কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা
*
বিয়েবাড়ির হট্টগোলে
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়

বিয়েবাড়ির জমজামাটি আলোর মাঝখানে,
ছুঁয়ে গেল একজোড়া চোখ
নরম উত্তাপে ।।
বেনারসি জরির পাড়ে
আলতা রাঙ্গা পা,
মুখখানি তার পানের পাতা ,
সোনায় মোড়া গা ।
সবকিছু দেয় ভুলিয়ে সেই চোখ –
মন বলে আজ এখান থেকেই জীবন শুরু হোক ।
তার ফোলা ফোলা অধরখানি লাল,
সিঁদুরে, চন্দনে সাজে গাল-
ছোট্ট মিষ্টি বংশী নাকে
হীরের নাকছাবি ।
ডাগর ডাগর কালো চোখে
আমার বুকের চাবি ।

কেন এমন অনর্থ, কেন খুললে
বন্ধঘর ।
তোমার পাশে দাঁড়িয়ে কেন
টোপর পড়া বর ।
বিয়েবাড়ির হট্টগোলে, ডুবল মন পাপে –
তোমার কাজল কালো চোখ
ভরল কেন হৃদয় আমার
নরম উত্তাপে ।

.       ****************  
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
আমরা কবির কাছে কৃতজ্ঞ কারণ এই সব কবিতাই কবি নিজে আমাদের টাইপ করে পাঠিয়েছেন।
*
সমান্তরাল
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়

মাকড়সার জাল হাতে এঁকে দেখালে আমায়
আমি অবাক বনে বলেছিলাম ,
দু-খানা সরল রেখা টান না তোমার হাতে,
যে রেখা অনন্ত অনাদি চলবে পাশাপাশি ,
তবু মিলবে না কোনদিনও ।
সে বলল – ও সরল রেখা
শুধু হাতে যায় নাটানা।
তাছাড়া মাকড়সার জাল কেমন
জটিল রহস্যময় ।
সরল রেখার মধ্যে কি আছেআকর্ষণ ।
সে তো চলেছে অন্তহীন চলেছে সোজা ।
তাকে বোঝা তো কঠিন নয় ।
আমার যেন মনে হয় –
সমান্তরালের অনাদি, অনন্ত রহস্যসহজ নয় ।
আমার চিন্তার জালছিন্ন-ভিন্ন করে
রোজ সে জাগিয়ে রাখে –
কেমন করে জানা যায়,
কেমন করেযায় বোঝা ।
এরা যদি অবিনশ্বর, যদি এরা কালাতীত-
তবে কি সত্য দুই- কে বলে দেবে !

.       ****************  
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
*
ইচ্ছে
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়

আমার ভীষণ ইচ্ছে করে
তোমার শার্টের কাপড় হতে,
কিম্বা ধর তোমার বুকের বোতাম ।
তাহলে কেমন তোমার নরম গরম
বুকের ছোঁয়া পেতাম ।।
যখন তুমি রাখতে আমায় খুলে ,
আলনাটাতে থাকতাম ঝুলে –
সকালের প্রতীক্ষায় ।
তোমার গন্ধ সারা রাত –
মাতাল বিবশ করে
ছেড়ে তো যেতো না আমায় ।।

.       ****************  
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
*
মায়ের ঠিকানা
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়

ছোটো বেলার গল্প মাগো-বল না আমায় আজ,
তুমিও কি মা মরতে ভয়ে-পড়ত যখন বাজ ।
বৃষ্টি শুরু হলে-যেতে কিমা লুকিয়ে ছাতে,
কারুক্কে না বলে । বৃষ্টি যখন যেত থেমে
ছাতের থেকে এসে নেমে,কি করতে ছল –
তোমারও কি ছিল না কেউ, দিত না কেউ জল
ঢেলে মাথার পর –সর্দি লেগে যেন তোমায়
ধরে নাকো জ্বর । একলা বসে ভাবতে কি মা
এটা কেমন ধারা, বিচার ভগবানের –
বোঝেনা যে কেন রে কেউ, তোর কান্নার মানে
রাতের বেলা একলা শুয়ে, পেতে কি মা ভয় ,
ভুত তাড়াতে বলতে কি মা, জয় রামের জয় ।
আমার যে মা ভাল্লাগে না, একলা বসে থাকা ।
কাগজ কলম নিয়ে শুধুই ,খেলার বাড়ি আঁকা ।
তোমার বাড়ি কতটা দূর, বলনা আমায়-
নাহয় তুমি নিজেই এসে, নিয়ে যাও সেথায় ।
আমি থাকব লক্ষ্মী হয়ে, করব না দুষ্টুমি ,
শুধু তুমি থেক পাশে আমার কপাল চুমি ।
তোমার পাশে নিয়ে আমায় থেকো সারাদিন,
তোমায় ছেড়ে যাব না মা, কোথাও কোনদিন ।
বর যদি মা ডাকে আমায়, বলে এস আমার ঘরে,
তিন সত্যি যাব না মা ,রেখো তোমার করে ।
দিদির যখন বিয়ে হল নিয়ে গেল বর-
মনের দুঃখে কোথায় গেলে ফিরলে না আর ঘর !
এবার দেখো দু-হাত দিয়ে রাখব তোমায় ঘিরে,
শুধু আমায় লক্ষ্মী মাগো নিয়ে যা তোর ঘরে ।।

.                ****************  
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
*
মন রে আমার মন
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়

মন রে আমার মন –
কার আশাতে থাকিস উচাটন ।
বন্ধ যে সব দ্বার
সেইখানে তোর আঘাত বারে বার ।
বোঝেনা তোর কথা –
জানাস সেইখানে তোর ব্যথা –
মন রে আমার মন-
কেন ভুল পথে তুই চলিস সারাক্ষণ ।
দিক-দিগন্ত ভেদ করে আর
কালকে ঝেড়ে ফেলে
তুই কেন তোর পাখনা দিসনা মেলে ।
বন্ধ দরজা যদিও বা কেউ খোলে,
কি আসে যায় তাতে ।
তোর আকাশ তবুও ঢাকা থাকবে ঘরের ছাতে ।
দুঃখ-সুখে, দিনে রাতে
অরণ্যে পর্বতে ,
কার আশাতে থাকিস উচাটন ।
মন রে আমার মন,
অখণ্ড এক আকাশ জুরে
আগল খোলা ঘর ।
চিরন্তনী কাল আছে, নেই
কেউ আপন কিম্বা পর ।
অসীম শূণ্যে, ক্ষণকালের
এই যে জীবন,
এই তো পরম পাওয়া ।
জানিস নাকি এ পথে আর
নেই তো ফিরে যাওয়া ।
মন রে আমার মন
কোনও দিনও বুঝলি না তুই কেন –
কার আশাতে থাকিস উচাটন ।

.         ****************  
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
*
কালজয়ী প্রেম
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়

তোমাকে ভালবেসে এত কিছু করি
টাকা, বাড়ি, গারি –
সময়ের স্রোতে ভেসে চলা ।

যেদিন ফেরালে মুখ ,
ক্ষত বিক্ষত বুক –
দিক বিদিকে হাহাকার ,
রক্তে রক্তে জ্বালা ।

শিশু পুত্র চেয়ে আছে মুখে ,
কি করে রক্ষা করি ওকে ,
বৃশ্চিক দংশনে কাঁদে ,
শিরা উপশিরা ।

অসহায়, আমি অসহায় ,
দুহাতে জড়িয়ে ধরি বুকে,
ছেড়ে দাও ছেড়ে দাও একে
দুরারোগ্য পীড়া ।

মৃত্যুর করাল ছায়া
গ্রাস করে কেন তাজা প্রাণ ।
বার্দ্ধক্যের এপারে বসে ,
তবু কেন ভালবাসি,
তবু কেন গাই আমি জীবনের গান ।

দিন যায়, মাস যায়, বছর বছর যায় চলে ,
তুমিও চলেছ সাথে , কালজয়ী প্রেম
আদি অন্তহীন ,
উত্তর মেলেনি কোনও কালে ।।

.         ****************  
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
*
অরূপরতন
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়

ছিলাম যখন অন্ধকারে,
ঝড়, বৃষ্টি, ঝঞ্ঝা চারিধারে ,
অন্ধজনের মতন বাড়িয়েছিলাম হাত ,
সঁপেছিলে অরূপরতন
কেটে গেল দুঃস্বপ্নের রাত ।।
তোমার সে দান রেখেছিলাম
হৃদয় মাঝে আঁচল দিয়ে ঢেকে ,
দুঃখ, কষ্ট যতই আসুক ,
হারাবনা আর কিছুতেই একে ।।
হৃদাকাশে মেঘ বৃষ্টি
এখনও আসে যায়,
সূর্য থাকে তার জায়গায় ,
উদয় অস্তাচলে ।
মনের জমিতে নরম মাটি ,
কত লোকে আসে যায় ,
তোমার দয়ায় ,
তবুও সেখানে এখনও ফসল ফলে ।
চোখের তারায় আঁধার-আলো
খেলা করে যায় জীবন জুরে ,
মনের গভীর অন্তঃপুরে ,
বিশ্বাস আলো জ্বালে ।
সেই বিশ্বাস দানা বেঁধে
আজ হয়েছে যে মহীরুহ,
বিরাট আকার বিশাল দৃঢ়তা
শান্তির ছায়া ফেলে ।।

.         ****************  
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
*
একালের রাধা-আয়ান সংবাদ
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়

রাধা
ভণ্ডামিটা ঘোমটা মাথায়
বসে আছে অন্তরে
বাইরে তবু লজ্জাবতী
কুলবধুর ভেক ধরে
ঠকাতে চাই জগত কে ।
ঘরের মানুষ দোষ করেনি
মন্দ আমার অন্তরে
পরপুরুষে মন মজেছে
সাপ নাচুনী মন্তরে
নাচাতে চাই মহৎ কে ।

আয়ান
নিজের উপর দোষ নিয়ে সব
বলছ কেন যাচ্ছে তাই ;
যা করেছ ঠিক করেছ
আমি তো আর পুরুষ নই ;
মদের নেশায় বুঁদ হয়ে রোজ
রাত্রে ফিরে ভোর ঘেঁসে ।
ন্যাতার মতন কেতরে থাকি
বিছানাটার একপাশে ।

সত্যি কথা বলতে গেলে
আমারও এই শরীরটা
সেঁকে আসি গরম তাপে-
লক্ষ্মী, চাঁপা, নন্দিতা,
নানা রকম নাম যে তাদের
হরেক রকম ঢং জানে ।
কিন্তু আমার মন মজেনা
সে সব ফুলের অঙ্গনে ।
আমার যে এক তুমিই আছ
মনটা জুরে সুন্দরী ।
যে চুলোতেই যাই না কেন,
আসব ফিরে রাত ভোরে।

.         ****************  
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
*
ভালবাসার বয়স
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়

এমন কোনও আইন আছে নাকি
বয়স হোল যার
ভালবাসার নেই কোনও দরকার !
ভালবাসার মানে শুধু,
ফুল ফোটান বুকে ,
বসন্ত বেলায় ,
শীতের জরা ছড়িয়েছে যার বুকে
এই অবেলায় তবু যার মনে
প্রেম রয়েছে বাকি,
ভালবাসায় তার –
নেই কি অধিকার ?

যৌবনে তার কাছে আসায় –
যে মাদক ছড়াত শীরায় ,
আজো আধো ঘুমের ঘোরে ।
আজো যে তন্দ্রায় ,
শীরায় শীরায় আগুন জ্বালে ,
বুকের মাঝে অবুঝ ব্যথা
ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায় ।

জেগে উঠে বসলে পরে ধমকে ওঠে মন –
ছিঃ এমন তর ধরণ -
দেখে লোকে বলবে কি ?
আর তোমার বয়স আছে নাকি ?

কে বলেছে নেই ! যত দিন জীবন আছে,
আছে সবুজ মন ।
ভালবাসায় অধিকার আছে ততক্ষণ ।

এখন শুধু চোখের দেখায় হৃদয় নাড়া দেয় ,
এখন শুধু আলো-ছায়ায় শরীর ছুঁয়ে যায় ,
কার পরশ মনের মনি কোঠায়
জ্বালিয়ে রাখে আলো ।
রক্তমাংসে গড়া আমি বুঝতে পারি না যে
শরীর ছাড়া কেমন করে বাসব তাকে ভালো ।
মন ছুঁয়ে সে শরীর জাগায় ,
তবুও কেন বল ,
আর নয় আর নয়,
অনেক বয়স হোল ।।

.         ****************  
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
*
শূন্য
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়

আকাশের অসীমে নাকি কালের অন্তহীনে
কোথায় দাঁড়িয়ে আছি –
দেখেছি স্ব-চোখে আমায় ,
নাকি সে তোমারই ছায়া ,
ফিরে আসে হাজার আলোকবর্ষ পরে !
দেহের ভিতর প্রাণ
চলে নিরন্তর
সেকি শুধু শেষ হতে মৃত্যুর ঘরে !

অসীম অনন্ত স্রোতে কারা যায়, আসে কারা
কোন উৎস ঘিরে , প্রাণের আবর্তন,
একটাই লক্ষ নাকি সেখানেও আছে
দুই , সত্যের ও বিভাজন !

আমি কি আমার কল্পনা ,
সত্য কিছু নই,
তোমার আলোয় জন্ম
মৃত্যু ছায়ায় ,
ক্ষণিকের পরিচয়,
অসীম অনন্ত দেশ-কালে ,
কোনদিন কোন ক্ষনে কিছুই যদি না থাকে ,
সবই তো শূন্য শূন্য
শূন্য মনে হয় ...

.         ****************  
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর