাত
এবার ধোবো হাত
ভাতে পড়লো মাছি
কোদাল দিয়ে চাঁচি।

.    *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর