দ্বৈরথ কবি সংযুক্তা বন্দ্যোপাধ্যায় (এই কবিতাটি সিঙ্গুর নন্দীগ্রাম আন্দোলন চলাকালীন, 'নন্দীগ্রাম থেকে কলিঙ্গনগর' কাব্য সংকলনে মে ২০০৭ তে প্রকাশিত হয়েছিল |)
ক্রোধ : মানো যা ঈশান কোণে ঘনায় ক্রোধ : মানে যা হলদি নদীর বাঁক ক্রোধের আগুন পুড়িয়ে দিল ঘর এবার তোরা শিল্পে বেঁচে থাক
ধানের চারা দোলে না এই দেশে এদেশ ভরা শিশুর লাশে লাশে কবন্ধেরা অস্ত্র চালায় শুধু ধাতুর নিচে নিহিত উল্লাসে
আমারও হাত নিশপিশিয়ে ওঠে আমার হাতে, একটি ধানের শিষ লাল পতাকা উড়িয়ে নিল হাওয়ায় ভয়ের মত বাঁচা অহর্নিশ
ভয় : মানে যা আবার ফিরে আসা ভয় : মানে যা হলদি নদীর বাঁকে প্রত্যাঘাত, ঘনিয়ে আসা মেঘ সব শেষে আর ভয় পাবে কে কাকে
মাঠের পশ্চিম কোণে ডান হাত তুলে দাঁড়িয়ে রয়েছেন চণ্ডী, আর তাঁর হাত থেকে ছিন্ন হয়ে ঝরে যাচ্ছে টুকরো খড়, পাথরের ফলা, সন্তানের মরা মুখ। ঘর বলে আজ আর চেনা যায় না কিছু, শুধু মাঝে মাঝে তাঁর এলোচুল বেঁধে নিতে সাধ হয়। সামান্য রমণী আঁচলে হলুদ-হাত মুছে নিয়ে গোপনে সংগ্রহ করে একটি-দুটি জবা, পরে ভুলে যায়। দেবী সেই বিস্মৃতিপরায়ণার শিয়রে দাঁড়ান ঘুম হয়ে, জবাকুসুমের তুল্য রাত্রি-রং পান করে প্রান্তরের মধ্যে মত্ত, একা।
মাঠের পশ্চিম কোণে দেবী নয়, সামান্য রমণী এক আঁচলে গুছিয়ে রাখে নষ্ট জবা, অনন্ত শূন্যতা।
শীতকাল এসে কবে চ’লে গোলো, এবারও সোয়েটার বোনা শেষ হলো না আমার। ভয়ঙ্কর এই দুপুর পোয়াতে পোয়াতে এখন দেখি, অনুতাপময় হাওয়া উড়ে যাচ্ছে সংকর বুগেনভেলিয়ার দামী পাপড়ি, রান্নাঘরের আটপৌড়ে ঝাঁজ, আর আমার সমস্ত দিন ; এমনি।
বুকে যে অস্পষ্ট ছুরির দাগ, তাকে ঢাকার জন্যে পশম কিনেছিলাম স্তরে স্তরে। আজ উড়ে যাচ্ছে তাদের আঁশ, ছোটবেলার প্রকৃতিবিজ্ঞানের পাতায় যারা জড়ো হয়েছিল। হঠাৎ মনে পড়ে যায় কাঁসাই, আর সেই একটুকরো-দেখা শাদা শিমুলো দেখি মনে পড়ছে আজ। সোজা-উল্টো ঘরতোলা জানতাম না তখন, বুঝে নিতে পারিনি লজেন্সের গন্ধভরা বোতামশৃঙ্খলা, আজকের ঘোর দুপুরে সেইসব শিক্ষাহীনতা নতমুখ ঘোরে ফেরে। ভেতরে ভেতরে আজ টের পাই শাদা শিমুলের ফুল, গভীর ক্ষরণ . . .
বুকে যে ছুরিকাঘাত ছিলো, এবার শীতেও তাকে ছুঁয়ে রইলো অবহেলা, সোয়েটার বিহীন।
ও আগুন, ঢেকে রাখো। ঢাকো মুখ এখনও জীবিত এ-দেশে আমার মুখে নেকাব ছিল না অন্ধভাবে মাথা তুলে ঘুরে বেড়াতাম কালো মথ আর তখন অন্ধকার লকলকে জিভ দিয়ে তাড়া ক’রে ফিরেছে . আমায়
ও আগুন, রাস্তা দাও। যে-রাস্তায় আমার খসম কথা বলতে না-পারা বাচ্চারা ঘরে গেছে আমিও এবার যাই। ঘর মানে যা ক্যাম্প সেখানে সাকিনা নয়, যদি ফুটে ওঠে এক আশমানতারা
হ্যাঁ আগুন, অন্য জন্ম না থাকলেও ধর্ষণের পর আবার, আবার আমি দেখতে পাচ্ছি সেই সব ঊরু ঝলসে-ওঠা ছোরা আর অঢেল টোটার গর্ভদাগ বলেছি না, সেবার ছিলাম আমি যুদ্ধশেষে লুটে-নেওয়া দাসী!
হ্যাঁ আগুন, আমি তো দাঙ্গাকে জানি, দ্বৈরথকে জানি শুধু এই চোখ-ধাঁধানো অন্ধকারে দেখিনি কখনও ধর্ষণের পর আমি উঠে বসছি---কখনও দেখিনি একতরফা প্রহারের ফাঁকে ফাঁকে একফালি আকাশ
ও আগুন, উঠে বসছি আমি এই এক আশমান তারা রক্তপ্রপাতের পর এনও রক্তের কলকল আমার বাচ্চাকে জন্ম এনে দেবে ক্যাম্পে, খয়রাতে না আগুন, আজ আমি আর ভাঙব না সব ভাঙনগুলিকে