কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা
|
তোমার চশমা
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়
তোমার চশমা আমার দৃষ্টি করে খাটো;
তোমার শাসন বন্ধ রাখে আমার কান দুটো ।
তোমার কাছে সবই সাদা-কালো
শুধুই দিনে দেখ তুমি আলো॥
তোমার আঙ্গুল বারণ শুধু করে ;
এগিয়ে নিয়ে যায় না কেন
আমার এ হাত ধরে॥
আমার চোখে যদি দেখতে
-দেখতে পেতে বালির পাহাড় পেড়িয়ে মরূদ্যান॥
শুনতে পেলে আমার মতো-
ভেসে আসত তোমার কানে
রুদ্ধ দ্বারের ওপার থেকে শিকল ভাঙার গান।
আমার রঙে রাঙতে যদি তুমি,
হয়ত আমায় রাখতে না আর শাসন দিয়ে বেঁধে।
আমার পথে চলতে যদি -
ফুল তুমি রাখতে গাছে
তাকে মালায় করে রাখতে না আর গেঁথে॥
এস, হাত দাও তো হাতে,
চশমাটা নাও খুলে,
ভালবাসা শেখাই তোমায়,
শাসনটা যাও ভুলে॥
. ****************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
ছড়া শোনাই আয়
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়
শুনতে চাইছে ছড়া- বেপাড়ার এক ছোঁড়া ,
বয়স নয় কো বেশী, দিব্যি হাসি-খুশি।
ডেকে বলি তারে, এস পথের ধারে।
এই যে ছোলা ভাজা, তার সাথে নাও খাজা।
পেট ভরে খাও ভাই, সময় বেশী নাই।
রাত নামবে, আঁধার হবে, শীতের চাদর গায় ;
ধরবে ঘিরে আস্তে-ধীরে ভুতেরা মায়-পোয়ে।
এ পাড়াতে খালের ধারে, লম্বা ঘাসের ডগা,
দুলিয়ে মাথা ডাকবে তোমায় দিস না মনে দাগা
বহুদিন খাইনা কিছু তাইতে রোগা কাঠি,
ভয় পেয়ে তুই যাসনে ভেগে রাতটা করে মাটি।
ওদের ডাকে দিসনা সাড়া, বলছি তোকে ভাই;
আয় কাছে আয়, ওদের তো আর ছড়া জানা নাই।
আমিও থাকি খালের ধারে শ্যাওড়া গাছের মাথায়,
নানান ছড়া লিখে রাখি গাছের পাতায় পাতায়।
আয়না কাছে, বস এখানে শোনাই তোকে ছড়া
ওমা একি পালাস কেন বেপাড়ার তুই ছোঁড়া।
বলছি এত ভয় নেই কো তবুও পালাস ছুটে।
ধরতে পারলে মটকাব ঘার সন্দেহ নেই মোটে॥
. ****************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
ব্যাঙ এর ছাতা
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়
ছোট্ট মেয়ে মিনি রানী
গায়েতে লাল জামা খানি
মুখ খানা তার অভিমানী
সামনে রঙ তুলি তবু আঁকছেনা।
বাবা ভাবেন হোলটা কি-
বসে কেন গিয়ে দেখি-
ছবি আঁকা হল নাকি –
থমথমে মুখ তবু মেয়ে কানছেনা।
কি হয়েছে মিনিমা রে,
আয়তো দেখি কোলের ধারে,
জল কেন তোর চোখের পরে ;
বাবা ডাকেন তবু মেয়ে শুনছেনা।
শুনবনা আর কারো কথা,
নেবনা রং-তুলি-খাতা,
আঁকতে গেলাম ব্যাঙ-এর ছাতা,
কিছুতেই সে আঁকাটা হচ্ছে না।
এখন যে খুব রোদ উঠেছে,
ঘাসের উপর ফুল ফুটেছে,
ব্যাঙ-এর ছাতা শুকিয়ে গেছে ;
দেখতে কেমন মনে যে আর পড়ছেনা।
বাবা বলেন তাই বুঝি মা,
রাজাবাবুর তুই ঠাকুমা,
আকাশ জোরে বৃষ্টি নামা,
নইলে ব্যাঙ-এর ছাতা যে আর হচ্ছেনা।
. ****************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
হিন্দু মুসলমান
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়
বাংলা মায়ের এপার ওপার হিন্দু মুসলমান।
এপারেতে থাকে দিদি ওপাড়ে ভাইজান।
গানের কলি লিখে লিখে দিদি ভাসায় জলে।
গানের ভেলায় সাজায় ভাই সুরে, ছন্দে, তালে।
দিদির চোখে স্বপ্নে শুধু গলায় যে নেই সুরে ;
ভাইজান কয় দিদির দুঃখ করব আমি দূর।
এপার বাংলা ওপাড় বাংলা বাঁধব আমি সুরে –
সবুর কর দিদি ,সে দিন আর তো নেই দূরে।
ভাইজান গায় উদার গলায় তার সুর ছুঁয়ে যায় মন ;
গর্বে স্নেহে ভরে ওঠে দিদির নরম মন।
দিদি- আর ভাইজান তারা হিন্দু মুসলমান,
এপার ওপাড় এক করল তাদের যুগল গান॥
. ****************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
গাছ কাটা
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়
ও মামাগো শুনতে পাচ্ছ, গাছ কাটছে ভুলো!
গাছ কাটছে কাটুক না সে, কানেতে দাও তুলো ।
কি যে বলও, গাছ কাটাটা বেআইনি তা জানো ?
তুইতো জানিস বলনা গিয়ে গোল করছিস কেন ।
য়্যায় ভুলো, আয় নেমে আয় তো , গাছ কাটছিস কেন ?
বেশ করেছি আমার ইচ্ছা বাবার গাছ যেন ।
তবেরে ব্যাটা বাপ তুলেছিস ডাকব-নাকি পুলিশ ?
গাছ নয়তো ডাল কেটেছি, দেখতে পাওনা , ফুলিস !
তাইবা তুই কাটবি কেন, গাছটা আমার জানিস !
তোর গাছ তো ডালপালাটা নিজের দিকে টানিস ।
ডাল বেয়ে চোর আসবে ছাতে পড়বে মাথায় বাজ।
চোরের সাথে আঁতাত করা বার করছি আজ ।
ওরে বাবা ডাল ভেঙ্গেছে পট পট পটাং,
ভুলোও ধুলোয় শুয়ে আছার খেল সটান ।
. ****************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
পণ্ডিত
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়
পণ্ডিত ডেকে বলে কি লিখেছ কবিতা
শেখালাম এত কিছু ভুলে গে লে সবই তা!
এখানে কমা, সেখানে দাঁডি
এবারে সেমিকোলন দাও
তোমাকে ক্ষমা কি করে করি,
আমাকে যিনি ভোলেন যাও,
তার নাকেতে তাড়াতাড়ি মস্ত বড় দড়ি দাও
অর্থহীন শব্দ কথা, শব্দহীন অর্থ যত,
এক হাঁড়িতে ঢাকনা দিয়ে
পাকাও কেন ইচ্ছা মত ?
মন বলে আমি অত ব্যাকরণ মানিনা,
শব্দের মাঝখানে দাঁড়ি কমা টানিনা
পণ্ডিত হতে আমি চাইনিতো কোনোদিন,
আমার এই মাথা জুরে শব্দের বিন্ বিন্
সেই সব শব্দকে টেনে এনে বাইরে ,
ছন্দের খাপে পুরে ভারি মজা পাইরে
ছন্দের ঘারে চেপে অর্থও আসবে
বের হবে বাহিরেতে যত ঝেড়ে কাশবে
শব্দই হাসে কাঁদে , শব্দই গান গায়,
শব্দের তালে তালে এ মনটা ভরে যায়।
আনন্দে থাকা চাই একটাই এ জীবন-
পণ্ডিত দূরে থাক সাথে নিয়ে ব্যাকরণ।
. ****************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
আজ দিনটা মায়ের
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়
আজ দিনটা মেঘলা,
বৃষ্টি হয়েছে শুরু ,
রাস্তায় এক হাঁটু জল,
মেয়ে বললে ডেকে
আজ খিচুরি কর মা,
আজ খাবনা মাছের ঝোল।
খিচুরির সাথে কি খাবি বিনু –
মা বলতেন ডেকে ,
ফুলুরি , বেগুনি ভাল লাগে খুব ,
ডিম ভাজা যদি থাকে।
চিকেন পাকোড়া – মেয়ে বলে দূর থেকে।
তোলা উনুনের গরমে মায়ের ফরসা মুখটা
লাল। আমি আর ভাই ,
গপা-গপ খাই বসে।
আহা কি যে স্বাদ তার।
ডিনার টেবিলে মেয়ে বলে-মা দারুণ হয়েছে ফ্রাই।
লাল পাড় সাদা সারিটা মায়ের –
প্রথম আমার কেনা।
চোখে জল মুখে হাসিটি মায়ের
ফ্রেমের দেবী প্রতিমা।
মাদার্স ডে-র গিফটা দেখ মা পছন্দ হল কিনা।
মাগো কোনদিন বুঝিনি তুমি কতখানি জুরে ছিলে-
বুঝিনি আমার জীবনে তুমি কতখানি ছিলে দামী।
বুঝেছি তোমার স্নেহকে আজ মা,
মেয়ের পানেতে চেয়ে, স্নেহ যে নিম্নগামী।
. ****************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
বুড়োর হুড়
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়
আমাদের অফিসেতে কাজ করে এক বুড়ো,
কাজের বেলায় অষ্টরম্ভা দিতে জানেন হুড়ো।
পিয়নটাকে কেবল ছোটান ‘কিনে আনরে পান’।
যখনই কেউ ছাড়বে ধুয়ো দেবেন একটা টান।
ফাইল যদি টেবিলে যায় দেবেন একটা তাড়া -
‘পিছনেতে লাগছে নাকি কেউ কিম্বা কারা?
অফিসেতে আসছি বলে কাজ করতেও হবে,
এমন কথা এই বয়সে কে শুনেছে কবে।
চিঠি যদি লিখতে হবে লেখনা রে ভাই তোরা,
কাজ দেখলেই ফাইল কেন আমার দিকে ছোঁড়া!
হিসাব কিতাব রাখতে বুড়োর ভীষণ করে ভয়,
চোখেও নাকি পড়ছে ছানি, হিসাব রাখা দায়।
সাহেব বলেন ‘বসুন তবে টেলিফোনটা নিয়ে’।
মনে ভাবেন কথাবার্তা শুনবো লুকিয়ে।
ফোনটা তুলেই চ্যাঁচ্যাঁয় বুড়ো -’কি চাই এতো ভোরে?
সকাল হতেই অফিসে ফোন, বসতে এরা দেবেনা চুপ করে!
আমি বলি -ও হুড়োদা সাহেবের ফোন ওটা।
তাইনাকিরে, এতক্ষণে বল্লি কেন ব্যাটা।
মজা বুঝি দেখছিলি তুই দেব এমন হুড়ো ‘
অফিস মাথায় করে চ্যাঁচ্যাঁয় আমাদের সেই বুড়ো।
. ****************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
দেবী-মা
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়
বড় বাড়ির বারান্দাতে প্রদীপ জ্বলে কত
দূরের থেকে দেখাচ্ছে ঠিক তারার মালার মত।
বড়বাড়ির বৌ যেন মা লক্ষ্মী প্রতিমা,
ছেলে কোলে দাঁড়িয়ে আছে, আয়মা দেখে যা।
ঝলমলে ওর পোশাক-আসক, মুখ ভরা ওর হাসি,
তোর কেনমা ছেঁড়া কাপড় কত দিনের বাসী।
চলনা মা যাই ভোজ হচ্ছে, পেট ভ’রে খাই গিয়ে।
নারে খোকা ভয় হয় রে, দেয় যদি তাড়িয়ে!
মাগো দূরে ঐ বুড়ি-মা ছেঁড়া কাপড় পরে,
দাঁড়িয়ে কেন ছেলের সাথে মুখটা কাল করে।
পূজোর দিনে বাজছে সানাই, জ্বলছে কত আলো,
মাগো ওদের দুঃখ দেখে লাগছেনাকো ভালো।
চলোনা যাই ডেকে আনি, পাত পেতে দিই খেতে-
এই দারোয়ান, এক্ষণই যাও, বল ওদের যেতে ।
নোংরা নাকে সর্দী ছিছি ওদের বাসিস ভালো-
তুই তো আমার সোনার ছেলে ঘর করেছিস আলো।
ছেলের বুকের মন্দিরে যে ছিলেন দেবীমা,
ব্যথায় কাঁদেন এই বুকে আর থাকা তো যায় না॥
. ****************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
নিমন্ত্রণ
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়
পরশু আমার বাড়ি এস মেয়ের আমার বিয়ে,
আসবে কিন্তু খালি হাতে উপহার না নিয়ে।
আশীর্বাদ আর ভালোবাসা এটাই প্রার্থনীয় ,
নেহাত যদি ইচ্ছা করে কিছু একটা দিও।
সোনার দাম তো অনেক চড়া, গয়না নাইবা দিলে,
আজকাল তো অল্প-দামেই অনেক কিছু মেলে।
মেয়ের পিসী শুনলোনাতো হার কিনেছে মোটা,
বিজনবাবু শুনছি নাকি দেবেন একটা গোটা।
গোটা মানে গোটের মালা দাম কত কে যানে,
মিতালি তো সোনার ফুল দিচ্ছে দুটো কানের।
পাশের বাড়ীর কুন্ডুবাবু দেবেন বেনারসি,
ওনার তো ভাই অনেক টাকা, খরচ করেন বেশী।
তোমাদের সে সামর্থ্য নেই কি হয়েছে তাতে!
এস কিন্তু পরশু রাতে, না হয় খালি হাতে।
. ****************
. সূচিতে . . .
মিলনসাগর
আমরা কবির কাছে কৃতজ্ঞ কারণ এই সব কবিতাই কবি নিজে আমাদের টাইপ করে পাঠিয়েছেন।