কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়ের কবিতা
*
সমর্পণ
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়

রাত তখন অনেক হবে, ঠিক মনে নেই কটা,
আকাশ জুড়ে কালো কালো ঘন মেঘের ঘটা ,
বসে ছিলাম বালির উপর, সামনে সমুদ্দুর ,
মেঘের ডাক আর ঢেউয়ের শব্দ বাজছে গুরুর গুর ।

দূরের থেকে আসছে তেড়ে পাগলা ঢেউয়ের দল,
আছড়ে পরে বালির উপর উচ্ছল চঞ্চল ,
কোথাও আলো যায়না দেখা, বসে ছিলাম আমি একা,
বুকের মধ্যে তোমার প্রেমের ছিল যে সম্বল ।

তুমি যদি এমন রাতে থাকতে পাশে আজ,
ঝড়ের সাথে উড়িয়ে দিতাম আমার যত লাজ,
যে কথাটা হয়নি বলা মনের মতন করে ,
সেই কথাটা শুনতে পেতে আকাশ বাতাস জুরে ।

ঢেউ যেমন আছড়ে পরে দুরন্ত দুর্দম,
তেমনটি ঠিক হয়না কেন আমার সমর্পণ ।
জলের শেষতো যায়না দেখা, নেই যেন তার সীমারেখা,
আমার সাথে তোমার মিলন অনেক খানি কম ,
এমনটি ঠিক হয়না কেন আমার সমর্পণ ।

হাওয়ার সাথে আসছে ভেসে জলের সুবাস ঐ ,
জল ছাড়া আর নেই কিছু আজ জল শুধু থৈ থৈ ।
আমার প্রেমের সাগর কেন এমন গভীর নয় ।
সমাজ তাকে রাখে বেঁধে এমনি মনে হয় ,

থাকতে যদি আমার পাশে এমন রাতে আজ ,
সাগর জলে ভাসিয়ে দিতাম আমার যত লাজ ।
আকাশ জুড়ে মেঘের ঘটা সাগর জুড়ে ঢেউ ,
আমার বুকে কে লুকাল জানল না তা কেউ ।
কাল নাগিনী ফুঁসছে যেন মেঘ করে গম গম ,
এমন রাতেই হোক আমার পূর্ণ সমর্পণ।

.     
        ****************  
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
আমরা কবির কাছে কৃতজ্ঞ কারণ এই সব কবিতাই কবি নিজে আমাদের টাইপ করে পাঠিয়েছেন।
*
কপালে তোর কি আছে মা
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়

বল মা তারা বল ;
সে কি চাঁদ, তারা না ত্রিশূল,
নাকি প্রদীপের শিখা ঝল মল
বল মা তারা বল ।

গৌরি মাগো কালী হয়ে
জগত নাচাও পায়ে ।
শরম ভুলে বসন খুলে
কেন এলে আদুর গায়ে
জগত নাচাও পায়ে ।

আমার দিন রাত তোর চোখের তারায়
মাগো নিলে চুরি করে ,
তোকে ছাড়বনা আর
ছাড়বনা মা ।
রাখব বুকে ধরে ।

আমার দিনে কালী রাতে কালী
আমার জগত কালী হল ।
মা তোর কপালে কি রাখিস ধরে
বল মা গো বল ।

চণ্ডী তোমার চোখে আগুন মুখে আগুন,
আগুনে নাচ তা তা থৈ ;
চোখ নামিয়ে দেখ মা পায়ে শিব শুয়েছে ঐ ।
মা তোর শরম গেল কৈ !

মাগো বসন পর অস্ত্র ছাড়
চোখের আগুন ঢাকো জলে ,
আমার পাগলি মেয়ে দেখ মা চেয়ে ,
ভোলানাথ পরে তোর রাঙা চরণ তলে ।

.             ****************  
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
*
আগমনী
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়

মাগো আমি মরি ডেকে ডেকে
তোমায় খুঁজি তোমার মাঝে থেকে থেকে ।
তুমি দাও না তবু সাড়া ,
তুমি চাও কি চাও কি গো মা
দেখতে আমায় তোমার মতন পাগলপারা ।
মায়ের স্নেহ পাইনা খুঁজে তোমার চোখে ,
ব্যথা বাজে করুণ সুরে আমার বুকে
চরণ তোমার লুকিয়ে কোথায় রাখলে মাগো ।
বৃথা হল আমার চোখের অশ্রুধারা ।

মাগো তোমার যে রূপ ছিল আমার মনে ।
খুঁজি তারে মনে মনে ।
ঠাকুর ঘরে যাইনা বলে
সবাই যে গো বলে আমায় লক্ষ্মীছাড়া ।

মাগো তোমার একটি নামের মালা জপি ।
জানি আমি মা যে আমার বহুরূপী,
সব নামেরই অন্তে তুমি ,
দুর্গা, কালী, লক্ষ্মী তারা ।

আমার আঁধার ঘরের সন্ধ্যা প্রদীপ
জ্বালাই যখন।
তোমার দুটি করুণ আঁখি পাখীর মতন
পালায় উড়ে।
শক্তি দে মা শক্তিময়ী রাখব ধরে ।
সব কালিমা ঘুচিয়ে দে মা
ভরিয়ে দে মা হৃদয় আমার
ভক্তি রসের বন্যা ধারায় ।

আমার আঁধার ঘরের সন্ধ্যা প্রদীপ তুমিই মাগো,
ঘুমায় যখন জগত তখন তুমিই জাগো।
নিদ্রা আমার ঘুচাও মাগ
ঢেলে তোমার নিদ্রাবিহীন আলোক ধারা।
তোমার আলোয় দেখব তোমায়
রূপ যে তোমার মনোহরা ।
তুমি চাও কি গো মা দেখতে আমায়
তোমার মতন পাগল পারা ।

.          ****************  
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
*
অঞ্জলি
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়

একবার তোর অন্ধ মেয়ের
চোখে মা তুই দৃষ্টি দে,
একবার তোর স্নেহের ছোঁয়ার
আকুল হৃদয় ভরিয়ে দে।
একবার তোর অভয় হাসি
দেখা মা তুই জগতকে ;
মাগো মা তোর প্রেমের সুধায়
হৃদয় পাত্র ভরিয়ে দে ।
যাক ঘুচে সব ভয় অপমান
সংশয় আজ যাক দূরে ।
শক্তিময়ী তোর চরণে
একবার দে ঠাই করে ।
তোর রাঙ্গাজবা চরণে মা
পাপ দেব সব অঞ্জলি
পাপের রক্তে তোমার পায়ে
চড়াব মা আজ বলি ।
পাপশূন্য হৃদয়ে মোর
নতুন আসন পাতবরে
শক্তিময়ী তোর চরণে
এইবারে দে ঠাঁই মোরে ।

.       ****************  
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
*
জিজ্ঞাসা
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়

অনন্ত জিজ্ঞাসা নিয়ে, অসীম বিস্ময়ে
আমার অন্তর চেয়ে থাকে
আমার বাইরে চিরদিন ।

তবু তার হয়না তো জানা -
আছে নাকি শেষ চাওয়া-পাওয়া ।
হয় নাকি মিলন সাধন
যেমন রাতের কোলে শেষ হয় দিন ।

পৃথিবীর মাটি চায়
আকাশকে নিতে কাছে টেনে ,
সুদূর দিগন্তে চেয়ে থাকে
অতৃপ্ত নয়নে ;

জানে মনে কোনোদিন তাকে
হবে না তো পাওয়া ।
সান্ত্বনা তার শুধু দূর থেকে
মিলনের রেশ টুকু ,
নিজের চোখেতে দেখা
মরীচিকাসম
আকাশ-মাটিতে মিশে যাওয়া ।

.       ****************  
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
*
কিছুটা বুঝেছি কিছুটা নয়
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়

আর কত দূরে আছ তুমি
আমি কিছুটা বুঝেছি কিছুটা নয় ।
ভাঙ্গা ভাঙ্গা সিঁড়ি কতটা উঠেছে ,
কত দূরে গেলে পাব তোমায় ।

আমি চাইনা কিছুই
আমি নিজের ভাগ্য করব জয় ।
কোন পথে গেছে সবাই
যাদের বেসেছ ভালো –
কোন পথে গেলে দেখব
তারারা জ্বেলেছে আলো ।
চন্দ্র সূর্য চাইনা আমার
শুধু চাই তোমায় ।

আমি কিছুটা বুঝেছি কিছুটা নয়,
আঁকা বাঁকা পথ কতটা গিয়েছে,
কত দূরে গেলে পাব তোমায় ।

সাদা-কালো নয় পৃথিবী আমার ,
বড় রঙ্গিন ।
সেখানে দিন রাত সব একসাথে ঘোরে ,
মন্দির আছে মূর্তিহীন ।
মহাকাশ আর মহাকাল জুরে ,
ওঁকার ধ্বনি ঐ বাজে ।
বিন্দুতে আর সিন্ধুতে তুমি
সবার মাঝে ।
নিয়েছে বাসা ।
তোমার স্বপ্ন চোখে নিয়ে আজ
অনন্ত এই স্রোতে ভাসা ।

কত কাল গেলে কত যুগ গেলে
পাব তোমায় ,
আমি কিছুটা বুঝেছি কিছুটা নয়

.       ****************  
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
*
গন্তব্যের গভীরে
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়

গন্তব্যের গভীরে ঢুকে পড়েছে ধূলা বালি ।
আমি বৃথা পথ চলি
সুখের আশায় ।
ঐ দূরে ঐ দিগন্ত রেখায়
দেখা যায় সুর্য অস্তগামী ।
পিছনে এসেছি ফেলে যা কিছু
বেসেছি ভালো, যত কিছু দামী ।
আজ মনে হয় ,
যে পথ ধূলায় ভরা , বালিময় সাহারায় টানে ,
কেন আমি চলেছি সে পথে ,
ফেলে রেখে জীবন সুন্দর ,

জীবন-যৌবন তোর থাকুক তফাতে ;
মরণ যে চির সাথী তোর –
বলে গেলে তুমি কানে কানে ।

.       ****************  
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
*
আমি বন্য, আদিম মানবী
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়

আমি যদি হতাম লাবণ্য-
তোমায় দেখে সাউথ সিটি মলে
শেলী, কিটি বা মিলির সাথে ,
কাফে-কফি-ডে-র চেয়ারে আড্ডারত –
চেয়ার টেবিল উলটে
কলার ধরে তোমায় টেনে আনার
ইচ্ছে টাকে বুকের মাঝে চেপে –
অনায়াসে এগিয়ে যেতাম ঠোঁটের কোনায়
শ্লেষের হাসি ঝুলিয়ে ।

যদি আমি লাবণ্য হতাম,
তোমার ঘৃণিত সহবাস
শেলী, কেটি বা মিলির সাথে
আমার বিদ্রূপের বন্যায় ভাসিয়ে –
আমারদের ‘অমর-প্রেম’ ফ্রেমে বন্দী
মনের মণিকোঠায় রাখতাম ঝুলিয়ে ।

কিন্তু আমি নই লাবণ্য-
আমি বন্য
আমি হিংস্র আদিম মানবী ।
তোমার সকল বিথ্যাচার
তছ-নছ করে –
তোমার অসহনীয় উন্নাসিক চরিত্র কে
ছিন্ন-ভিন্ন করে
ছড়াব আকাশে ।
কারন আমি নই প্রেমের কবিতা
আমি নই বন্যা, মিতার ।
আমি বন্য, আদিম মানবী ।

.       ****************  
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
*
তোমার ছোঁয়া
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়

এখন রাতের ভোর
তারারা একে একে যাচ্ছে ঘুমের দেশ ।
পাখির সাথে সাথে
ডানা ঝাপটায়ে জাগছে শহর ।
এখনো আমার ভাঙেনি ঘুমের রেশ ।
আকাশে সোনা আলো
কোনও তারা এখনো উঁকি মেরে যায় ।
আমার শরীর-মন
তোমার ওমেতে মাখো মাখো ।
এখনো তোমার গন্ধ আছে বিছানায় ।
চুরি করে গেলে যে মাহেন্দ্র ক্ষণ
জীবনের ভোরে ,
আমার রোমে রোমে তার আহ্বান ।
এখনো রয়েছে ঘিরে ।
এখন রাতের শেষে
পৃথিবী জাগে ছেড়ে ঘুমের দেশ ।
আমি জীবন ভর আছি প্রতীক্ষায়
নিয়ে তোমার আবেশ ।।

.       ****************  
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর
*
ভালবাসা কাছে এসে আমায় জাগাও
কবি সান্ত্বনা চট্টোপাধ্যায়

আমি দুঃখ পেতে ভালবাসিনা,
আমায় ভালবাসতে দাও ,
ভালবাসা, তোমার নরম হাতে উষ্ণ উত্তাপ ,
সেই তাপে আমায় পোড়াও ।
ভালবাসা কাছে এসে আমায় জাগাও ।
কাছে-দূরে, আসে-পাশে ,
রক্তের কনায় কনায়
নেচে ওঠো উদ্দাম উন্মত্ততায় ।
তোমার সাথে সাথে নাচুক হৃদয় ,
বেদনার নীল বিষ –
অশ্রু রাশি রাশি –
হয়ে যাক বাসী ।
নুতন লেখনী দিয়ে,
ভালবাসা বুকে নিয়ে ,
শত্রু মিত্র ভুলে ,
হৃদয়ের দরজা দেব খুলে ।
দখিন হাওয়ার সাথে এসেছিলে তুমি ,
থেক অন্তহীন চির অর্চিষ্মান ।
তোমার আলোতে প্রাণ হোক উজ্জীবিত ,
দুঃখকে পার করে, অন্ধকার ভুলে ,
ভালবাসা তোমাকে চাই শুধু ।
কোথায় আছ যে তুমি ,
এড়িয়ে বেড়াও ।
ভালবাসা কাছে এসে আমায় জাগাও

.       ****************  
.                                                                             
সূচিতে . . .    



মিলনসাগর