কবি সঞ্জয় ভট্টাচার্যের কবিতা
*
পরিবেশ
কবি সঞ্জয় ভট্টাচার্য

প্রাচীন এ-দৃশ্যপট :
প্রত্যহ সমুদ্র-শব্দে জাগে সমতট,
অরণ্যে সবুজ দিন আসে,
রাত্রিরা তারায় তীব্র আদিম আকাশে |
কোনো এক প্রাগৈতিহাসিক
ভাদ্রের পদ্মায় আজও দেখে গেল রৌদ্রের ঝিলিক---
দিগন্তে মেঘের ছবি অদ্ভুত রেখায় আজও আছে---
কালো-নীলে রাঙা পাখি উড়ে যায়
এক বুনো গাছ থেকে আর এক গাছে---
এএক মুঠো ধান
দেয় ম্লান অঘ্রানের হাওয়ায় অপরিমেয় ঘ্রাণ |

এই দৃশ্যে আমরা নূতন---
আমরা নূতন অভিনেতা:
আমাদের সুপ্তি-জাগরণ
যেন অন্য কোনো দিনে,
আমাদের হাসি-অশ্রু-ব্যথা
শুধু নিতে পারে চিনে
অন্য কোনো সময়ের আকাশ-বাতাস |
এই নদি এই জল
সমতলে অলস ফসল
দূর হতে করে শুধু রূঢ় পরিহাস |

আমরা সমুদ্র চাই
যে-সমুদ্র নয় এ সুন্দবনের,
বন্দরের আলো আর
জাহাজের ইস্পাতী ছায়ায়
সে-সমুদ্র করে ঝলমল |
আমরা এসেছি নিয়ে মনে এক ধোঁয়াটে আকাশ
সেখানে পাখির পাখায়
ছবি নেই---এলুমিনিয়াম |
আমাদের ক্ষেত হতে মুছে গেছে বলদের চোখে
কোনো বিষন্ন দুপুর
সেখানে লোহার দাঁত---
গভীর লোহার দাগ
গ্রাম ছেড়ে একদিন শেষে
পৃথিবীর দিকপ্রান্তে মেশে ||

.    *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
গেহিনীর জন্যে
কবি সঞ্জয় ভট্টাচার্য

দেবে কি আমাকে তুমি তৃতীয় নয়ন
পারো যদি দিতে তবে ভীরু পলায়ন
জীবনের জনপদ থেকে দূরে যাবে,
তুমিই আবার এসে তেমন সাজাবে
এই ভাঙা হাটের হৃদয়, পলে পলে
তবেই তো বিপণিতে একে একে জ্ব’লে
উঠবে বিদ্যুৎ-বাতি, তখন এ-মন
উপাসনাময়, তার কত আয়োজন
জনসমাগম হবে ব’লে--- থরে থরে
এনেছি, দেখবে, ঘরে দুই হাত ভ’রে
সিবাসিত বেল-জুঁই, মধুফল কত
অনাবিল অপরূপ নিটেল অক্ষত,
দিয়ে যাই অকাতরে উপহার আমি
যার কিছু নেই, কিছু ছিলা না বেনামি
যে কেবল, যাযাবর পথে এতদিন,
উত্তর-পাহাড় থেকে সমুদ্র-দক্ষিণ
ঘুরে-ঘুরে দিশেহারা পাখির মতন,
শুধু বাকি আছে যার এ মাহেন্দ্রক্ষণ
তোমা হৃদয়-দ্বারে, কিছু নয় বেশি---
তোমারও তো আসতেই হোতো শেষাশেষি
এই ফথে তাই আজ বলি অনুরোধে :
(পুরাতন ঋণে যাব পুরো ঋণ-শোধে)
ভুলে যাও ভুল, পাপপুণ্য, অভিমান
তাকাও প্রাণের দিকে, চাই এই দান,
আমার কপালে শুধু কাজলের আঁকে
অবিকল চোখ এঁকে দাও, যেন থাকে
তাতে স্বচ্ছ জল তবু দেখার ক্ষমতা,
কারণে ও অকারণে মন সোমলতা
বলে যেন চিনে নেয় তোমারে আবার,
যেন দেখি বারবার তুমিই আমার
ছিলে শিল্পী, স্বপ্না, নিদ্রা, বিস্মৃতি, শয়ন,
দাও যাদুকরী সেই তৃতীয় নয়ন!

.
        *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
ইন্দ্রাজা
কবি সঞ্জয় ভট্টাচার্য

যত নদী ছিল যত পাহাড়ের চূড়া থেকে খসা,
যত না হ্রদের হৃৎপিণ্ড-জোড়া নাড়ী,
স্ফটিক, লোহিত, নীল, দুধ-সাদা তুষাড়ের কণা,
মনে এনে সব-কিছু ডাকলাম কাকে তাড়াতাড়ি,
যেতে হবে ব’লে --- কাকে ডাকি ?

যত দিক ছিল চোখে গণিতের মতো,
আকাশের দৃকে নীহারিকা---ইতস্তত,
পাতালের ঝিরঝিরে বালুর সরণি---
চুল ছোঁয়া পায়ে দেওয়া বাসর-তরুণী
নামে ওঠে মনে --- সব ফাঁকি  |

সব ছেড়ে চ’লে যাওয়া এত চুপচাপ!
গেল তো কতই আরো, নেমে গেল সাপ
গরল-গমনে, স্মৃতি পলকের পরে নেই আর,
তেমন আমার যাত্রা সুপ্তির সমুদ্রে অনিবার,
পাই নে তোমায়, ফিরে আসি |

তুমিও তপস্যা ছেড়ে গেলে যদি, তৃষ্ণা রাখি কোথা!
দেবে আর কোন বুক আলাপন-স্রোতা
সুপানীয় বারিধারা কণ্ঠে নিতে ফের জন্মান্তরে ?
দেবে যদি বলে কেউ, ফিরি তবে ঘরে,
ফিরে তোমাকেই ভালোবাসি ||

.         *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
পাওনা ছুটি
কবি সঞ্জয় ভট্টাচার্য

স্বপ্নে নয় কোনো এক ছুটিতে পাব কি
হরিণের বন আমলকী
পাহাড়ে ঢালুতে গড়ানো |
কাছে জলা পদ্মগন্ধ গায়ে মেখে থাকে,
দূরের ওপার হতে ঝাউয়ের গানও
এসে শিরশির ক’রে ঢেউ দেবে বুকে |

মোটের উপর বটগাছের যৌতুকে
সে-দেশ সবুজ নয়, ডুমুরের কচি মুখ আঁকে
অনেক পুরোনো দিন অনেক পুরোনো ফলস্রুতি,
সেখানে কপোত-ভোর দ্বারে দ্বারে জাগার আকূতি
দিয়ে দুপুরে ঘুঘু-নিদালী ছড়ায় |

যে দূর-স্থানের কাল সুদূর জড়ায়
তার কাছে ছুটি-মনে খানিক সময়
ধার নিতে পারবে কি সময়ের বহু অপচয় ?
তুমি আমি সেইখানে---
(তুমি ছাড়া সে ছুটির নেই কোনো মানে |)
হয়তো গেলাম, পথে রাত্রি হয়ে গেল ;
“সকলি গরল ভেল”
মনে-মনে বলবে হৃদয়জ্যোত্স্নাআর হাওয়া যদি লেবুফুলে গন্ধ মেখে রয়
মনে হবে--- সে হাওয়া কি আমাদের মন ---
যে-মন প্রথম-জাগা সাপলার বন ?

.         *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
জার্নাল
কবি সঞ্জয় ভট্টাচার্য

বিকেলে

তোমার চোখের যত গান
তোমার কথার যত আলো
যেন ছোট ছোট অভিমান
এ-বিকেলে তোমায় ছড়ালো |

এ-বিকেল জানে তুমি ছিলে
যে-ভোরের তুমি সে জানে না
যেন শেষ বিদায়ের নীলে
তোমাতে আমাতে হয় চেনা ||


সন্ধ্যায়

সন্ধ্যা তার অন্ধকার-মন
রাত্রিতে পায় না তেমন
যেমন আমার দেহে পায় |
আকাশের রক্ত মুছে যায়,
আমার রক্তের ্ন্ধকার
রক্ত দেয় রাত্রি জানে, তার
জীবনের রহস্যের মানে,
ঘুমের শব্দের কানে-কানে ||

.   *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
রাজকন্যা
কবি সঞ্জয় ভট্টাচার্য

তোমার মুখের ভোর মনে পড়ে যখন ঘুমনো ছিলে---
তোমমার মুখের ভালোবাসা ছিল আকাশ-রাঙানো নীলে |
তোমাকে জাগাব সাধ্য ছিল না, সোনার রূপোর কাঠি
কোথায় পেতাম, তাই খুঁজে আজও তেপান্তরেই হাঁটি ||

.   *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
শূন্য মন্দিরে
কবি সঞ্জয় ভট্টাচার্য

রোজ আমি ডুবে যাই রাত্রিতে, রাত্রির অন্ধকারে |
রোজ আমি ভেসে উঠি রাত্রিতে, রাত্রির অন্ধকারে |
তারপর পারে, কেউ পারে ?
কে পারে দিনকে আর ভালোবাসা দিতে ?
উপরে যে ভেসে উঠলাম, তা-ই মনে পড়ে | শীতে
কখন যে ডুবে গিয়েছিলাম অতলে---
সেখানেও আলো ছিল কিনা তারামাছে
মনে করতে গিয়ে বারেবারে
উপরের তারাই তো ধু ধু মনে পড়ে! মনে আছে
শুধু নীল ঢেউ, তাও আকাশেরই জলে
কৃষ্ণা --- মিশে যায় উষা-অরুণার হাতে, তার নিকানোর কাজে---
প্রেমে, দেখি তকতকে মেঝের রক্তিমা, খালি ঘর |
তবু বিছানার ভাঁজে-ভাঁজে
আছে, ভাবি, সহজ, সুন্দর
তোমার চুলের ঢেউ | তুমিও চুলের রাত্রি ছিলে মনে পড়ে
নীল ঢেউয়ে, প্রেমে, জলপ্রভায়, প্রভাত-তক না-হারানো নদীর কাঁকরে ||

.   *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
আলো-অন্ধকারে কবিতা
কবি সঞ্জয় ভট্টাচার্য

সাহস হল না |
বস্তুত সাহসী নই রৌদ্রের মতন
খুব অন্ধকারে চলে যেতে |
যত কাছে এলে তুমি তত যেন বেশি অন্ধকার |
স্বচ্ছ করে দিয়ে যাব তোমাকে, তেমন
সাহস হল না |
ভীরু দীপ নিবে যাবে, ভয়ে---
চোখ অন্ধ হয়ে যাবে, ভয়ে---
একটি মুহূর্ত স্থির হয়ে যাবে, ভয়ে---
তোমাকে ছুঁতেই আর সাহস হল না |  

.  
     *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
জন্মাষ্টমী
কবি সঞ্জয় ভট্টাচার্য

জলে হাত রেখে বোঝা যায়
এই জলে ছিলেন ঈশ্বর |
জল নড়ে ওঠে জলে
তারপর হাতের ভেতর |
হাত বেয়ে সমস্ত শরীরে |
মনে হয় কবে যেন বৃষ্টি হয়েছিল |
জলে হাত রেখে বোঝা যায় ||

.       *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর
*
বন
কবি সঞ্জয় ভট্টাচার্য

হয়তো বা তুমি দেখনি কখনো গভীর বন
যেখানে লুকিয়ে আছে কবেকার রাতের ছায়া
এলান যেখানে আকাশের হিম-নয়ন নীল---
.        তেমন বন  |

যে স্বপনগুলি চোখ হতে রাতে হারিয়ে যায়
তারা কথা কয় বনের নরম লতার ফুলে :
তারা যেন লঘু পালকের মতো, বনের মেঘ ---
.        স্বপ্নগুলি |

হয়তো তখন তারা-ঝরে পড়া অনেক রাত
অলস বাতাস ঘুমায় হ্রদের জলের মতো
জাগায় চোখের পাতায় তখন ছোঁয়ায় ঘুম
.        বনের হিম |

যদি কোনদিন আকাশের তরে তোমার চুল
ভিজে ওঠে কালো নতুন মেঘের শীতল ডালে
দেখো ছুঁয়ে যাবে কতদূর হতে তোমার বুক
.        গভীর বন |

.     
      *************************  

.                                                                                          
সূচিতে . . .   


মিলনসাগর